বেল্লিক রামায়ণ/অভারামের ব্যবসা
অভারামের ব্যবসা।
আশা-মরীচিকা লােক চিরদিন কয়।
আশাই বাঁচায় সবে আশাই মারয়॥
অতি আশা কিছু না, কথা ঠিক ঠিক্।
অতি-আশাকারী জনে ধিক্ শত ধিক্॥
ভাবিল বেল্লিক-পিতা, চাকরী ছাড়িব।
ঋণ কিছু নিয়ে, নয় ব্যবসা করিব॥
কিন্তু কে দিবে বা ঋণ তার মত জনে।
বিষম ভাবনা তার বাড়ে মনে মনে॥
এরে একবার ওরে একবার করি।
জিজ্ঞাসয় খালি খালি ব্যগ্রতা সে ভারি॥
“কে দিবে আমারে ঋণ, ওহে মহাশয়।
ব্যবসা করিতে মাের বড় ইচ্ছা হয়॥
করিয়ে ব্যবসা আমি যেবা লাভ পাব।
লাভের অর্দ্ধেক অংশ সুদ ধরে দিব॥”
কেহ ভাবে, দিই দিই, কেহ ভাবে, নয়।
কেহ ভাবে, ওরে দিলে কোন্ ফলােদয়॥
ও কি এ জীবনে ওর দিবে শােধ ঋণ।
কোন মতে কায়ক্লেশে চালাইবে দিন॥
কেবল পড়িব ফাঁকে মােরা মাঝে হতে।
মিছে সুদ আশে কেন পড়িব ফেরেতে॥
এইরূপে সকলেই হয় পাছুপদ।
সাধ করি কেবা বল বাড়ায় বিপদ॥
কেহ নাহি দেয় টাকা কোনমতে তায়।
ঠেকিল সে অভারাম মহা ভাবনায়॥
হয়েছে ব্যবসা সাধ এতটা সে বেশী।
কিছুতে ত না কোরে তা, নাহি হয় খুসী॥
একটি উপায় শেষ ভাবে অভারাম।
যাহাতে ক্রমেতে তার পূর্ণ মনস্কাম॥
‘আতর’ নামেতে এক বেশ্যা কোন ছিল।
বয়েসে অনেক টাকা কামাইয়া ছিল॥
রূপবতী বারাঙ্গনা সে আতরমণি।
ঠসকে ঠমকে ঠিক পরীকন্যা ধনী॥
মধুর-ভাষিণী বামা মধুর-গঠনা।
কতই খােল্তা গায়ে ওড়ালে ওড়না॥
সদা ভুর্ভুরে বাসে আতর-গােলাপে।
বিলাতী এসেন্স সে ত প্রতি বাসি ধােপে॥
গিলে-কোঁচা ব্যতিরেকে পরেনি কাপড়।
অষ্ট অলঙ্কারে বিভূষিত নিরন্তর॥
তবে, এবে, বয়েস হয়েচে না কি ঢের।
সহজে কেহ না আর ঘেঁসে কাছে এর॥
নামজাদা কোনএক থিয়েটারে ছিল।
সম্প্রতি ছেড়েছে কাজ, বুড়া যেই হ’ল॥
থিয়েটার নামে, তবে, আছে না কি রস।
তাতেই এখনাে সবে গণে না বয়স॥
দেখিলেই তারে, তার সেই পূর্ব্ব ঢঙ।
মনে করি, ঘেঁসে লােক সেজে যেন সঙ॥
গােডিম্ ভেঙ্গেচে সবে, হেন পুঁটে ছেলে।
সেও এসে ধরে হাত, মেরিজান্ বােলে॥
কথাটা এই যে, তবু, ইয়ার-মণ্ডলী।
মানিয়া লইবে তারে সুরসিক বলি॥
থিয়েটারি বিবি বিনে বিবিই সে নয়।
সে বিবি রাখে যে তারে কে গণ্য করয়?
থিয়েটারি বিবি যদি অতি বুড়ী হবে।
এ কালের বাবু সব তারে পছন্দিবে॥
অথার উকিল এডিটার্ আদি করি।
লেখা-পড়া জানা যত করে লােচ্চাগিরি॥
সবাই যে এই সব স্থানে আসে যায়।
সভ্য বেশ্যারি কাছেতে সভ্য বাবু ধায়॥
কেন না ইদানী এই আজব সহরে।
সভ্যতা বলিলে যাহা বুঝে সর্ব্বনরে॥
তাহা শুধু থিয়েটার দেখা আর শুনা।
থিয়েটারী ঢঙে সর্ব্ব বিষয়ালােচনা॥
কহিবে যদ্যপি কথা বাপে ও বেটায়।
থিয়েটারী ঢঙ কিছু থাকিবেই তায়॥
না হলে অসভ্য সবে কবে তাহাদের।
সুরে লয়ে বিনে কথা অশ্রাব্য ভদ্রের॥
গৃহ-কোণে অবলার যত এক ঠাঁই।
থিয়েটারী ঢঙ চাহে তারাও সবাই॥
নূতন কাপড় যদি পান একখান।
থিয়েটারী ঢঙে তাহা পরেন,—পরান্॥
বলে, “ওলো ছােটদিদি এমন ত নয়।
দেখাইয়ে দিই দেখ্ আমি সে নিশ্চয়॥
অমুক্ নাটকে সেই অমুক্ যে সাজে।
আমি সে দেখাব দেখ্, কিরূপে সে সাজে॥
এই সে আঁচল থাকে এই দিক পানে।
বুকের কাছটা ঠিক্ এই মত টানে॥”
কেহ বলে, “এই যে দাঁড়ায়ে আছ তুমি।
এমন দাঁড়ান বদ্ দেখিনি ত আমি॥
তারা কি এমন কোরে বাঁকিয়া দাড়ায়।
কেমন বুকের ছাতি তাহারা ফুলায়॥”
কেহ বলে, “আচ্ছা দিদি, সেই যে ছুঁড়ীটে।
বল দেখি কেমন গলাটি তার মিঠে॥”
অমনি দ্বিতীয়া সেই অবলাটী হেসে।
বলিল, “আর কি নাই তেমন্ এ দেশে?
আমি যদি মনে করি ওর চেয়ে ভাল।
নিশ্চয় গা হতে পারি শুন লাে শুন লো॥”
ব্যস্—এই বলিয়েই ধােরে দিল গান।
অবলা-কুলের বালা কিবে খােলা প্রাণ॥
ধন্য থিয়েটার তুমি স্থান চমৎকার।
তােমার মহিমা বর্ণি কি সাধ্য আমার॥
তােমাতে পেয়েছে যারা স্থান একরতি।
ঠিক যেন স্বর্গে তারা করয়ে বসতি॥
তােমারে ধরিয়ে যারা লেখয় কেতাব।
কতদিকে কত তারা পাইল খেতাব॥
কেহ সেক্ষপীর সেথা কেহ কালিদাস।
দিগ্ দিগন্তরে তার উড়ে যে সুবাস॥
তামুক নাটকে ইহা লেখে থিয়েটারে।
বলিলে সে শাস্ত্র বলি সকলে তা ধরে॥
এর চেয়ে শুভদৃষ্ট কিবা আর হয়।
ধন্য থিয়েটার তুমি বঙ্গেতে উদয়॥
তাই বলি থিয়েটার নামে না কি মধু।
তাই সে আতরমণি পায় আজো বঁধু॥
মনােমত হােক্ বা না হােক্ ক্ষতি কিবা।
তাতেই বা কেবা তারে না দিবে বাহবা॥
চল্লিশ বৎসরাবধি এরূপে কাটায়ে।
তাবশেষে আশাশূন্য ক্রমে কিন্তু হয়ে॥
হইল পঞ্চাশ পার ক্রমেতে যখন।
তেজারতি করিতে সে করিল মনন॥
নিতান্ত নাচার দেখি বেল্লিক-পিতায়।
সেই সে আতর টাকা দিল কিছু তায়॥
একটি হাজার টাকা নগদ সে দিল।
টাকা প্রতি আনা সুদ কবুল করা’ল॥
গরজ হইতে না কি বালাই সে নাই।
গরজে স্বীকার অভা করিল তাহাই॥
খুলিল অচিরে এক মুদীর দোকান।
ছাড়িয়ে চাকরী সেই মলি নাক-কাণ॥
ভাবয়ে নির্ব্বোধ শীঘ্র ছেলে বড় হবে।
কিসের ভাবনা আর তা হলে রহিবে॥
একান্তই যদি ডুবি করিয়ে ব্যবসা।
পুত্র সে মানুষ হয়ে করিবে খােলসা॥
জ্যেষ্ঠপুত্র রাম মাের গুণের নিধান।
অবশ্যই হবে কালে মানুষ-প্রধান॥
হাকিম হেকিম কিম্বা জজ ম্যাজিষ্টর।
যা’ হােক্ একটা সেই হবে অতঃপর॥
যদিই ফতুর আমি হই ব্যবসায়।
নিশ্চয় উদ্ধার সেই করিবে দেনায়॥
তাহা ছাড়া, আরো এক আশা অভারামে।
বিয়ে দিলে লভ্য কিছু আছে ‘ছেলে’ নামে॥
তাহার উপর, এ ‘বেল্লিক’ ভাল অতি।
চারিদিকে রাষ্ট্র আছে ইহার সুখ্যাতি॥
প্রতি এক্জামিনে হয় সবার প্রধান।
দুহাজার টাকা কোন্ না পাব নিদান॥
তা হলেই অনায়াসে পাব মুক্তি ঋণে।
কে আর আমারে ঋণী বলিবে সে দিনে॥
ভাবিয়ে নিশ্চিন্ত হেনমতে অভারাম।
খুলিল সত্বর সেই মুদীর দোকান॥
হায় রে বাঙালী জাতি গােবর গণেশ।
ব্যবসার ধার কিবা ধারে তব দেশ॥
বাবুগিরী মাত্র শুধু করিতে শিখেছ।
বাবুগিরী বিনে আর কিবা জানিয়াছ?
পরের চাকরী করি ফতােবাবু চাল।
ব্যবসার সাধে কেন বাড়াও জঞ্জাল॥
কি কঠিন কাজ ইহা নাহি না কি জানো।
তাই সে ব্যবসা করি, ওঠে সাধ হেন॥
ফর্সা কাপড়খানি ফর্সা চাদোর।
গিলেতে কোঁচান দেহ নদোর গদোর॥
ঢিলে আস্তিনের জামা ইস্তিরি সার্ট্।
সাহেব-বাড়ীর বিনে পসন্দ না ছাঁট॥
লিক্লিকে ছড়ি একগাছি চাই হাতে।
সিল্কের রুমাল এক রবে তার সাথে॥
গলায় জুঁয়ের গােড়ে বেলফুল চাই।
এ সব থাকিতে ব্যব্সা কর কিসে ভাই॥
বৎসরমধ্যেই টাকা উড়িল বেবাক।
দুঃখিনী অভার পত্নী দেখেই অবাক্॥
বলে, “ও মা এ কি সর্ব্বনাশ গো করিলে।”
এমন করিয়ে মাথা কি হেতু খাইলে?”