ব্যঙ্গকৌতুক/পয়সার লাঞ্ছনা

পয়সার লাঞ্ছনা

 আমাদের আপিসের সাহেব বলে, বাঙালীর বেশি প্রয়ােজন নাই। সে স্থির করিয়া রাখিয়াছে ভদ্র বাঙালীর ছেলের পক্ষে মাসিক পঁচিশ টাকা খুব উচ্চ বেতন। আমাদের অবস্থা এবং আমাদের দেশের সম্বন্ধে সাহেবরা যখন একটা মত স্থির করে তখন তাহার উপর আমাদের কোনাে কথা বলা প্রগল্‌ভতা। কেবল সাহেবের প্রতি একটা অন্তত ঘনিষ্ট কুটুম্বিতাসূচক বিশেষণ প্রয়োগপূর্ব্বক মনের ক্ষোভে আপনা-আপনির মধ্যে বলাবলি করি—সাহেব সবই তো জানেন।

 শােনা যায় জগতের হরণ-পূরণের একটা নিয়ম আছে। সে নিয়মের অর্থ এই—যাহার একটার অভাব তাহার আর একটার বাহুল্য প্রায়ই থাকে। আপিসেও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের যেমন বেতন অল্প, তেমনি খাটুনি এবং লাঞ্ছনা অধিক এবং সাহেবের ঠিক তাহার বিপরীত।

 কিন্তু জগতের এ নিয়ম কোনো কোনো জগদ্বাসীর পক্ষে যেমনই আনন্দ জনক হৌক আমাদের পক্ষে ঠিক তেমন সুবিধার হয় নাই। কেবল অগত্যা সহিরা ছিলাম, কিন্তু যেদিন আমাদের উপরের স্তরে একটা কর্ম্ম খালি হইল এবং বাহির হইতে একটা কাঁচা ইংরাজের ছেলেকে সেই কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়া আমাদের প্রমােশন্ বন্ধ করা হইল, সেদিল আমাদের ক্ষোভের আর সীমা রহিল না। ইচ্ছা হইল তখনি কাজ ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাই, একটা মিউটিনী করি, ইংরাজকে দেশ হইতে দুর করিয়া দিই, পার্লামেণ্টে একটা দরখাস্ত করি, ষ্টেট্‌স্‌ম্যান্ কাগজে একটা বেনানী পত্র লিখি। কিন্তু তাহার কোনােটা না করিয়া বাড়িতে চলিয়া গিয়া সেদিন আর জলখাবার খাইলাম না, খোকার সর্দ্দি হইয়াছে বলিয়া স্ত্রীকে যৎপরােনাস্তি লাঞ্ছনা করিলাম, স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল, আমি সকাল সকাল শুইয়া পড়িলাম। শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিলাম, হায়রে পয়সা তাের জন্য এতে অপমান!

 স্ত্রী অভিমান করিয়া আমার কাছে আসিলেন না, কিন্তু নিঃশব্দ চরণে নিদ্রাদেবী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হঠাৎ কখন্ দেখিতে পাইলাম—আমি একটি পয়সা। কিছু আশ্চর্য্য বােধ হইল না। কবে কোন্ সনাতন টাঁকশাল হইতে বাহির হইয়াছি যেন মনেও নাই। এই পর্য্যন্ত অবগত আছি যে, ব্রহ্মার পা হইতে যেমন শূদ্রের উৎপত্তি সেইরূপ টাঁকশালের অত্যন্ত নিম্নবিভাগেই আমাদের জন্ম।

 সেদিন শিকি দু-আনীর একটা মহতী সভা বসিবে কাগজে এইরূপ একটা বিজ্ঞাপন পড়া গিয়াছিল। হাতে কাজ ছিল না, কৌতূহলবশত গড়াইয়া গড়াইয়া সেই সভায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং দেয়ালের কাছে একটা কোণে আশ্রয় লইলাম।

 সুকুমারী সহধর্ম্মিণী দু-আনীকে সযত্নে বামপার্শ্বে লইয়া শুভ্রকায় চারআনীগুলি দলে দলে আসিয়া সভাগৃহ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তাহারা বাস করে কেহ বা কোটের পকেটে, কেহ বা চামড়ার থলিতে, কেহ বা টিনের বাক্সে। কেহ কেহ বা অদৃষ্টগতিকে আমাদের প্রতিবেশীরূপে আমাদের পাড়ায় ট্যাঁকের মধ্যেও বদ্ধ হইয়া দিনযাপন করে।

 সেদিনকার আলােচনার বিষয়টা এই যে, “আমরা পয়সার সহিত সর্ব্বতােভাবে পৃথক হইতে চাহি, কারণ, উহারা বড়ােই হীন।” দু-আনীরা সুতীক্ষ্ণ উচ্চস্বরে কহিল “এবং উহারা তাম্রবর্ণ ও উহাদের গন্ধ ভালো নহে।” আমার পাশে একটি দু-আনী ছিল, সে ঈষৎ বাঁকিয়া বসিয়া নাসাগ্র কুঞ্চিত করিল, তাহার পার্শ্ববর্ত্তী চার-আনী আমার দিকে কট্‌মট্‌ করিয়া তাকাইল, আমি তো একেবারে সঙ্কোচে শিকি পয়সা হইয়া গেলাম। মনে মনে কহিলাম, আমাদেরই তো আটটা যােলটা হজম করিয়া তােমাদের আজ এতো মূল্য, সে জন্য কি কিছু কৃতজ্ঞতা নাই? মাটির নীচে তাে উভয়ের সমান পদবী ছিল!

 সেদিন প্রস্তাব হইল গৌরমুদ্রা এবং তাম্রমুদ্রার জন্য স্বতন্ত্র টাঁকশাল স্থাপিত হৌক। যদিও এক মহারাণীর ছাপ উভয়ের উপর মারা হইয়াছে, তাই বলিয়া কোনােরূপ সাম্য আমরা স্বীকার করিতে চাহি না। আমরা এক ট্যাঁক, এক থলি, এক বাক্সে বাস করিব না, এমন কি শিকি দু-আনী ভাঙাইয়া পরসা করা ও পয়সা ভাঙাইয়া শিকি দু-আনী করা এরূপ অপমানজনক আইন ও আমরা পরিবর্ত্তন করিতে চাহি। সাম্যবাদের গৌরব আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু তাহার একটা সীমা আছে। গিনি মােহরের সহিত সিকি দু-আনি এক সাম্যসীমার অন্তর্গত, কিন্তু তাই বলিয়া শিকি দু-আনীর সহিত পয়সা।

 সকলেই চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “কখনই নহে, কখনই নহে!” দু-আনীর তীব্র কণ্ঠস্বর সর্ব্বোচ্চে শােনা গেল। যে খনিতে আমার আদিম উৎপত্তি সেই খনির মধ্যে প্রবেশ করিবার ইচ্ছায় আমি বসুমতীকে দ্বিধা হইতে অনুরােধ করিলাম, বসুমতী সে অনুরােধ পালন করিল না—দেয়াল ঘেঁষিয়া রক্তবর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম।

 এমন সময়ে এক ঝক্‌ঝকে নূতন আট-আনী গড়াইয়া এক শিকি-দুআনীর সভার মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে দেখিলাম সকলকে ছাড়াইয়া উঠিল। সতেজে বক্তৃতা দিতে লাগিল, ঝন্‌ঝন্ শব্দে চারিদিকে করতালি পড়িল।

 কিন্তু আমি ঠাহর করিয়া শুনিলাম, বক্তৃতাটা যেমন হৌক আওয়াজটা ঠিক রূপালি ছাঁদের নহে। মনে বড়ো সন্দেহ হইল। সভা যখন ভঙ্গ হইল, ধীরে ধীরে গড়াইয়া গড়াইয়া বহুসাহসপূর্ব্বক তাহার গায়ের উপর গিয়া পড়িলাম―ঠন্ করিয়া আওয়াজ হইল, সে আওয়াজটা অত্যন্ত দিশি এবং গন্ধটাও দেখিলাম, আমাদের স্বজাতীয়ের মতাে। মহা রাগিয়া উঠিয়া সে কহিল, “তুমি কোথাকার অসভ্য হে!” আমি কহিলাম “বৎস, তুমিও যেখানকার আমিও সেখানকার!”—ছোঁড়াটা আমাদের নিম্নতন কুটুম্ব―আধপয়সা; কোথা হইতে পারা মাখিয়া আসিয়াছে।

 তাহার রকম-সকম দেখিয়া হাঃ হাঃ শব্দে হাসিয়া উঠিলাম।

 হাসির শব্দে জাগিয়া উঠিয়া দেখি, স্ত্রী পাশে শুইয়া কাঁদিতেছে। তৎক্ষণাৎ তাহার সঙ্গে ভাব করিয়া লইলাম। ঘটনাটা আদ্যোপান্ত বিবৃত করিয়া বলিলাম―বড়ো ধরা পড়িয়াছে! কিন্তু মনে করিতেছি আমিও কাল হইতে পারা মাখিয়া আপিসে যাইব।

 আমার স্ত্রী কহিল, তাহার অপেক্ষা পারা খাইয়া মরা ভালো।

  ১৩০০