ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ/সম্পাদকের প্রস্তাবনা

প্রস্তাবনা

 ফাদার হস্টেন বঙ্গদেশের সুধীসমাজে সুপরিচিত। পর্ত্তুগীজ ও লাটীন ভাষায় লিখিত দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও অপ্রকাশিত পুস্তক হইতে তিনি আমাদের দেশের বহু ঐতিহাসিক তথ্য উদ্ধার করিয়া বাঙ্গালী জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। বাঙ্গালা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসেও তাঁহার দান পরিমাণের অনুপাতে বিশেষ মূল্যবান্ বলিতে হইবে। ১৯১৪ সালের বেঙ্গল পাষ্ট এণ্ড প্রেজেণ্ট (Bengal Past and Present, Vol. XI, pp. 40-63) পত্রিকায় তিনি তিনখানি বাঙ্গালা পুস্তকের বিবরণ প্রদান করেন। স্পেন দেশের ভালাদোলিদনিবাসী ফাদার থিরসো লোপেসের নিকট তিনি বই তিনখানির খবর পাইয়াছিলেন। থিরসো লোপেস এই তিনখানি পুস্তক-সম্বন্ধে যে তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন তাহার কতক লাটীন ও কতক স্পেনিস ভাষায় লিখিয়া ফাদার হস্টেনের নিকট পাঠাইয়াছিলেন। লোপেদের লেখা পড়িয়া ফাদার হস্টেনের ধারণা হইয়াছিল যে এই তিনখানি পুস্তকই ১৭৪৩ সালে লিস্‌বন নগরে ফ্রান্সিসকো দা সিলভার ছাপাখানায় মুদ্রিত হইয়াছে এবং বাঙ্গালা ভাষায় মুদ্রিত পুস্তকের এইগুলিই প্রাচীনতম নিদর্শন। ডাক্তার সুশীলকুমার দে তাঁহার History of Bengali Literature in the Nineteenth Century নামক গ্রন্থে কার্য্যতঃ হস্টেনের কথারই পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। সুতরাং বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত প্রাচীন গদ্যপুস্তক-সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে হস্টেন সাহেবের ইংরাজী প্রবন্ধের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। আলোচ্য পুস্তকত্রয়ের নাম ও বিবরণ-প্রদান-প্রসঙ্গে হস্টেন থিরসো লোপেসের লেখাই ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়া দিয়াছেন:—

 Father Manoel da Assumpçaó, a Portuguese, and different from the preceding one, a member of the congregation of the East Indies, laboured there strenuously for the conversion of the infidels, for he had learned their language with great zeal and success. Accordingly, being about 1742 Rector of the Mission of St. Nicolas of Tolentino in the kingdom of Bengalla, he wrote and printed in the Vernacular for the easier instruction of his neophytes:—

 (1) A catechism of the Christian Doctrine, in the form of a dialogue. It was printed in 8vo at Lisbon in 1743 by Francisco da Silva. The contents are: A discussion about the Law between a Christian Catholic Roman, and a Bramene or Master of the Gentoos. It shows in the Bengalla tongue the falsity of the gentoo sect and the infalliable truth of our Holy Catholic faith in which alone is the way of salvation and the knowledge of God’s true Law. Composed by the son of the king of Busna Dom Antonio, that great Christian Catechist, who converted so many Gentoos, it was translated into Portuguese by father Frey Manoel da Assumpçăo, a native of the city of Evora, and a member of the Indian Congregation of the Hermits of St. Augustine, actually Rector of the Bengalla Mission, his object being to facilitate to the Missionaries their discussion in the said tongue with the Bramenes and Gentoos. It is a Dialogue between the Roman Catholic and the Gentoo Bramene written in two columns, Bengala and Portuguese.

 The title and the Prologue are signed by father Frey Jorge da Apresentaçaó’. CodCXVI1—1 from page 1 of the 2nd series of numbering.

 (2) An abridgement of the Mysteries of the Faith, composed in the Bengalla language by Father Frey Manoel da Assumpçaó, actually Rector of St. Nicolas of Tolentino in Bengalla. It is also in two columns, Bengalla and Portuguese, and Barbosa notes that it was printed at Lisboa by Francisco da Silva 1743, 8vo, Cod DXVI1-1 from page 141 of the 2nd series of numbering.

 (3) A Vocabulary in Bengala and Portuguese devided into two parts and dedicated to the most excellent and Reverend Sr. D. Miguel de Tavora, Archbishop of Evora. Lisboa na officina de Francisco da Silva, 1743, 8vo.

 It contains two parts: A Bengala-Portuguese and a Portuguese-Bengala vocabulary. It is preceded by a Compendium of Bengala Grammar.

 এই টীকার মূলানুগত বঙ্গানুবাদ প্রদান করিবার প্রয়োজন নাই। থিরসো লোপেস তিনখানি মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থের উল্লেখ করিয়াছেন। প্রথমখানি একজন বাঙ্গালী খ্রীষ্টানের লেখা, প্রতিপাদ্য বিষয়: হিন্দুধর্ম্মের অসারতা ও রোমান ক্যাথলিক ধর্ম্মের উৎকর্ষ। পুস্তকখানি কথোপকথনচ্ছলে লিখিত। এভোরার অধিবাসী এবং বাঙ্গালা-প্রবাসী মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও নামক একজন পর্ত্তুগীজ সন্ন্যাসী ইহার পর্ত্তুগীজ অনুবাদ করেন। শিরোনামা ও ভূমিকা ভাই জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁও নামক আর একজন সন্ন্যাসী কর্ত্তৃক স্বাক্ষরিত। (এ স্থলে বলিয়া রাখা সঙ্গত যে শিরোনামায় বা ভূমিকায় জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁওর স্বাক্ষর নাই, পুথির ঐ অংশ তাঁহার হাতের লেখা বলিয়া বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন।) পুস্তকের ক্রমিক সংখ্যা—Cod CXVI1—1. দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তকের গ্রন্থকার পূর্ব্বোক্ত মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও। এই দুইখানি গ্রন্থই ১৭৪৩ সালে লিসবোঁয়াতে (লিস্‌বন নগরে) ফ্রান্সিস্‌কো দা সিলভা কর্ত্তৃক মুদ্রিত হইয়াছিল।’ তৃতীয় বইখানি এভোরার আর্চবিশপ মিগেল দা তাভোরাকে উৎসর্গ করা হইয়াছে। দ্বিতীয় গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় খ্রীষ্টান ধর্ম্মের রহস্য; তৃতীয় গ্রন্থ দুই ভাগে বিভক্ত: প্রথম ভাগে বাঙ্গালা ব্যাকরণের মূল সূত্র ব্যাখ্যা করা হইয়াছে এবং দ্বিতীয় ভাগে বাঙ্গালা-পর্ত্তুগীজ ও পর্ত্তুগীজ-বাঙ্গালা শব্দকোষ প্রদত্ত হইয়াছে। দ্বিতীয় গ্রন্থের ক্রমিক সংখ্যা—Cod DXVI1—1. তৃতীয় গ্রন্থের ক্রমিক সংখ্যার উল্লেখ নাই। হস্টেন সাহেব মনে করেন যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রন্থের ক্রমিক সংখ্যা অভিন্ন,— ভুলে CXVI স্থলে DXVI লেখা হইয়াছে। থিরসো লোপেস নিম্নলিখিত পুস্তক হইতে উল্লিখিত তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন: Catalogo dos Manuscriptos da Bibliotheca Publica Eborense ordenado pelo Bibliothecairo Joaquim Heliodoro da Cunha Ribera (sic.) tom. I. p. 345. Barbosa Machado, Bibliotheca Lusitana Historica, Critica and Chronologica, t. III, p. 183, Col. II. Ossinger, Bibl. August., p. 84. Silva t. v. 367. Bonifacio Moral, Revista La Ciudad de Dios, t. 37, pp. 433-434.

 এই বইগুলি যেমন প্রাচীন তেমনই দুষ্প্রাপ্য। কলিকাতার কোন গ্রন্থালয়েই এই পুস্তকগুলির সন্ধান পাই নাই। গোয়ার জাতীয় গ্রন্থালয়ে কুহ্না রিভারের তালিকা আছে। পর্ত্তুগালে যাইবার পূর্ব্বে হস্টেন সাহেবের প্রবন্ধ পড়া থাকিলে অসিঙ্গার ও বোনিফাসিয়ো মরালের গ্রন্থের অনুসন্ধান করিতে পারিতাম। বারবোসা মাসাদো ও ইনোসেন্সিয়ো ফ্রান্সিসকো দা সিলভা (Innocencio Francisco da Silva) পর্ত্তুগীজ ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ও পর্ত্তুগীজ গ্রন্থকারদিগের জীবনীকোষ সঙ্কলন করেন। সাধারণতঃ অপ্রসিদ্ধ পর্ত্তুগীজ লেখকদিগের সম্বন্ধে কিছু জানিতে হইলে সকলেই ইহাদের (মাসাদো ও দা সিলভার) অভিধানের পাতা একবার উল্টাইয়া দেখেন। লিস্‌বন প্রবাসকালে আমিও ঠিক তাহাই করিয়াছিলাম। দিয়োগো বারবোসা মাসাদো ১৭৫২[১] খ্রীষ্টাব্দে, অর্থাৎ আসুম্পসাঁওর পুস্তক মুদ্রিত হইবার মাত্র নয় বৎসর পরে, তাঁহার Bibliotheca Lusitana প্রকাশ করেন। ঐ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ১৮৩-১৮৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখিয়াছেন,—“ভাই মানুয়েল বাঙ্গালা ভাষা শিখিয়া হিন্দুদিগকে খ্রীষ্টধর্ম্মের প্রতি আকৃষ্ট করিবার অভিপ্রায়ে ১৭৩৫ সালে একখানি বাঙ্গালা গ্রন্থ রচনা করেন। উহার নাম Cathecismo do Doutrina Christáá ordenado por modo de Dialogo em idioma Bengala e Portugues, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে এই বইখানি লিস্‌বনে ফ্রান্সিসকো দা সিলভা কর্ত্তৃক মুদ্রিত হয়। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে মানুয়েল-কৃত ব্যাকরণ ও শব্দকোষের কথা মাসাদোর অভিধানে নাই এবং মানুয়েলের জীবন ও কার্য্যাবলী সম্বন্ধেও তাঁহার পুস্তকের শিরোনামায় প্রদত্ত তথ্যের অতিরিক্ত কোন কথা মাসাদো লেখেন নাই। বোধ হয় মানুয়েলের বাঙ্গালা ব্যাকরণ তাঁহার স্বদেশে যাজক-সম্প্রদায়ের বাহিরে তেমন প্রচার লাভ করে নাই। ইনোসেন্সিইয়ো দা সিলভার Diccionario Bibliographico Portuguez ইহার প্রায় একশত বৎসর পরে (১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে) বাহির হয়। দা সিলভা মাসাদোর এই ত্রুটি লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন যে, Libraria Jesus নামক পুস্তকালয়ে আসুম্পসাঁওর একখানি ব্যাকরণ ও শব্দকোষ দেখিয়াছিলেন, বাজারে তখনই ঐ গ্রন্থ অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হইয়াছে। তিনি পুস্তকের নাম, পত্রসংখ্যা, আলোচ্য বিষয়, প্রকাশকের নাম এবং প্রকাশের স্থান ও তারিখ যথাযথ উল্লেখ করিয়াছেন। এ স্থলে একটি বিষয় লক্ষ্য করা আবশ্যক। দিয়োগো বারবোসা মাসাদো অথবা ইনোসেন্সিয়ো ফ্রান্সিসকো দা সিলভা কেহই তাঁহাদের অভিধানে দোম আস্তোনিয়োর নাম অথবা তাঁহার গ্রন্থের বিষয় উল্লেখ করেন নাই। যদি ঐ গ্রন্থ কখনও কোথাও মুদ্রিত হইয়া থাকে, তবে এই দুই জন পর্ত্তুগীজ পণ্ডিত তাহার অস্তিত্ব অবগত ছিলেন না। ১৮৮০ সালে এ. সি. বার্নেল (A. C. Burnell) তৎকৃত A Tentative List of Books and MSS. relating to the History of the Portuguese in India Proper নামক গ্রন্থে ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত মানুয়েল-কৃত Vocabulario (শব্দকোষ) এবং Cathecismo da Doutrina Christa (খ্রীষ্টধর্ম্মমত-সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তরমালা) উল্লেখ করিয়াছেন। শেষোক্ত গ্রন্থের বাঙ্গালা নাম “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ” (Crepar Xaxtrer Orth Bhed)। যদি বার্নেলের তালিকায় মানুয়েলের “প্রশ্নোত্তরমালা”র এই বাঙ্গালা নাম প্রদত্ত হইত তাহা হইলে তখনই এই প্রাচীন গদ্যগ্রন্থের প্রতি বহু অনুসন্ধিৎসু বাঙ্গালী পণ্ডিতের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইত সন্দেহ নাই। হস্টেন সাহেব থিরসো লোপেসের টীকা সাধারণে প্রচার না করিলে এখনও হয়ত আমরা দোম আন্তোনিয়ো ও মানুয়েলের গদ্যপুস্তক-সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিতাম।

 অসিঙ্গার ও বোনিফাসিয়ো মরালকে[২] বাদ দিলে থিরসো লোপেসের উল্লিখিত গ্রন্থকারদিগের মধ্যে একমাত্র কুহ্না রিভার-ই দোম আন্তোনিয়োর গ্রন্থের কথা জানিতেন। ১৮৫০ সালে তৎকৃত এভোরার সাধারণ গ্রন্থালয়ের হস্তলিখিত পুথির তালিকা (Catalogo dos Manuscriptos da Bibliotheca Publica Eborense) বাহির হয়। এই তালিকায় হস্তলিখিত পুথি-হিসাবেই দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকের নাম করা হইয়াছে। থিরসো লোপেস মানুয়েলের বই দুইখানির মুদ্রণের বর্ষ উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু এক নম্বরের বই অর্থাৎ দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকের প্রতিপাদ্য বিষয়-সম্বন্ধে সমস্ত জ্ঞাতব্য তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়াও কেবল তাহার ক্রমিক সংখ্যা দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন। বলা বাহুল্য যে ক্রমিক সংখ্যা এভোরার পুস্তকালয়ের তালিকায় প্রদত্ত সংখ্যার সহিত অভিন্ন এবং এভোরার পুথির শিরোনামায় গ্রন্থ ও গ্রন্থকার-সম্বন্ধে যেটুকু লেখা আছে, লোপেস সাহেবের সঙ্কলিত বিবরণেও তাহার বেশী কিছু পাওয়া যাইতেছে না। তবে তিনি কেন লিখিয়াছেন যে মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও যখন বঙ্গদেশে ভলেন্তিনোর সন্ত নিকোলাস মিশনের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন তাহার শিষ্যদিগের শিক্ষার নিমিত্ত এই তিনখানি বই প্রাদেশিক ভাষায় লিখিয়া ছাপিয়া ছিলেন?

 থিরসো লোপেসের সংক্ষিপ্ত টীকায় ত্রস্ততা-জনিত ভ্রমের বহু চিহ্ন বিদ্যমান। এই সম্পর্কে এক নম্বর ও দুই নম্বর পুস্তকের ক্রমিক সংখ্যার পার্থক্য এবং প্রমাণপঞ্জীতে কুহ্না রিভারের নামের বানান (Rivara স্থলে Ribara) ভুলের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। যদি তিনি এভোরার পুথির ক্রমিক সংখ্যার কথাই লিখিয়া থাকেন, তবে তাহাও একেবারে ভ্রম-বিরহিত নহে। এভোরার পুথিতে “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের” যেটুকু আছে তাহা ১২৮ পৃষ্ঠা হইতে আরম্ভ হইয়াছে। ১৪১ পৃষ্ঠা হইতে আরম্ভ হইয়াছে শব্দকোষের খণ্ডিত অংশ। এই শব্দকোষের সহিত আবার মুদ্রিত শব্দকোষের কিছু পার্থক্য আছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে হয় তিনি নিজে এভোরার পুথি দেখেন নাই, না হয় ত, অসতর্কতা- অথবা ত্রস্ততা-বশতঃ “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের” পত্রসংখ্যা-সম্বন্ধে ভুল করিয়াছেন। এক নম্বর পুস্তকের গ্রন্থকার যে দোম আন্তোনিয়ো তাহা লোপেস সাহেব নিজেই জানিতেন। আসুম্পসাঁও কেবল দোম আন্তোনিয়োর বাঙ্গালা গ্রন্থের পর্ত্তুগীজ অনুবাদ করিয়াছেন; সুতরাং আসুম্পসাঁওকে কোন মতেই এক নম্বর বইর গ্রন্থকার বলা যায় না। আমার মনে হয় যে, এই কারণেই থিরসো লোপেসের মন্তব্য দুই ও তিন নম্বরের পুস্তক-সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, এক নম্বরের বই-সম্বন্ধে তাঁহার উক্তি গৃহীত হইতে পারে না। বিশেষতঃ ফাদার আম্ব্রোসিয়ো সন্ত আগুন্তিনো ১৭৫০ সালে সন্তনিকোলাস তলেন্তিনো মিশনের যে বিবরণ লিখিয়াছেন তাহাতে আন্তোনিয়োর পুথির কথা আছে, কিন্তু মুদ্রিত পুস্তকের কথা নাই। দোম আন্তোনিয়োর বই যে কখনও ছাপা হইয়াছে, এ যাবৎ তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। যদি কখনও ঐ গ্রন্থ ছাপা হইয়া থাকে, তবে মুদ্রিত পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। এভোরা ব্যতীত অন্য কোথাও এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি আছে বলিয়াও আমরা এ পর্য্যন্ত খবর পাই নাই।

 থিরসো লোপেসের নিকট অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে মুদ্রিত তিনখানি বাঙ্গালা পুস্তকের খবর পাইয়া হস্টেন সাহেব বই তিনখানি দেখিবার জন্য উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠেন। এই অভিপ্রায়ে তিনি স্পেন ও পর্ত্তুগালের বহু পুস্তকালয়ে পত্র লেখেন, কিন্তু এক জায়গা ব্যতীত অন্য কোন স্থান হইতে কোন উত্তর আসে নাই। যিনি হস্টেন সাহেবের চিঠির জবাব দিয়াছেন তিনিও বই তিনখানি-সম্বন্ধে কোন সংবাদ দিতে পারেন নাই। পরলোকগত প্রসিদ্ধ পণ্ডিত হেনরী বেভারিজ হস্টেন সাহেবকে লেখেন যে, ব্রিটিশ মিউজিয়মে উল্লিখিত পুস্তকত্রয়ের একখানিও নাই। অগত্যা হস্টেন সাহেব বেলজিয়মের কন্‌সালের মারফতে পর্ত্তুগালে অনুসন্ধান আরম্ভ করেন। তাহার ফলে তিনি পর্ত্তুগালের পররাষ্ট্র-বিভাগের (Ministerio dos Negocios Estrangeiros) সেনর গনসালভিস তেসিরার নিকট জানিতে পান যে, এভোরার সাধারণ পুস্তকালয়ে রক্ষিত তিনখানি বাঙ্গালা পুস্তকই হাতে লেখা, সুতরাং মুদ্রিত পুস্তকের সন্ধান করা নিষ্প্রয়োজন ও অপ্রাসঙ্গিক। বস্তুতঃ হস্টেন সাহেব যাহাদিগকে পুস্তকের খোঁজ লইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন, তাঁহারা কেহই এ বিষয়ে তেমন যত্ন বা পরিশ্রম স্বীকার করেন নাই। কারণ ১৯১৯ সালে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ মিউজিয়মেই আসুম্পসাঁওর বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও শব্দকোষ পাইয়াছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁহার ও অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন মহাশয়ের সম্পাদকতায় ঐ গ্রন্থ বঙ্গানুবাদ সমেত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে। ১৯২৬ সালে এই পুস্তকের আর একখানি আমি এভোরায় দেখিয়াছি। “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের” একাধিক সংস্করণ হয়। প্রথম সংস্করণ ১৭৪৩ সালে লিস্‌বনে ফ্রান্সিসকো দা সিলভা কর্ত্তৃক প্রকাশিত হয়। ১৮৩৬ সালে চন্দননগরের ফরাসী পাদ্রী ফাদার গেঁরা (Guerin) শ্রীরামপুর হইতে এই পুস্তকের পরিশোধিত ও পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ বাহির করেন। ১৮৬৯ সালে গোয়ার সন্নিহিত মারগাঁও সহরে ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ তৃতীয় বার মুদ্রিত হয়।[৩] লিস্‌বনের জাতীয় গ্রন্থালয়ে (Bibliotheca Nacional) প্রথম ও তৃতীয় সংস্করণের পুস্তক আছে। এভোরার পুথিতে দোম আন্তোনিয়োর সমগ্র গ্রন্থ থাকিলেও আসুম্পসাঁওর দুইখানি পুস্তকের কিয়দংশ মাত্র আছে। সুতরাং গনসালভিস তেসিরা ফাদার হস্টেনকে যে খবর দিয়াছিলেন তাহাও একেবারে অভ্রান্ত বলা যায় না। যাহা হউক, হস্টেন সাহেব সহজে নিরুদ্যম হইবার লোক নহেন। অনেক পরিশ্রমের পর তিনি বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটিতে “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের” প্রথম সংস্করণের একখানি খণ্ডিত পুস্তক পাইয়াছেন। এই পুস্তকখানির মলাট (title page) ৩৩ হইতে ৪৮, ১৫৫ হইতে ১৫৮, ৩২১ হইতে ৩২৬, ৩৭১ ও ৩৭২ এবং ৩৮০-র পর বাকী পৃষ্ঠাগুলি নাই। এই সংস্করণে ৩৯১ পৃষ্ঠায় গ্রন্থ শেষ হইয়াছে। ফাদার হস্টেন তাঁহার প্রবন্ধে এই খণ্ডিত পুস্তকখানিরই বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন।

 দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকের পর্ত্তুগীজ অনুবাদ করিয়াছেন পাদ্রী মানুয়েল। সম্ভবতঃ তাঁহারই যত্নে এভোরার পুথি লেখা হইয়াছিল। সুতরাং দোম আন্তোনিয়ো ও তৎকৃত “শাস্ত্রসম্পর্কীয় তর্ক ও বিচার”-সম্বন্ধে আলোচনা করিবার পূর্ব্বে পাদ্রী মানুয়েল ও তাঁহার দুইখানি বই-সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

 মানুয়েল দা আসুম্পসাঁওর জন্মস্থান এভোরা পর্ত্তুগালের রাজধানী লিস্‌বন হইতে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত। আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও এভোরা অত্যন্ত প্রাচীন সহর। খ্রীষ্টের জন্মের আশী বৎসর পূর্ব্বে রোমান সেনাপতি সারটরিয়াস এখানে শিবির স্থাপন করিয়াছিলেন। ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে মুসলমানেরা এই জায়গা দখল করেন, আবার চারি শত সত্তর বৎসর পরে এইখানেই তাঁহারা পর্ত্তুগালের খ্রীষ্টান বীরদিগের হস্তে পরাজিত হন। পূর্ব্বে পর্তুগালের রাজারা মধ্যে মধ্যে এভোরায় আসিয়া থাকিতেন। জিল ভিসেন্তের কয়েকখানি নাটক এইখানেই অভিনীত হইয়াছিল। ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে এভোরায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্তিত্ব বহুদিন হয় লোপ পাইয়াছে, কিন্তু এভোরার প্রাচীন গির্জা (ক্যাথিড্রাল) এখনও পর্ত্তুগালের স্থাপত্য-গৌরবের অন্যতম নিদর্শন বলিয়া বিবেচিত হয়। এভোরার গ্রন্থালয়ে বহু প্রাচীন গ্রন্থ, অপ্রকাশিত পুথি এবং ঐতিহাসিক চিঠিপত্র আছে। এই গ্রন্থালয়ের অন্যতম অধ্যক্ষ কুহ্না রিভার বহুদিন পর্ত্তুগীজ-ভারতে রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাঁহার বিশেষ অনুরাগ ছিল। তাঁহার সংগৃহীত কাগজপত্র এখন এভোরার গ্রন্থালয়ে আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস যাঁহারা আলোচনা করিয়া থাকেন তাঁহাদের পক্ষে এখানকার পুথি ও চিঠিপত্র বিশেষ প্রয়োজনীয়।

 মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও কবে কোন্ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা আমরা জানি না। তিনি কবে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিলেন, কোথায় কি ভাবে তাঁহার শিক্ষা সমাপ্ত হইয়াছিল, তাহাও আমাদের অজ্ঞাত। তাঁহার ভারতবর্ষে আগমনের সময়ও আমাদের জানা নাই। আমরা কেবল এইটুকু জানি যে ১৭৩৪ সাল হইতে ১৭৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভাওয়ালের খ্রীষ্টান প্রচারকদিগের পরিচালক ছিলেন। তৎকৃত বাঙ্গালা পুস্তকদ্বয়ের শিরোনামা ও ভূমিকা এবং পরবর্ত্তী কালের চিঠিপত্র হইতে মাত্র এইটুকুই জানা গিয়াছে। অভিধানকার মাসাদো এবং দা সিলভাও ইহার অধিক আর কিছু বলেন নাই। তবে একথা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে যে ভাই মানুয়েল অত্যন্ত কর্ত্তব্যনিষ্ঠ ধর্ম্মপ্রচারক ছিলেন। তৎকৃত ব্যাকরণের ভূমিকাই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি নিজে যত্নপূর্ব্বক বাঙ্গালা ভাষা অভ্যাস করিয়াছিলেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের অভাবসত্ত্বেও কেবল প্রচলিত ভাষার প্রকৃতি পর্যালোচনা করিয়া ব্যাকরণের নিয়ম নির্দ্দেশ করা কম কৃতিত্বের কথা নহে। এই ব্যাকরণ তাঁহার সহকর্ম্মিগণের কাজে লাগিবে বলিয়া তিনি ইহার মুদ্রণের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই কার্য্যে ভাই জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁও তাঁহাকে বিশেষ সাহায্য করেন। তৎকালে এ দেশে মুদ্রাযন্ত্র স্থাপিত হয় নাই। সেইজন্য পর্ত্তুগালে গ্রন্থমুদ্রণের ব্যবস্থা করিতে হইয়াছিল। পর্ত্তুগালে বাঙ্গালা অক্ষরে বই ছাপিবার সম্ভাবনা ছিল না বলিয়া এবং সম্ভবতঃ নূতন শিক্ষার্থীকে অপরিচিত অক্ষর আয়ত্ত করিবার ক্লেশ হইতে অব্যাহতি দিবার জন্য আসুম্পসাঁও যথাসম্ভব উচ্চারণ ঠিক রাখিয়া রোমান হরফে বাঙ্গালা লিখিবার নিয়ম বাহির করিয়াছিলেন। তাঁহার দুইখানি পুস্তকই রোমান হরফে ছাপা হইয়াছে, দোম আন্তোনিয়োর গ্রন্থের বাঙ্গালা অংশও রোমান অক্ষরে লেখা। জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁওর স্বাক্ষরিত বাঙ্গালা ব্যাকরণের মুখবন্ধে জানা যায় যে, তিনি নিজে সাড়ে আট বৎসর বঙ্গদেশে মানুয়েলের সহকর্ম্মী ছিলেন এবং বাঙ্গালা ভাষা ভাল করিয়া শিখিয়াছিলেন। তিনিই দেশে ফিরিবার সময়ে ব্যাকরণের পাণ্ডুলিপি ও এই শ্রেণীর অপর একখানি পুস্তক পর্ত্তুগালে লইয়া গিয়াছিলেন। মানুয়েলের ব্যাকরণ বঙ্গদেশের খ্রীষ্টানদিগের সমধিক হিতকর হইবে বলিয়া ভাই জর্জ ইহার মুদ্রণের ব্যবস্থা করিলেন। ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ” এবং ব্যাকরণ ও শব্দকোষ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। ভাই মানুয়েল কবে তাঁহার ব্যাকরণ রচনা করিয়াছিলেন তাহা জানিবার উপায় নাই। “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের” রচনা-কাল মোটামুটি নির্ণয় করা যাইতে পারে। এই প্রসঙ্গে ঐ পুস্তকের শিরোনামা উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। হস্টেন সাহেব এই শিরোনামা দেখেন নাই বলিয়াই বোধ হয় নিঃসংশয়ে বলিয়াছেন যে, মানুয়েল ১৭৩৪ সালে ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ রচনা করিয়াছিলেন।

 ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের (প্রথম সংস্করণ) মলাটে লেখা আছে—

Crepar Xaxtrer Orth Bhed
Xixio Gurur Bichar

Fr Manoel da Assumpçam
Liqhiassen, O buzhaiassen
Bengallate Baoal dexe Xon hazar
Xat xoho pointix bossor Christor
Zormo bade Bhetton Corilo boro
TThacurque D Fr Miguel de Tavora Evorar
Xohorer Arcebispo+ Lisboate Francisco
da Sylvar xaze’ Patxaer quitaber xapcorinia
Xpor Zormo bostore 1743
Xocol uchiter hucume.
ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ
শিষ্য গুরুর বিচার
ফ্র মানুয়েল দা অসুম্পসাঁও
লিখিয়াছেন ও বুঝাইয়াছেন
বেঙ্গালাতে বাওয়াল দেশে সোন হাজার
সাত শো পঁয়তিশ বছছর খ্রীষ্টর
জর্ম বাদে ভেটন করিলো বরো
ঠাকুরকে দোম ফ্র মিগেল দে তাভোরা এভোরার
সহরের আর্চবিশপ+লিসবোয়াতে ফ্রান্সিসকো
দা সিলভার সাজে পাতশাএর কিতাবের ছাপ ছোরিনিয়া
খ্রীষ্টর জর্ম বস্তরে ১৭৪৩
সকল উচিতের হুকুমে।

এখানে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও তাঁহার ধর্ম্মরহস্যের সারসংগ্রহ বা ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দে লিখিয়াছিলেন। ১৮৩৬ সালে পাদ্রী গেরাঁ ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের যে পুস্তক পাইয়াছিলেন তাহার মলাটেও এই তারিখই ছিল। কিন্তু মুদ্রিত পুস্তকের মুখবন্ধে দেখা যায় পাদ্রী মানুয়েল ২৮এ অগষ্ট ১৭৩৪ তারিখ দিয়াছেন। সম্প্রতি শ্রীযুত সজনীকান্ত দাস লিখিয়াছেন যে তিনি ভাল করিয়া দেখিয়াছেন যে ভূমিকার তারিখ ১৭৩৪ নহে ১৭২৪। মাসাদো লিখিয়াছেন যে মানুয়েল ১৭৩৫ সালে বঙ্গদেশে সন্ত আগুস্তিনো সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসি-দলের সন্ত নিকোলাও তলেন্তিনো মিশনের পরিচালক (Reytor, ইংরাজী Rector) ছিলেন। তিনিও পুস্তকের শিরোনামায় প্রদত্ত তথ্য হইতেই এই সিদ্ধান্ত করিয়া থাকিবেন। ভূমিকার তারিখ সংখ্যা দিয়া নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। সংখ্যায় ছাপার ভুল হইবার সম্ভাবনা বেশী, সুতরাং শিরোনামায় অক্ষরের সাহায্যে যে তারিখ লেখা হইয়াছে তাহাই সমধিক গ্রহণযোগ্য বলিয়া মনে করি।

 ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদের ভূমিকাও উদ্ধৃত করিবার যোগ্য। ভূমিকায় মানুয়েল লিখিয়াছেন:—

পরহ

 বেঙ্গালীরে জানান

 দোস্তো বেঙ্গালী, শোনো, পুথি সকোলের উতম পুথি; শাস্ত্রো সকোলের উতম শাস্ত্রো; শাস্ত্রী সকোলের উত্তম শাস্ত্রী খ্রীষ্টোর শাস্ত্রী, ক্রেপার শাস্ত্রো; এবং ক্রেপার শাস্ত্রের পুথি;

 এহি পুথিতে শোন মোন দিয়া পাইবা বুঝন, বুঝান, বুঝিবার, বুঝাইবার উপাএ তরিবার। আস্তার বেধের অর্থো শোন, শুনাও; পর্তক্ষ্যে জানিয়া বুঝো, বুঝাও পরিণামের পন্থ ধরো, ধরাও; শিষ্য গুরুর নিয়াতে নিয়াএ করিতে শিখো, শিখাও; এহা জানিয়া, বুঝিয়া, মানিয়া, মুক্তি হইবেক; দশ আগ্যা পালোন কর যদি।

 ভূমিকার বাঙ্গালা মন্দ নহে। সাধারণ পাদ্রী-বাঙ্গালা অপেক্ষা ভালই বলিতে হইবে। কোথাও আড়ষ্টতা নাই। কিন্তু তাই বলিয়া পাদ্রী মানুয়েলের যে বাঙ্গালা ভাষার উপর খুব দখল ছিল তাহা বলা যায় না। মলাটের পৃষ্ঠায় তিনি com todas as licenças necessarius এর অনুবাদ করিয়াছেন “সকল উচিতের হুকুমে”। প্রিয়রঞ্জন সেন মহাশয়ের ভাষান্তর—“যাবতীয় প্রয়োজনীয় অনুমতি পত্র সমেত।” রোমান হরফে বাঙ্গালা লিখিবার সময় মানুয়েল পূর্ব্ববঙ্গের উচ্চারণ-রীতি অনুসরণ করিয়াছেন। buzhon, buzhan প্রভৃতি শব্দে zএর ব্যবহারই তাহার প্রমাণ। কিন্তু পুর্ব্ববঙ্গের উচ্চারণও যে তিনি সম্যক আয়ত্ত করিতে পারিয়াছেন এমন বলা যায় না। শব্দকোষের শেষে তিনি বিভিন্ন অর্থবাচক একই উচ্চারণের কতকগুলি শব্দের উদাহরণ দিয়াছেন, যথা—

chor Ladrão চোর, তস্কর
chor ilha চর, দ্বীপ
chor Espia চর, গুপ্তচর
zor febre জ্বর
zor força জোর

 চর এবং চোর, জ্বর এবং জোর-এর উচ্চারণগত পার্থক্য এত স্পষ্ট যে এ বিষয়ে কাহারও ভুল করিবার সম্ভাবনা খুবই কম। বাঙ্গালা-পর্ত্তুগীজ শব্দকোষের মধ্যেও দুই-একটি মারাত্মক ভুল আছে, যেমন মানুয়েল Abixcar (আবিষ্কার)-এর অর্থ লিখিয়াছেন Compaixão, সহানুভূতি, দয়া, অনুকম্পা। আবিষ্কার কথাটা কথোপকথনের জন্য নিত্য প্রয়োজন হয় না বলিয়াই বোধ হয় মানুয়েল এই শব্দটি সম্বন্ধে এত বড় ভুল করিয়াছেন। অথচ পূর্ব্ববঙ্গের চলতি ভাষায় তিনি এরূপ ভুল করেন নাই বরং তাঁহার অনুবাদকই অনেক সময়ে ভ্রমে পতিত হইয়াছেন।[৪]

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে এভোরার পুথিতে ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ ও শব্দকোষের কিয়দংশ আছে। পুথির ১২৮ পৃষ্ঠায় ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ আরম্ভ হইয়াছে। শেষ হইয়াছে ১৩৮ পৃষ্ঠায়। মুদ্রিত পুস্তকের প্রথমাংশের সহিত পুথির কিঞ্চিৎ অমিল আছে বলিয়া এখানে ঐ অংশটুকু উদ্ধৃত করিলাম।

 P. Tomi Christao?

 Z. Hoe Pormexor Crepae.

 P. Cothae hote Paiaso Christaer nam?

 Z. Christo hote.

 P. Qobe?

 Z. Baptismote.

 P. Christaor nixan qui?

 Z. Xidhi crux.

 P. Coro deqhi.

 Z. xidhi cruxer + sinniote: Roghia coro Pormexor + amar diguer Thaqur. Amardiguer xotur + hote: Pitar name ebong Putrer ebong Espirito Santo amen.

 ১৩৮ পৃষ্ঠার শেষের দুই লাইন—

 P. Xorir zia utthon quemon buzho?

 Z. Buzhi, ze xocol manux bala ar bura zia uthibo moha proloyer din xorir, ar atua xomet bichar hoite.

 বলা বাহুল্য যে এ পুথিতে মুদ্রিত পুস্তকের শিশু-যীশুর আরাধনা সঙ্গীত নাই।

 শব্দকোষ আরম্ভ হইয়াছে ১৪১ পৃষ্ঠায় আর শেষ হইয়াছে ২২১ পৃষ্ঠায়। কিন্তু ইহার অনেকগুলি পাতাই একেবারে শাদা, তাহাতে কিছু লেখা নাই। মুদ্রিত শব্দকোষের সঙ্গে এভোরার পুথির পার্থক্য এই যে পুথিতে প্রথম প্রথম চলতি ভাষা, সাধুভাষা ও হিন্দুস্থানীতে পর্ত্তুগীজ শব্দের প্রতিশব্দ দিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। যথা—

Portuguese Bengala Pulida Industani
A falça feé Misshaasta nixfol Zuttâ mazob
মিছা আস্তা নিষ্ফল
A boca d’noite xanzer cal xoindabag
সাঁজের কাল সৈন্দাবাগ
Algua’ pessoa cuno zon begty coy admy
কুনো জন বেগতি (ব্যক্তি)
A larga cauza digol
দিগল
Alerta Huxiar xabdhaner qhabordar
হুসিয়ার সাবধানের
A maneira dhoraner eirup ey tare
ধরাণের এইরূপ
A mas tente Hater casshe xonicott hatcanasdig
হাতের কাছে সনিকট

দেখা যাইতেছে যে প্রথম পৃষ্ঠায়ও মানুয়েল সর্ব্বত্র হিন্দুস্থানী প্রতিশব্দ দিতে পারেন নাই। সাধুভাষাও পূর্ব্ববঙ্গের উচ্চারণে বিকৃত হইয়াছে; যেমন “সন্ধ্যা ভাগের” স্থলে “সৈন্দা বাগ”; আর সাধু ভাষায় যথেষ্ট দখল না থাকায় প্রতিশব্দের ভুলও হইয়াছে। A falça feéর প্রতিশব্দ ভাওয়ালের কৃষকদিগের ভাষায় হয়ত মিছা আস্থা হইতে পারে, কিন্তু সাধুভাষায় ভ্রান্ত বিশ্বাস বলাই সঙ্গত, নিষ্ফল শব্দ ঐ অর্থে প্রযোজ্য নহে। যাহা হউক, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একজন বিদেশী ধর্ম্মযাজকের পক্ষে বাঙ্গালা ভাষায় এরূপ একখানি ব্যাকরণ এবং শব্দকোষ সঙ্কলন করিয়া রোমান হরফে লেখা যে অসাধারণ অধ্যবসায় ও ভাষানুরাগের পরিচায়ক তাহাতে সন্দেহ নাই। মানুয়েলের শব্দকোষে আরও অধিক দোষ-ত্রুটি থাকিলেও আমরা বিস্মিত হইতাম না। তিনি ভাওয়ালের নিরক্ষর খ্রীষ্টানদিগের মধ্যে কালাতিপাত করিয়াছেন। সেখানে বিদ্যার্চ্চার বিশেষ সুবিধা ছিল বলিয়া মনে হয় না। সুতরাৎ তাঁহার গ্রন্থে যে সামান্য দোষ-ত্রুটি দেখা যায় তাহা আদৌ ধর্ত্তব্য নহে।

 মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও তাঁহার দুইখানি গ্রন্থই এভোরার আর্চ্চবিশপ মিগেল দা তাভোরার নামে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁও ব্যাকরণ ও শব্দকোষের উৎসর্গপত্রে লিখিয়াছেন, মানুয়েল যে আগুস্তিনীয় সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী, মিগেল দা তাভোরা সেই সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনিই ধর্ম্মপ্রচারের জন্য মানুয়েলকে ভারতবর্ষে পাঠাইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত এভোরা-নিবাসী সন্ন্যাসী যে এভোরার আর্চ্চবিশপকেই স্বকীয় গ্রন্থ উৎসর্গ করিবেন ইহাই ত স্বাভাবিক। মিগেল দা তাভোরা এভোরার আর্চ্চবিশপ-পদে নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে কইম্ব্রা (Coimbra) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। কইম্ব্রাকে পর্ত্তুগালের নবদ্বীপ অথবা অক্সফোর্ড বলা যাইতে পারে। তাভোরা-বংশের প্রাচীন প্রাসাদ এখনও এভোরা সহরে বিদ্যমান। এই বংশের নাম ভারতবর্ষের ইতিহাসেও একেবারে অজ্ঞাত নহে। ফ্রান্সিসকো দা তাভোরা আলবুকার্কের অধীনে কার্য্য করিয়াছেন। রুই লরেন্সো দা তাভোরা ১৬০৯ হইতে ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পর্ত্তুগীজ-ভারতের গভর্নর ছিলেন। ১৬৮১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত আর এক ফ্রান্সিসকো দা তাভোরা পর্ত্তুগীজ-ভারতের রাজ প্রতিনিধির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁহার সময়েই মারাঠা বীর শিবাজীর পুত্র শাম্ভাজী পর্ত্তুগীজ রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহাদিগকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। পম্বালের আমলে রাজদ্রোহের অভিযোগে যে তাভোরার ডিউকের শিরশ্ছেদ হইয়াছিল, তাঁহার সহিত আর্চ্চবিশপ মিগেলের কোন নিকট সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নহে।

 এখন দেখা যাউক দোম আন্তোনিয়োর গ্রন্থ কেমন করিয়া কি সূত্রে মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও ও জর্জ দা আপ্রোজেতন্তাসাওঁর মারফতে পর্ত্তুগালে পৌঁছিল। আসুম্পসাঁও ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ভাওয়াল পরগনার নাগরীর সত্ত নিকোলাস তলেন্তিনো মিশনের পরিচালক ছিলেন। প্রচলিত প্রবাদ এবং ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে ফাদার আম্ব্রোসিয়ো দে সন্ত আগুস্তিনো-লিখিত বিবরণ বিশ্বাস করিলে দোম আন্তোনিয়োই এই মিশনের প্রতিষ্ঠাতা। ফাদার আম্ব্রোসিয়ো ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে ভাওয়ালে প্রচারকার্য্য আরম্ভ করেন। সেই সময়ে তিনি দোম আন্তোনিয়োর পুথি দেখিয়াছিলেন। যিশনের একজন পাদ্রী ব্রাহ্মণদিগের সহিত বিচার করিবার অভিপ্রায়ে এই পুথির পর্ত্তুগীজ অনুবাদ করিয়াছিলেন। মানুয়েল কবে নাগরীতে আসেন তাহা জানা না থাকায় তিনিই ফাদার আম্ব্রোসিয়োর পত্রে উল্লিখিত ধর্ম্মযাজক কিনা বলা যাইতেছে না। কিন্তু ইহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে যে নাগরীর মিশন-কেন্দ্রে দোম আন্তোনিয়োর পুথির বহুল ব্যবহার ছিল এবং অন্যান্য খ্রীষ্টান প্রচারকদিগের কার্য্যে লাগিবে বলিয়া তিনি জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাওঁর মারফতে উহা পর্ত্তুগালে মুদ্রণের অভিপ্রায়ে পাঠাইয়া থাকিবেন। যে কোন কারণে হউক জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁও এক সঙ্গে তিনখানি বাঙ্গালা বই ছাপিবার ব্যবস্থা করিতে পারেন নাই। মানুয়েলের বই দুইখানির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইবার আট বৎসর পরে ছাপা হইয়াছে[৫] আর আন্তোনিয়োর পুস্তক অমুদ্রিতই রহিয়া গিয়াছে। এই জন্যই আমরা ফাদার আম্ব্রোসিয়োর পত্রে অথবা অন্য কোথাও দোম আন্তোনিয়োর মুদ্রিত পুস্তকের খোঁজ পাইতেছি না।

 দোম আন্তোনিয়ো কে? পৃথির শিরোনামায় তাঁহার পরিচয় দেওয়া আছে,— “filho do Rey de Busna”—বুসনার (ভূষণার) রাজার পুত্র এবং “grande chathequista”— প্রসিদ্ধ খ্রীষ্ট-শাস্ত্রজ্ঞ। আরও লেখা আছে “que converteo tantos gentios”—যিনি বহু হিন্দুকে খ্রীষ্টান করিয়াছেন। ভূষণার রাজা হিন্দু; তাঁহার পুত্র কি করিয়া খ্রীষ্টানদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করিলেন? হিন্দুদিগকে ধর্ম্মান্তর-গ্রহণ করাইতেই বা তিনি উদ্যোগী হইলেন কেন? আগুন্তিনীয় সন্ন্যাসি-সঙ্ঘের গোয়া-কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ফাদার ফ্রেই আম্বোসিয়ো দে সন্ত অগস্তিনো ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের ২৫এ নভেম্বর গোয়ার রাজপ্রতিনিধির নিকট সন্ত নিকোলাস তলেন্তিনো মিশনের যে সুদীর্ঘ বিবরণ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতে এই সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে। (এই পত্র গোয়ার সরকারী দপ্তরের Monçoes do Reino No. 125-A 1704-1751 fol. 397তে আছে। কুহ্না রিভারা-সম্পাদিত 0 Chronista de Tissuary নামক মাসিক পত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে মূল পর্ত্তুগীজ পত্র মুদ্রিত হইয়াছিল। ফাদার হস্টেনের প্রবন্ধে এই পত্রের কিয়দংশ ইংরাজীতে অনুদিত হইয়াছে। Bengal Past and Present, Vol. IX, pp. 44-45 দ্রষ্টব্য।) এই বিবরণে এত অলৌকিক কাহিনীর সমাবেশ হইয়াছে যে ডাক্তার সুশীলকুমার দে দোম আন্তোনিয়োকে semilegendary figure বলিতে ইতস্ততঃ করেন নাই।

 ফাদার আম্ব্রোসিয়োর বিবরণের আক্ষরিক অনুবাদ করিবার প্রয়োজন নাই। তিনি লিখিয়াছেন,—“সন্ত নিকোলাস তলেন্তিনো মিশনের খ্রীষ্টানেরা সকলেই কৃষিজীবী। পর্ত্তুগীজ ভাষা তাহাদের একেবারেই বোধগম্য হয় না। তাহারা স্বাধীন কৃষক, তাহাদের বাপপিতামহ কেহই কখনও গোলাম ছিল না। ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে মগেরা ভূষণার রাজার একটি ছেলেকে আরাকানে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল। ফাদার মানুয়েল দো রোজারিও নামক একজন আগুস্তিনীয় যাজক তাহাকে টাকা দিয়া উদ্ধার করেন এবং ধর্ম্মশাস্ত্র পড়াইতে থাকেন। রাজপুত্র পরিশ্রম-সহকারে শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু পৌত্তলিক ধর্ম্মে তাঁহার এমনই অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে ভগবানের ইঙ্গিত ব্যতিরেকে তিনি স্বকীয় ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া খ্রীষ্টান হইতে সম্মত হইলেন না। একদিন রাত্রিতে সন্ত আন্তোনিয়ো স্বপ্নে দেখা দিয়া রাজপুত্রকে জানাইলেন যে তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন ইহাই ভগবদিচ্ছা। রাজপুত্র তাঁহার নিকট নিদর্শন চাহিলে সন্ত আন্তোনিয়ো তাঁহার গণ্ডদেশে ক্রশ-চিহ্ন অঙ্কিত করিয়া দেন। তাঁহার মৃত্যু পর্যন্ত এই চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। পর দিন তিনি পাদ্রীকে সন্ত আন্তোনিয়োর প্রদত্ত চিহ্ন দেখাইয়া দীক্ষা (Baptism) চাহিলেন। দীক্ষার পরে এই অলৌকিক ঘটনার স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য তাঁহার নাম হইল আন্তোনিয়ো। রাজপুত্র বলিয়া আমরা তাঁহাকে দোম আন্তোনিয়ো দো রোজারিয়ো বলিয়া থাকি।” (পর্ত্তুগীজ Dom দোম ইংরাজী Lord লর্ডের মত আভিজাত্য-সূচক শব্দ।)

 দীক্ষার পর দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিয়া নবধর্ম্ম-প্রচারের অদম্য প্রেরণা লইয়া দোম আন্তোনিয়ো স্বদেশে ফিরিলেন। বাঙ্গালায় প্রত্যাবর্ত্তনের পর তাঁহার প্রথম কাজ মাতৃভাষায় একখানি গ্রন্থ-রচনা। উদ্দেশ্য, জনৈক ব্রাহ্মণ ও খ্রীষ্টানের বাদ-বিতর্ক উপলক্ষ করিয়া হিন্দুধর্ম্মের ভ্রান্তি ও খ্রীষ্টানধর্ম্মের সারসত্য প্রতিপাদন। মিশনের একজন পাদ্রী পরে এই বাঙ্গালা পুথি নকল করিয়াছিলেন। তিনি যে নিছক কৌতূহলের বশবর্ত্তী হইয়া আন্তোনিয়োর পুস্তক নকল করিতে বসিয়াছিলেন এমন মনে হয় না; বইখানিতে কুশাগ্রবুদ্ধি ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণের কূটতর্কের উত্তর দিবার প্রচুর উপাদান আছে। অন্ততঃ পাদ্রীরা তাহাই বিশ্বাস করিতেন। পাদ্রীসাহেব দুই কলমে আন্তোনিয়োর পুথি নকল করিয়াছিলেন—এক দিকে বাঙ্গালা অক্ষরে আর একদিকে পর্ত্তুগীজ হরফে মূল বাঙ্গালা হুবহু নকল করিয়া তিনি নীচে পর্ত্তুগীজ অনুবাদ যোগ করিয়া দিয়াছিলেন। পত্নী, পিতৃব্য-পত্নী[৬] ও কয়েকজন আত্মীয়কুটুম্বকে খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষা দিয়া আন্তোনিয়ো তাঁহার প্রচার-কার্য্য আরম্ভ করিলেন। এইরূপে সন্ত নিকোলাস তলেন্তিনো মিশনের সূত্রপাত হইল। ইহার পর আন্তোনিয়ো প্রকাশ্যভাবে হিন্দুধর্ম্মের বিরুদ্ধে সমালোচনা আরম্ভ করিলেন। ব্রাহ্মণদিগের সহিত প্রায়ই তাঁহার বাদবিতণ্ডা হইতে লাগিল। ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণেরা নাকি কুহক-প্রভাবে তাঁহার প্রাণনাশের প্রয়াস পাইয়াছিল। কেবল ভগবানের একান্ত অনুগ্রহেই তাহাদের সে কুঅভিসন্ধি সফল হয় নাই। একদিন ব্রাহ্মণেরা বলিলেন যে অগ্নিদিব্যের সাহায্যে তাঁহাদের তর্কের মীমাংসা হইবে। ফলে আন্তোনিয়োই জয়লাভ করিলেন। ব্রাহ্মণদিগের শাস্ত্রগ্রন্থ আগুনে পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, কিন্তু বাইবেলে আগুনের স্পর্শও লাগিল না। ইহার পর হিন্দুদিগের ত কথাই নাই, অনেক মুসলমানও খ্রীষ্টানধর্ম্ম গ্রহণ করিলেন। ইতিপূর্ব্বে কোন মুসলমান খ্রীষ্টান হয় নাই। কিন্তু ব্রাহ্মণদিগের অন্ধ বিশ্বাস কিছুতেই শিথিল হইল না। তাঁহাদিগকে পৌত্তলিকতা ও জাত্যভিমান হইতে উদ্ধার করা মানুষের অসাধ্য। কয়েক বৎসর ধর্ম্ম প্রচার করিবার পর দোম আন্তোনিয়ো পরলোক গমন করেন। তাঁহার জন্ম বা মৃত্যুর সন-তারিখ ফাদার আম্ব্রোসিয়োর জানা ছিল না। খ্রীষ্টান ধর্ম্মযাজকেরা অনেক দিন পর্য্যস্ত আন্তোনিয়োর পিতার জমিদারির মধ্যে কোষাভাঙ্গা নামক স্থানে ছিলেন। কোষাভাঙ্গা ঢাকা ও হুগলীর মধ্যে অবস্থিত। এইখানেই সন্ত নিকোলাস ভলেন্তিনো মিশনের আরম্ভ হয়। পরে এখানকার খ্রীষ্টানদিগের উপর নানা প্রকারের উপদ্রব হওয়ায় ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে ফাদার লুইস দোস আঞ্জোস (Luis dos Anjos) ভাওয়াল পরগনার নাগরী গ্রাম খরিদ করিয়া সেখানে মিশনের কেন্দ্র স্থানান্তরিত করেন।

 দোম আন্তোনিয়োর পিতৃদত্ত নাম জানিবার উপায় নাই। তাঁহার বংশ-পরিচয় বাহির করাও সহজ নহে। ইসলাম খাঁ যখন বাঙ্গালার শাসনকর্ত্তা তখন সত্রাজিত বা শাহজাদা রায় ভূষণার রাজা ছিলেন। ১৬৩৬ সালে তিনি ঢাকায় নিহত হন। তাঁহার মৃত্যুর পর সংগ্রামসিংহ বা সংগ্রাম শাহ ভূষণার জায়গীর প্রাপ্ত হন। সংগ্রামসিংহ মগের উপদ্রব নিবারণ করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্রের নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হইলে ভূষণার জায়গীর খাস হয়। পরে প্রসিদ্ধ রাজা সীতারাম রায় ভূষণার জমিদারি পাইয়াছিলেন। (সতীশচন্দ্র মিত্র-কৃত যশোহর-খুলনার ইতিহাস দ্রষ্টব্য।) সংগ্রামসিংহ যাঙ্গালী নহেন তিনি বাহুবলে বৈদ্য হইয়াছিলেন। ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে সত্রাজিত রায় এবং সংগ্রামসিংহের বংশের লোকেরা ভূষণার রাজবংশীয় বলিয়া দাবী করিতে পারিত। দোম আন্তোনিয়ো সত্রাজিতের রাজ-উপাধির উত্তরাধিকারী অথবা সংগ্রাম শাহের পরিবারের লোক-হিসাবে ভূষণার রাজপুত্র বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলেন তাহা এখন অনুমান করা অসম্ভব। সংগ্রামসিংহের বংশ-লোপ ও রাজা সীতারামের অভ্যুদয়ের মধ্যকালে ভূষণার কোন রাজার সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। তবে ফাদার আম্ব্রোসিয়ো Ficarão os pp Reytores muitos annos em Coxabanga, terras do Rey de Busna, entre Dacca e Ugullim, onde teve principio esta missão (ভূষণার রাজার জমিদারি কোষাভাঙ্গায় মিশনের পরিচালক পাদ্রীগণ অনেক বৎসর ছিলেন। এই স্থান ঢাকা ও হুগলীর মধ্যে অবস্থিত এবং এখানে মিশনের আরম্ভ হয়) লিখিলেন কেন? তবে কি পূর্ব্বোক্ত দুই পরিবার ব্যতীত অন্য কোন জমিদার-বংশও ভূষণার রাজ-উপাধি দাবী করিতেন? এ বিষয়ে অধিক জল্পনা-কল্পনা করিয়া লাভ নাই।

 থিরসো লোপেসের তালিকার এক নম্বর গ্রন্থ সত্য সত্যই দোম আন্তোনিয়ো লিখিয়াছিলেন কিনা, ফাদার হস্টেন তৎসম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে ফাদার আম্ব্রোসিয়োর বিবরণে আন্তোনিয়োকে যেরূপ ধার্ম্মিক ও সাধু বলিয়া চিত্রিত করা হইয়াছে, প্রকৃত পক্ষে তিনি সেরূপ সচ্চরিত্র ছিলেন না। সমসাময়িক জীশুট যাজকদিগের চিঠিপত্রে তাঁহার বিরুদ্ধে অনেক কথা আছে। ১৬৮৩ সালের ৩রা জানুয়ারী যীশুট যাজক ফাদার মারকোস আন্তোনিয়ো সান্তুচি গোয়া-কেন্দ্রের যীশুট প্রধানের নিকট লিখিয়াছেন যে, ফাদারেরা তাঁহাদের কর্ত্তব্যে ত্রুটি করেন নাই, তাঁহারা ভাষা শিক্ষা করিয়া শব্দকোষ, ব্যাকরণ, confessionary ও প্রার্থনামালা রচনা করিয়াছেন ও খ্রীষ্টধর্ম্মতত্ত্ব ((doctrines) অনুবাদ করিয়াছেন, পূর্ব্বে ইহার কিছুই ছিল না। সান্তুচির এই উক্তির উপর নির্ভর করিয়া ফাদার হস্টেন ইঙ্গিত করিয়াছেন যে হয়ত যীশুট যাজকগণের রচিত গ্রন্থই পরবর্ত্তী কালে দোম আন্তোনিয়োর নামে প্রচারিত হইয়াছে। ফাদার আম্ব্রোসিয়ো আন্তোনিয়োর মৃত্যুর ৩০।৩৫ বৎসর পরে ভাওয়ালে আসিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে আন্তোনিয়োর রায়তেরা তাঁহার সম্বন্ধে বহু কিম্বদন্তী রচনা করিয়াছিল এবং আগুস্তিনীয় সন্ন্যাসি সঙ্ঘের পরিচালক তাহাই অবিচারে গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই ইঙ্গিত বিচারসহ নহে।

 প্রথমতঃ ভাওয়ালের খ্রীষ্টান কৃষকেরা যে দোম আন্তোনিয়োর রায়ত ছিল তাহার কোন প্রমাণ নাই! ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে লুইস দোস আঞ্জোস নাগরী খরিদ করেন, তৎপূর্ব্বে মিশনের কেন্দ্র ছিল ভূষণার অন্তঃপাতী কোষাভাঙ্গায়।[৭] হয়ত নাগরী গ্রামের সহিত আন্তোনিয়োর আদৌ পরিচয়ই ছিল না। তবে মিশনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তাঁহাকে ভাওয়ালের খ্রীষ্টানেরা হয়ত ভক্তি-শ্রদ্ধা করিত। দ্বিতীয়তঃ ১৬৮৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব্বে যে আর কখনও খ্রীষ্টধর্ম্মের সার তত্ত্বগুলি বাঙ্গালা ভাষায় লিপিবদ্ধ হয় নাই, এ কথা সত্য নহে। ১৫০৯ সালে দোমিনিক সোসা নামক আর একজন যীশুট যাজক বাঙ্গালা ভাষায় এই প্রকারের গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। (Sosa endeavoured to learn the Bengalan Language and translated into it a tracte of Christian Religion in which were confuted the Gentile and Mahumetan errours: to which was added a short Catechisme by way of Dialogue, which the children frequenting the Schoole learned by heart.” Purchas His Pilgrimes, Vol. x, p. 205) ফাদার সোসাও যীশুট সম্প্রদায়ের লোক। শব্দকোষ বা ব্যাকরণ রচনা না করিলেও তিনি খ্রীষ্টধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় যে পুস্তিকা অনুবাদ করিয়াছিলেন তাহার মধ্যে Catechism বা ধর্ম্মতত্ত্ব ছিল। অথচ ৮০ বৎসর পরে তাঁহার স্বসম্প্রদায়ের আর একজন বিজ্ঞ যাজক এই পুস্তকের কথা মোটেই জানিতেন না। দেখা যাইতেছে যে ১৫৯৯ হইতে ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধিক খ্রীষ্টান প্রচারক এই জাতীয় পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। যীশুট সম্প্রদায়ের যাজকেরা হয়ত আগুস্তিনের সম্প্রদায়-ভুক্ত আন্তোনিয়োর গ্রন্থের কথা জানিতেন না অথবা ঐ গ্রন্থ তাঁহাদের মনঃপূত হয় নাই, তাই তাঁহাদের চিঠিপত্রে আস্তোনিয়োর পুথির উল্লেখ নাই। এ বিষয়ে ফাদার আম্ব্রোসিয়োর বিবরণে সংশয়ের অবকাশ খুবই কম। ভূষণা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সমৃদ্ধ স্থান বলিয়া পরিচিত ছিল। বাঙ্গালা দেশে তখন প্রায় সর্ব্বদাই মগের উৎপাত হইত। ভূষণা যে তাহাদের উপদ্রব হইতে অব্যাহতি পায় নাই, তাহার প্রমাণ মুসলমান ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। ১৬৬৩-৬৪ সালেও ভূষণার লোকেরা মগের অত্যাচারে উদ্বাস্তু হইয়াছিল। মগ ও ফিরিঙ্গিরা আক্রান্ত স্থানের লোকদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়া বিক্রয় করিত। সুতরাং ভূষণার জমিদার-পুত্রের ১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে তাহাদের হাতে বন্দী হওয়া মোটেই অসম্ভব নহে। আম্ব্রোসিয়োর বিবরণে দুইটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে। সেকালে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের খ্রীষ্টানেরা অলৌকিকে অবিশ্বাস করিতেন না। সুতরাং এই দুইটি ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন বলিয়া ফাদার আম্ব্রোসিয়োর বিবরণের সকল কথাই অবিশ্বাস্য বলিয়া অগ্রাহ্য করা সঙ্গত হইবে না। তিনি দোম আন্তোনিয়োর পুথি-সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহাতে ঐ পুথি ভাওয়াল অঞ্চলে আগুস্তিনীয় মিশনারীদিগের মধ্যে তৎকালে সুপরিচিত ছিল বলিয়াই মনে হয়। বিশেষতঃ এভোরার পুথির শিরোনামা ও প্রস্তাবনায় দোম আন্তোনিয়োর নাম গ্রন্থকার-হিসাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। সুতরাং মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও এবং জর্জ দ্য আপ্রেজেন্তাসাঁও ও আন্তোনিয়োকেই এই পুথির লেখক বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বৎসরের মধ্যেই যীশুট ফাদারদিগের বই আন্তোনিয়োর নামে চলিয়া গিয়াছে ইহা সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। বিশেষতঃ পুস্তকের ভাষা এবং বিষয়বস্তুর বিচার করিলেও গ্রন্থকার যে বাঙ্গালী ছিলেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। অতএব দেখা যাইতেছে যে, সে যুগের বাঙ্গালা গদ্য-লেখকদিগের মধ্যে একমাত্র দোম আন্তোনিয়ো রোজারিওই বাঙ্গালী এবং এভোরার পুথিই বাঙ্গালীর লেখা বাঙ্গালা গল্পের প্রাচীনতম নিদর্শন।[৮]

 এইবার এভোরার পুথির কথা আলোচনা করা যাক। ফুলস্ক্যাপের ৮ পেজী খাতায় দুই কলমে বইখানা লেখা, শিরোনামা ও প্রস্তাবনা ভিন্ন। এই দুইটি পৃষ্ঠা পর্ত্তুগীজ ভাষায় লেখা। প্রত্যেক পৃষ্ঠার বাম দিকে মূল বাঙ্গালা রোমান হরফে লেখা, আর ডান দিকে পর্ত্তুগীজ ভাষায় ঠিক অনুবাদ নহে, সার মর্ম্ম। সুতরাং ফাদার আন্তোনিয়ো ভাওয়ালের নাগরী পল্লীতে যে পুথি দেখিয়াছিলেন, সে পুথি এভোরায় যায় নাই। এভোরার পুথিতে বাঙ্গালা অক্ষর একেবারেই নাই। অথচ ফাদার আম্ব্রোসিয়ো বলিতেছেন যে নাগরীর পুথির এক দিকে বাঙ্গালা হরফে লেখা ছিল।

 এইবার এভোরার পুথিতে অনুসৃত অনুলিখন-প্রণালী-সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা প্রয়োজন। ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ এবং শব্দকোষের অনুলিখন-প্রণালীর সহিত এভোরার পুথির অনুলিখন-প্রণালীর বিশেষ অনৈক্য আছে বলিয়া মনে হয় না। অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তৎসম্পাদিত আসুম্পসাঁওর ব্যাকরণ ও শব্দকোষের প্রবেশিকায় বিশেষ পাণ্ডিত্য-সহকারে পর্ত্তুগীজ অক্ষরের উচ্চারণ-রীতি আলোচনা করিয়া রোমান হরফের সাহায্যে বাঙ্গালা শব্দ লিখিবার নিয়ম পর্য্যালোচনা করিয়াছেন। তাঁহার মতে রোমান হরফে বাঙ্গালা লিখিবার সময় পর্ত্তুগীজ পাদ্রীরা একটি নির্দ্দিষ্ট নিয়ম মানিয়া চলিতেন। আজকাল যেমন নানারূপ সাঙ্কেতিক চিহ্ন-দ্বারা রোমান হরফের সাহায্যে প্রাচ্য ভাষা-সমূহের বিভিন্ন ধ্বনি নির্দ্দেশ করিবার নিয়ম বাহির হইয়াছে, সেকালে তাহা হয় নাই। তখন মাত্র অল্প কয়েকজন পাদ্রী নিজেদের প্রয়োজন- ও সুবিধা-অনুসারে প্রাদেশিক ভাষার চর্চ্চা করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে আবার দুই-তিনজন ব্যতীত আর কেহ আলোচ্য ভাষায় গ্রন্থ রচনা করিবার ক্লেশ স্বীকার করেন নাই। ইঁহারা অনুলিখনের সময় কোন বাঁধাধরা নিয়ম প্রতিপালন করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। অবশ্য ত্রস্ততার জন্য বানানের ব্যতিক্রম যে হয় নাই, তাহা বলা যায় না। প্রথম পৃষ্ঠার তৃতীয় রেখার bhoso (ভজো) এবং bhusi (ভজি) এই প্রকারের ব্যতিক্রম দৃষ্টি হয়। probe ও prubei (পৃঃ ৬), iccha এবং ichae প্রভৃতিতে লিখিবার তাড়াতাড়িতে বানানের পার্থক্য আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু “চ্ছ”-এর পরিবর্ত্তে ইচ্ছা লিখিতে এক জায়গায় ccha (পৃঃ ১১) আর এক জায়গায় chchaর (পৃঃ ১৫) ব্যবহার হইয়াছে অথচ উচ্ছেদ (used পৃঃ ৩৬) লেখা হইয়াছে s দিয়া। ইহার কোনও সঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ নহে। চাকরের (xacor পৃঃ ৪৪) আদ্য “চ”কার x দিয়া লেখা হইয়াছে অথচ চাও লিখিবার (chao পৃঃ ৮) সময় chর ব্যবহার হইয়াছে। এইরূপ বিচারে (bisare পৃঃ ১৭), অবিচার (obichar পৃঃ ৪) এবং অগোচর (ogoxor পৃঃ ৭) লিখিবার সময় একই ধ্বনি নির্দ্দেশ করিবার সময় বিভিন্ন বর্ণের ব্যবহার কেন হইল আপাতদৃষ্টিতে বুঝা যাইতেছে না। সেই (xei) ও সেইয়া (seia) লিখিবার সময় শব্দের একই আদ্যক্ষর অনুলিখনে কেন বিভিন্ন রোমান অক্ষরের ব্যবহার হইল, তাহাও বলা যাইতেছে না। সুতরাং পাদ্রী সাহেবেরা বাঙ্গালা অনুলিখনের জন্য যে কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়ম স্থির করিয়া লইয়া ছিলেন, এমন মনে হয় না। তবে যে ভাবে তাঁহারা রোমান হরফে বাঙ্গালা লিখিতেন, তাহা পড়িতে সকল সময় বিশেষ কষ্ট হয় না। এভোরার পুথিতে বিভিন্ন স্থানে, শ, স, ষ, চ, ছ এবং য-এর পরিবর্তে x ব্যবহৃত হইয়াছে:

চাকর = xucor, পৃঃ ৪৪
ছিষ্টি = xistti পৃঃ ২২
ছোটো = xotto পৃঃ ৩৮
মছ্যো = moxiu পূঃ ১৮
মুনিষ্যো = munixio পৃঃ ৯
য়ুত = xut পৃঃ ১১
শোলোকে = xoluque পৃঃ ৪
শরীরে =xorire পৃঃ ৪
সুরাপান = xurapanপৃঃ ৪

এইরূপ বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন ধ্বনি একই অক্ষর দ্বারা সূচিত হইয়াছে আবার একই ধ্বনিনির্দ্দেশের জন্য বিভিন্ন অক্ষরের যথেচ্ছ ব্যবহার হইয়াছে। অধিক দৃষ্টান্ত দেওয়া নিষ্প্রয়োজন মনে করি।[৯]

 দোম আন্তোনিয়ো তাঁহার পুথি বাঙ্গালা অক্ষরে লিখিয়াছিলেন। পাদ্রী সাহেবেরা নিজেদের সুবিধার জন্য রোমান হরফে তাহা নকল করেন। আমি আবার রোমান হরফে লেখা বাঙ্গালা শব্দগুলিকে বঙ্গাক্ষরে লিখিবার প্রয়াস পাইয়াছি। এই ভাবে তিন নকলে আসল যে অনেক সময় নষ্ট হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রথমতঃ পাদ্রী সাহেবেরা কথ্য ভাষার উচ্চারণ ঠিক রাখিতে যাইয়া মূল পুস্তকের পাঠ বিকৃত করিয়া থাকিবেন। প্রুব, প্রছাত, নীলা, কেমতে প্রভৃতি ইহার উদাহরণ। ২৪ পৃষ্ঠায় bubon বুবন ও ২৮ পৃষ্ঠায় bhubone দেখিয়াও ইহাই মনে হয় যে অনুলিখনের সময় এক জায়গায় সাধুভাষার বানান রক্ষিত হইয়াছে, অপর জায়গায় অভ্যাসমত প্রচলিত উচ্চারণ-অনুসারে বানান করা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ, পাদ্রী সাহেবেরা স্থানে স্থানে দুই-একটি শব্দ ঠিকভাবে না পড়িতে পারিয়া এমন ভাবে বিকৃত করিয়া ফেলিয়াছেন যে এখন আর তাহার প্রকৃত পাঠোদ্ধার সম্ভব নহে; যথা—৪ পৃষ্ঠায় purazhinio, ৬৫ পৃষ্ঠায় bodotarzier এবং ৫২, ৭৩, ২৭৪ পৃষ্ঠায় biate ও beati। একটি সংস্কৃত শ্লোক অনুলিখনের দোষে একেবারে অবোধ্য অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে। এই শ্লোকের পাঠ হয়ত পণ্ডিত ব্যক্তিরা চেষ্টা করিলে উদ্ধার করিতে পারিবেন কিন্তু আমি ইহার অধিকাংশ শব্দেরই প্রকৃত রূপ অনুমান করিতে পারি নাই এবং একটি চরণও শুদ্ধভাবে লেখা সম্ভব হয় নাই। যাঁহারা রোমান হরফে পুথি নকল করিয়াছিলেন তাঁহারা পূর্ব্ববঙ্গের ভাষা ও উচ্চারণের সহিতই সমধিক পরিচিত ছিলেন। আমি পূর্ব্ববঙ্গবাসী। কিন্তু একালে সাধুভাষা লেখাই আমাদের অভ্যাস। সুতরাং রোমান হরফ বঙ্গাক্ষরে রূপান্তরিত করিতে যাইয়া আমারও নানা যায়গায় দোষ ত্রুটি হইয়াছে। guia অনুলিখনের কালে যে gu-র স্থানে গ লিখিতে হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু aguia ও guian-এর বেলায় কি করিব? আজ্ঞা ও জ্ঞান শুদ্ধরূপ, পূর্ব্ববঙ্গে আইগ্যা ও গেয়ান উচ্চারণ প্রচলিত। অনুলিখনের সময় কোথাও আজ্ঞা কোথাও আগ্যা লিখিয়াছি, ছাপিবার সময় এই অনৈক্য চক্ষু এড়াইয়া গিয়াছে। আজকাল আমরা দয়া, উভয়ে, ছাওয়াল এরূপ লিখিয়া থাকি; কিন্তু প্রাচীন পুথিতে উভএ, ছাওাল প্রভৃতি পাঠ দৃষ্ট হয়। পাদ্রী সাহেবেরা doea, saoal প্রভৃতি লিখিবার সময় ঐ নিয়মই অনুসরণ করিয়াছেন। বায়ু কোথাও bau কোথাও বা baeu লিখিয়াছেন। এ সকল স্থানে নির্দ্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে আমার দএয়া, ছাওআল, বাউ অথবা বাএউ লেখা উচিত ছিল অনবধানতা বশতঃ সর্ব্বত্র এই নিয়ম পালন করিতে না পারায় ব্যতিক্রমের অপরাধ হইয়াছে। কিন্তু রোমান হরফে লেখা পুথি যথাসাধ্য অবিকল মুদ্রিত করিবার চেষ্টা পাইয়াছি বলিয়া আমার এই সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য সুধীজনের কোন অসুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং এই প্রকার অসঙ্গতির বিস্তৃত তালিকা দিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না। কিন্তু পণ্ডিতগণের বিবেচনার জন্য একটি বিষয় এইখানে উল্লেখ করা দরকার মনে করি। পর্ত্তুগীজ ভাষায় h-এর উচ্চারণ নাই, পূর্ব্ববঙ্গেও হকারের উচ্চারণ অনেকটা লুপ্ত অকারের মত। বর্ত্তমান পুস্তষ্কের ৪২ পৃষ্ঠায় প্রয়োজন লিখিতে এইরূপ অনুচ্চারিত h-এর ব্যবহার (prohojon) দৃষ্ট হয়। কিন্তু অন্যত্র tahar, ehare, cohibo, tahan, hoe, hoste প্রভৃতি শব্দে হকারের উচ্চারণ থাকিবে কিনা তাহা বিবেচনার বিষয়। যদি পূর্ব্ববঙ্গের কথিত ভাষার উচ্চারণ অনুসরণ করা হয় তবে ehare, cohibo, hoe প্রভৃতি শব্দে লুপ্ত হকার ব্যবহার করা যাইতে পারে। Hironio, tahar, tahan, hoste প্রভৃতি শব্দে হকারের উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রাখিতে হয়। সুনীতিবাবু habilaxকে অভিলাষ উচ্চারণ করিতে চাহেন। এখানে বোধ হয় পাদ্রী সাহেবেরা মূল সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ অবিকৃত রাখেন নাই, কারণ পূর্ব্ববঙ্গের অশিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমানদিগের মুখে এখনও “হাবিলাস” উচ্চারণ শুনিতে পাওয়া যায়। আমার মনে হয় যে, স্থানে স্থানে সামান্য গ্রাম্যতা দোষ দেখা গেলেও দোম আন্তোনিয়ো কথিত ভাষায় পুথি লেখেন নাই। কথিত ভাষায় কেহ “বরুণের ব্রেক্ষ” বলে না। সুতরাং পর্ত্তুগীজ উচ্চারণ-রীতি-অনুসারে বাঙ্গালা অনুলিখনের কালে হকারের লোপ করা সঙ্গত বোধ করি নাই। প্রিয়রঞ্জনবাবু কোন কোন স্থানে শব্দের অন্তে অবস্থিত e-র পরিবর্ত্তে “ই” লিখিয়াছেন, যেমন Bodboe বদবোই=খারাপ গন্ধ। কিন্তু আলোচ্য পুথিতে e-র পরিবর্ত্তে এ লেখাই সঙ্গত মনে করিয়াছি, যথা tobe=তবে, hoste=হস্তে, hoite = হইতে, ze=যে, quemote= কেমতে। বদবই না লিখিয়া “বদবএ”(=বদবয়) লিখিলে পূর্ব্ববঙ্গের উচ্চারণ ঠিক থাকিত। মুসলমান কৃষকদিগের মুখে ঐ কথাটি এখনও শুনা যায়। সুনীতিবাবু আসুম্পসাঁওর পুস্তকে ফ-র পরিবর্ত্তে f-এর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পান নাই। এভোরার পুথিতে কিন্তু feliben, fonate প্রভৃতি পাঠ আছে, আবার staphona-ও আছে। সুনীতিবাবু বলেন যে কোঁকনী ও মারাঠী ভাষায় ঋ-র উচ্চারণ বাঙ্গালা উচ্চারণ হইতে পৃথক্‌। আমরা কর্তৃত্ব বলি, তাঁহারা বলেন কর্তূত। গোয়ার পাদ্রীরা রোমান হরফে কোঁকনী লিখিবার সময় cortut লিখিতেন, আসুম্পসাঁও এবং তাঁহার সহযোগীও বাঙ্গালা পুথি লিখিবার সময় সেই রীতিই অনুসরণ করিয়াছেন। এভোরার পুথিতেও cortut পাইতেছি। অথচ রূপ বা কৃপার বেলায় এই নিয়মের অন্যথা হইয়াছে। এই পুথিতে “ভ্রম”-এর পরিবর্ত্তে bhum কেন লেখা হইয়াছে বুঝা যায় না। এভোরার পুথিতেও “র” ও “ড়”-এর অনুলিখনে পার্থক্য নাই।

 দোম আন্তোনিয়োর ভাষা অত্যন্ত সরল। সপ্তদশ শতাব্দীতে লিখিত হইলেও তাঁহার গদ্য যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে লিখিত বাঙ্গালা গদ্য অপেক্ষা অধিক অবোধ্য নহে ইহাতে বিস্ময়ের কারণ নাই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁহারা বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্য সৃষ্টি করিতে উদ্যোগী হইয়াছিলেন তাঁহারা প্রায় সকলেই সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, অপর পক্ষে দোম আন্তোনিয়ো গুটিকয়েক সাধারণ শ্লোক জানিতেন মাত্র, কোন সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি পাঠ করিয়াছিলেন কিনা সন্দেহ। তখনকার দিনে জমিদারদিগের মধ্যে পারশী ভাষার পঠন-পাঠনই বেশী ছিল। প্রচলিত ভাষায়ও বহু পারশী শব্দ স্থায়ী ভাবে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকে পারশী শব্দের ব্যবহার অত্যক্ত অল্প। ৪৪ পৃষ্ঠায় “পাতিশা” ও “নফর”, ৫৭ পৃষ্ঠায় “হায়াত”, “হামেশা” ও “রাএ”, ৬৮ পৃষ্ঠায় “তাগাদ” ও ৭৫ পৃষ্ঠায় “বদরিয়া” ব্যতীত আর কোন পারশী শব্দ এই পুথির মুদ্রিত অংশে লক্ষ্য করি নাই। ৩ পৃষ্ঠায় “বেমতি” ও ৭২ পৃষ্ঠায় “বাকারে” সংস্কৃত শব্দের সহিত পারশী অভাবসূচক বে-শব্দের সংযোগের নিদর্শন। স্থানে স্থানে সামান্য পরিবর্ত্তন করিলেই দোম আন্তোনিয়োর গদ্য আধুনিক গদ্য বলিয়া চালান যাইতে পারে।

 দোম আন্তোনিয়োর গদ্যে স্বভাবতঃই পূর্ব্ববঙ্গের প্রচলিত কতকগুলি বাক্য ও পদ স্থান পাইয়াছে। আবার এমন কয়েকটি বাক্য পাওয়া যাইতেছে যাহার প্রয়োগ বহুকাল হয় লোপ পাইয়াছে, যথা, ৫৩ পৃষ্ঠায় “মলংধারী পানোপ শরীর”। “মর” অর্থে “নাশীন” (“নাশীন বট পত্রে বা কোথাএ ছিলো”, পৃঃ ৭৪) এবং “নাশী” (“গৃহস্তো বীর্য্যের শরীর নাশী” পৃঃ ৩৯) সচরাচর দেখা যায় না। ১৩ পৃষ্ঠায় “নাশিষ্ট” শব্দ পাওয়া যাইতেছে— “নাশিষ্টের কর্মো এই যে নাশ করে”। দাতা অর্থে “দাতক”, “সাধুজনোচিত” অর্থে “সাধুয়” এবং বিপরীত অর্থে “অসাধুয়”; যুক্তিযুক্ত এবং মূল কারণ অর্থে “কারণীয়”, মনুষ্যোচিত অর্থে “মুনিষিয়”, সর্ব্বজ্ঞ অর্থে “সর্ব্বজান” এবং ভুল বিচার অর্থে “গর্বোবিচার” প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ১৫ পৃষ্ঠায় “কোনমতে”র অর্থে “কিমতের ব্যবহার পাইতেছি। তুলনা করিবার সময়ে আমরা এখন “হইতে” শব্দের ব্যবহার করি, ৪৫ ও ৪৬ পৃষ্ঠায় “হইতের” পরিবর্ত্তে “করিতে” পাওয়া যায়; যথা—“তিনি কি প্রতিবীর রাজারে করিতেও অধোম”, “আর আর যতো অবোতার কহিয়াছো তাহারে করিতে কৃষ্ণো বিস্তর কার্য্যো করিয়াছেন অসম্ভব্য।” দুই-এক স্থানে কর্ত্তৃকারকে “তে” ও “এ”-র ব্যবহার দেখা যায়, যেমন ২৬ পৃষ্ঠায় “ভালো প্রথিবী কোথাএ ছিলো যে বরাহোতে উধার করিলেন?” ৩৫ পৃষ্ঠায়—“শিবে ও বাসে (ব্যাসে)ও দেখিয়াছে।” অপর পক্ষে “প্রথিবী তল যায়” (পৃঃ ২২), “যতো কথা কহো এ অলড়” (পৃঃ ২৮), “তোমার পরোমার্থে নি লএ এ বিচার” (পৃঃ ৫), “এখোন থাউক” (পৃঃ ২৭), “বিচারে যে ঠাওর হএ” (পৃঃ ৪৭) প্রভৃতি বাক্য পূর্ব্ববঙ্গের কথিত ভাষায় এখনও প্রচলিত। দোম আন্তোনিয়ো সেকালের রীতি অনুসারে দ্বিতীয়া বিভক্তিতে “কের” পরিবর্ত্তে সাধারণতঃ “রে”-র ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু দুই-এক জায়গায় ইহার অন্যথা হইয়াছে। ৬৩ পৃষ্ঠায় পরাৎপরেক”, ৬৫ পৃষ্ঠায় “জনেক” এবং ৬৭ পৃষ্ঠায় “ব্রমের্ক” পাইতেছি। এখনও পাবনা জেলার অনেক জায়গায় “আমাদিগকে” এবং “তাহাদিগকে” না বলিয়া “আমাদেক” ও “তাদেক” বলে। পুথির প্রথম পৃষ্ঠায় আমি শব্দের সম্বন্ধপদে বহুবচনে এক জায়গায় “আমারদিগের” স্থলে “আমারগোর” আছে। আসুম্পসাঁওর ব্যাকরণে আছে “আমারগো বা আমারদিগের”। কেরির ব্যাকরণে “আমারদিগের, আমারদের” পাই, “আমারগো” নাই। পূর্ব্ববঙ্গে কিন্তু এখনও “আমাগো”, “আমারগো”, “আমাগোর” প্রভৃতি প্রচলিত। আন্তোনিয়োর গ্রন্থ হইতে প্রমাণিত হইতেছে যে পূর্ব্ববঙ্গের ভাষায় বাঙ্গালার প্রাচীন রূপ এখনও কিয়ৎ পরিমাণে অব্যাহত আছে। এভোরার পুথিতে “যেখান হইতে” অর্থে “যেখানে থাকিয়া” (পৃঃ ৪৬), “তাহা হইতে” অর্থে “তাহাতে থাকিয়া” (পৃঃ ৩০), “তল হইতে” অর্থে “তলে থাকিয়া” (পৃঃ ১৮) এবং “লঙ্কা হইতে” অর্থে “লঙ্কাতে থাকিয়া” (পৃঃ ৩৭) পাইতেছি। ইহার সহিত পূর্ব্ববঙ্গের “যেথান থিকা”, “তাত্থিকা”, “তলেত্থিকা”, “লঙ্কাত্থিকা” তুলনীয়। ৪৪ পৃষ্ঠার “পুরোস্তাপ” এখনও কৃষকদিগের ভাষায় “প্রস্তাবে”র পরিবর্ত্তে ব্যবহৃত হয়। “আইয়ো”, “সেইয়া”, “চৌগুরা”, “অকুমারী”, “অনাশ্চর্য্য”, “দাবরাইয়া”, “দৈস্যো”, “ঠেক”, “পৃকৃতি”, “ক্রোদো” “যোথাএ”, “মঞ্চো” (মর্ত্ত্য অর্থে) “কেমতে”, ‘হেও’ (সেও অর্থে’) প্রভৃতি শব্দ এখনও পূর্ব্ববঙ্গে সচরাচর শ্রুত হয়।

 স্থানান্তরে বলিয়াছি যে এভোরার পুথিতে বাঙ্গালার পর্ত্তুগীজ অনুবাদ সর্ব্বদা মূলানুগত হয় নাই। ইহার প্রমাণস্বরূপ দুইটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিলেই চলিবে। প্রথম পৃষ্ঠায় ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিককে বলিতেছেন,— “ইহাতে তোমারদিগের শাস্ত্রে অপরিণাম নাহি?” পর্ত্তুগীজ অংশে লেখা আছে—logo & vossa lei não he bõa. অর্থাৎ তবে তোমাদিগের রীতি (বা শাস্ত্র) ভাল নহে। ৬৬ পৃষ্ঠায় ব্রাহ্মণ ক্যাথলিককে প্রশ্ন করিতেছেন,—“তোমারদিগের শাস্ত্রে নি কহো যে কলকীশো অবতার হইবে?” ক্যাথলিকের উত্তর,—“হত্র ক্রেপার শাস্ত্রে লিখিয়াছে।” ইহার পর্ত্তুগীজ অনুবাদে আছে—Sim, nos ta’be dissemos q ha de vir coloquixo a quem chamamos Antecrysto—হাঁ, আমরাও কহি যে কল্কীশো আসিবেন তাহাকে আমরা খ্রীষ্টবৈরী (Antichrist) কহিব। পাদ্রী আসুম্পসাঁও দোম আন্তোনিয়োর গ্রন্থের ভাবানুবাদ করিয়াছেন, মূলানুগত ভাষান্তর করেন নাই। সুতরাং যেখানে গ্রন্থের কোন শব্দের অর্থ-সম্বন্ধে আমাদের সংশয় উপস্থিত হয় সেখানে পর্ত্তুগীজ অনুবাদে প্রায়ই প্রকৃত প্রতিশব্দ খুজিয়া পাওয়া যায় না।

 দোম আন্তোনিয়ো হিন্দুধর্ম্মের অসারতা প্রতিপন্ন করিবার জন্য পুস্তক লিখিয়াছিলেন; কিন্তু হিন্দুধর্ম্মের প্রকৃত তত্ত্ব তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। বোধ হয় তাঁহার শাস্ত্রজ্ঞানও খুব গভীর ছিল না। তিনি প্রথম দশাবতারের কথা আলোচনা করিয়াছেন, তারপর কৃষ্ণের চরিত্রপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন। ইহার পরে আসিয়াছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের কথা, তারপর ক্ষীরোদশায়ী ভগবান্, আদ্যাশক্তি, মধুকৈটভ প্রভৃতির উপাখ্যান আলোচনা করিয়া তিনি তীর্থজলে স্নান প্রভৃতি নৈষ্ঠিক হিন্দুর আচরণীয় কর্ম্মের অযৌক্তিকতা প্রদর্শন করিয়াছেন। গ্রন্থের সমাপ্তি অত্যন্ত আকস্মিক। “আর তীর্থো কারে কহো তাহা বুঝাই” বলিয়া আর প্রসঙ্গান্তর উত্থাপন করা হয় নাই।

 দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকে গুটিকয়েক সুপরিচিত সংস্কৃত শ্লোক আছে। কিন্তু তাহার সংস্কৃতে বিশেষ দখল ছিল কিনা সন্দেহ। পৌরাণিক যে কাহিনীগুলি তিনি আলোচনা করিয়াছেন তাহা প্রায় সকল হিন্দুই জানে। “জানামি ধর্ম্মং”, মোহমুদ্গরের শ্লোক, “তেজীয়সাং ন দোষায়”, “বলিরে ছলিতে প্রভু হইলা বামন”, প্রভৃতি কথা জানিবার জন্য শাস্ত্রজ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পৌরাণিক উপাখ্যান বলিতে গিয়া তিনি যে সমস্ত ভুল করিয়াছেন তাহা হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইবে যে মহাকাব্য বা পুরাণ-গ্রন্থের সহিত প্রত্যক্ষ পরিচয় তাঁহার ছিল না।

 প্রথম বিষ্ণুর দশাবতারের কথা ধরা যাক। ভাগবতমতে অবতার অসংখ্য,— “অবতারাহসংখ্যেয়াঃ”। এক সময়ে ব্যাস, দত্তাত্রেয়, কৃষ্ণ বাসুদেব প্রভৃতি বিষ্ণুর অবতার বলিয়া পরিগণিত হইতেন। বোধ হয় জয়দেবের পরে বাঙ্গালা দেশে বিষ্ণুর অসংখ্য অবতারের মধ্যে মাত্র দশটি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেন। দোম আন্তোনিয়োও দশ অবতারের কথা বলিয়াছেন,—“কৃষ্ণ বাসুদেব অবতার নহেন— কারণ কৃষ্ণন্তু ভগবান্ স্বয়ম্। দোম আন্তোনিয়োর তালিকায় স্থান পাইয়াছেন—মৎস্য, কূর্ম্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন (দোম আন্তোনিয়োর মতে ব্রামণ), পরশুরাম, বলরাম, ক্বপ, শ্রীরামচন্দ্র ও কল্কী। সংখ্যা ঠিক আছে, কিন্তু জয়দেবের তালিকা ও দোম আন্তোনিয়োর তালিকায় এক জায়গায় প্রভেদ দৃষ্ট হয়। প্রচলিত তালিকায় আছে—

“মৎস্যঃ কূর্ম্মো বরাহশ্চ নৃসিংহো বামনস্তথা।
রামো রামশ্চ রামশ্চ বুদ্ধঃ কল্কী চ তে দশ॥”

বামন জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি যদি দোম আন্তোনিয়োর তালিকায় ব্রাহ্মণ বলিয়া উল্লিখিত হইয়া থাকেন তাহাতে মারাত্মক ভুল হয় নাই। কিন্তু আন্তোনিয়োর তালিকায় বুদ্ধের উল্লেখ নাই, উল্লেখ আছে কৃপের। সাধারণের বিশ্বাসমতে কৃপাচার্য্য অমর হইলেও শাস্ত্রমতে তিনি অবতারদিগের অন্যতম নহেন। তবে কূপের নাম কেমন করিয়া আন্তোনিয়োর তালিকায় আসিল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন নহে। “বনজৌ বনজৌ হ্রস্বঃ ত্রিরামাঃ সকৃপাকৃপৌ” বলিয়া দশাবতারের যে সংক্ষিপ্তপরিচয় দেওয়া হইয়াছে তাহা সম্ভবতঃ আন্তোনিয়োর জানা ছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে সাধারণ বাঙ্গালী বুদ্ধের কথা ভুলিয়া গিয়াছে। “সকৃপ” যে বুদ্ধ তাহা জানিবার ও বুঝিবার মত সংস্কৃত জ্ঞান আন্তোনিইয়োর ছিল না। কাজেই দশাবতার আলোচনা করিতে গিয়া তিনি বুদ্ধকে বাদ দিয়া কৃপের নাম করিয়াছেন। আন্তোনিয়ো বলিতেছেন,—শ্রীরাম ইন্দ্রজিৎকে বধ করিয়াছিলেন এবং লব ও কুশের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য এখানেও জনশ্রুতি তাঁহার একমাত্র অবলম্বন। ব্রহ্মার সেবক ব্রহ্মদৈত্য হইবে এবং শিবের ভক্তগণ ভূত-পিশাচ হইবে ইহা আন্তোনিয়ো কোথায় পাইয়াছিলেন, জানি না। “ঊষাহরণে বিষ্ণু কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধকে বাঁচাইলেন রাজার সবংশে বধ করিয়া,” এই হইল আন্তোনিয়োর উক্তি। এ স্থলে তিনি কৃষ্ণ ও বিষ্ণুকে পৃথক্ মনে করিয়াছেন। কৃষ্ণ ও প্রদ্যুম্ন বাণকে পরাজিত করিয়া অনিরুদ্ধকে উদ্ধার করিয়াছিলেন, এখানে বিষ্ণু আসিলেন কেমন করিয়া? শঙ্খাসুর ও শঙ্খচূড়ের কাহিনী আন্তোনিয়োর বিবরণে গুলাইয়া গিয়াছে। শঙ্খাসুরকে সফরীরূপী বিষ্ণু বধ করিয়াছিলেন, শঙ্খচূড়কে নিধন করিয়াছিলেন শিব। তুলসীর শাপে বিষ্ণু যক্ষ্মাগ্রস্ত হন নাই। দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গের পর পার্ব্বতী আসিয়া যুযুৎসু বিষ্ণু ও শিবের মধ্যে বিবসনা হইয়া দাঁড়াইলেন ইহাই বা কোন্ পুরাণে আছে? আন্তোনিয়ো কতকগুলি প্রচলিত পৌরাণিক উপাখ্যান লোকমুখে শুনিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার গ্রন্থে পৌরাণিক কাহিনী নির্ভুলভাবে বিবৃত হয় নাই। হিন্দুধর্ম্মের গভীর তত্ত্ব তিনি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই। “জানামি ধর্ম্মং” ইত্যাদি শ্লোকে যে কর্ত্তৃত্ববোধরহিত আত্মসমর্পণের অপূর্ব্ব ভাব প্রকাশিত হইয়াছে, তিনি সাধারণ খ্রীষ্টান প্রচারকের ন্যায় তাহার কদর্থ করিয়াছেন। তাঁহার ধারণা যে এই সকল পৌরাণিক কাহিনী ও দশাবতারের কথা বেদ হইতে গৃহীত। বৈদিক ধর্ম্ম তখন সাধারণে অপরিজ্ঞাত। সাধারণ লোকের মতই আন্তোনিয়ো বেদসম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ ছিলেন।

 ব্রাহ্মণের সহিত তর্কে আন্তোনিয়ো প্রথমতঃ সরল যুক্তিমার্গের আশ্রয় লইয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য এই যে যাহা অযৌক্তিক তাহা অগ্রাহ্য। পরমেশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্। তাঁহার ইচ্ছায় এবং বাক্যে সকলই সম্ভব। তিনি পশু এবং মনুষ্যদেহ ধারণ না করিয়াও পৃথিবী উদ্ধার, সাধুদিগের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতদিগকে বিনাশ করিতে পারেন। কিন্তু খ্রীষ্টানগণের বিশ্বাস যে ভগবান্ খ্রীষ্টরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন; এই জন্য আন্তোনিয়ো অবতারবাদ একেবারে অস্বীকার করিতে পারেন নাই। তিনি বলিতেছেন যে মর জীব ভগবান্ নহে, ভগবানের সৃষ্ট! ভগবান্ অবিনশ্বর। দেহধারী হইলে তাঁহার দেহেরও বিনাশ নাই। ক্বষ্ণের উপাখ্যান আলোচনা-কালে তিনি যুক্তিমার্গ পরিত্যাগ করিয়াছেন। কৃষ্ণ অনেক অসম্ভব কার্য্য করিয়াছেন। রোমান ক্যাথলিকেরাও miracles বা অলৌকিকে বিশ্বাস করেন। সুতরাং কৃষ্ণের অবতারত্ব অস্বীকার করিতে হইলে অন্য পন্থা অবলম্বন করিতে হয়। আস্তোনিয়ো বলিতেছেন যে সয়তানই কৃষ্ণের শরীরে প্রবেশ করিয়া এই সকল অলৌকিক কার্য্য করিয়াছে। হিন্দুধর্ম্মের ব্যাখ্যার একালের ও সেকালের খ্রীষ্টান প্রচারকগণের মধ্যে বিশেষ তারতম্য দেখা যায় না।

 হিন্দুধর্ম্ম-সম্বন্ধে আন্তোনিয়োর জ্ঞান যতই সঙ্কীর্ণ হউক না কেন, তাঁহার বিচারপ্রণালীতে যতই ত্রুটি থাকুক না কেন, বাঙ্গালীদিগের মধ্যে তিনিই প্রথম মাতৃভাষায় গদ্যগ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। মানুয়েল দা আসুম্পসাঁও ও জর্জ দা আপ্রেজেন্তাসাঁওর মত বিদেশী ধর্ম্মযাজকদিগের যত্নের ফলে সেই গ্রন্থ আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্ত্য দেশে রক্ষিত হইয়াছে। আবার ফাদার হস্টেন ও ফাদার লোপেসের অনুসন্ধিৎসার জন্যই বিস্মৃতির কবল হইতে বাঙ্গালী খ্রীষ্টান-রচিত এই সুপ্রাচীন বাঙ্গালা গ্রন্থখানির পুনরুদ্ধার হইয়াছে। এই জন্য বাঙ্গালী জাতি ক্যাথলিক যাজকদিগের নিকট চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকিবে।

BENGALI MANUSCRIPTS AT EVORA

(Reprinted from the Acharyya Sir P. C. Ray Commemoration Volume.)

 The little town of Evora lies on a low hill in the midst of a fertile valley seventy-five miles from Lisbon. In size and population it hardly bears any comparison even with our small countrytowns but it occupies a deservedly high place in the history of Portugal. The ruins of a Roman temple, popularly associated with the goddess Diana, testify to its great antiquity, and eighty years before the birth of Christ this obscure place formed the headquarters of Sertorious. In 712 Ebora, as it was then called, passed into the hands of the Moorish conquerors to witness four hundred and seventy years later a glorious triumph of the Christian arms. Here the great dramatist Gil Vicente, the greatest of his land, breathed his last and some of his “autos” or religious pieces were staged at Evora to divert his royal patron. In the 16th century Evora became the seat of an Archbishop and a University was founded in 1550. To-day Evora has hardly anything to boast of. The University is a thing of the past, the small museum attracts but few visitors, the cathedral is no more attended by the proud nobility, but the Public Library is rich in rare manuscripts and inquisitive students, though their number is necessarily limited, still make their pilgrimage to the capital of Alemtejo. Among its jealously guarded treasures are three Bengali manuscripts, two of which are unfortunately incomplete.

 That Bengali manuscripts should find their way to this far-off Portuguese town is no wonder, for Frei Manoel da Assumpção was a native of Evora, and we are indebted to him for a Bengali grammar in Portuguese and a Bengali prose dialogue with a Portuguese version of the original text. These are now fairly well known to students of Bengali language and literature. Crepar Xastrer Orthbhed or Compendio dos misterios de fee have been frequently referred to by many Bengali scholars and copious extracts from it as specimens of early Bengali prose, as it was written by a foreign student of the language, have been quoted by Prof. S. K. De in his Bengali Literature in the 19th Century and by Professors Suniti Kumar Chatterji and Priya Ranjan Sen in their edition of Manoel Da Assumpção’s grammar. There was a fairly large Christian community in the villages of Bhawal in the 17th century and it was urgently needed that missionaries well versed in the dialect of the district should minister to its spiritual needs. From a letter in the Cunha Rivara collection (Evora, Public Library) addressed by a Portuguese priest, Frei Alvaro da Costa, in 1682 to his friends at home, it appears that he found many Christians in Bengal, particularly in an island called Ramnacor (Ramnagar) but they had not seen a Padre for many years. Frei Manoel da Assumpção was Rector or Head of the Mission of the Saint Nicholas Tolentino in the province of Bengal in 1735 and things seem to have considerably improved in the meantime. It was for the benefit of the missionaries, who were expected to make new converts and to look after the moral and spiritual welfare of their flock that Frei Manoel compiled his grammar and vocabulary and the dialogue. Both of these works were dedicated to Dom Miguel de Tavora, Archbishop of Evora, and were printed simultaneously in 1743 at Lisbon by Francisco da Sylva, under the supervision of Frei George da Apresentação, who was probably an intimate friend and colleague of the author. The grammar and vocabulary seem to have received bnt scant attention at the time, for Diogo Barbosa Machado does not mention it in his Bibliotheca Lusitana published only nine years later. Nor does he give any detail about the life and occupation of Manoel da Assumpção that cannot be gleaned from his title page. Innocencio Francisco da Silva, who brought out his Diccionario Bibliographico Portuguez in 1840, refers to this omission on the part of Barbosa Machado but observes that the book had already become rare and he came across only one copy, that in Libraria de Jesus. Crepar Xastrer Orthbhed seems to have been more popular and went through two successive editions in 1836 and 1869. The second revised edition was printed at Serampore while the third edition wae published at Margão near Goa and copies of the first and the third editions are to be found in the Bibliotheca Nacional of Lisbon. The Calcutta copy unfortunately lacks the title page and the preface and I need not offer any apology for reproducing them here. The title runs as follows:

Crepar Xaxtrer Orth Bhed
Xixio Gurur Bichar

 Fr Monoel da Assumpcãm, Liqhiassen O buzhaiassen Bengallate Baoal dexe, xon hazar xat xohopointix bossor Christor zormo bade. Bhetton corilo boro thacurque D Fr Miguel de Trvora Evorar xohorer arcebispo.

 Lisboate Francisco da Sylvar xaze, Pataxaer quitaber xap sorinia xpor zormo bostore 1743.

Xocol uchiter hucume

 It will be perceived that Manoel da Assumpção and his printers had for obvious reasons to make use of Roman scripts. Probably the author thought that it would be too much to expect the new arrivals from his country to learn an unfamiliar script as well as a novel tongue. “Xocol uchiter hucume” seems to be the literal translation of “com todas as licencas necessarias,” not a happy rendering in any case. In the preface the Bengali reader is addressed as follows:

Bengallire Zanan
Poroho

 Doxto Bengali, Xono: Puthi xocoler utom puthi, Xaxtro xocoler utom xaxtro; Xaxtri xocoler utom xaxtri Christor Xaxtri, Crepar xaxtro ebong crepar xaxtrer puthi.

 Ehi puthite xon mondia paiba buzhon, buzhan, buzhibar, buzhaibar upae tribar. Axtar bedher ortho xono, xonao; porthoquie zania, buzho, buzhao porinamer ponth dhoro, dhorao; xixio Gurur niate niae corite xiqho, xiqhao; eha zania, buzhia, mania mucti hoibeq; dox agguia palon coro zodi.

 The Bibliotheca Publica of Evora possesses an incomplete manuscript of this work. The opening lines differ slightly form the opening lines of the published book and the last page concludes thus:

P. xorir zia utthon quemon buzho?
Z. Buzhi, ze xocol manux, bala ar bura zia uthibo moha proloyer din xorir, ar atua xomet bichar hoite.

 Of the grammar Evora possesses only a printed copy but on p. 141 of the above mentioned manuscript (CX VI1—1) we come across a fragment of a Dictionary which may be reasonably ascribed to Frei Manoel. Here he starts with an effort to supply the colloquial and polished Bengali as well as Hindusthani synonyms of Portuguese words. But after a few pages he gives up the attempt probably because the task was beyond his capacity. The Dictionary consists of 22 pages only, many of which are blank, and ends with the phrase “depois de amanha-calicarpor.” The third manuscript is luckily complete except for a few lacunae evidently caused by the depredations of worms. It was first noticed by Cunha Rivara in his descriptive catalogue of the manuscripts at Evora. We learn from the title page that the author was “that great Christian Cathecist who converted so many Hindus, called D. Antonio, son of the king of Busna.” Of Dom Antonio we know but little. He was taken captive to Arakan in 1663 and was subsequently ransomed by a Portuguese priest, Manoel do Rozario, who converted the Bengalee prince. When exactly this dialogue was written we do not precisely know but it can be safely surmised that this manuscript supplies specimens of the later seventeenth century Bengali prose. The language is naturally more chaste than that of Fr. Manoel da Assumpção and the best portion bears comparison with the less sanskritised portion of Mrityunjaya Tarkalankar’s Prabodh Chandrika. It also illustrates the persistency of some Eastern Bengal proverbs, phrases and expressions which still run current. The title page and the prologue are in the handwriting of Fr. George da Apresentação and the Protuguese version was made by the indefatigable head of the mission of St. Nicholas Tolentino. The translation is not literal but it gives the general sense fairly correctly. Probably when Frei Manoel da Assumpção sent his grammar and dialogue for publication at home he also forwarded the earlier work of Dom Antonio with the same intention, for we cannot otherwise explain his prologue. Dom Antonio does indeed make several references to Crepar Xaxtro but it does not follow that he alludes to the work of Frei Manoel, for mention of such a work is found in earlier Jesuit letters. Crepar Xastro or the Chirstian doctrine was probably known in an earlier Bengali version. As is apparent from the title, Dom Antonio’s avowed object was to demonstrate the falsehood of Hinduism and to establish the superiority as well as the infallibility of his own faith. His book, therefore, is written in the form of a dialogue between a Roman Catholic and a Brahman, and as it can be easily guessed the Roman Catholic had the best of the debate. The dialogue opens with an examination of the Hindu theory of predestination and then the ten incarnations of the Hindu mythology are discussed in detail. The Brahman next goes on to explain the Hindu trinity which is also rejected by the Christian. Finally some of the popular religious practices and rites are reviewed and the Brahman is converted to the views of the Roman Catholic. The dialogue ends rather abruptly.

 Dom Antonio had one advantage over the Portuguese missionaries. He was more familiar with the religious beliefs and superstitions of his countrymen than the foreign priests, and as Bengali was his mother-tongue he uses its idioms with greater success and more freedom than Frei Manoel. But at times Dom Antonio betrays the superficial nature of his acquaintance with the Puranas, for he includes Kripacharya, the Brahman warrior, among the ten incarnations of Vishnu and omits Buddha, the ninth on the popular list. Nor is his version of other Pauranik incidents free from inaccuracy. But we do not expect in this rare manuscript a reliable treatise on popular Hinduism; it is to be prized as the earliest known prose work in Bengali and as such is its value to be assessed.

 The prose of Dom Antonio is simple but it cannot be claimed that he always used the colloquial language of his time. Although the vulgar word is not systematically excluded, the author does not hesitate to use the more polished language which the learned alone would appreciate. It is not the place to discuss the method of transliteration, suffice it to note that the same word is sometimes differently reproduced in Roman script. The text covers 120 pages quarto of foolscap, in one column is reproduced the original text while the Protuguese version is written opposite. There are in the text several Sanskrit quotations, but the transliteration is in these cases so unsatisfactory that I have not been able to restore two of them.

 The major portion of the text was copied by me during my sojourn in Portugal. The text, as now published, will, I hope, be of some use to more serious students of Bengali language and literature.

 The Portuguese were responsible for many misdeeds in Bengal. They are remembered to-day as ruthless pirates. But they certainly deserve well of us for the valuable service their missionaries rendered by giving the much-needed impetus to the growth of prose literature in this province. Had Manoel da Assumpção nothing but his Grammar and Vocabulary to his credit he would still be entitled to our homage of gratitude, but he did something more. It was he and his friend George da Apresentação who were responsible for preserving the earliest known prose work of a native-born Bengalee and it was rescued from oblivion by a Portuguese scholar, the late Sr. J. H. da Cunha Rivara. Let us forget Gonzales and his ferocious marauders and cherish the memory of Manoel, George and their noble associates.

  1. মাসাদো এবং দা সিলভার অভিধানের যে যে খণ্ডে আলোচ্য গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের উল্লেখ আছে কেবল সেই সেই খণ্ড প্রকাশিত হইবার তারিখ প্রদত্ত হইল।
  2. এই দুইজন লেখকের গ্রন্থ দেখিবার সুযোগ না হওয়ায় তাঁহারা দোম আন্তোনিয়োর পুস্তকের কথা লিখিয়াছেন কিনা বলিতে পারিলাম না।
  3. তৃতীয় সংস্করণের বই গোয়ার জাতীয় পুস্তকালয়ে নাই। এই সংস্করণ ভারতবর্ষে এমন দুস্প্রাপ্য হইবে অনুমান করিতে পারি নাই, নতুবা ইহার ভূমিকা ও নামপত্রও নকল করিয়া আনিতাম।
  4. গুটিকয়েক দৃষ্টান্ত দিলেই চলিবে। অনুবাদকদ্বয়ের মতে Adar শব্দের বাঙ্গালা প্রতিশব্দ “ছিপে মাছ গাঁথা”, মানুয়েলের পর্ত্তুগীজ অনুবাদ Iscar do anzol। পাখী, মাছ প্রভৃতির খাদ্যকে পূর্ব্ববঙ্গে অনেক জায়গার পাখীর আধার, মাছের আধার বা আদার বলে। মাছ ধরিবার জন্ম বঁড়শিতে আধার গাঁথা হয়, সুতরাং মানুয়েলের অনুবাদ ভুল নহে। Aguiçha Baguicha, আগিচা বাগিচা, আগান বাগান প্রভৃতি সমার্থক শব্দ; প্রিয়রঞ্জনবাবু ও সুনীতিবাবুর অনুবাদে—“সময়, কাল, অথবা বাগান।” আগিচা বাগিচা কখনও সময় বা কাল অর্থে ব্যবহৃত হয় না। পর্ত্তুগীজে আছে Hora, ou quinta। Hora নিশ্চয়ই Horta-র লিপিকর অথবা মুদ্রাকর-প্রমাদ-জনিত বিকৃতি। Horta অর্থ Kitchen garden বা সব্জীবাগান। çhamchora ছোট বাদুর—কৃষ্ণবর্ণ পক্ষিবিশেষ নহে; পর্ত্তুগীজ Andorinha কেবল পক্ষী অর্থে ব্যবহৃত হয় না, মৎস্য ও উদ্ভিদ্‌ সম্বন্ধেও এই শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। চামচড়ার (পশ্চিম-বঙ্গের চামচিকা) বৈজ্ঞানিক নাম Cynopterus Marginatus। Buimali ভুঁইমালীকে যথার্থ প্রতিশব্দের অভাবে গর্ত্তিগীজ ভাষার cavador বলা যাইতে পারে কিন্তু বাঙ্গালার “মৃত্তিকাখনক” বলা চলে না। Urux (উরুস) উকুন নহে, ছারপোকা | Xans সাঁজ = বিকাল বেলা, দেরী নহে, পর্ত্তুগীজ অনুবাদ A tarde ঠিকই হইয়াছে। Zhiman ঝিমান শব্দের অর্থ প্রিয়রঞ্জনবাবু ও সুনীতিবাবুর মতে “ঝি ঝি ধরা, খিল ধরা”, “নিদ্রায় ঢুলিয়া পড়া” অর্থেই এই শব্দটি পূর্ব্ববঙ্গে ব্যবহৃত হয়, মানুয়েলের Adormecerও এই অর্থই সমর্থন করে। অলমতিবিস্তরেণ।
  5. “ক্রেপার শাস্ত্রের অর্থভেদ”-সম্বন্ধেই এই মন্তব্য প্রকৃত পক্ষে প্রযোজ্য, তবে অনুমান হয় যে ব্যাকরণ এবং শব্দকোষের পাণ্ডুলিপিও ঐ সময়েই প্রস্তুত হইয়া থাকিবে।
  6. tia, ইংরেজীর aunt-এর ন্যায় পিতৃস্বসা, মাতৃস্বসা এবং মাতুলানী অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
  7. কোষাভাঙ্গা কোথায় স্থির করিতে পারি নাই।
  8. কেহ কেহ শূন্য পুরাণের অংশবিশেষকে প্রাচীন গদ্য বলিয়া মনে করেন; কিন্তু শূন্য পুরাণে প্রকৃত গদ্য আছে বলিয়া মনে হয় না।
  9. এই পুথিতে উত্তম, তত্ত্ব প্রভৃতি শব্দের অনুলিখনে একটি মাত্র t-এর ব্যবহার দেখা যায়। ত-এর দ্বিত্ব কোথাও সূচিত হয় নাই।