ব্যঙ্গকৌতুক/বিনিপয়সায় ভোজ
বিনিপয়সায় ভােজ
আপিসের বেশে অক্ষয় বাবু।
(হাসিতে হাসিতে) আজ আচ্ছা জব্দ ক’রেচি। বাবু রােজ আমাদের স্কন্ধে বিনামূল্যে বিনামাশুলে ইয়ার্কি দিয়ে বেড়ান, আর লম্বা চওড়া কথা কন্! মশায়, আজ বছর খানেক ধ’রে রােজ বলে আজ খাওয়াবাে,কাল খাওয়াবাে,খাওয়াবার নাম নেই! যতােখানি আশা দিয়েছে তা’র শিকি পরিমাণ যদি আহার দিত তা হ’লে এতোদিনে তিনটে রাজসূয় যজ্ঞ হ’তে পা’র্তাে। যা হােক্ আজ তো বহু কষ্টে একটা নিমন্ত্রণ আদায় করা গেছে। কিন্তু দুটি ঘণ্টা ব’সে আছি এখনাে তার দেখা নেই। ফাঁকি দিলে না তাে? (নেপথ্যে চাহিয়া) ওরে কী তাের নাম, ভূতাে, মােধো, না হরে?,
চন্দ্রকান্ত? আচ্ছা বাবু তাই সই। তা ভালাে চন্দ্রকান্ত, তােমার বাবু কখন্ আস্বে বলো দেখি?
কী বল্লি! বাবু হােটেল থেকে খাবার কিনে আন্তে গেচেন? বলিস্ কী রে? আজ তবে তো রীতিমত খানা! ক্ষিদেটিও দিব্যি জ’মে এসেচে! মটনচপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ ক’রে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতাে চক্চকে ক’রে রেখে দেবাে। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাক্বে—কিন্তু কতোক্ষণই বা থাক্বে? আর দুরকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হ’লে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলােকে একেবারে কাঁচের আয়না বানিয়ে দেবো। যদি মনে ক’রে ডজন্দুত্তিন অয়ষ্টার প্যাটি আনে তা হ’লে ভােজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়। আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচ্চে, বােধ হয় অয়ষ্টার প্যাটি আস্বে! ওহে ও চন্দ্রকান্ত, তােমার বাবু কখন্ গেছেন বলো দেখি?
অনেকক্ষণ গেচেন? তবে আর বিস্তর বিলম্ব নেই। ততােক্ষণ একছিলিম তামাক দাও না। অনেকক্ষণ ধ’রে ব’ল্চি কিন্তু তােমার কোনাে গা দেখ্চিনে!—
তামাক বাইরে নেই? বাবু বন্ধ ক’রে রেখে গেছেন? এমন তো কখনো শুনিনি! এ তাে কোম্পানির কাগজ নয়! কী করা যায়! আমি একটু-আধটু আফিম খাই, তামাক না হ’লে তো আর বাঁচিনে! ওহে মােধো, না না চন্দ্রকান্ত, কোনাে মতে মালিদের কাছ থেকে হােক্ যেখান থেকে হােক্ এক ছিলিম জোগাড় ক’রে দিতে পারো না?
বাজার থেকে কিনে আন্তে হবে? পয়সা চাই? আচ্ছা বাপু তাই সই! এই নাও, এক পয়সার তামাক চট্ ক’রে কিনে নিয়ে এসাে।
এক পয়সায় তামাক হবে না? কেন হবে না? বাপু, আমাকে কি মুচিখােলার নবাব ব’লে হঠাৎ তােমার ভ্রম হয়েছে? যােলাে টাকা ভরির অম্বুরি তামাক না হ’লেও আমার কষ্টেসৃষ্টে চ’লে যায়— এক পয়সাতেই ঢের হবে।
হুঁকো কোল্কেও কিনে আন্তে হবে? সে-ও তােমার বাবু লােহার সিন্দুকে পূরে রেখে গেছেন না কি? বাঙাল ব্যাঙ্কে সেফ্ ডিপজিট করে আসেন নি কেন? ওরে বাস্রে! এ তাে ভালাে জায়গায় এসে পড়া গেচে দেখ্চি! তা নাও, এই ছ’টি পয়সা ট্রামের জন্যে রেখেছিলুম। উদয় ফিরে এলে তার কাছ থেকে সুদসুদ্ধ আদায় ক’রে নিতে হবে!—এই বুঝি বাবুর বাগানবাড়ি, তা হ’লে এঁর ভদ্রাসন বাড়ি কী রকম হবে না জানি! কড়িগুলো মাথায় ভেঙে না প’ড়্লে বাঁচি। এই তাে একখানি ভাঙা চৌকি আস্বাবের মধ্যে! এ আমার ভর সইবে না! সেই অবধি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে পা ব্যথা হ’য়ে গেল—আর তো পারিনে—এই মাটিতেই বসা যাক্!
(কোঁচা দিয়া ধূলা ঝাড়িয়া একটা খবরের কাগজ মাটিতে পাতিয়া উপবেশন ও গুন্ গুন্ স্বরে গান)
যদি জোটে রােজ
এম্নি বিনি পয়সায় ভােজ!
ডিশের পরে ডিশ্
(শুধু) মটন্ কারি ফিশ্,
সঙ্গে তারি হুইস্কি সােডা দুচার রয়াল ডােজ!
পরের তহবীল্
চোকায় উইল্সনের বিল্;
থাকি মনের সুখে হাস্যমুখে কে কার রাখে খোঁজ!—
কইরে! তামাক এলো? ও কী রে! শুধু কোল্কে? হুঁকো কই? এখানে ছ-পয়সায় হুঁকো পাওয়া যায় না? কোল্কেটার দাম দু-আনা! হ্যা দ্যাখ বাপু চন্দ্রকান্ত,বাইরে থেকে আমাকে দেখে যতটা বােকা মনে হয় আমি ততোটা নই! শরীরটা যতো মােটা, বুদ্ধিটা তা’র চেয়ে কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম! তােমার বাবু যে হুঁকোটা কোল্কেটা তামাকটা পর্য্যন্ত আয়রণ্চেষ্টে তুলে রেখে দেন এতােক্ষণে তা’র কারণ বােঝা গেল। কেবল তােমার মতাে রত্নটিকে বাইরে রাখাই তাঁর ভুল হ’য়েছে। বােধ হয় বেশি দিন বাইরে থাক্তেও হবে না! কোম্পানি বাহাদুর একবার খবরটি পেলেই পাহারা বসিয়ে খুব হেপাজতের সঙ্গেই তােমাকে রাখ্বেন! যা হােক্ তামাক না খেয়ে তো আর বাঁচিনে! (কলিকায় মুখ দিয়া তামাক টানিয়া কাশিতে কাশিতে) ওরে বাবা, এ কোথাকার তামাক! এ যে উইল্ ক’রে টান্তে হয়! এর দু-টান টান্লে স্বয়ং বাবা ভােলানাথের মাথার চাঁদি ফট্ ক’রে ফেটে যায়, নন্দীভৃঙ্গীর ভীর্ম্মি লাগে! কাজ নেই বাপু, থাক্! বাবু আগে আসুন! কিন্তু বাবুর আস্বার জন্যে তাে কোনাে রকম তাড়া দেখ্চিনে! সে বােধ হয় প্যাটিগুলো একটি একটি ক’রে শেষ ক’র্চে। এদিকে আমার পেট এমনি জ্ব’লে উঠেচে যে, মনে হ’চ্চে যেন এখনি কোঁচায় আগুন ধ’রে যাবে! তৃষ্ণাও পেয়েচে। কিন্তু জল চাইলেই আমাদের চন্দ্রকান্ত ব’লে ব’স্বেন গেলাস্ কিনে আন্তে হবে, বাবু, বন্ধ ক’রে রেখে গেচেন। কাজ নেই, বাগানের ডাব খাওয়া যাক্।
ওহে বাপু চন্দ্র, একটি কাজ ক’র্তে পারো? বাগান থেকে চট্ ক’রে একটি ডাব পেড়ে আন্তে পারো? বড় তেষ্টা পেয়েচে!—
কেন? ডাব পাওয়া যাবে না কেন? বাগানে তাে ডাব বিস্তর দেখে এলুম?
সব গাছ জমা দেওয়া হ’য়েচে? তা হােক্ না বাপু, একটি ডাবও মিল্বে না?
পয়সা চাই? পয়সা তাে আর নেই! তবে থাক্, বাবু আসুন, তা’র পরে দেখা যাবে!―সঙ্গে মাইনের টাকা আছে কিন্তু ওকে ভাঙাতে দিতে সাহস হয় না। এখনো কোম্পানির মুলুকে যে এতো বড়ো একটি ডাকাত বাইরে ছাড়া আছে তা আমি জান্তুম না!—যাই হোক্ এখন উদয় এলে যে বাঁচি!
ঐ বুঝি আস্চে! পায়ের শব্দ শুন্চি। আঃ বাঁচা গেল। ওহে উদয়, ওহে উদয়! কই, না তো! তুমি কে হে?―
বাবু তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন? তা’র চেয়ে নিজে এলেই তো ভালো ক’র্তেন! ক্ষিদেয় যে মারা গেলুম!
হোটেলের বাবু? কেরাণী বাবু? কই, তাঁর সঙ্গে আমার তো কোনো আত্মীয়তা নেই। কিছু খাবার পাঠিয়েচেন ব’ল্তে পারো? অয়ষ্টার প্যাটি?
পাঠান্ নি? বিল্ পাঠিয়েচেন? কৃতার্থ ক’রেচেন আর কি! যে বাবুটির নামে বিল্ তিনি এখানে উপস্থিত নেই!
আরে না রে না! আমি না। এও তো ভালো বিপদে প’ড়্লুম! —আরে মাইরি না! কী গেরো! তোমাকে ঠ’কিয়ে আমার লাভ কী বাপু? আমি নিমন্ত্রণ খেতে এসে তিন ঘণ্টা এখানে ব’সে আছি— তুমি হোটেল থেকে আস্চো, তবু তোমাকে দেখেও অনেকটা তৃপ্তি হ’চ্চে। বোধ হয় তোমার ঐ চাদরখানা সিদ্ধ ক’র্লে ওর থেকে নিদেন—ভয় নেই, আমি তোমার চাদর নেবো না, কিন্তু বিল্টিও চাইনে!
এ তো ভালো মুস্কিল দেখ্চি! ওগো না গো না! আমি উদয় বাবু নই, আমি অক্ষয় বাবু! কী গেরো! আমার নাম আমি জানিনে তুমি জানো? অতো গোলে কাজ কী বাবু, তুমি নীচে গিয়ে একটু বোসো, উদয় বাবু এখনি আস্বেন।
বিধাতা সকাল বেলায় এই জন্যেই কি ডান চোখ নাচিয়েছিলে? হোটেল থেকে ডিনার না এসে বিল এসে উপস্থিত!
“সখি, কি মাের করম ভেল!
পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবি, বজর পড়িয়া গেল!”
হে বিধি, তােমারই বিচারে সমুদ্রমন্থনে একজন পেলে সুধা আর একজন পেলে বিষ, হােটেলমন্থনেও কি একজন পাবে মজা আর একজন পাবে তা’র বিল্! বিল্টাও তো কমদিনের নয় দেখ্চি।
তুমি আবার কে হে? বাবু পাঠিয়ে দিলে? বাবুর যথেষ্ট অনুগ্রহ! কিন্তু তিনি কি মনে ক’রেচেন তােমার মুখখানি দেখেই আমার ক্ষুধা—তৃষ্ণা দূর হবে? তােমার বাবু তাে বড়ো ভদ্রলােক দেখ্চি হে?
কী ব’ল্লে? কাপড়ের দাম? কার কাপড়ের দাম?
উদয় বাবু কাপড় কিন্বেন আর অক্ষয় বাবু তা’র দাম দেবে। তােমার তো বিবেচনাশক্তি বেশ দেখ্চি।
সত্যি না কি? কিসে ঠাওরালে আমারই নাম উদয় বাবু? কপালে কি সাইনবাের্ড টাঙিয়ে রেখেচি? আমার অক্ষয় বাবু নামটা কি তােমার পছন্দ হ’লো না?
নাম ব’দ্লেচি? আচ্ছা বাপু শরীরটি তাে বদ্লানো সহজ ব্যাপার নয়। উদয় বাবুর সঙ্গে কোন্খানটা মেলে, বলো দেখি?
উদয় বাবুকে কখনাে চাক্ষুষ দেখােনি?—আচ্ছা একটু সবুর করো, তােমার মনের আক্ষেপ মিটিয়ে দেবো। বিস্তর দেরি হবে না, তিনি এলেন ব’লে।
আরে মােলো! আবার কে আসে? মশায়ের কোত্থেকে আসা হ’লাে? মশায়েরও এখানে নিমন্ত্রণ আছে বুঝি?
বাড়িভাড়া? কোন্ বাড়ির ভাড়া মশায়? এই বাড়ির? ভাড়াটা কতো হিসেবে?
মাসে সতেরো টাকা? তা হলে হিসেব করুন দেখি সাড়ে তিন ঘণ্টায় কতো ভাড়া হয়?
ঠাট্টা ক’র্চিনে মশায়—মনের সে রকম প্রফুল্ল অবস্থা নয়! এ বাড়িতে নিমন্ত্রিত হ’য়ে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টা কাল আছি। সে জন্যেও যদি ভাড়া দিতে হয় তো ন্যায্য হিসেব ক’রে নিন্! তামাকটা পর্য্যন্ত পয়সা দিয়ে খেয়েচি।
আজ্ঞে না, আপনি ঠিকটি অনুমান ক’র্তে পারেন নি—আপনার ঈষৎ ভুল হ’য়েছে—আমার নাম উদয় নয়, অক্ষয়। এ রকম সামান্য ভুলে অন্য সময় বড়ো একটা কিছু আসে যায় না কিন্তু বাড়ি ভাড়া আদায়ের সময় বাপ মায়ে যার যে নাম দিয়েচেন সেইটে বাঁচিয়ে কাজ ক’র্লেই সুবিধে হয়!
আমাকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে ব’ল্চেন? মাপ ক’র্বেন, ঐটি পার্বো না! সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে পেটের জ্বালায় ম’র্চি, ঠিক যেই খাবারটি আস্বার সময় হ’লো অমনি আপনি গাল দিচ্ছেন ব’লেই যে বাড়ি ছেড়ে চ’লে যাবো আমাকে তেমন গর্দ্দভ ঠাওরাবেন না! আপনি ঐখানেই বসুন, যা যা বল্বার অভিপ্রায় আছে ব’লে যান্, আমি আহারান্তে বাড়ি ছেড়ে যাবো!
ব’কে ব’কে আমার গলা শুকিয়ে এলো, আর তো বাঁচিনে! ক্ষিধেয় নাড়িগুলো বেবাক্ হজম হ’য়ে গেল! ঐ যে পায়ের শব্দ! ওহে উদয়, আমার অন্ধের নড়ি, আমার সাগরসেঁচা সাত রাজার ধন মাণিক, একবার উদয় হও হে! আর তো প্রাণ বাঁচে না!
তুমি আবার কে হে? যদি গালমন্দ দেবার থাকে তো ঐখানে ব’সে আরম্ভ ক’রে দাও! দোহার্কি কর্বার অনেকগুলি লোক উপস্থিত আছে!
হরি বাবু আমাকে ডেকে পাঠিয়েচেন? শুনে বড়ো সন্তোষ লাভ ক’র্লুম! তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন সন্দেহ নেই কিন্তু আমার পরমবন্ধু যাঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ ক’রে পাঠিয়েছেন তাঁদের কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই আর যাঁদের সঙ্গে আমার কোনো কালে কোনো পরিচয় নেই, তাঁরা যে আজ প্রাতঃকাল থেকে আমাকে এতো ঘন ঘন খাতির ক’র্চেন এর কারণ কী? আচ্ছা মশায়, হরি বাবু নামক কোনো একটি ভদ্রলােক আমাকে কেন এমন অসময়ে স্মরণ ক’র্লেন এবং হঠাৎ এতােই অধৈর্য্য হ’য়ে উঠ্লেন ব’ল তে পারেন কি?
কী! আমি আমার স্ত্রীর বালা গড়াবার জন্যে তাঁর কাছ থেকে নমুনাস্বরূপ গহনা এনে ফিরিয়ে দিচ্চিনে?—দেখো, এ সম্বন্ধে আমার অনেক গুলি কথা বল্বার ছিল কিন্তু আপাতত একটি ব’ল্লেই যথেষ্ট হবে —আমি কারো কাছ থেকে কোনো গহনা আনিনি এবং আমার স্ত্রীই নেই। প্রধান প্রধান কথা আর যা বল্বার ছিল সে আজকের মতাে মাপ ক’র্বেন—গলা শুকিয়ে তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মর্চি! আপনি আর আধ ঘণ্টা কাল অপেক্ষা করুন, সমস্ত সমাচার অবগত হবেন! (উচ্চৈঃস্বরে) ওরে উদয়, ওরে উদো, ওরে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা পাজি ছুঁচো ড্যাম শুয়ার ইষ্টুপিড্—ওরে পেট যে জ্ব’লে গেল, গলা যে শুকিয়ে যায়, মাথা যে ফেটে যাচ্চে—ওরে নরাধম, কুলাঙ্গার!
আরে না মশায়—আপনাদের সম্ভাষণ ক’র্চিনে! আপনারা হঠাৎ চঞ্চল হবেন না। আমি পেটের জ্বালায় মনের খেদে আমার প্রাণের বন্ধুকে ডাক্চি। আপনারা বসুন!
আর ব’স্তে পার্চেন না? অনেক দেরি হ’য়ে গেচে? সে কথা আর আমাকে ব’ল্তে হবে না! দেরি হ’য়েচে সন্দেহ নাই। তা হ’লে আপনাদের আর পীড়াপীড়ি ক’রে ধ’রে রাখ্তে চাইনে! তবে আজকের মতো আপনারা আসুন! আপনাদের সঙ্গে মিষ্টালাপে এতোক্ষণ সময়টা বেশ সুখে কেটেছিলাে!
কিন্তু এখন যে কথাগুলাে ব’ল্চেন ওগুলাে কিছু অধিক পরিমাণেই ব’ল্চেন! খুব পরম বন্ধুকেও মানুষ ভালােবেসে শ্যালক সম্ভাষণ ক’র্ত্তে হঠাৎ কুণ্ঠিত হয়, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে অতি অল্পক্ষণের আলাপেই যে আপনারা এতােটা বেশি ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তা ক’র্চেন সে জন্যে আমি মনে মনে কিছু লজ্জাবােধ ক’র্চি! জান্বেন আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক কোনাে রকম অসদ্ভাব নেই কিন্তু আপনারা আমার কাছে যতােটা প্রত্যাশা ক’র্চেন আমি ততােটা দিতে একেবারে অক্ষম!
মশায়রা আর বাড়াবাড়ি ক’র্বেন না। আপনারা বােধ হয় দু-বেলা নিয়মিত আহার ক’রে থাকেন, ক্ষিদে পেলে মানুষের মেজাজটা কী রকম হয় ঠিক জানেন না, তাই আমাকে এমন অবস্থায় ঘেঁটাতে সাহস ক’র্চেন!
আবার! ফের! দেখাে বাপু, আমার সঙ্গে পার্বে না। শরীরটা দেখেই বুঝ্তে পারচো না! বহু কষ্টে রাগ চেপে আছি, পাছে একটা খুনােখুনি কাণ্ড ক’রে বসি! আচ্ছা, আমাকে রাগাও দেখি! দেখি তােমাদের কতাে ক্ষমতা! কিছুতেই রাগাতে পার্বে না। এই দেখাে আমি খুব গম্ভীর হ’য়ে ঠাণ্ডা হয়ে ব’স্লুম। ও বাবা! এরা যে সবাই মিলে মারধাের কর্বার জোগাড় করে! খালিপেটে ক্ষিদের উপর মারটা সয় না দেখ্চি! আচ্ছা বাপু, তােমরা সবাই বােসো! তােমাদের কার কতো পাওনা আছে বলো। ভাগ্যি মাইনের টাকাটা পকেটে ছিল, নইলে আজ নিতান্তই ধনঞ্জয়কে স্মরণ ক’রে একপেট ক্ষিদে সুদ্ধ দৌড় মার্তে হ’তো! আপাতত প্রাণটা বাঁচাই, তা’রপর টাকাটা উদয়ের কাছ থেকে আদায় ক’রে নিলেই হবে!
তােমার পাঁচ টাকা বই পাওনা নয় কিন্তু তুমি পঞ্চান্ন টাকার গাল পেড়ে নিয়েচো বাপু—এই লও তােমার টাকা!
ওহে বাপু, তােমার হােটেলের বিল এই শুধে দিচ্চি, যদি কখনাে অসময়ে তোমাদের শরণাগত হ’তে হয় তা হ’লে স্মরণ রেখো।
তােমার তিনমাসের বাড়িভাড়া পাওনা? একমাসের টাকাটা আজ দিচ্চি বাকি পরে নিয়ো। তুমি তাে ভাই তােমার গালমন্দ আমাকে ষোল আনাই চুকিয়ে দিয়েচো, তা’তে বােধ করি তােমার মনটা কতকটা খােলসা হ’য়েচে, এখন আশীর্ব্বাদ ক’রে বাড়ি চ’লে যাও!
ওহে বাপু, তােমার গহনা ফিরিয়ে দেওয়া সহজ নয়। যদি আমার স্ত্রী থাক্তেন আর তােমার গহনা তাঁকে দিতুম তা হ’লেও ফিরিয়ে আনা শক্ত হতো; আর যখন তিনি বর্ত্তমান নেই এবং তােমার গহনা তাঁকে দিইনি তখন ফিরিয়ে আনা আরো কতাে কঠিন তা একটুখানি ভেবে দেখ্লে তুমিও হয় তো বুঝ্তে পারবে। তবু যদি পীড়াপীড়ি করো তা হ’লে কাজেই তােমার হরিবাবুর ওখানে আমাকে যেতে হবে, কিন্তু খাবারটা আসে কি না আর একটু না দেখে যেতে পারচিনে!—উঃ! আর তো পারিনে! চন্দ্র, ওহে চন্দ্র! এখানে উদয়ের তো কোনাে সম্পর্ক নেই, এখন তুমি সুদ্ধ অস্ত গেলে আমি যে অন্ধকার দেখি! চন্দ্র! ওহে চন্দ্রকান্ত! এই যে এসেচো! চন্দ্র, তুমি তো তােমার বাবুকে চেনো, সত্য ক’রে বলাে দেখি আজ কাল এবং পরশুর মধ্যে তিনি কি হােটেল থেকে ফিরবেন?
বােধ হয় ফিরবেন না? এতােক্ষণ পরে তােমার এই কথাটি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হ’চ্চে। যা হােক্ বড্ডো ক্ষিদে পেয়েচে এখন আর গাল দেবার সময় নেই, এই আধুলিটি নিয়ে যদি চট্ ক’রে কিছু খাবার কিনে আনো, তা হলে প্রাণ রক্ষে হয়।
লােকটা নবাবী ক’রে বেড়ায় অথচ কাজকর্ম্ম কিছু নেই, আমরা ভাব্তুম চালায় কী ক’রে! এখন ব্যাপারটা বুঝ্তে পারচি! কিন্তু প্রত্যহ এতোগুলি গাল হজম ক’রে, এতােগুলি বিল্ ঠেকিয়ে, এতােগুলো লােক খেদিয়ে রাখা তো কম কাণ্ড নয়! এতে মজুরি পােষায় না, এর চেয়ে ঘানি ঠেলেও সুখ আছে!
কী হে! শুধু মুড়ি নিয়ে এলে? আর কিচ্ছু পাওয়া গেল না? পয়সা কিছু ফিরেচে?
না? আচ্ছা, তবে দাও মুড়িই দাও! (আহার)
ওহে চন্দ্র, কী ব’ল্বো, ক্ষুধার চোটে এই বাসি মুড়ি যেন সুধা ব’লে বােধ হ’চ্চে! অনেক নিমন্ত্রণ খেয়েচি কিন্তু এমন সুখ পাইনি! চন্দ্র, তুমিই সুধাকর বটে কিন্তু আজকে কলঙ্কের ভাগটাই কিছু বেশি দেখা গেল! ডাবও একটা এনেচো দেখ্চি, এর জন্যেও স্বতন্ত্র কিছু দিতে হবে না কি?
হবে না? শরীরে দয়ামায়া কিছু আছে বােধ হ’চ্চে, এখন যদি একটি গাড়ি ডেকে দাও তো আস্তে আস্তে বিদায় হই।
গাড়ি এখানে পাওয়া যায় না? তবে তো বড়াে বিপদে ফেল্লে? আমি এখন না খেয়ে কাহিল শরীরে দেড়ক্রোশ রাস্তা হাঁট্তে পারবো না; যখন সম্মুখে আহারের আশা ছিল তখন পেরেছিলুম। কী ক’রবো! বেরিয়ে পড়া যাক্!
কী সর্ব্বনাশ! এই সময়ে আবার হরিবাবুর ওখানে যেতে হবে। চন্দ্র, তুমি আজ আমার বিস্তর উপকার ক’রেচো, এখন আর কিছু ক’র্তে হবে না, এই ভদ্রলােকের ছেলেটিকে বুঝিয়ে দাও আমি উদয় বাবু নই, আমি আহিরিটোলার অক্ষয় বাবু।
ও তােমার কথা বিশ্বাস ক’র্বে না? সেজন্যে ওকে আমি বেশি দোষ দিতে পারিনে, বােধ হয় তােমাকে ও অনেক দিন থেকে চেনে! যা হােক আর ঝগড়া করবার সামর্থ্য নেই, আস্তে আস্তে হরিবাবুর ওখানেই যাওয়া যাক্। বাপু, যে রকম অবস্থা দেখ্চো পথে যদি একটা কিছু ঘটে, দাহ কর্বার ব্যয়টা তােমার স্কন্ধে প’ড়বে—আগে থাকতে বলে রাখ্লুম।
চন্দ্র, তুমি আবার হাত বাড়াও কেন হে? তােমাদের কল্যাণে যে রকম সস্তায় আজ নেমন্তন্ন খেয়ে গেলুম বহুকাল আমার আর ক্ষিদে থাক্বে না! আরাে কী চাও?
ও! বকশিষ! সেটা চুকিয়ে দেওয়াই ভালাে! যখন এতোই ক’র্লেম তখন সর্ব্বশেযে ঐ খুঁৎটুকু আর রাখ্বো না। কিন্তু আমার কাছে আর একটিমাত্র টাকা বাকি আছে। তা’র মধ্যে বারো আনা আমি গাড়ি ভাড়ার জন্যে রেখে দিতে চাই। তােমার কাছে খুচ্রো যদি কিছু থাকে তা হ’লে ভাঙিয়ে—
খুচ্রাে নেই? (পকেট উল্টাইয়া শেষ টাকাটি দিয়া) তবে এই লও বাপু, তােমাদের বাড়ি থেকে বেরােলুম একেবারে “গজভুক্ত কপিত্থবৎ!”
কিন্তু এই যে টাকাগুলি দিলুম, উদয়ের কাছ থেকে ফিরে আদায় কর্বার কী উপায় করা যায়? একটা দামি জিনিষ যদি কিছু পাওয়া যায় তো আটক ক’রে রাখি! দামী জিনিষের মধ্যে তাে দেখ্চি ঐ চন্দ্রকান্ত! কিন্তু যে রকম দেখ্লুম ওঁকে সংগ্রহ করা আমার কর্ম্ম নয়, আমাকে উনি ট্যাঁকে গুঁজে নিতে পারেন।
(কোণে একটা দেরাজ সবলে খুলিয়া) বাঃ, এই তাে ঠিক হ’য়েছে! চেনটিও দিব্যি! তা’ হ’লে ঘড়িসুদ্ধ এইটি দখল করা যাক!
কী হে চন্দ্র, এতো ব্যস্ত কেন?
পুলিস? পুলিস আস্চে?
আমাকে পালাতে হবে? কেন, কী দুষ্কর্ম্ম ক’রেচি? কেবল এক ভদ্রলােকের নিমন্ত্রণ রক্ষা ক’র্তে এসেচি, তা’র যা শাস্তি যথেষ্ট হ’য়েচে।
তাই তাে সত্যিই দেখ্চি! চন্দ্র কোথায় গেল? হরিবাবুর সেই লােকটিকেও যে দেখ্চিনে! সবাই পালিয়েচে।
দেখাে বাপু গায়ে হাত দিয়ো না! ভালো হবে না! আমি ভদ্রলােক। চোর নই জালিয়াৎ নই।
উঃ করো কী! লাগে যে! বাবা আজ সমস্ত দিন কেবল মুড়ি খেয়ে পথ চেয়ে আছি, আজ তােমাদের এ-সব ঠাট্টা আমার ভালাে লাগ্চে না।
পেয়াদা বাবা, বরঞ্চ কিছু জলপানী নাও! (পকেটে হাত দিয়ে) হায় হায় একটি পয়সা নেই! দারােগা সাহেব, যদি চোর ধ’র্তে চাও, চলাে আমি তােমাকে দেখিয়ে দিচ্চি! জেল সৃষ্টি হ’য়ে পর্য্যন্ত এতো বড়ো চোর পৃথিবীতে দেখা দেয় নি।
কী ক’রেচি বলো দেখি? জীবন বাবুর নাম সই ক’রে হ্যামিল্টনের দোকান থেকে ঘড়ি এনেচি? পেয়াদা সাহেব, ভদ্রলােক হ’য়ে ভদ্রলােকের নামে ফস্ ক’রে এতো বড়ো অপবাদটা দিলে?
ও কী ও! ওটা ধরে টেনো না! ও আমার ঘড়ি নয়! শেষকালে যদি চেন্মেন্ ছিঁড়ে যায় তা হ’লে আবার মুষ্কিলে প’ড়্তে হবে।
কী! এই সেই হ্যামিল্টনের ঘড়ি? ও বাবা সত্যি নাকি! তা নিয়ে যাও নিয়ে যাও এখনি নিয়ে যাও! কিন্তু ঘড়ির সঙ্গে আমাকে সুদ্ধ টানাে কেন? আমি তো সােনার চেন নই! আমি সােনার অক্ষয় বটে, কিন্তু সে-ও কেবল বাপ মায়ের কাছে।
তা নিতান্তই যদি না ছাড়তে পারো তো চলো। বাবা, আমাকে সবাই ভালােবাসে, আজ তা’র বিস্তর পরিচয় পেয়েছি, এখন তােমার ম্যাজিষ্ট্রেটের ভালােবাসা কোনাে মতে এড়াতে পার্লে এ যাত্রা রক্ষে পাই।
যদি জোটে রােজ
এম্নি বিনিপয়সায় ভােজ!