ভানুসিংহের পত্রাবলী/৫৫
৫৫
আজ সন্ধ্যাবেলায় ঘন মেঘ ক’রে খুব একচোট বৃষ্টি হ’য়ে গেছে। এখন বৃষ্টি নেই কিন্তু আকাশে মেঘ কালো হ’য়ে জ’মে আছে। প্রশান্ত আর রাণী কোথায় চ’লে গেচে—বাড়িতে কেউ কোথাও নেই—আমি টেবিলের উপর ইলেক্ট্রিক্ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে তোমাকে চিঠি লিখ্তে ব’সেচি। সমস্ত দিন নানা কাজে, নানা লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে, নানা লেখায় কেটে গিয়েচে। এক মুহুর্ত্ত বিশ্রাম ক’র্তে পাইনি—লেখার মাঝে মাঝে খুব ঘুম পেয়েছিলো, কিন্তু ক’ষে ঝাঁকানি দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে কাজ ক’রে গেচি। নিজেকে একরকম ক’রে খুঁচিয়ে কাজ করানো একেবারেই ভালো নয় জানি। তাতে কাজও-যে ভালো হয় তা নয় আর বিশ্রামও মাটি হ’য়ে যায়। কিন্তু আমার কুষ্ঠিতে কর্ম্ম-স্থানে শনি আছে, সে আমাকে দয়ামায়া একটুও করে না—ক’ষে খাটিয়ে নেয়, মজুরিও যথেষ্ট দেয় না। কাল দিনেরবেলায় আবার নানারকম কাজের পালা আরম্ভ হবে—তাই এখন চিঠি লিখ্তে ব’সেচি। এখন সন্ধ্যে সাড়ে আটটা —তোমার ওখানে হয় তো তুমি এখন পড়ার বই নিয়ে ব’সে গেচো। আজকাল আমাকে যে-রকম দায়ে প’ড়ে খাট্তে হয়, যদি তোমাদের বয়সে সেইরকম পরীক্ষার পড়ায় খাট্তুম তা হ’লে এতদিনে হয় তো আই, এ, পরীক্ষা পাসের তক্মা প’রে কন্যাকর্ত্তাদের মহলে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পার্তুম। তা হ’লে পণের টাকায় বিশ্বভারতীর ঝুলি ভর্ত্তি ক’রে দিনে-দুপুরে নাকে তেল দিয়ে নিদ্রা দিতে একটুও দ্বিধা বোধ হ’তো না। আমার ক’ল্কাতার কাজ শেষ হ’য়ে এলো, পরশু কিম্বা শনিবার শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবো, সেখানে এতদিনে শরৎকালের রোদ্দুরে আকাশে সোনার রং ধ’রেচে আর শিউলি ফুলের গন্ধে বাতাস ভোর হ’য়ে আছে। আজ বুধবার; আজ থেকে ছেলেরা সব হো হো ক’র্তে ক’র্তে বাড়িমুখো দৌড়েচে—কাল পর্শুর মধ্যে আশ্রম প্রায় শূন্য হ’য়ে যাবে। এদিকে শুক্লপক্ষ এসে প’ড়্লো, দিনে দিনে সন্ধ্যার পেয়ালাটি চাঁদের আলোয় ভর্ত্তি হ’য়ে উঠ্তে থাক্বে। আমি বারান্দায় আরাম কেদারার উপর পা তুলে দিয়ে একলা চুপ করে ব’স্বো—চাঁদ আমার মনের ভাবনাগুলির ’পরে আপন রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের স্বপ্নময় ক’রে তুল্বে,—ছাতিমতলায় ঝ’রে-পড়া মালতী ফুলের গন্ধ জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে যাবে। সেই সুগন্ধি শুক্লরাত আমার মনের একোণ-ওকোণে উঁকি দিয়ে কোনো নতুন গানের সুর খুঁজে বেড়াবে—বেহাগ কিম্বা সিন্ধু কিম্বা কানাড়া। থাক্—সে-সব কথা পরে হবে, আপাততঃ চিঠি বন্ধ ক’রে এখানকার বারান্দায় মেঘাবৃত রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে মনটাকে ডুবিয়ে দিয়ে একটু বিশ্রাম ক’র্তে যাই। যদি ক্লান্তির ঘুমে চোখ বুজে আসে তা হ’লে তাকে তাড়া দিয়ে দেশছাড়া ক’র্বো না।