ব্রজবিলাস/চতুর্থ উল্লাস

চতুর্থ উল্লাস।


শ্রীমান্ নদিয়ায় চাঁদ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয়, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্মরক্ষিণী সভায় আহূত হইয়া, বিধবাবিবাহ বিষয়ে নে বক্তৃতা লিখিয়া, সমবেত সমস্ত সভ্যগণের, ও রবাহূত তামাসাগির বহুসংখ্যক দর্শকগণের সমক্ষে পাঠ করিয়াছেন, ও তদুপলক্ষে বেধড়ক ধন্যবাদ পাইয়াছেন, তাহার আরম্ভ ভাগ ও উপসংহার ভাগ মাত্র আপাততঃ আলোচিত হইতেছে। এই দুই অংশই তাঁহার বক্তৃতার সারভাগ মধ্যবর্ত্তী অংশে কেবল ফেচফেচ, ফাজিলচালাকি, ও স্মৃতিশাস্ত্রে যে কিছু মাত্র বোধ ও অধিকার নাই, তাহার অসন্দিগ্ধ প্রমাণ প্রদর্শন করিয়াছেন; এ জন্য, অনাবশ্যক বিবেচনায়, সে অংশের আলোচনা এ বৈঠকে মুল‍্তুবি রাখা গেল। পরে, ইস্তাহার দ্বারা সময় নির্দ্ধারিত করিয়া, সে অংশেরও, মাফিক আইন, বিচার পূর্ব্বক, চুড়ান্ত হুকুম দেওয়া যাইবেক।

আরম্ভ ভাগ।

সকৃদংশো নিপততি সকৃৎ কন্যা প্রদীয়তে।
সকৃদাহ দদানীতি ত্রীণ্যেতানি সতাং সকৃৎ॥

ইত্যনেন মনুনা সকৃদ্দানবিধানাৎ বিহিতদানোত্তরগ্রহণস্যৈব
বিবাহপদার্থাভ্বৎ সুতরাং পুনর্ব্বিবাহোহসম্ভব ইতি।”

বিষয়বিভাগ এক বার হয়, কন্যাদান এক বার হয়, দিলাম এই বাক্য প্রয়োগ এক বার হয়; এই তিন সাধুদের এক বার। এই বচনে মনু এক বার দানের বিধি দিয়াছেন এবং যথাবিধি দানের পর যে গ্রহণ। তাহাই বিবাহশব্দবাচ্য, সুতরাং পুনর্ব্বার বিবাহ অসম্ভব।

ইহার তৎপর্য্য এই, মনু এক বার মাত্র কন্যাদানের বিধি দিয়াছেন; সুতরাং, এক বার কন্যা দান করিলে, সে কন্যার পুনরায় আর দান হইতে পারে না। কন্যাকর্ত্তা যথাবিধি কন্যার দান করেন, সেই দানের পর, বর যথাবিধি কন্যার যে গ্রহণ করেন, তাহারই নাম বিবাহ। সুতরাং, এইরূপ যথাবিধি দান ও যথাবিধি গ্রহণ ব্যতিরেকে, স্ত্রী পুরুষের যে মিলন, তাহা বিবাহ বলিয়া পরিগৃহীত নহে। যখন, এক বার কন্যাদান করিলে, সে কন্যার পুনরায় আর দান হইতে পারে না, তখন বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার বিবাহ কোনও মতে সম্ভবিতে পারে না।

 বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয় এ দেশের সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মর্ত্ত; সুতরাং, এক্ষণে, স্মৃতিশাস্ত্রের সর্ব্বপ্রধান মীমাংসাকর্ত্তা। তাঁহার চাঁদমুখ বা স্বর্ণময়ী লেখনী হইতে, যখন যাহা বহির্গত হয়, তাহাই, বেদবাক্যের ন্যায়, অভ্রান্ত ও অকাট্য, সে বিষয়ে এক পয়সারও, এক কানা কড়িরও, সন্দেহ নাই। তাঁহার মীমাংসাতে দোষারোপ করিতে উদ্যত হওয়া অতি বড় আস্পর্দ্ধার কথা, ও অতি বড় মহাপাতকের কর্ম্ম, তাহারও কোনও সন্দেহ নাই। এজন্য, কেহ, সাহস করিয়া, সে বিষয়ে অগ্রসর হইতে পারেন না। কিন্তু, উপযুক্ত ভাইপোর সঙ্গে, খুড় মহাশয়ের যেরূপ পবিত্র সম্পর্ক, তাহাতে উপযুক্ত ভাইপো, খুড়র মীমাংসা লইয়া, যৎকিঞ্চিৎ আমোদ আহলাদ করিলে, সাধুসমাজে অপদস্থ বা নিদাভাজন হইতে হইবেক, এরূপ বোধ ও বিশ্বাস হয় না। এজন্য, আস্তে আস্তে, দুই একটি প্রশ্ন করিতে অগ্রসর হইতেছি।

প্রথম প্রশ্ন।

সতু যদ্যন্যজাতীয়ঃ পতিতঃ ক্লীব এব বা।
বিকর্ম্মন্থঃ সগোত্রো বা দাসো দীর্ঘাময়োহপি বা॥
ঊঢ়াপি দেয়া সান্যস্মৈ সহাভরণভূষণা[১]

যাহার সহিত কন্যার বিবাহ দেওয়া যায়, সে ব্যক্তি যদি অন্যজাতীয়, পতিত, ক্লীব, যথেচ্ছচারী, সগোত্র, দাস, অথবা চিররোগী হয়, তাহা হইলে, উঢ়া অর্থাৎ বিবাহিতা কন্যাকেও, বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া, অন্য পাত্রে দান করিবেক।

 এই লক্ষ্মীছাড়া বচনের সহিত, খুড় মহাশয়ের অভ্রান্ত, অকাট্য মীমাংসার, আপাততঃ, বিরোধের মত বোধ হইতেছে। খুড় মহাশয়ের সিদ্ধান্ত এই, এক বার কন্যাদান করিলে, সে কন্যার পুনরায় আর দান হইতে পারে না; এবং, দান পূর্ব্বক গ্রহণ না হইলে বিবাহ সম্পন্ন হয় না; সুতরাং, বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার বিবাহ অসম্ভব। কিন্তু, উপরি দর্শিত কাত্যায়নবচনে, বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার অন্য পাত্রে দানের স্পষ্ট বিধি দৃষ্ট হইতেছে।

 আর, বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার অন্য পাত্রে দানের যে কেবল বিধিই দৃষ্ট হুইতেছে, এরূপ নহে; পিতা বিবাহিতা বিধবা কন্যাকে পুনর্ব্বার অন্য পাত্রে দান করিয়াছেন, তাহারও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। যথা,

অর্জ্জুনস্যাত্মজঃ শ্রীমানিরাবান্নাম বীর্য্যবান্
সুতায়াং নাগরাজদ্র জাতঃ পার্থেন ধীমতা।
ঐরাবতেন সা দত্তা হনপত্যা মহাত্মনা।
পত্যৌ হতে সুপর্ণেন কৃপণা দীনচেতনা[২]

নাগরাজের কন্যাতে অর্জ্জুনের, ইরাবান্ নামে, এক শ্রীমান্, বীর্য্যবান পুত্র জন্মে। সুপর্ণ কর্ত্তৃক ঐ কন্যার পতি হত হইলে, নাগরাজ মহাত্মা ঐরাবত সেই দুঃখিতা, বিষণ্ণা, পুত্রহীনা কন্যা অর্জ্জুনকে দান করেন।

 এক্ষণে, সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত্ত শ্রীমান বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয়ের নিকট প্রশ্ন এই, বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার আর দান হইতে পারে না, তাঁহার এই সিদ্ধান্তের সহিত, কাত্যায়নবচনের ও পঞ্চম বেদ মহাভারতের বিরোধ ঘটিতেছে কি না; এবং ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না, তিনি পূর্ব্বে, অতি প্রশংসনীয় কমনীয় সাধুভাষায়, এই যে কবুল দিয়াছেন, এই সিদ্ধান্ত উহার একটি অকাট্য নজির খাড়া হইতেছে কি না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন।

 খুড় মহাশয় বিবাহের যে লক্ষণ নির্দ্ধারিত করিয়াছেন, তাহাও, আমাদের স্থূল বুদ্ধিতে, সঙ্গত বলিয়া বোধ হইতেছে না। যথা,

বিহিতদানোত্তরগ্রহণস্যৈব বিবাহপদার্থত্বাৎ।

যথাবিধি দানের পর যে গ্রহণ, তাহাই বিবাহশব্দবাচ্য।

অর্থাৎ, বিধি পূর্ব্বক কন্যার দান, ও সেই দানের পর, বিধি পূর্ব্বক কন্যার যে গ্রহণ, তাহাকেই বিবাহ বলে। সুতরাং, যেখানে এ উভয়ের অসদ্ভাব, অর্থাৎ বিধি পূর্ব্বক দান ও গ্রহণ নাই, সে স্থলে বিবাহ শব্দ প্রযুক্ত হইতে পারে না।

 বিবাহ অষ্টবিধ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধব, রাক্ষস, পৈশাচ[৩]। যে স্থলে, কন্যাকে, যথাশক্তি বস্ত্রালঙ্কারে ভুষিতা করিয়া, স্বয়ং আহ্বান পূর্ব্বক সৎপাত্রে দান করা যায়, তাহার নাম ব্রাহ্ম বিবাহ[৪]। যে স্থলে, কন্যাকে, যথাশক্তি বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিত করিয়া, যজ্ঞক্ষেত্রে যজ্ঞানুষ্ঠানব্যাপৃত ব্যক্তিকে দান করা যায়, তাহার নাম দৈব বিবাহ[৫]। যে স্থলে, বরের নিকট হইতে গোযুগল গ্রহণ করিয়া, কন্যাদান করা যায়, তাহার নাম আর্য বিবাহ[৬]। যে স্থলে, উভয়ে মিলিয়া ধর্ম্মের অনুষ্ঠান কর, ইহা কহিয়া, বিবাহার্থী ব্যক্তিকে কন্যাদান করা যায়, তাহার নাম প্রাজাপত্য বিবাহ [৭]। যে স্থলে, বরপক্ষের নিকট হইতে ধন গ্রহণ পূর্ব্বক, কন্যাদান করা যায়, তাহার নাম আ্রসুর বিবাহ[৮]। যে স্থলে, বর ও কন্যা, পরস্পর অনুরাগ বশতঃ, আপন ইচ্ছা অনুসারে, দম্পতিভাবে মিলিত হয়, তাহার নাম গান্ধর্ব্ব বিবাহ[৯]। যে স্থলে, কন্যার কর্ত্তৃপক্ষকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া, বল পূর্ব্বক কন্যাহরণ করে, তাহার নাম রাক্ষস বিবাহ[১০]। যে স্থলে, ছল পূর্ব্বক কন্যাহরণ করে, তাহার নাম পৈশাচ বিবাহ[১১]

 এক্ষণে, খুড় মহাশয়ের নিকট প্রশ্ন এই, যথাবিধি দানের পর যে গ্রহণ, তাহাই বিবাহশব্দবাচ্য, তাঁহার নির্দ্ধারিত এই বিবাহ লক্ষণ গান্ধর্ব্ব, রাক্ষস, পৈশাচ, এই তিন বিবাহে খাটিতেছে কি না। গান্ধর্ব্ব বিবাহ, বর ও কন্যার স্বেচ্ছাতে, সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহাতে দান ও গ্রহণের কোনও সংস্রব নাই; দায়ী মুদ্দাই রাজি, কি করিবে কাজি; বর কন্যায়, রাজি হইয়া, কাজ শেষ করিলে, বাপের আর চালাকি করিবার দরকার থাকিতেছে না[১২]। কন্যার কর্ত্তৃপক্ষকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া, বল পূর্ব্বক কন্যাহরণের নাম রাক্ষস বিবাহ; ছল পূর্ব্বক কন্যাহরণের নাম পৈশাচ বিবাহ; এই দুই স্থলে, দান ও গ্রহণের সম্ভাবনাই নাই। সুতরাং, যথাবিধি দানের পর যে গ্রহণ, তাহাই বিবাহশব্দবাচ্য, এই লক্ষণ ঐ তিন বিবাহে খাটা অসম্ভব বোধ হইতেছে। যদি না খাটে, তবে মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রকর্ত্তারা যে এই তিনকে বিবাহ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তাহা কিরূপে সঙ্গত হয়; এবং, ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না, এই কবুলের আর একটি নজির খাড়া হয় কি না।

উপসংহার ভাগ।

যদি চাপরিতোষো বিদুষাৎ তদা পরাশরবচনং বাগ্ধত্তা বিষয়মিতি অত্রায়ম্ভাবঃ যৈস্ম বাগানৎ কৃতং তস্মিন বিদেশ গতে মৃতে পতিতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ স্ক্রীণাং মহতী বিপদেব সম্ভবতি তৎ কারণং ক্রয়তা, অজাতবিদেশগমনাদিদশায়াং যেভ্যো বাদানং কৃতং তেষু বিদেশাদিগতেষু অনগতিকানাং দৃশস্ত্রীণাং বিবাহং বিনা ভাদৃশবিপদুদ্ধার কদাপি ন সম্ভবতি, বাচা দত্তেতি কাশ্যপবচনেন বাগাদীনাং স্ত্রীণাং বিবাহকরণে নিন্দাশ্রবণাৎ তৎপরিণয়নে কেমপি প্রবৃত্তির্ন স্যাৎ অতঃসম্পূর্ণা আপদুপস্থিত। তত্রৈব পরাশরবচনং প্রতিসবিধায়কং নতু বিবাহিতায়া পুনর্বিবাহবিধায়ক তথাত্বে প্রাগুক্তমখাদিবচনবিরোধাপত্তিরিতি।

ইহাতে যদি পণ্ডিতগণের পবিতোষ না জমে, তবে পরশিরবচন বাগতা কন্যার বিষয়ে। ইহার অভিপ্রায় এই, যে ব্যক্তিকে কন্যার বাগান করা গিয়াছে, সে বিদেশগত, মৃত, পতিত, প্রব্রজিত, ও ক্লীব স্থির হইলে, প্রীদিগের বড়ই বিপদ ঘটে। তাহার কারণ শুন, যে সময়ে বিদেশগমনাদি ঘটে নাই, তখন যাহাদিগকে কন্যার বাগদান করা হয়, তাহার বিদেশাদিগত হইলে, অনন্যগতি তাদৃশ স্ত্রীদিগের বিবাহ ব্যতিরেকে তাদৃশ বিপদুন্ধার কদাপি সস্তষে না। বাচা দা এই কাপবচনে বাগা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহকরণে নিশাকীর্ত্তন আছে, ভজ তাহাদিগকে বিবাহ করিতে কাহারও প্রবৃত্তি না হইতে পারে, সুতরাং সম্পূর্ণ জাপদ উপস্থিত, পরাশরবচন এই বিষম্বেই বিশেষ বিধি হইতেছে, বিবাহিতার পুনর্ব্বার বিবাহের বিধিদায়ক নহে; সেরূপ হইলে, পূর্ব্বোক্ত মনু প্রভৃতির বচনের সহিত বিরোধ ঘটে।

 শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়র সিদ্ধান্ত এই, পরাশরের বিবাহবিধি বাগ্দত্তা কন্যার বিষয়ে, অর্থাৎ বাগ্দত্তা কন্যার বর বিদেশগত, মৃত, পতিত, প্রব্রজিত ও ক্লীব স্থির হইলে, সেই কন্যার অন্য পাত্রের সহিত বিবাহ হইতে পারিবেক, পরাশর এই বিধি দিয়াছেন; বিবাহিতা কন্যার পুনর্ব্বার বিবাহ তাঁহার অভিমত নহে।

 খুড় মহাশয়ের চাঁদমুখ হইতে যখন যে ফয়তা নির্গত হয়, তাহাই অভ্রান্ত ও অকাট্য; দোষের মধ্যে, ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না, তদীয় এই কবুলের এক একটি নজির খাড়া হইয়া পড়ে।

তৃতীয় প্রশ্ন।

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে॥
অষ্টৌ বর্ষাণ্যপেক্ষেত ব্রাহ্মণী প্রোষিতং পতিম্।
অপ্রসূতা তু চত্বারি পরতোঽন্যৎ সমাশ্রয়েৎ॥
ক্ষত্রিয়া ষট্‌ সমাস্তিষ্ঠেদপ্রসূতা সমাত্রয়ম্।
বৈশ্যা প্রসূতা চত্বারি দ্বে বর্ষে ত্বিতরা বসেৎ॥
ন শূদ্রায়াঃ স্মৃতঃ কাল এষ প্রোষিতযোষিতাম্।
জীবতি শ্রূয়মাণে তু স্যাদেষ দ্বিগুণো বিধিঃ॥
অপ্রবৃত্তৌ তু ভূতানাং দৃষ্টিরেষা প্রজাপতেঃ।
অতোঽন্যগমনে স্ত্রীণামেষু দোষো ন বিদ্যতে[১৩]

স্বামী অসুদ্দেশ হইলে, 'মরিলে, সংসারধর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, ক্লীব স্থির হইলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বর বিৰাহ শাস্ত্রবিহিত। স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রী আট বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। যদি সন্তান না হইয়া থাকে, তবে চারি বৎসর; তৎপরে বিবাহ করিবেক। ক্ষত্রিয়জাতীয় স্ত্রী ছয় বৎসর প্রতীক্ষা করিবেক। যদি সন্তান না হইয়া থাকে, তবে তিন বৎসর। বৈশ্যজাতীয় স্ত্রী, যদি সন্তান না হইয়া থাকে, চারি বৎসর, নতুবা দুই বৎসর। শূদ্রজাতীয়া স্ত্রীর প্রতীক্ষার কালনিয়ম নাই। অনুদ্দেশ হইলেও, যদি জীবিত আছে বলিয়া শুনিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে পূর্ব্বোক্ত কালের দ্বিগুণ কাল প্রতীক্ষা করিবেক। কোনও সংবাদ না পাইলে, পূর্ব্বোক্ত কাল নিয়ম। প্রজাপতি ব্রহ্মার এই মত। অতএব, এই কয় স্থলে, স্ত্রীদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ দোষবহ নহে।

নারদসংহিতার এই অংশ খুড় মহাশয়ের দিব্য চক্ষুর গোছর হইলে, তিনি, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, এই বচন বাগ্দত্তাবিষয়ক বলিয়া, অভ্রান্ত, অকাট্য সিদ্ধান্ত করিতে অগ্রসর হইতেন, এরূপ বোধ হয় না। কারণ, যদি এই বচন বাগ্দত্তাবিষয়ক হইত, তাহা হইলে, অনুদ্দেশ স্থলে, সন্তান হইলে এক প্রকার কালনিয়ম, সন্তান না হইলে আর এক প্রকার কালনিয়ম, কিরূপে সঙ্গত হইতে পারে। অতএব, খুড় মহাশয়ের নিকট প্রশ্ন এই পরাশরবচন বাগদত্তা বিষয়ে ব্যবস্থাপিত হইলে, নারদসংহিতার সহিত বিরোধ ঘটে কি না।

চতুর্থ প্রশ্ন।

 শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়র নিকট আর একটি প্রশ্ন এই; যে ব্যক্তিকে কন্যার বাগ্দান করা যায়, সে সগোত্র, চিররোগী, যথেচ্ছাচারী, অন্যজাতীয় প্রভৃতি স্থির হইলে, ঐ বাগ্দত্তা তা কন্যার কিরূপ গতি হইবেক। কারণ, খুড়র সিদ্ধান্ত এই, পরাশর, বাঙ্গতা কন্যার পক্ষে, বর বিদেশগত, মৃত, পতিত, প্রব্রজিত ও ক্লীব স্থির হইলে, বিবাহের বিধি দিয়াছেন। যখন, এই পাঁচটি স্কুল ধরিয়া, বাগা কন্যার পক্ষে, বিবাহের বিধি দেওয়া হইয়াছে; তখন, তন্নি স্বলে, কি রূপে বাঙ্গতা কন্যার বিবাহ হইতে পারে। মনে কর, কেহ, সজাতীয় স্থির করিয়া, কোনও ব্যক্তিকে কন্যার বাগান করিয়াছে; পরে জানা গেল, সে ব্যক্তি অঙ্গজাতীয়; এক্ষণে, ঐ বাদত কন্যাকে সেই অন্যজাতীয় পাত্রে দেওয়া যাইবেক; কিংবা, সজাতীয় অন্য পাত্র স্থির করিয়া, তাহার সহিত বিবাহ দেওয়া যাইবেক; অথবা, খুড় মহাশয়ের অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে, বাঙ্গত্তা কন্যাকে যে পাঁচ স্কুলে অন্য পাত্রে দিবার বিধি আছে, এ সে পাঁচের অন্তর্গত স্থল নহে; সুতাং, তাহার আর বিবাহ হইবার পথ নাই; এজন্য, তাহাকে যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য করিতে হইবেক। এই সন্দেহভঞ্জনের জন্য, খুড় মহাশয়ের নিকট এই লক্ষীছাড়া প্রশ্নটি অগত্যা উপস্থিত করিতে হইল।

পঞ্চম প্রশ্ন।

বাচাদত্তেতি কাশ্যপবচনেন বাগ্দত্তাদীনাং স্ত্রীণাং বিবাহকরণে নিন্দাশ্রবণাৎ তৎপরিণয়নে কেমপি প্রবৃত্তির্ন স্যাৎ অতঃ সম্পূর্ণ। আপদুপস্থিত তত্রৈব পরাশরবচনৎ প্রতিপ্রসববিধায়কম।

বাচাদত্তা এই কাশ্যপবচনে বাগ্দত্তা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহকরণে নিন্দাকীর্ত্তন আছে, এজন্য তাহাদিগকে বিবাহ করিতে কাহারও প্রবৃত্তি না হইতে পারে, সুতরাং সম্পূর্ণ আপঙ্গ উপস্থিত। পরাশরবচন সেই বিষয়েই বিশেষবিধি হইতেছে।

 খুড় মহাশয়ের উপসংহারভাগের এই অংশটি দেখিয়া, আমার সন্দেহ হইতেছে, “যখন আসরে নামিব, তোমাদের হইয়াই নাচিব ও গাইব’, এই আশয় দিয়া, নলডাঙ্গার চেনা বাহাদুরের নিকট হইতে, তৈলবট লওয়া হইয়াছে। যাহা লিখিয়াছেন, তাহা দ্বারা, কৌশল করিয়া, আঁতিকুল, বৈষ্ণবকুল, উভয় রক্ষা করা হইয়াছে। প্রথমতঃ, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ ও অসম্ভব, এইরূপ লিখিয়া, মতী যশোহহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর মন রাখিয়াছেন; আর, উপরি নির্দিষ্ট অংশটুকু লিখিয়া, নলডাঙ্গার চেনা বাহাদুরের মান রাখিয়াছেন। এক্ষণে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, বিধবার বিবাহপক্ষে শ্রীমা বিদ্যায়তু খুড়র সম্পূর্ণ আন্তরিক টান আছে, অন্য পক্ষে কেবল মৌখিক। কারণ, বিবাহের পক্ষে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা অকাট্য; বিবাহের বিপক্ষে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা টেকসই নয়। পরাশরুবচন বাঙ্গতা কন্যার বিষয়ে, এই যে কথা বলিয়াহেন, সে ছেলেখেলা মাত্র। কারণ, এ দিকের চন্দ্র ও দিকে উঠিলেও, পরাশরবচন বাত্তাবিষয়ক, ইহা কদাচ সার্য্য হইবার নহে। আর, এ দিকে, কাশ্যপছনে বাঙ্গা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহের যে নিষেধ আছে, সেই নিষেধ রহিত করিয়া, পরাশর বিবাহের বিশেষ বিধি দিয়াছেন, এই যে নির্দেশ করিয়াছেন, ইহা অকাট্য। নলডাঙ্গার চেনা বাহাদুরকে, প্রথমতঃ, লক্ষ্মীছাড়া ও বক্কেশ্বর ঠাহরাইয়াছিলাম। এক্ষণে দেখিতেছি, ইনি এক জন খুব তুখড় সিয়ান হোকরা; বিদ্যারত্ন খুড়কে হাত করিয়া, ভিতরে ভিতরে, কেমন কাজ গুছাইয়া লইয়াছেন। অথবা, তিনি দেখিতে যেরূপ শিষ্ট ও শান্তুপ্রকৃতি, তাহাতে এটি তাঁহার বুদ্ধির খেলা বলিয়া বোধ হয় না। মজুমদার বলিয়া তাঁহার যে একটি বেদড়া মন্ত্রী আছেন, এটি তারই তেঁদড়ামি।

 অমায়িক, উদারচিত্ত, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয় লিখিয়াছেন, কাশ্যপবচনে বাগ্দত্তা প্রভৃতি স্ত্রীদিগের বিবাহে নিন্দাকীর্ত্তন আছে। সুতরাং, কেহ তাহাদিগকে বিবাহ করিতে সম্মত হইবেক না; পরাশর সেই বিষয়েই বিশেষ বিধি দিয়াছেন; অর্থাৎ, বাদত্ত প্রভৃতির বর ক্লীব প্রভৃতি স্থির হইলে, তাহাদের পুনর্বার বিবাহ হইতে পারিবেক, পরাশর এই বিধি দিয়াছেন। খুড় মহাশয়ের উল্লিখিত কাশ্যপচন এই;—

সপ্ত পৌনর্ভবাঃ কন্যা বর্জনীয়াঃ কুলাধমাঃ।
বাচাদত্তা মনোদত্তা কৃতকৌতুকমঙ্গল॥
উদকস্পর্শিতা যা চ যা চ পাণিগৃহীতিকা।
অগ্নিৎ পরিগতা যা চ পুনর্ভুপ্রভবা চ যা।
ইত্যেতাঃ কাশ্যপেনোক্তা দহন্তি কুলমগ্নিবৎ[১৪]

বাচদত্তা অর্থাৎ বাক্য দ্বারা যাহাকে দান করা গিয়াছে, মনোদ অর্থাৎ মনে মনে যাহাকে দান করা গিয়াছে, কৃতকৌতুকমঙ্গলা অর্থাৎ যাহার হস্তে বিবাহকাল বম করা গিয়াহে, উদকস্পর্শিত অর্থাৎ যাহাকে যথাবিধি দান করা গিয়াছে, পাণিগৃহীক্তি অর্থাৎ যাহার পাণিগ্রহণ যথাবিধি সম্পন্ন হইয়াছে, অগ্নিং পরিগ অর্থাৎ যাহার কুশণ্ডিকা যথাবিধি নিষ্পন্ন হইয়াছে,

 পুনর্ভুপ্রভর অর্থাৎ পুঙুর গর্ডে যাহার জন্ম হইয়াছে; কুলের অধই সা পেইনর্ভব কন্যা বর্জন করিবেক। এই সাত কাশ্যপোক্তা কন্যা, বিবাহিতা হইলে, অগ্নির ন্যায়, কুল দগ্ধ করে।

 খুড় মহাশয়ের মীমাংসা অনুসারে, এই কাশ্যপবচনে যাহাদের বিবাহ নিন্দিত ও নিষিদ্ধ হইয়াছিল, পরাশর, অমুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ স্কুলে, তাহাদের বিবাহের বিধি দিয়াছেন। সুতরাং, অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ স্থলে, বাচাদস্তা, মনোদতা, কতকৌতুকমঙ্গল, উদকস্পর্শিতা, পানিগৃহীতিকা, অগ্নিং পৱিগতা, পুনর্ভুপ্রভবা, এই সাত প্রকার ফন্যার বিবাহ বিধিসিদ্ধ হইতেছে। তন্মধ্যে, উদকস্পর্শিত অর্থাৎ যাহাকে যথাবিধি দান করা গিয়াছে, পাণিগৃহীতিকা অর্থাৎ যাহার পাণিগ্রহণ যথাবিধি সম্পন্ন হইয়াছে, অগ্নিং পরিগতা অর্থাৎ যাহার কুশণ্ডিকা যথাবিধি নিষ্পন্ন হইয়াছে, এই তিন কন্যাকে বিবাহিতা বলিয়া গণ্য করিতে হইবেক। এই তিন কন্যার পতি মৃত, পতিত, প্রব্রজিত প্রভৃতি স্থির হইলে, খুড় মহাশয়ের মীমাংসা অনুসারে, পরাশরের বিশেষবিধির বলে, তাহাদের বিবাহ হইতে পারিতেছে। সুতরাং, বিদ্যাসাগরের ব্যবস্থার সহিত, খুড় মহাশয়ের মীমাংসার, আর কোনও অংশে, অনুষত্র প্রভেদ বা বৈলক্ষণ থাকিতেছে না। এক্ষণে সকলে দেখুন, খুড় মহাশয়, কেমন চালাকি খেলিয়াছেন। শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর দিব্য চক্ষে ধুলিমুষ্টি প্রক্ষেপ করিয়া, নলডাঙ্গার তৈলবটের সার্থকতা সম্পাদন করিয়াছেন কি না।  যে আহামক মহামহোপাধ্যায়, বিদ্যাবাগীশ পুড়দের বাকে বিশ্বাস ও ব্যবস্থায় আস্থা করেন, তাঁর বাপ নির্বংশ।

ষষ্ঠ প্রশ্ন।

যে প্রসিদ্ধ পরিবারে, পরম পবিত্র গোমাংস প্রভৃতি পাক করিয়া দিবার নিমিত্ত, বিচক্ষণ মুসলমান পাচক, আর বিশুদ্ধ শূকরমাংস পাক করিয়া দিবার নিমিত্ত, উপযুক্ত হাড়ি পাচক নিযুক্ত থাকে, সেই পবিত্র পরিবারের অতি পবিত্র। পুরোহিতকুলে দোষম্পৰ্শ হইতে পারে কি না।

যদিও বিধবাবিবাহের সহিত, ঈদৃশ প্রশ্নের কোনও সংঅব নাই, তথাপি, অনেক দিন অবধি, এই বিষয়টি জানিবার নিমিত, ' আমরা অনেকে অতিশয় উৎসুক আছি। এজন্য, এই সুযোগে, এই পরম সুন্দর কর্ণসুখকর প্রশ্নটি অমায়িক, উদারচিত্ত, নদিয়ার চাঁদ খুড় মহাশয়ের টুকটুকে রাঙা, পায়ে, প্রগাঢ় ভক্তিযোগ সহকারে, চন্দনচর্চিত পুস্পাঞ্জলি স্বরূপ, সমর্পিত হইল।

 এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় ধুড় মহোদয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁত গুতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাম ও ফোৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে, উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া বসিয়া থাকিলে, আমি হাড়িব না। আমি খুড়র বড় খাতির রাখি, এজন্য প্রসনোহাকে এক মাস মিয়াল দিতেছি; এই মিয়া মধ্যে উত্তর না পাইপে, সঙ্কল্পিত তুমুল কাণ্ড অবধারিত উপস্থিত করিব। যদি না করি, খুড়র মাথা খাই।

 যদি বলেন, তোমার ঠিকানা জানি না, উত্তর লিখিয়া কোথায় পাঠাইব। তাহার উত্তর এই, আপনি, যাঁহাদের মন যোগাইবার নিমিত্ত, এই দেবদুর্লভ ব্যবস্থা লিখিয়াছেন, আমার প্রশ্নের উত্তর লিখিয়া, সেই সাধুসমাজের অগ্রগণ্য, বিদকুটে ধন্য, বেয়াড়া মান্য, অসামান্যবুদ্ধিবিদ্যাসম্পন্ন মহাপুরুষদিগের নিকটে পাঠাইবেন। তাঁহারা যখন, দেশের ধর্ম্মরক্ষার জন্য, কোমর বাঁধিয়াছেন, তখন আপনকার উত্তর মুদ্রিত ও প্রচারিত করিতে কখনই পরান্মুখ হইতে পারিবেন না, যদি এতাদৃশ দেশহিতকর বিষয়ে পরান্মুখ হন, তাহা হইলে, তাঁহারা, নিঃসন্দেহ, মহাপাতকগ্রস্ত ও অন্তে অবধারিত অধোগতি প্রাপ্ত হইবেন। যদি না হন, আমি যেন উচ্ছন্ন যাই।

 খুড় মহাশয়ের এই অপূর্ব্ব ব্যবস্থা দেখিয়া, কতকগুলি অবোধ, অর্ব্বচীন, বানরকল্প, অল্পদর্শী লোকে বলিতে আরম্ভ করিয়াছে,

 হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র পাত্র,

 যেমন পোড়ামুখ দেবতা তেমনই ঘুটের ছাই নৈবেদ্য।

অর্থাৎ, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা যেমন অপূর্ব্ব বিচারালয়, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ব খুড় তদুপযুক্ত ব্যবস্থাদাতা। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ আহলাদ করিয়া, আমার কাছও, ঐরূপ নানা কথা, নানা রঙ্ চড়াইয়া, বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। আমি কিন্তু তাহাদিগকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। ইহাতে, শ্রীমান নদিয়ার চাঁদ খুড় মহাশয়, অক্লেশে, বুঝিতে পারিবেন, উপযুক্ত ভাইপো খুড়য় রয়ে দরদের কি না।

 ইহা সত্য বটে, এ দেশে খুড় ভাইপোয় মুখদেখাদেখি থাকে না; সর্ব্বদা ই দ্বেষাঘেষি, গালাগালি, মারামারি, ফাটাকাটি, বলিতে লজ্জা উপস্থিত হয়, জুতাপেটাপেটি পর্যপ্ত চলিয়া থাকে। খুড় যেমন হউন, ' আমি কিন্তু পুড় তেমন লীড়া ভাইপো নই। যদি সেরূপ লক্ষীছাড়া ভাইপো হইতাম, তাহা হইলে উপযুক্ত” এই দেলজ বিশেষণ লাভ করিতে পারিতাম না, এবং খুড় মহাশয়েরাও, এফুল চিত্তে, অকৃত্রিম ভক্তিবতরে, আমার পর পজি, কমনীয়, কোমল চরণকমলে, সচন্দন পুষ্পাঞ্জলি প্রদানে তৎপর ও অগ্রসর হইতেন না।


 ফোনও অপরিহার্য কার্য্যবিশেষের অনুরোধে, আমি, কিঞ্চিৎকালের নিমিত্ত, সভামণ্ডপের বহির্দেশে গিয়াছিলাম। আবশ্যক কার্যের সমাধা করিয়া, প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, শুনিতে পাইলাম, এক মহামহোপাধ্যায় বিদ্যভুড়ভুড়ি বিদ্যাবাগীশ খুড় বড় সুন্দর বক্তৃতা করিয়াছেন। হায়! হায়! কেন আমি এমন সময়ে উপস্থিত ছিলাম না, এই বলিয়া, মাথায় চাপড়াইয়া, যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া, বক্তৃতার প্রশংসা কারী ব্যক্তিবর্গের নিকট, বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করিলাম, ঐ বক্তৃতার স্কুল সর্ম্ম ও তাৎপর্য কি, আপনারা অনুগ্রহ করিয়া বলুন। তাঁহারা, মদীয় অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া, অতি সংক্ষেপে, এই মাত্র কহিলেন, বিদ্যাবাগীশ খুড় বলিয়াছেন, বিধবাবিবাহসংসৃষ্ট লোক-সকল বিজাতক, অর্থাৎ তাহাদের জন্মের ব্যত্যয় আছে; এবং, সভাস্থ সত্য মহোদয়গণ, তদীয় চিত্তহারিণী বক্তৃতা শ্রবণে চমৎকৃত ও পুলকিত হইয়া, বক্তাকে মুক্তকণ্ঠে শতসহস্র সাধুবাদ প্রদান কয়িয়াছেন। এই কথা শুনিয়া, কি কারণে বলিতে পারি না,আমি কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ ও হতবুদ্ধির মত হইয়াছিলাম; অনন্তর, স্থিরচিত্তে, সকল বিষয়ের সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া, উপলব্ধি করিতে পারিলাম, যদি যথার্থই ঐরূপ বিদ্যাপ্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে, বা বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়, নিঃসংশয়, প্রকৃত পণ্ডিতপদবাচ্য। কারণ, নীতিশাস্ত্রে নিরুপিত আছে,

আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ।
যিনি সকলকে আপনার মত দেখেন, তিনি পণ্ডিত।

 যাহা হউক, ঈদৃশ অভাবনীয়, অচিন্তনীয় পাণ্ডিত্যপ্রকাশ দর্শনে, অনির্ব্বচনীয় প্রীতিরসে অভিষিক্ত হইয়া, উপযুক্ত ভাইপো, কায়মনোবাক্যে, প্রার্থনা, ও আশীর্ব্বাদ করিতেছেন, এই সুশীল, সুবোধ, সুসন্তান, সদ্বক্তা, সবিবেচক, বিদ্যাবাগীশ খুড়, চিরজীবী, চিরসুখী, ও চিরস্মরণীয় হইয়া, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেবীর প্রিয় পোষ্য পুত্র অবতারবর্গের অবিশ্রান্ত অকৃত্রিম আনন্দবর্দ্ধন করুন।

 ইতি ব্রজবিলাসে মহাকাব্যে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য কৃতৌ

চতুর্থ উল্লাস।

  1. পরাশরভাষ্য ও নির্ণয়সিন্তু ধৃত কাত্যায়নরচন।
  2. মহাভারত। ভীষ্মপর্ব্ব। ৯১ অধ্যায়।
  3. ব্রাহ্মো দৈবন্তখৈবার্য প্রাজাপত্যন্তথাসুরঃ।
    গান্ধর্ব্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোঽধমঃ॥ মনু। ৩। ২১।

  4. ব্রাহ্মো বিবাহ আহূয় দীয়তে শক্ত্যলঙ্কৃতা। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৫৮।
  5. যজ্ঞস্থায়র্ত্বিঙ্গে দৈরঃ। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৫৯।
  6. আদায়ার্বন্ত গোদ্বয়ম্‌। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৫৯।
  7. ইত্যুক্ত্ব্য চরতাং ধর্ম্ম সহ যা দীয়তেহর্থিনে। স কায়ঃ। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৬০।
  8. আসুরো দ্রবিণাদাসাৎ। যাজ্ঞবল্ক্য॥ ১। ৩১।
  9. গান্ধর্ব্বঃ সময়ান্মিথঃ। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৬১।
  10. রাক্ষসো যুদ্ধহরণাৎ ১। ৬৯।
  11. পৈশাচঃ কন্যকাচ্ছলাৎ। যাজ্ঞবল্ক্য। ১। ৬১।
  12. দ্বয়োঃ সকানম্নোর্মাতাপিতৃহিতো যোগো গান্ধর্ব্বঃ। বিষ্ণু। ২৪ অধ্যায়।
  13. নারদসংহিতা, দ্বাদশ বিবাহপদ।
  14. উদ্বাহুতত্ত্বঃত।