ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস/পঞ্চম উপদেশ
পঞ্চম উপদেশ।
ঈশ্বরানুরাগ এবং বিষয়-বিরাগ।
ব্রহ্মেতে অনুরাগ ভিন্ন ব্রহ্মদর্শন নিষ্ফল। অনুরাগের আলোকে ঈশ্বর আমারদিগের নিকটে যদ্রূপ প্রকাশিত হয়েন, এমন আর কিছুতেই হন না। অনুরাগের এরূপ প্রভা যে যে জ্ঞান প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে, তাহা সমুজ্জ্বলিত হয়—যে সত্য ছায়ার ন্যায় মনে হয়, তাহা প্রদীপ্ত হয়— যে ধর্ম্ম আয়াস সাধ্য অতি কঠোর, তাহাও মধুস্বরূপ প্রতীয়মান হয়। ঈশ্বরই আমাদের সেই অনুরাগের প্রেরয়িতা এবং তিনি নিজেই তাহার বিষয়। তাঁহার জন্য ক্ষুধা তৃষ্ণা হইলে তিনি স্বয়ং আমাদের অন্নপান হয়েন। তাঁহার প্রতি অনুরাগ দৃঢ়তর হওয়া আমারদের সমুদায় ধর্ম্ম কার্য্যের অব্যর্থ ফল; আমরা বিষয়াকর্ষণকে বল-পূর্ব্বক নিরস্ত করিয়া যে অপূর্ব্ব ধর্মশিক্ষা লাভ করি, সে শিক্ষা কেবল ইহারই জন্য যে আমরা সেই সর্ব্বাতীত পরমেশ্বরের সহবাস লাভের যোগ্য হই। আমরা আমাদিগের দুর্ব্বিনীত প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া যে ধর্ম্মবল উপার্জন করি, তাহাতে কেবল আমাদের ঈশ্বরের পথে যাইবার শিক্ষা হয়। আমরা সে মুক্তি লাভের জন্য অনন্ত ভাবী কালের প্রতি দৃষ্টি করিতেছি, ধর্ম্ম আমারদের এই জীবদ্দশাতেই সেই মুক্তির সোপান প্রদর্শন করিতেছেন।
ধর্ম্ম যেমন আমারদিগকে ব্রহ্মধামে লইয়া যান,সেই রূপ এই পৃথিবী-লোকেও ধর্ম্ম আমারদের মন্ত্রী ও সহায়। কি বিষয়ী ব্যক্তি কি ঈশ্বরানুরাগী; ধর্ম্ম সকলেরই সুহৃৎ ও রক্ষক। যাহারা কেবল বিষয়সুখকেই প্রার্থনা করে, ধর্ম্মপথে থাকিলেই তাহাদের মঙ্গল—এবং যাঁহারা ঈশ্বরকে প্রার্থনা করেন, তাঁহারাও ধর্ম্মকেই অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে লাভ করিতে পারেন। এক দিকে শ্রেয়ঃ এক দিকে প্রেয়; এক দিকে সংসার, এক দিকে ঈশ্বর—এ দুয়েতেই সমান অনুরাগ হয় না। যাহাদের সংসারে অনুরাগ, তাহাদের ঈশ্বরে বিরাগ—যাহাদের ঈশ্বরে অনুরাগ তাহাদের সংসারে বিরাগ। গৃহত্যাগী হইয়া অরণ্যে বাস করাতেই যে বৈরাগ্য হয়, তাহা নহে। ঈশ্বরে অনুরাগই যথার্থ বৈরাগ্যপথ। ধর্মই সেই পথের প্রদর্শক। আমরা কুপ্রবৃত্তির উপরে ধর্ম্মকে যত বার জয়ী হইতে দিই—ধর্ম্মের সুতীব্র ভর্ৎসনাতে স্বার্থপরতার কুটিল মন্ত্রণাকে যতবার নিরস্ত করি; ততই আমরা বল পাই, ততই আমারদের শিক্ষা হয়—বিষয়ের প্রতিস্রোতে যাইবার জন্য ততই প্রস্তুত হই। বিষয়-বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়াই আমারদের। মুক্তি। পাপ হইতে দূরে থাকিবার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টাই আমারদের উৎকৃষ্ট শিক্ষা। ঈশ্বরে যে অটল অনুরাগ, সেই অনুরাগই আমারদের প্রকৃত বৈরাগ্য।
ঈশ্বরানুরাগের যে প্রকার স্বর্গীয় ভাব,—ধর্ম্মের যে প্রকার মাহাত্ম্য, তাহাতেই সুস্পষ্ট প্রতীতি হয় যে তাহা কেবল ইহ লোকের জন্য নহে। গর্ভস্থিত বালকের সুচারু অঙ্গসৌষ্ঠব ও কর্ম্মক্ষম ইন্দ্রিয় সকল দেখিলে যেমন তাহাকে চিরকাল গর্ভে থাকিবারই উপযুক্ত বোধ হয় না, কিন্তু এই কর্ম্মক্ষেত্র পৃথিবীর উপযুক্ত বলিয়া মনে হয়। সেইরূপ মনুষ্যের নিষ্কাম ধর্ম্মের অনুষ্ঠান—ঈশ্বরে নিস্বার্থ অনুরাগ দেখিয়া তাহাকে ভাবী কালের মহত্তর উচ্চতর অবস্থার উপযুক্ত বোধ হয়। এই সকল ভাব পৃথিবীর ভাব হইতে এত উচ্চতর, যে এখানে তাহাদের সম্যক্ চরিতার্থতা কখনই হয় না। বিষয়-সুখ অকাতরে বিসর্জন দেওয়া—পৃথিবীর খ্যাতি প্রতিপত্তিকে তুচ্ছ করা—কেবল এই পৃথিবীর জীবের পক্ষে কখনই সম্ভব হয় না।
যাহারা কেবল বিষয়-সুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া স্বর্গীয় ধর্ম্মকে প্রার্থনা করে, তাহাদের অতি নীচ লক্ষ্য। স্বোপর্জিত দুর্ল্লভ ধর্ম্ম-রত্নের বিনিময়ে ক্ষুদ্র বিষয়-সুখ কদাপি প্রার্থনীয় হইতে পারে না। ধর্ম্মের উপযুক্ত লক্ষ্য, ধর্ম্মের যোগ্য পুরস্কার, কেবল সেই ধর্ম্মাবহ একমাত্র পরমেশ্বর। ধর্ম্মপথ মধ্য পথ। ধর্ম্ম সংসার-বন্ধন রক্ষা করেল, ধর্ম্ম মোক্ষের সেতু হইয়া ঈশ্বরের নিকটে লইয়া যান। বিষয়সুখ ভোগের জন্য যে ধর্ম্ম, তাহা অতি নিকৃষ্ট—ঈশ্বরের জন্য যে ধর্ম্ম, তাহাই উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম। আমরা প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যে ধর্ম্মকে উপার্জন ও রক্ষা করি; পার্থিব কোন বস্তু তাহার সম্যক্ লক্ষ্য কখনই হইতে পারে না। বিষয়-সুখের জন্য কে প্রাণ দিতে পারে? কিন্তু ধর্ম্মের জন্যই প্রাণ দেওয়া যায়। বিষয়-সুখকে যদি ধর্ম্মের পুরস্কার মনে করা যায়—স্বার্থপরতার চরিতার্থতা যদি ধর্ম্ম সাধনের উদ্দেশ্য হয়; তবে সে ধর্ম্ম রক্ষা করা বিষম দায়। বহু আয়াসে, বহু দিবসে, বহু কষ্টে, যদি সে ধর্ম্ম কিছু রক্ষা হয়; তবে পরম সৌভাগ্য। ধর্মকে যাহারা কেবল বিষয় উপভোগের উপায় করে, তাহারদের নিকটে ধর্ম্ম রক্ষার কত ব্যাঘাত, কত প্রতিবন্ধক। যখন ধর্ম্মের সঙ্গে সুখের সঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হয়; তখন সেই সুখ বিসজন তাহাদের কি কষ্ট। ধর্ম্ম যখন গম্ভীরস্বরে ত্যাগের আদেশ প্রদান করে, তখন বিষয় ত্যাগ তাহাদের কি তক্ত বোধ হয়। তাহাদের লক্ষ্য কেবল সুখ, ধর্ম্ম কেবল তাহাদের উপায় মাত্র; এই হেতু ধর্ম্ম রক্ষা তাহাদের অতীব কষ্টদায়ক। ধর্ম্মের মূর্ত্তি তাহাদের নিকটে কখনই সৌন্দর্যময়ী হয় না, কিন্তু সর্ব্বদাই বিরস দেখায়। ধর্ম্মের পথ তাহারা কখনই সরল জ্ঞান করে না, কিন্তু কণ্টকাবৃতই বোধ করিয়া থাকে।
এই জন্য ধর্ম্মের প্রাণ ঈশ্বরে অনুরাগ। ঈশ্বর-লাভের জন্যই ধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ উপায়; বিষয়-সুখের জন্য তাহা অতি কনিষ্ঠ উপায়। ঈশ্বর যিনি মহীয়ান্, তাঁহাকে পাইবার জন্যই ধর্ম্ম আমাদের সহায়; বিষয় সুখ যে কণীয়ান্, ধর্ম্ম তাহার যোগ্য বস্তু হইতে পারে না। এক দিকে সংসার, এক দিকে ঈশ্বর, মধ্যে ধর্ম্ম। এ দিকের মঙ্গলের জন্যও ধর্ম্ম অবশ্যক; ঈশ্বরের দিকে যাইবার জন্যও ধর্ম্ম সহায়। যাহারা ধর্ম্মকে পরিত্যাগ করিয়া সাংসারিক সুখ ভোগে রত থাকে; এখানে তাহারদের কথা হইতেছে। এখানে মনুষ্যের বিষয়ে বলা যাইতেছে; পশুতুল্য লোকের বিষয় নহে। সংসারের প্রতি লক্ষ্য করিয়া যাহারা ধর্ম্ম উপার্জন করে, ধর্ম্ম তাহারদের উপরের শ্রেণীতে থাকে; ঈশ্বরের প্রতি যাহাদের লক্ষ্য থাকে, ধর্ম্ম তাহাদের আশ্রয় ভূমিস্বরূপ। ধর্ম্মের প্রথম পুরস্কার ঈশ্বরে অনুরাগ সঞ্চার হওয়া; তাহার শেষ পুরস্কার ঈশ্বরকে লাভ করা। ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ হইলে ধর্ম্মের পথ আপনা হইতে সহজ হইয়া যায়। যাহাদিগের পবিত্র হৃদয়ে সেই বিশুদ্ধ অনুরাগ প্রথমেই প্রদীপ্ত হইয়াছে, ধর্ম্ম শিক্ষা যে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষা, তাহা তাহাদের সহজেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু যাহাদের প্রথমেই ঈশ্বরে অনুরাগ অনুভব না হয়, ধর্ম্মই ক্রমে তাহাদের মনে সেই অনুরাগ উদ্দীপন করেন। স্বার্থপরতার বিপরীত ভাব ঈশ্বরে অনুরাগ—ধর্ম্ম মধ্যবর্ত্তী শিক্ষা গুরু।
ধর্ম্মেতে যাঁহারদিগের শ্রদ্ধা জন্মিয়াছে; ধর্ম্মের নৈসগিক সৌন্দর্য্য ও পাপের স্বাভাবিক মলিনত্ব যাঁহার প্রতীতি করিয়াছেন; তাঁহারা যে ঈশ্বরের পথেরই অভিমুখী, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বিষয় ত্যাগ, বিষয় বিসর্জন, প্রথমে ধর্ম্মের উপদেশে এসকলের শিক্ষা হয়। ধর্ম্মের অনুরোধে যত টুকু ত্যাগ স্বীকার করিতে পারি—বিষয়ের যত প্রতিকুলগামী হই—ঈশ্বরের পথে ততই অগ্রসর হইতে থাকি; ঈশ্বরের নিকটে যাইবার জন্য ততই বল পাই। বিষয় হইতে মন যত আকৃষ্ট হয়, বিষয়ের অতীত পদার্থের প্রতি ততই ধাবমান হয়। এদিকে যে পরিমাণে বিরাগ উপস্থিত হয়, ঈশ্বরে অনুরাগ সেই পরিমাণে উজ্জ্বল হইতে থাকে। ঈশ্বরে অনুরাগ যেমন প্রবল হইতে থাকে, তেমনি ধর্ম্মবল আরো বৃদ্ধি হয়, বিষয়াকর্ষণ আরো ক্ষীণ হয়। অতএব প্রথমে যাঁহার ধর্ম্মের প্রতি, কর্ত্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা হয়, ইহা নিশ্চয়, যে ঈশ্বর তাঁহার অনুরাগ শীঘ্রই তাঁহার মনে উদ্দীপন করেন। ঈশ্বর তো সর্ব্বত্রই তাঁহার ক্রোড় প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছেন এবং প্রতিক্ষণেই আমারদিগকে আহ্বান করিতেছেন; আমরা তাঁহার সন্নিধানের উপযুক্ত হইলেই তিনি আমারদিগকে গ্রহণ করেন। তাঁহার নিকটে লইয়া যাইবার জন্য ধর্ম্মই প্রথমে আমাদের সহায় হয়েন।
বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের লক্ষ্য হয়,তবে সে বিপরীত লক্ষ্য; সে লক্ষ্য সিদ্ধিতেও বিস্তর ব্যাঘাত। বিষয়-সুখ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হইয়াই ধর্ম্ম-পথে গমন করিতে হয়; আনুষঙ্গিক যদি বিষয়-মুখ রক্ষা পায়, তবে ভালই। ধর্ম্ম কিছু বিষয়-সুখের অনুচর নহে—কিন্তু ধর্মের অনুচর যদি বিষয়সুখ হয়, তবে তাহা অবশ্য সেব্য। আমরা আত্মসুখের জন্য ধর্ম্মকে প্রার্থনা করিলে সে কেবল স্বার্থপরতা মাত্র। স্বর্গের লোভে বা নরকের ভয়ে নিরাহারে দিন যাপন করাতে ধর্ম্ম হয় না। ধর্ম্মের ভাব নিঃস্বার্থ ভাব। বিষয়সুখ যে ধর্ম্মের অব্যর্থ পুরস্কার তাহা নহে; কিন্তু সুবিমল আত্ম-প্রসাদই ধর্ম্মের পুরস্কার,ঈশ্বর ধর্ম্মের শেষ পুরস্কার। ধর্ম্মের স্বর্গীয় জ্যোতির নিকটে স্বর্ণ রৌপ্য হীরকের পার্থিব জ্যোতি কোথায় থাকে? কেবল এক লক্ষ্যের দোষে ধর্ম্মকেও দূষিত মনে হয়। বিষয়-সুখই যাহার লক্ষ্য থাকে, সে পৃথিবীতে ধর্ম্মের হীনাবস্থা ও পাপের স্ফীতভাব দেথিয়া ঈশ্বরের অখণ্ড মঙ্গল স্বরূপেতেও দোষারোপ করিতে প্রবৃত্ত হয়। সে হয়তো এই মনে করে যে আমি সত্যের পথে ধর্মের পথে থাকিয়া কেবল লোকের নিকট হইতে নিষ্ঠুর আঘাত সহ্য করিতেছি; আর পাপী ব্যক্তি ধন মান প্রভুত্ব বর্দ্ধন করিয়া কেমন সুখে কাল যাপন করিতেছে অতএব ঈশ্বরের রাজ্যে কিছুই বিচার নাই। ধর্ম্মকে যাহার সুখের উপায়স্বরূপ জ্ঞান করে, তাহাদের মুখ হইতে এই রূপ অক্ষেপোক্তি অনেক সময় শ্রবণ করা যায়।
ধর্ম্ম যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হইতে হইলে ত্যাগ তো স্বীকার করিতেই হইবে—বিষয়-সুখ হইতে তো অনেক সময় পরিচ্যুত হইতেই হইবে—কুপ্রবৃত্তির বিপরীত পথে তো অনেকবার গমন করিতেই হইবে। আমারদের যদি মূলধন সঞ্চিত থাকে, তবে অতিরিক্ত ধনের ক্ষতিতে তেমন বিশেষ ক্ষতি বোধ হয় না। ঈশ্বরকে যিনি মূলধন রূপে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন, বিষয় ত্যাগে তাহার ক্ষতির সম্ভাবনা নাই। যিনি সকল সম্পদের সমুদ্রকে প্রাপ্ত হইয়াছেন, বিষয় বিপদকে তাঁহার বিপদ বোধ হয় না। তিনি সুখের সময় সেই সর্ব্বসুখদাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হইয়া সেই সুখকে দ্বিগুণিত করেন, এবং বিপদের সময় তিনি সেই সর্ব্বাশ্রয় পরমেশ্বরের আশ্রয়ে থাকিয়া নির্ভয়ে বিচরণ করেন। পাপই তাঁহার নিকটে অমঙ্গল; দুঃখও বাস্তবিক অমঙ্গল নহে, বিপদও বাস্তবিক অমঙ্গল নহে। আত্মার কিসে আত্ম-প্রসাদ থাকে—ঈশ্বর কিসে নিরন্তর জ্ঞান-চক্ষে প্রকাশিত থাকেন; ইচ্ছাতেই তাঁহার প্রাণগত যত্ন—এবং তদনুরূপ আচরণে তৎপর থাকেন। কিসে লোকে মান্য হইব, এজন্য তাঁহাকে কষ্ট পাইতে হয় না, ঈশ্বর হইতে পাছে বিচ্যুতি হয়, এই ভয়েই তিনি পাপ হইতে দূরে থাকেন; লোকেরা পাছে মন্দ বলে, ইহারই প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তাঁহার কপটতা কুটিলতা ছদ্মতা অভ্যাস করিতে হয় না।
যাঁহারা ধর্ম্মেতে অনেক সময় বিষয়-সুখের হানি দেখিয়া ঈশ্বরের মঙ্গল-স্বরূপে দোষারোপ করেন, তাঁহারা ধার্ম্মিকদিগের বৃদ্ধ-বয়সে যৌবন কালের বল বীর্য উদ্যমের হ্রাস দেখিয়াও তো সেই রূপ বলিতে পারেন? বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের যথার্থ বিষয় হইত, তবে ধার্ম্মিক ব্যক্তিরাই অধিক বিষয়ী হইত; তবে ধর্ম্মের যত উপার্জন হইত, ইন্দ্রিয় সকল ততই বিবৃত দ্বার হইত, বিষয় লালসা ততই বৃদ্ধি হইত, ভোগের শক্তি ততই প্রবলা হইত। কিন্তু বাস্তবিক ঠিক তাহার বিপরীত। ব্রহ্ম-রসগ্রহ ধার্ম্মিক বৃদ্ধ দিন দিন আপনাকে স্বীয় গম্য স্থানের নিকট জানিয়া সর্ব্বদাই প্রসন্ন ও হৃষ্ট থাকেন; বিষয়-ভোগের লালসা তাঁহাকে আর সুখ বা দুঃখ দিতে পারে না।
ধর্ম্মপরায়ণ সাধু ব্যক্তিরা বিষয়-সুখ হইতে বিরত হন বলিয়া যে পাপী ব্যক্তি নির্ব্বিঘ্নে থাকে, এমত নহে। পাপীর যে যন্ত্রণা সে সেই পাপী জানে, আর সেই অন্তর্যামী পুরুষই জানেন। তাহাদের যদি ধন, মান, ঐশর্য্য; অশ্ব, রথ, গজ, পর্য্যঙ্ক থাকে, তাহাতেই বা কি? তাহারা নরক সমান স্বকীয় হৃদয় জ্বালাতেই সর্ব্বদা অস্থির, তাহাদের কোন সুখ উপভোগের ক্ষমতাই থাকে না। তাহাদের নিকটে এই জগৎ দাব-দাহময় হয়। তথাপি করুণা-সিন্ধু পরমেশ্বর তাহারদিগকে পরিত্যাগ করেন না। তাহারদিগকে আপনিই দণ্ড বিধান দ্বারা বিপথ হইতে স্বপথে আহ্বান করেন।