ব্যঙ্গকৌতুক/সারবান সাহিত্য

সারবান সাহিত্য

নাটক

সম্পাদক মহাশয়,

 আজকাল বাঙ্গালা সাহিত্যে রাশি রাশি নাটক নভেলের আমদানী হইতেছে। কিন্তু তাহাতে সার পদার্থ কিছুমাত্র নাই। না আছে তত্ত্বজ্ঞান, না আছে উপদেশ। কী করিলে দেশের ধনবৃদ্ধি হইতে পারে, গো-জাতির রােগ-নিবারণ করিবার কী কী উপায় আছে; দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত এবং শুদ্ধাদ্বৈতবাদের মধ্যে কোন্ বাদ শ্রেষ্ঠ; কফ পিত্ত ও বায়ু বৃদ্ধির পক্ষে দিশিকুম্‌ড়া ও বিলাতী কুম্‌ড়ার মধ্যে কোনাে প্রভেদ আছে কি না, অশোক এবং হর্ষবর্ধনের মধ্যে কে আগে কে পরে—আমাদের অগণ্য কাব্যনাটকের মধ্যে এসকল সারগর্ভ বিশ্বহিতকর প্রসঙ্গের কোনো মীমাংসা পাওয়া যায় না। একবার কল্পনা করিয়া দেখুন, যদি কোনো নাটকের পঞ্চমাঙ্কের সর্বশেষভাগে এমন একটি তত্ত্ব পাওয়া যায় যদ্দ্বারা জৈবশক্তি ও দৈবশক্তির অন্যান্য সম্বন্ধ নিরূপিত হয় অথবা সৃষ্টি বিকাশের ক্রম পর্য্যায় নাটকের অঙ্কে অঙ্কে বিভক্ত হইয়া দুর্গম জ্ঞান শিখরের মরকত-সোপান-পরম্পরা রচিত হয়, তবে রসগ্রাহী সহৃদয় পাঠকেরা কিরূপ পুলকিত ও পরিতৃপ্ত হইতে পারেন। এখন যে সকল অসার, ম্লেচ্ছভাবসংস্পর্শ-দূষিত গ্রন্থ বাহির হইতেছে তাহা পাঠ করিয়া বাবুরা সাহেব এবং ঘরের গৃহিণীরা বিবি হইতেছেন। বঙ্গসাহিত্যের এই কলঙ্ক অপনোদন করিবার মানসে আমি নাটক উপন্যাসের ছলে কতকগুলি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ প্রণয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। প্রথম সংখ্যায় পঞ্জিকা নাট্যাকারে বাহির করিব স্থির করিয়াছি। গ্রহ ফলাফলের প্রতি বর্ত্তমান কালের ইংরাজি-শিক্ষিত বাবু-বিবিদিগের বিশ্বাস ক্রমশ হ্রাস হইতেছে। সেই নষ্ট বিশ্বাস উদ্ধার করিবার জন্য আমি এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছি। সাধারণের চিত্ত আকর্ষণের অভিপ্রায়ে এই নাটকের কিঞ্চিৎ নমুনা মহাশয়ের জগদ্বিখ্যাত পত্রের এক পার্শ্বে প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি।

নাটকের পাত্রগণ।

 হর।

 পার্ব্বতী।

প্রথম অঙ্ক। দৃশ্য কৈলাস পর্ব্বত।

হর পার্ব্বতী।

 পার্ব্বতী। নাথ!

 হর। কেন প্রিয়ে?

 পার্ব্বতী। শ্বেতবরাহ কল্পাব্দ হইতে কয়জন মনুর আবির্ভাব হইয়াছে, সেই মনােহর প্রসঙ্গ শুনিবার জন্য আমার একান্ত বাসনা হইতেছে।

 হর। (সহাস্যে) প্রিয়ে, পঞ্জিকার প্রথম সৃষ্টিকাল হইতে আজ পর্য্যন্ত প্রত্যেক বর্ষার দিনে এই পরম জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তরে তােমার কৌতূহল নিবৃত্ত করিয়া আসিতেছি। জীবিতবল্লভে, আজও কি এ সম্বন্ধে তােমার ধারণা জন্মিল না?

 পার্ব্বতী। প্রাণনাথ, জানই তো আমরা বুদ্ধিহীন নারীজাতি, বিশেষত আজকালকার বিবিদের মতো ফিমেল ইস্কুলে পড়ি নাই। (বােধ করি সকলে বুঝিতে পারিয়াছেন এইখানে বর্ত্তমান শিক্ষিত মহিলাদের প্রতি তীব্র বিদ্রূপ করা হইল। ইহাতে স্ত্রীশিক্ষা অনেকটা নিবারণ হইবে।―লেখক) হৃদয়নাথ, অহর্নিশি একমাত্র পতিচিন্তা ব্যতীত যাহার আর কোনো চিন্তা নাই তাহার স্মৃতিপটে অতােগুলা মনুর কথা কিরূপে অঙ্কিত হইবে? হাজার হৌক্, তাহারা তো পরপুরুষ বটে! (বর্ত্তমান কালের পাঠিকারা এইস্থল হইতে পতিভক্তির সুন্দর উপদেশ পাইবেন।―লেখক)

 হর। প্রিয়তমে, তবে অবহিত হইয়া মনােহর কথা শ্রবণ করো। শ্বেত-বরাহ কল্পাব্দের পর হইতে ছয় জন মনু গত হইয়াছেন। প্রথম স্বায়ম্ভুব মনু। দ্বিতীয় স্বারােচিষ মনু। তৃতীয় ঔত্তমজ মনু। চতুর্থ তামস্ মনু। পঞ্চম রৈবত মনু। ষষ্ঠ চাক্ষুষ মনু। সম্প্রতি সপ্তম মনু বৈবস্বতের অধিকার চলিতেছে। সপ্তবিংশতিযুগ গত হইয়াছে। অষ্টবিংশতি যুগে কলিযুগের প্রারম্ভ। তত্র চতুর্যুগের পরিমাণ বিংশতি সহস্রাধিক ত্রিচত্বারিংশল্লক্ষ পরিমিত বর্ষ।

 পার্ব্বতী। (স্বগত) অহো কি শ্রুতিমনােহর! (প্রকাশ্যে) প্রাণেশ্বর! এবার সত্য যুগােৎপত্তির কাল নিরূপণ করিয়া দাসীর কর্ণকুহর সুধাসিক্ত করো।

 হর। প্রিয়ে, তবে শ্রবণ করো। বৈশাখ শুক্লপক্ষ অক্ষয় তৃতীয়া রবিবারে সত্যযুগোৎপত্তি। ইত্যাদি।

 (এইরূপে কাব্যকৌশল সহকারে প্রথম অঙ্কে একে একে চারিযুগের উৎপত্তি-বিবরণ বর্ণিত হইবে।—লেখক)

দ্বিতীয় অঙ্ক। দৃশ্য কৈলাস।

 বৃষস্কন্ধে মহেশ এবং শিলাতলে হৈমবতী আসীনা। নাটকের মধ্যে বৈচিত্র্য সাধনের জন্য হর পার্ব্বতীর নাম পরিবর্তন করা গিয়াছে এবং দ্বিতীয় দৃশ্যে বৃষের অবতারণা করা হইয়াছে। যদি কোনাে রঙ্গভূমিতে এই নাটকের অভিনয় হয় নিশ্চয়ই বৃষ সাজিবার লােকর অভাব হইবে না। বক্ষ্যমাণ অঙ্কে পার্ব্বতী মধুর সম্ভাষণে মহেশ্বরের নিকট হইতে বর্ষফল জানিয়া লইতেছেন। এই অঙ্কে প্রসঙ্গক্রমে সােনার ভারতের দুর্দ্দশায় পার্ব্বতীর বিলাপ এবং রেলগাড়ী প্রচলিত হওয়াতে আর্য্যাবর্তের কী কী অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা কৌশলে বর্ণিত হইয়াছে। অবশেষে আঢ়কেশ ফল, কুড়বেশ ফল এবং গােটিকাপাত ফল নামক সুখশ্রাব্য প্রসঙ্গে এই অঙ্কের সমাপ্তি।

তৃতীয় অঙ্ক এবং চতুর্থ অঙ্ক। দৃশ্য কৈলাস।

গজচর্ম্মে এ্যম্বক ও অম্বিকা আসীনা।

 নাট্যশালায় গজচর্ম্মের আয়ােজন যদি অসম্ভব হয়, কার্পেট পাতিয়া দিলেই চলিবে। এই দুই অঙ্কে বারবেলা, কালবেলা, পরিঘযােগ, বিষ্কম্ভ যােগ, অসৃক যােগ, বিষ্টিভদ্রা, মহাদগ্ধা, নক্ষত্রফল, রাশিফল, ববকরণ, বালবকরণ, তৈতিলকরণ, কিন্তুঘ্নকরণ, ঘাতচন্দ্র, তারা প্রতিকার, গােচরফল প্রভৃতির বর্ণনা আছে। অভিনেতাদিগের প্রতি লেখকের সবিনয় অনুরােধ, এই দুই অঙ্কে তাঁহারা যথাযথ ভাব রক্ষা করিয়া যেন অভিনয় করেন—কারণ অরিদ্বিদশ এবং মিত্রষড়ষ্টক কথনে যদি অভিনেতার কণ্ঠস্বর ও অঙ্গভঙ্গীতে ভিন্নতা না থাকে, তবে দর্শকগণের চিত্তে কখনই অনুরূপ ভাব উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবে না।―লেখক।

পঞ্চমাঙ্ক। দৃশ্য কৈলাস।

সিংহের উপর ত্রিপুরারি ও মহাদেবী আসীন।

(সিংহের অভাবে কাঠের চৌকি হইলে ক্ষতি নাই।―লেখক)

 মহাদেবী। প্রভু, দেবদেব, তুমি তাে ত্রিকালজ্ঞ, ভূতভবিষ্যৎ বর্ত্তমান তােমার নখদর্পণে; এইবার বলো দেখি ১৮৭৯ সালের এক আইনে কী বলে?

 ত্রিপুরারি। মহাদেবি, শুম্ভনিশুম্ভঘাতিনি, তবে অবধান করো। কোনো একটি বিষয়ের অনেকগুলি দলিল হইলে তাহার মধ্যে প্রধান খানিতে নিয়মিত ষ্টাম্প অপরগুলিতে এক টাকা অনুসারে দিতে হয়।

 ইহার পর দলিল রেজেষ্টরীর খরচা, তামাদির নিয়ম, উকিল খরচ, খাজনা বিষয়ক আইন, ইন্‌কম্‌ট্যাক্স, বাঙ্গিডাক, মণিঅর্ডার; সর্ব্বশেষ সাউথ ইষ্টারণ ষ্টেট্ রেলওয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়ার কথা বিবৃত করিয়া যবনিকা পতন। এই অঙ্কে যে ব্যক্তি সিংহ সাজিবে তাহার কিঞ্চিৎ আপত্তি থাকিতে পারে,―অতােক্ষণ দুই জনকে স্কন্ধে করিয়া হামাগুড়ির ভঙ্গিতে নিশ্চল দাঁড়াইয়া থাকা কঠিন ব্যাপার। সেই জন্য উকিলখরচা কথনের মধ্যে সিংহ একবার গর্জ্জন করিয়া উঠিবে, “মা, আমার ক্ষুধা পাইয়াছে।” মা বলিবেন “তা যাও বাছা, সাহারা মরুতে তােমার শিকার ধরিয়া খাওগে, আমরা নীচে নামিয়া বসিতেছি।” হামাগুড়ি দিয়া সিংহ নিষ্ক্রান্ত হইবে। এই সুযােগে দর্শকেরা সিংহের আবাসস্থলের পরিচয় পাইবেন।―আমার কোনাে কোনাে নব্যবন্ধু পরামর্শ দিয়াছিলেন ইহার মধ্যে মধ্যে নন্দী ভৃঙ্গীর হাস্যরসের অবতারণা করিলে ভালাে হয়। কিন্তু তাহা হইলে নাটকের গৌরব লাঘব হয়। এই জন্য হাস্য প্রগল্‌ভতা আমি সযত্নে দূরে পরিহার করিয়াছি। ভবিষ্যতে সুশ্রুত ও চরক সংহিতা নাট্যাকারে রচনা করিবার অভিলাষ আছে এবং উপন্যাসের ন্যায় লঘু সাহিত্যকে কতোদূর পর্য্যন্ত সারবান করিয়া তোলা যাইতে পারে, পাঠকদিগকে তাহারো কিঞ্চিৎ নমুনা দিবার সঙ্কল্প করিয়াছি।

ভবদীয় একান্ত অনুগত শ্রীজনহিতৈষী সাহিত্য প্রচারক।

 ১২৯৮।