ব্রজবিলাস/প্রথম উল্লাস

ব্রজবিলাস

প্রথম উল্লাস।

ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন বেহুদা পণ্ডিত।
আপাদমস্তক গুণ রতনে মণ্ডিত॥
শুভ ক্ষণে তাঁর মাতা ধরিল। উদরে।
নাহি দেখি সম তাঁর ভুবন ভিতরে॥
বুদ্ধির তুলনা নাই যেন বৃহস্পতি।
রূপের তুলনা নাই যেন রতিপতি॥
রসিকের চুড়ামণি সর্বগুণাকর।
সুশীলের শিরোমণি দয়ার সাগর॥
সুবোধের অগ্রগণ্য দানে কর্ণ প্রায়।
যেই যে বিধান চায় সেই তাহা পায়॥
এ বিষয়ে কেহ নাহি তাহার সমান।
এক মাত্র তিনি নিজ উপমার স্থান॥
তাঁহার গুণের কিছু করিব বর্ণন।
অবহিত চিত্তে সবে করই শ্রবণ॥

 যদি আপনারা বলেন, তুমি কে হে বাপু; তোমার এত বড় আম্পর্ধা কেন। তুমি, বামন হয়ে, আকাশের চাঁদ ধরিতে চাও। তোমার এমন কি ক্ষমতা, যে তুমি বিশ্ববিজয়ী দিগ্গজ পণ্ডিতের গুণ বর্ণনা করিবে। আমার উত্তর এই, সবিশেষ না জানিয়া শুনিয়া, সহসা আমায় হেয়ঞ্জান করিবেন না। আমি এক জন; যথার্থ কথা বলিতে গেলে, আমি নিতান্ত যেমন তেমন এক জন নই। আমার পরিচয় শুনিলে, আপনারা চমকিয়া উঠিবেন, সে বিষয়ে এক কড়ারও সংশয় নাই। ‘বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরিতে চাও’, এ কথাটি, বোধ হয়, আপনারা ঠাট্টা করিয়া বলিয়াছেন। আমি কিন্তু, ঠাট্টা না ভাবিয়া, শ্লাঘা জ্ঞান করিতেছি। আমাদের বংশমর্যাদা অতি বেয়াড়া। বামন বংশের আদিপুরুষ তারতবর্ষের পঞ্চম অবতার। তিনি, ত্রিলোকবিজয়ী বলি রাজার যজ্ঞক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া, কি ফেলাৎ, কি কারখানা, করিয়াছিলেন, তাহা কি কখনও আপনাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে নাই।

বাপ কা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া
কুছ না রহে তব ভি থোড়া।

যদিও, যুগমাহাত্ম্যে, আদিপুরুষের সম্পূর্ণ ক্ষমতা আমাদের না থাকে, কিছু ত থাকিবে। তিনি এক পদে সমস্ত আকাশমণ্ডল আক্রমণ করিয়াছিলেন। আমরা কি, তাঁহার বংশের তিলক হইয়া, আকাশমগুলের এক অংশেও হাত বাড়াইতে পারিব না। অবশ্য পরিব। অল্প, ইহাও বিবেচনা করা আবশ্যক, আমি খাঁহাকে ধরিতে চাহিতেছি, তিনি আকাশের চাঁদ নহেন, নদিয়ার চাঁদ[১]। নদিয়ার চাঁদকে ধরিতে যাওয়া, আমার মত বেহুদা বাহাদুরের পক্ষে, নিতান্ত অসংসাহসিকের কার্য্য বলিয়া বোধ হয় না।

 এক সময়ে, চৈতন্য দেব, নদিয়ার চাঁদ বলিয়া, খ্যাত হইয়াছিলেন। বোধ হয়, তাঁর রঙটা বেস ফরসা ছিল, তাই তাঁকে নদিয়ার চাঁদ বলিত। যথার্থ গুণ প্রকাশ অনুসারে বলিতে গেলে, বিদ্যারত্ন খুড়ই নদিয়ার প্রকৃত চাঁদ। নদিয়ার চাঁদ, অর্থাৎ নদিয়া উজ্জ্বল করিয়াছেন। তাঁহার পূর্ব্বে, রঘুনাথ, জগদীশ, গদাধর, রঘুনন্দন প্রভৃতি নদিয়াকে যেমন উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়, নিজগুণে, তদপেক্ষা শত সহস্র গুণে, অধিক উজ্জ্বল করিয়াছেন। বলিতে কি, খুড় যে এত বড় ভাগ্যধর হইবেন, ইহা, ক্ষণ কালের জন্যে, আমাদের কাহারও খেয়ালে আইসে নাই।

স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষ ভাগ্যং
দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ।

স্ত্রীলোকের চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যের কথা দেবতারা জানেন না, মানুষে কেমন করিয়া জানিবে।

 ইতি পূর্বে বলিয়াছি, আমার পরিচয় শুনিলে, আপনাৱা চমকিয়া উঠিবেন। কিন্তু, অন্যমনস্ক হইয়া, এ পর্যন্ত আত্মপরিচয় দিতে পারি নাই। এজন্য, যদিও আপনার, সাহস করিয়া, মুখ ফুটিয়া বলিতে না পারুন, মনে মনে বিরক্ত হইতেছেন, তাহার সন্দেহ নাই। বোধ করি, পরিচয় দিতে বিলম্ব করা আর, কোনও মতে, উচিত হইতেছে না। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে, আমি কে, ও কি ধরপের জানোয়ার, তাহা জানিবার জন্য, আপনারা ছটফট করিতেছেন। যদি বলেন, তবে পরিচয় দিতে এত বিলম্ব ও আড়ম্বর করিতেছ কেন। তাহার কারণ এই, পরিচয় দিলেই, ভুর ভাঙিয়া যাইবে; তাহা অপেক্ষা, চালাকি ও গোলমাল করিয়া, যত ক্ষণ আপনাদিগকে ফাঁকি দিতে পারি, সেই লাভ, সেই বাহাদুরি। যদি বলেন, লোককে ফাঁকি দেওয়া কি ভদ্রের কর্ম। এ বিষয়ে বক্তব্য এই, আপনারা ভদ্র কাহাকে বলেন, তাহা আমি জানি না। অভিধানে ভদ্র শব্দের যে অর্থ শিখিয়াছিলাম, সে অর্থের ভদ্র শব্দে নির্দেশ করিতে পারা যায়, এরূপ লোক দেখিতে পাই না। তবে

যদদারতি শ্রেষ্ঠগুদেবেতনরা জনঃ।
ইতর লোকে ভদ্র লোকের দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া চলিয়া থাকে।
এই ব্যবস্থা অনুসারে, আমরা, শ্রীমান্ নদিয়ার চাঁদ বিদ্যারত্ন খুড় প্রভৃতি, এ কালের ভদ্রশব্দবাচ্য, মহাপুরুষদিগের দৃষ্টান্ত অনুসারে, চলিতে শিখিতেছি। কিছু কাল অভ্যাস করিলে, হয় ত, ব্যুৎপত্তিবলে, তাঁহাদের ঘাড়ে চড়িয়া বসিব। ইহার পর, আর তাঁহারা আমাদের কাছে কলিকা পাইবেন না।

বাঁশের চেয়ে কন‍্চি দড়।
শিষ্যবিদ্যা গরীয়সী॥

 আমি বড় মজার লোক, বাজে গোল করিয়া, মিছা সময় নষ্ট করিতেছি। পরিচয় দিতে আর বিলম্ব করা, বোধ হয়, ভাল দেখাইতেছে না। পাঠক মহাশয়েরা শুনুন আমি কে। শুনিয়া কিন্তু, আপনারা অবাক হইবেন,

আমি উপযুক্ত ভাইপো।

কেমন, এখন, আমি কে, চিনিলেন। যদি কেহ বলেন, চিনিতে পারিলাম না; তাঁর বাপ নির্ব্বংশ হউক। কি পাপ! কি বালাই! কি বিড়ম্বনা! অনায়াসে, আমার পরম রমণীয় প্রফুল্ল মুখকমল হইতে, অতি বিষম অতিসম্পাতবাক্য বিনির্গত হইল। অথবা, সে জন্যে ভাবনাই বা কি; কলিকালে ত অভিসম্পাত ফলে না; যদি ফলিত, রক্ষা থাকিত না। বিদ্যভুড়ভুড়ি বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা, কথায় কথায়, অভিসম্পাত দিয়া থাকেন। তাহাতে, এ পর্যন্ত, কার কি হয়েছে। চুলায় যাউক, আর বাজে কথায় কাজ নাই।

 যদি বলেন, তুমি এত কাল কোথায় ছিলে। তুমি যে আজও নরলোকে বিরাজমান আছ, তাহার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় নাই কেন। ইহার উত্তর এই, আমি অজগরের ন্যায় অলস, কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রালু; সহজে নড়িতে চড়িতে ইচ্ছা করে না; আর, নিদ্রাগত হইলে, সহজে নিদ্রাভঙ্গ হয় না। বিবেচনা করিতে গেল, আমি এক রকম খুব সুখে কাল কাটাইতেছি। তবে কি জানেন, শ্রীমান্ বিদ্যাবাগীশ খুড়দের বাড়াবাড়ি দেখিলে, উপযুক্ত ভাইপো হইয়া, উপেক্ষা করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে, ধর্ম্মবহির্ভূত ব্যবহার হয়। এজন্য, বহুবিবাহ বিষয়ক বিচারের সময়, মহামহোপাধ্যায় পূজ্যপাদ শ্রীমান্ তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য্য খুড় মহাশয়কে কিছু উপদেশ দিয়াছিলাম। সম্প্রতি, মহামহোপাধ্যায় পূজ্যপাদ নদিয়ার চাঁদ শ্রীমান্ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য্য খুড় মহাশয়, বিধবাবিবাহ বিষয়ক বিচার উপলক্ষে, যে অদৃষ্টচর, অশ্রুতপূর্ব্ব পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে তাঁহাকে কিছু উপদেশ না দিলে, আমার মত যথার্থ উপযুক্ত ভাইপোর উপর, পক্ষপাতিতা দোষের আরোপ হইতে পারে; নিরবচ্ছিন্ন সেই ভয়ে, বিদ্যারত্ন খুড়কে উচিত মত উপদেশ দিতে, বদ্ধপরিকর হইলাম।

ইতি শ্রীব্রজবিলাসে মহাকাব্যে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য কৃতৌ

প্রথম উল্লাসঃ


  1. আমি এ স্থলে, শ্রীমান ব্রজনাথ বিদ্যারত্নকে নদিয়ার চাঁদ বলিলাম। কিন্তু, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভা দেরী, ইতিপুর্ব্বে, শ্রীমান্ ভুবনমোহন বিদ্যারত্নকে নবদ্বীপচন্দ্র অর্থাৎ নদিয়ার চাঁদ বলিয়াছেন। উভয়েই বিদ্যারত্ন উপাধিধারী, উভয়েই স্ব স্ব বিষয়ে সর্ব্বপ্রধান বলিয়া গণ্য, বিদ্যা বুদ্ধির দৌড়ও উভয়ের একই ধরণের। সুতরাং, উভয়েই নবদ্বীপচন্দ্র অর্থাৎ নদিয়ার চাঁদ বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হইবার যোগ্য পাত্র, সে বিষয়ে সংশয় নাই। কিন্তু, এ পর্যন্ত, এক সময়ে, দুই চাঁদ দেখা যায় নাই। সুতরাং, এক জন বই, দুজনের নদিয়ার চাঁদ হইবার সন্তাবনা নাই। কিন্তু, উভয়ের মধ্যে, এক জন এক বারেই বঞ্চিত হইবেন, সেটাও ভলি দেখায় না; এবং, ঐ উপলক্ষে, দুজনে হুড়হুড়ি ও গুঁতগুঁতি করিয়া মরিবেন, সেটাও ভাল দেখায় না। এ জন্য, আমার বিবেচনায়, সমাংশ করিয়া, দুজনকেই, এক এক অর্দ্ধচন্দ্র দিয়া, সন্তুষ্ট করিয়া, বিদায় করা উচিত। শ্রীমঙী যশোহর হিন্দুধর্ম্মরক্ষণী সভা দেবী আমার এই পক্ষপাতবিহীন কয়তা ঘাড় পাতিয়া লইলে, আর কোনও গোলযোগ বা বিবাদ বিসংবাদ থাকে না। এক্ষণে, তাঁর যেরূপ মরজি হয়।