বোধোদয়/মানব জাতি
মানব জাতি
মনুষ্যজাতি বুদ্ধি ও পরাক্রমে সকল জন্তু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাহাদিগের বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি আছে; এজন্য পশু পক্ষী ও অন্য অন্য সর্ব্বপ্রকার জীব জন্তুর উপর আধিপত্য করিতে পারে। মনুষ্য পশুর ন্যায় চারি পায় চলে না; দুই পায়ের উপর ভর দিয়া সোজা হইয়া দাঁড়ায়। তাহাদের হস্ত ও অঙ্গুলি সহিত, দুই বাহু আছে; ঐ হস্ত ও অঙ্গুলি দ্বারা তাহারা ইচ্ছানুরূপ সকল কর্ম্ম করিতে পারে। অন্য অনা জন্তুর শীরের চর্ম্ম রোমশ; এ জন্য তাহারা শীতে ও বাতাসে ক্লেশ পায় না। কিন্তু মানুষের চর্ম্ম রোমশ নহে; সুতরাং শীত বাত বারণের নিমিত্ত আবরণ বস্ত্র আবশ্যক। ঈশ্বর মনুষ্যকে হস্ত দিয়াছেন; উহা দ্বারা তাহারা বস্ত্র, গৃহ, গৃহসামগ্রী ও অন্য অন্য আবশ্যক বস্তু প্রস্তুত করিয়া লইতে পারে; এবং রন্ধন ও শীত নিবারণের নিমিত্ত অগ্নিও জ্বালিতে পারে।
মনুষ্য জাতি একাকী থাকিতে ভাল বাসে না। তাহারা পিতা, মাতা, ভ্রাতা, স্ত্রী, পুত্ত্র কন্যা প্রভৃতি পরিবারের মধ্যগত ও প্রতিবেশি মণ্ডলে বেষ্টিত হইয়া বাস করে। এরূপও দেখিতে পাওযা যায়, কোন কোন ব্যক্তি লোকসমাজ পরিত্যাগ করিয়া অরণ্যের মধ্যে কুটীর নির্ম্মাণ করিয়া বাস করে; কিন্তু তাদৃশ লোক অতিবরল। অধিকাংশ লোকই গ্রামে ও নগরে পরস্পরের নিকট বাটী নির্ম্মাণ করিয়া অবস্থিতি করে। যে স্থানে অল্প লোক বাস করে, তাহার নাম গ্রাম। যেখানে বহুসঙ্খ্যক লোকের বাস, তাহাকে নগর কহে। যে নগরে রাজার বাস, অথবা রাজকীয় প্রধান স্থান থাকে, তাহাকে রাজধানী কহে; যেমন কলিকাতা বাঙ্গলা দেশের রাজধানী।
মনুষ্যেরা গ্রামে ও নগরে একত্র হইয়া বাস করে। ইহার তাৎপর্য্য এই; তাহাদের পরস্পর সাহায্য ও আনুকুল্য হইতে পারিবেক; এবং পরস্পর দেখা শুনা ও কথা বার্ত্তায় সুখে কাল যাপন হইবেক। যে লোক যে দেশে বাস করে তাহাকে সেই দেশের নিবাসী কহে; এবং সেই সমস্ত নিবাসী লোক লইয়া এক জাতি হয়। পৃথিবীতে নানা দেশ ও নানা জাতি আছে।
লোক মাত্রেরি জন্মভূমি ঘটিত এক এক উপাধি থাকে; ঐ উপাধি দ্বারা তাহাদিগকে অন্য দেশীয় লোক হইতে পৃথক বলিয়া জানা যায়। বাঙ্গালা দেশে আমাদের নিবাস, এই নিমিত্ত আমাদিগকে বাঙ্গালি বলে! এইরূপ উড়িষ্যা দেশের নিবাসি লোকদিগকে উড়িয়া কহে। মিথিলার নিবাসিদিগকে মৈথিল; ইংলণ্ডের নিবসিদিগকে ইংরেজ।
মনুষ্যের দুইহাত; একটী ডানি, একটা বাম। আমরা যে হস্তে লিখি ও আহার করি সেই ডানি হাত; তদ্ভিন্নটী বাম হাত। বাম হস্ত অপেক্ষা দক্ষিণ হস্তে অনেক কর্ম্ম করা যায়। এইরূপ ডানিপা, বাঁ পা; ডানি চক্ষু, বাম চক্ষু; ডানি পাশ, বাঁ পাশ।
জন্তু সকল যখন শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয় তখন তাহারা আরাম করে ও নিদ্রা যায়। নিদ্রা যাইবার সময় তাহারা শয়ন ও নয়ন মুদ্রিত করে। অশ্ব প্রভৃতি কতক গুলি জন্তু দাঁড়িয়া নিদ্রা যায়। শশ প্রভৃতি কতক গুলি চক্ষু না বুজিয়া নিদ্রা যাইতে পারে। নিদ্রার প্রকৃত সময় রাত্রি; ঐ সময়ে সমস্ত জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। আমরা নিদ্রা যাইবার সময় কখন কখন স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন সকল কেবল অমূলক চিন্তা মাত্র; কোন কার্য্যকারক নহে। জন্তু সকল যখন নিদ্রা যায় তথন তাহারা নিদ্রিত; আর যখন নিদ্রা না যাইয়া জাগিয়া থাকে তখন তাহারা জাগরিত।
মনুষ্য ভিন্ন সকল জন্তুই কাঁচা বস্তু ভক্ষণ করে। ছাগ, মেষ, গো, মহিষ প্রভৃতি জন্তু মাঠের কাঁচা ঘাস খায়। সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভূতি শ্বাপদেরা কোন জন্তু মারিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার কাঁচা মাংস খাইয়া ফেলে। পক্ষিগণও জীয়ন্ত কীট পতঙ্গ ধরিয়া তৎক্ষণাৎ ভক্ষণ করে। মনুষ্যেরা কাঁচা বস্তু খায় না; থাইলে পরিপাক হয় না, পীড়াদায়ক হয়। কিন্তু কতকগুলি পক্ক ফল মুল ভক্ষণ করিতে পারে; ভক্ষণ করিলেও পীড়াদায়ক হয় না। তাহারা প্রায় সকল বস্তুই অগ্নিতে পাক করিয়া খায়। ভক্ষ্য বস্তু ভাল পাক করা হইলে সুস্বাদ ও শরীরের পুষ্টিকর হয়;
জন্তুগণ যখন সচ্ছন্দ শরীরে আহার বিহার করিয়া বেড়ায় তখন তাহাদিগকে সুস্থ বলা যায়। আর ঘথন তাহাদের পীড়া হয়, সচ্ছন্দে আহ্বার বিহার করিতে পারে না, সর্ব্বদা শুইয়া থাকে এসময়ে তাহাদিগকে অসুস্থ বলে। মনুষ্যের পীড়া হইবার অধিক সম্ভাবনা। পীড়া হইলে চিকিৎসকেরা ঔষধ দিয়া আরোগ্য করেন। অতএব পীড়িত হইলে বৈদ্যেরা যে ঔষধ দেন তাহা অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। রোগ হইলে ঔষধ ভিন্ন সুস্থ হইবার আর উপায় নাই। অনেকে ঔষধে অবহেলা করিয়া মরিয়া গিয়ছে।
কোন কোন জন্তু অধিক কাল বাঁচে; কোন কোন জন্তু অতি অল্প কাল মাত্র। ইহা প্রসিদ্ধ আছে, কুকুর প্রায় চৌদ্দ পনর বৎসর বাঁচে। কোন কোন ঘোড়া প্রায় কুড়ি বৎসর বাঁচে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষি সকল কেবল কয়েক বৎসর মাত্র বাঁচিয়া থাকে। অধিকাংশ কীট পতঙ্গ প্রায় এক বৎসরের অধিক বাঁচে না। কোন কোন কীট এক ঘণ্টা মাত্র বাঁচে। অতি ক্ষুদ্র জাতীয় মশা সূর্য্যের আলোকে অল্প কাল মাত্র খেলা করিয়া ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়।
সকল জন্তুরই স্ত্রী ও পুরুষ আছে; এবং তাহাদিগের সন্তানেরা ঐ রূপ স্ত্রী ও পুরুষ হইয়া থাকে। মৃত্যুকালে তাহারা সন্তান দিগকে রাথিয়া যায়। ঐ সন্তানেরাও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া আপন আপন সন্তান রাখিয়া লোক যাত্রা সম্বরণ করে। এই রূপে এক পুরুষ গত ও আর এক পুরুষ আগত হয়। মনুষ্যজাতি অন্য অন্য প্রায় সমুদায় জন্তু অপেক্ষা অধিক কাল বাঁচে।
মরণের অবধারিত কাল নাই; অনেকে প্রায় ষাটি বৎসরের মধ্যেই মরিয়া যায়। যাহারা সত্তর, আশী, নব্বই অথবা এক শত বৎসর বাঁচে তাহাদিগকে লোক দীর্ঘজীবী বলে, কিন্তু অনেকেই শৈশব কালে কালগ্রাসে পতি হয়। এক্ষণে যাহারা নিতান্ত শিশু আছে তাহারাও তাহাদের পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহীর ন্যায় বৃদ্ধ বয়স পর্য্যন্ত বঁচিতে পারে; কিন্তু চিরজীবী হইবে না। কেহই অমর নহে; সকলকেই মরিতে হইবেক।
জন্তু সকল মরিলে তাহাদের শরীরে প্রাণ ও চেতনা থাকে না। তখন উহারা আর পূর্ব্বের মত দেখিতে, শুনিতে, চলিতে, বলিতে কিছুই পারে না; কেবল অচেতন স্পন্দহীন জড় পদার্থ মাত্র পড়িয়া থাকে। মৃত শরীর বিশ্রী বিবর্ণ হইয়া যায়; দেখিলে অত্যন্ত অসন্তোষ জন্মে: এই জন্যে লোকে অবিলম্বে তাহা দাহ করে। কোন কোন জাতি দাহ করে না, মাটিতে পুতিয়া ফেলে।
মনুষ্য শৈশব কালে অতি অজ্ঞ থাকে; পরে, ক্রমে ক্রমে যত বড় হয়, উপদেশ পাইয়া নানা বিষয় শিখিতে থাকে। আমরা এই ষে পৃথিবীতে বাস করিতেছি, ইহা কত বড় ও ইহার কেমন আকার, শিশুরা তাহার কিছুই জানে না। তাহারা মনে করে পৃথিবী মেজের মত সমান ভূমি; কিন্তু ক্রমে পুস্তক পাঠ ও গুরূপদেশ দ্বারা জানিতে পারে পৃথিবী কমলা লেবুর ন্যায় গোল। শিখাইয়া না দিলে, শিশুরা কিছুই জানিতে পারে না; অধিক কি, তাহাদের কি নাম, কোন হাত ডানি, কোন হাত বাঁ, ইহাও জানিতে পারে না।
বালকেরা সকল বিষয়ে অজ্ঞ বলিয়া তাহাদিগকে শিক্ষার্থে পাঠশালায় পাঠাান যায়। যাহারা বাল্যকালে যত্ন পূর্ব্বক বিদ্যা অভ্যাস করে তাহারা চিরদিন ধনে, মনে, মনের সুখে কাল যাপন করে। আর যাহারা বিদ্যাভ্যাসে ঔদাস্য ও অবহেলা করিয়া কেবল খেলা করিয়া বেড়ায় তাহারা মূর্খ হয় ও যাবৎ জীবন দুঃখ পায়।