ভানুসিংহের পত্রাবলী/৫৮
৫৮
ভারতবর্ষ ছেড়ে এই খানিকক্ষণ হ’লো সিংহলে এসেচি। কাল সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়্বে। আকাশ অন্ধকার। ঘন বাদলার মেঘ সকালবেলার সোনার আলো গণ্ডুষ ভ’রে পান ক’রেচে, কেবল তা’র তলানি ছায়াটুকু বাকি। দেশে থাক্লে সকালবেলায় দিনের এই ছায়াবগুণ্ঠন ভালোই লাগ্তো। ইচ্ছে ক’র্তো, কাজকর্ম্ম বন্ধ ক’রে মাঠের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নরাজ্যে মনটাকে পথহারা ক’রে ছেড়ে দিই, কিম্বা হয় তো গুন-গুন সুরে নতুন একটা গান ধ’রে মেঘদূতের কবির সঙ্গে যথাসাধ্য পাল্লা দিতে ব’স্তুম।
কিন্তু এখানে মনটা বিরাগী, তা’র একতারাটা কোথায় হারিয়ে গেচে। “গানহারা মোর হৃদয়তলে” এই অন্ধকার যেন একটা স্তূপাকার মূর্চ্ছার মতো উপুড় হ’য়ে প’ড়ে আছে। সুদূর এবং সুদীর্ঘ যাত্রার দিনের মুখে আকাশ থেকে সূর্য্যের আলো দেবতার অভিনন্দনের মতো বোধ হয়। আজ মনে হ’চ্চে যেন আমার সেই জয়যাত্রার অধিদেবতা নীরব। গগন-বীণার থেকে যে-বাণী পাথেয় স্বরূপ সংগ্রহ ক’রে সমুদ্রে পাড়ি দিতুম, সেই আকাশভরা বাণী আজ কোথায়?
কালস্রোতে যে-বাড়িতে এসে আছি, এ একজন লক্ষপতির বাড়ি। প্রকাণ্ড প্রাসাদ। আরামে বাস কর্বার পক্ষে অত্যন্ত বেশি ঢিলে, ঘরগুলোর প্রকাণ্ড হাঁ মানুষকে গিলে ফেলে। যে-ঘরে ব’সে আছি, তা’র জিনিসগুলো এত বেশি ফিটফাট-যে, মনে হয় সেগুলো ব্যবহার কর্বার জন্যে নয়, সাজিয়ে রাখ্বার জন্যে। বস্বার শোবার আসবাবগুলো শুচিবায়ুগ্রস্ত গৃহিণীর মতো; সন্তর্পণে থাকে, কাছে গেলে যেন মনে মনে স’রে যায়। এই ধনী-ঘরের অতিপারিপাট্য এও যেন একটা আবরণের মতো।
আমার সেই তেতালা ঘরের চেহারা মনে পড়ে তো? সমস্ত এলোমেলো। সেখানে শোবার বস্বার জন্যে একটুও সাবধান হবার দরকার হয় না; তা’র অপরিচ্ছন্নতাই যেন তা’র প্রসারিত বাহু, তা’র অভ্যর্থনা। সে-ঘর ছোটো, কিন্তু সেখানে সবাইকেই ধরে। মানুষকে ঠিক মতো ধর্বার পক্ষে হয় ছোট্ট একটি কোণ, নয় অসীম বিস্তৃত আকাশ। ছেলেবেলায় যখন আমি পদ্মার কোলে বাস ক’র্তুম, তখন পাশাপাশি আমার দুই রকম বাসাই ছিল। একদিকে ছিল আমার নৌকোর ছোটো ঘরটি, আর-একদিকে ছিল দিগন্তপ্রসারিত বালুর চর। ঘরের মধ্যে আমার অন্তরাত্মার নিশ্বাস, আর চরের মধ্যে তা’র প্রশ্বাস। একদিকে তা’র অন্দরের দরজা, আর একদিকে তা’র সদর দরজা।