ভগ্নহৃদয়/ত্রয়স্ত্রিংশ সর্গ

ত্রয়স্ত্রিংশ সর্গ।

পর্ণ শয্যায় শয়ান মুরলা; চপলা।

চপলা।—কি করিয়া এত তুই হলিরে নিষ্ঠুর, 
ললিতা সে, এত ভাল বাসিতিস যারে,
কি করিয়া ফেলি তারে যাবি দূর—দূর—
এতদিনকার প্রেম ছিঁড়ি একেবারে!
কবি তোরে এত ভাল বাসে যে মুরলে,
তা’রেও কি তুই, সখি, ফেলে যাবি চ’লে?

কবি ও অনিলের প্রবেশ।


কবি।—কি করিলি বল্ দেখি? কি করেছি তোর? 
মুরলারে—মুরলারে—মুরলা আমার, হা—রে
কি ক’রেছি এত তুই হলি যে কঠোর?
প্রাণ মোর, মন মোর, হৃদয়ের ধন মোর,
সমস্ত হৃদয় মোর, জগৎ আমার—
একবার বল্ বালা-বল্ একবার
ছাড়িয়ে যাবিনে মোরে ফেলি এ সংসার—ঘোরে,
নিতান্ত এ হৃদয়েরে রাখি অসহায়।
আয়, সখি, বুকে থাক্‌, এই হেথা মাথা রাখ্,
হৃদয়ের রক্ত ফেটে বাহিরিতে চায়।

মুরলা, এ বুক্ তুই ত্যজিস্‌নে আর,
চিরদিন থাক্ সখি হৃদয়ে আমার?
মুরলা।—লও কবি—এই লও—এই মাথা তুলে লও— 
অবসন্ন এ মাথা যে পারিনে তুলিতে,
একবার রাখ সখা, রাখ ও কোলেতে!
নিতান্তই স্বার্থপর হৃদয় আমার—
অতি নীচ হীন হৃদি এই মুরলার—
নির্দ্দয়—নির্দ্দয় বড়—পাষাণ হতেও দড়
ধূলি হতে লঘুতর হৃদয় আমার!
নহিলে কি করে আমি—কবি—কবি মোর—
(হৃদয়ে ঘনায়ে ছিল কি মোহের ঘোর!)
স্নেহময় তোমারেও ত্যজি অনায়াসে
কি করে আইনু চলি এ দূর প্রবাসে?
ও করুণ নয়নের অশ্রুবারি ধার
একবারো মনে নাহি পড়িল আমার?
অমন স্নেহের পানে ফিরে না চাহিয়ে
পারিনু আঘাত দিতে ও কোমল হিয়ে?
মার্জনা করিও এই অপরাধ তার—
কবি মোর—শেষ ভিক্ষা এই মুরলার!
এমন দুর্বল হৃদি—এত নীচ, হীন—
এমন পাষাণে গড়া—এতই সে দীন,
এযে চিরকাল ধ’রে ছিল তব কাছে—
এ অপরাধের, কবি, মার্জ্জনা কি আছে?
সখা, অপরাধ সারা অস্তিত্ব তাহার—

মরণে করিবে আজ প্রায়শ্চিত্ত তার!
কেন আজ মুখখানি শীর্ণ ও মলিন—
বড় যেন শান্ত দেহ—অতি বলহীন—
রাখ কবি মাথা রাখ’-এই বুকে মাথা রাখ’
একটু বিশ্রাম কর হৃদয়ে আমার!—
ছিছি সখা কেঁদোনাকো—মুরলার কথা রাখো
ও মুখে দেখিতে নারি অশ্রু বারি ধার!
কবি।—এতদিন এত কাছে ছিনু এক ঠাঁই 
মিলনের অবসর মোরা পাই নাই।
কে জানিত ভাগ্যে, সখি, ঘটিবে এমন
মরণের উপকূলে হইবে মিলন।
মুরলা।—কি যে সুখ পেতেছি তা’ বলিব কি কোরে— 
বল সখা, এখনি কি যাব’ আমি মোরে?
এই মরণের দিন না যদি ফুরায়—
মরিতে মরিতে যদি বেঁচে থাকা যায়—
দিন যায় দিন যায়—মাস চোলে যায়
তবু মরণের দিন না যদি ফুরায়!—
সখা ওগো—দাও মোরে—দাও মোরে জল
সুখেতে হোয়েছি শ্রান্ত—অতি দুরবল।—
কবি।—বিবাহ হইবে, সখি, আজ আমাদের— 
দারুণ বিরহ ওই আসিবার আগে, সই,
অনন্ত মিলন হোক্ এই দুজনের!
আকাশেতে শত তারা চাহিয়া নিমেষ হারা,—
উহারা অনন্ত সাক্ষী রবে বিবাহের!—

আজি এই দুটি প্রাণ হইল অভেদ,
মরণে সে জীবনের হবেনা বিচ্ছেদ।
হোক্ তবে, হোক্, সখি, বিবাহ সুখের—
চিতায় বাসর শয্যা হোক্ আমাদের!—
মুরলা।-তবে তুলে আন ত্বরা রাশি রাশি ফুল! 
চিতাশয্যা হোক্ আজি কুসুমে আকুল!
রজনী গন্ধার মালা গাঁথগো ত্বরায়,—
সে মালা বদল করি দিও এ গলায়,—
সেই মালা পোরে আমি তোমার সমুখে স্বামি—
করিব শয়ন সুখে সুখের চিতায়,
সেই মালা পোরে যেন দগ্ধ হয় কায়!

(অনিলের ফুল আনিতে প্রস্থান)


কবি গো, বড়ই সাধ ছিল মনে মনে
এক দিন কেঁদে নেব ধরি ও চরণে,—
দেখি, কবি, পা দুখানি দেখি একবার,
বড় সাধ গেছে মনে সুখে কঁদিবার!
কই, ফুল এল’ না তো আসিবে কখন?
এখনি ফুরায়ে পাছে যায় এ জীবন!
আরো কাছে এস কবি, আরো কাছে মোর,
রাখ হাত দুই খানি হাতের উপর!
কবিগো, স্বপ্নেও আমি ভাবি নাই কভু
শেষদিনে এত সুখ হবে মোর প্রভু!
এখনো এলনা ফুল! সখাগো আমার

বড় যে হোতেছি শ্রান্ত পারিনে যে আর!

(ফুল লইয়া অনিলের প্রবেশ।)


(অনিলের প্রতি) ললিতা, কেমন আছে বল ভাই বল। 
অনিল।—ললিতা কেমন আছে? সে আছেরে ভাল! 
মুরলা।—চিরকাল ভাল যেন থাকে আদরিণী 
চিরকাল পতি সুখে থাকে সোহাগিনী!
কথা ক’ চপলা, সখি, মাথা খা আমার,
নীরবে নীরবে বসি কাঁদিস্ না আর!
মরণের দিনে দুঃখ র’য়ে গেল চিতে
হাসি খুশি মুখ তোর পেনুনা দেখিতে।
সুখে থাক্, সখি তুই চির সুখে থাক্,
হাসিয়া খেলিয়া তোর এ জীবন যাক্।
ওই যে এসেছে মালা, কবিগো ত্বরায়
পরায়ে দাওগো তাহা এ মোর গলায়।
এই লও হাত মোর রাখ তব হাতে,
ছেলেবেলা হোতে মোরে কত দয়া স্নেহ কোরে
রেখেছ এ হাত ধরি তব সাথে সাথে,
আবার মোদের যবে হইবে মিলন
এ হাত আমার, কবি, করিও গ্রহণ,
যেথা যাবে সেথা রব দুই জনে এক হব,
অনন্ত বাঁধনে রবে অনন্ত জীবন!
কবি।—বিবাহ মোদের আজ হোল এই তবে, 
ফুল যেথা না শুকায় সদা ফুটে শোভা পায়

সেথায় আরেক দিন ফুল শয্যা হবে!
মুরলা (কবিকে) এস কবি বুকে এস, 
(অনিলকে) এস ভাই কাছে বস, 
(চপলাকে) একটি চুম্বন সখি, বুঝি প্রাণ যায়, 
এই শেষ দেখা এই দুখের ধরায়,
আসিছে আঁধার ঘোর, কবি, কোথা তুমি মোর!
আরো কাছে, আরো কাছে, এসগো হেথায়!
আজ তবে বিদায়, বিদায়।
স্বামি, প্রভু, কবি, সখা,
আবার হইৰে দেখা,
আজ তবে বিদায় বিদায়!