ভাব্‌বার কথা (১৯১৯)/জ্ঞানার্জ্জন

জ্ঞানার্জ্জন।

 ব্রহ্ম।—দেবতাদিগের প্রথম ও প্রধান, শিষ্য পরম্পরায় জ্ঞানপ্রচার করিলেন; উৎসর্পিণী ও অবসর্পিণী কালচক্রের মধ্যে কতিপয় অলৌকিক সিদ্ধপুরুষ—জিনের প্রাদুর্ভাব হয় ও তাঁহাদের হইতে মানব সমাজে জ্ঞানের পুনঃপুনঃ স্ফূর্ত্তি হয়; সেই প্রকার বৌদ্ধমতে সর্ব্বজ্ঞ বুদ্ধনামধের মহাপুরুষদিগের বারংবার আবির্ভাব; পৌরাণিকদিগের অবতারের অবতরণ, আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে বিশেষরূপে, অন্যান্য নিমিত্ত অবলম্বনেও; মহামনা স্পিতামা জরতুষ্ট্র জ্ঞানদীপ্তি মর্ত্ত্যলোকে আনয়ন করিলেন; হজরৎ মুশা, ঈশা ও মহম্মদও তদ্বৎ অলৌকিক উপায়শালী হইয়া, অলৌকিক পথে অলৌকিক জ্ঞান মানব-সমাজে প্রচার করিলেন।

 কয়েকজন মাত্র জিন হন, তাহা ছাড়া আর কাহারও জিন হইবার উপায় নাই, অনেকে মুক্ত হন মাত্র; বুদ্ধনামক অবস্থা সকলেই প্রাপ্ত হইতে পারেন, ব্রহ্মাদি—পদবীমাত্র, জীবমাত্রেরই হইবার সম্ভাবনা; জরতুষ্ট্র, মুশা, ঈশা, মহম্মদ—লোক-বিশেষ, কার্যাবিশেষের জন্য অবতীর্ণ; তদ্বৎ পৌরাণিক অবতারগণ—সে আসনে অন্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ বাতুলতা। আদম ফল খাইয়া জ্ঞান পাইলেন, ‘নু’ { Noah) জিহোবাদেবের অনুগ্রহে সামাজিক শিল্প শিখিলেন। ভারতে সকল শিল্পের অধিষ্ঠাতা—দেবগণ বা সিদ্ধপুরুষ; জুতা সেলাই হইতে চণ্ডীপাঠ পর্য্যন্ত সমস্তই অলৌকিক পুরুষদিগের কৃপা। ‘গুরু বিন্ জ্ঞান নহি’; শিষ্য-পরম্পরায় ঐ জ্ঞানবল গুরু-মুগ্ধ হইতে না আসিলে, গুরুর কৃপা না হইলে, আর উপায় নাই।

 আবার দার্শনিকেরা—বৈদান্তিকেরা—বলেন, স্বভাব-সিদ্ধ ধন—আত্মার প্রকৃতি; এই মানবাত্মাই অনন্ত জ্ঞানের আধার, তাহাকে আবার কে শিখাইবে? সুকর্ম্মের দ্বারা ঐ জ্ঞানের উপর যে একটা আবরণ পড়িয়াছে, তাহা কাটিয়া যায় মাত্র। অথবা ঐ ‘স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান’ অনাচারের দ্বারা সঙ্কুচিত হইয়া যায়, ঈশ্বরের কৃপায় সদাচার দ্বারা পুনবিস্ফারিত হয়। অষ্টাঙ্গ যোগাদির দ্বারা, ঈশ্বরে ভক্তির দ্বারা, নিষ্কাম কর্ম্মের দ্বারা, অস্তর্নিহিত অনস্ত শক্তি ও জ্ঞানের বিকাশ—ইহাও পড়া যায়।

 আধুনিকেরা অপরদিকে, অনন্তস্ফূর্ত্তির আধারস্বরূপ মানব-মন দেখিতেছেন, উপযুক্ত দেশকালপাত্র পরস্পরের উপর ক্রিয়াবান্ হইতে পারিলেই জ্ঞানের স্ফূর্ত্তি হইবে, ইহাই সকলের ধারণা। আবার দেশকালের বিড়ম্বনা পাত্রের তেজে অতিক্রম করা যায়। সৎপাত্র, কুদেশে, কুকালে পড়িলেও বাধা অতিক্রম করিয়া আপনার শক্তির বিকাশ করে। পাত্রের উপর, অধিকারীর উপর যে সমস্ত ভার চাপান হইয়াছিল, তাহাও কমিয়া আসিতেছে। সেদিনকার বর্ব্বর জাতিরাও যত্নগুণে সুসভ্য ও জ্ঞানী হইয়া উঠিতেছে—নিম্নস্তর উচ্চতম আসন অপ্রহিত গতিতে লাভ করিতেছে। নিরামিষ-ভোজী পিতামাতার সন্তানও সুবিনীত, বিদ্বান্ হইয়াছে, সাঁওতাল বংশধরেরাও ইংরাজের কৃপায় বাঙ্গালির পুত্রদিগের সহিত বিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থাপন করিতেছে। পিতৃপিতামহাগত গুণের পক্ষপাতিতা ঢের কমিয়া আসিয়াছে।

 একদল আছেন, যাঁহাদের বিশ্বাস—প্রাচীন মহাপুরুষদিগের অভিপ্রায় পূর্ব্বপুরুষ-পরম্পরাগত পথে তাঁহারাই প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং সকল বিষয়ের জ্ঞানের একটি নির্দ্দিষ্ট ভাঙার অনন্ত কাল হইতে আছে, ঐ খাজানা পূর্ব্বপুরুষদিগের হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল। তাঁহারা উত্তরাধিকারী, জগতের পূজ্য। যাঁহাদের এ প্রকার পূর্ব্বপুরুষ নাই, তাঁহাদের উপায়? কিছুই নাই। তবে যিনি অপেক্ষাকৃত সদাশয়, উত্তর দিলেন—আমাদের পদলেহন কর, সেই সুকৃতফলে আগামী জন্মে আমাদের বংশে জন্মগ্রহণ করিবে।—আর এই যে আধুনিকেরা বহুবিদ্যার আবির্ভাব করিতেছেন—যাহা তোমরা জান না এবং তোমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যে জানিতেন, তাহারও প্রমাণ নাই? পূর্ব্বপুরুষেরা জানিতেন বৈকি, তবে লোপ হইয়া গিয়াছে, এই শ্লোক দেখ—।

 অবশ্য প্রতাক্ষবাদী আধুনিকেরা এ সকল কথায় আস্থা প্রকাশ করেন না।

 অপরা ও পরা বিদ্যায় বিশেষ আছে নিশ্চিত, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিশেষ আছে নিশ্চিত, একের রাস্তা অন্যের না হইতে পারে, এক উপায় অবলম্বনে সকল প্রকার জ্ঞান-রাজ্যের দ্বার উদ্ঘাটিত না হইতে পারে, কিন্তু সে বিশেষণ (difference) কেবল উচ্চতার তারতম্য, কেবল অবস্থা-ভেদ, উপায়ের অবস্থানুযায়ী প্রয়োজন-ভেদ, বাস্তবিক সেই এক অখণ্ড জ্ঞান ব্রহ্মাদিস্তত্ব পর্য্যন্ত ব্রহ্মাণ্ড-পরিব্যাপ্ত।

 “জ্ঞান-মাত্রেই পুরুষ-বিশেষের দ্বারা অধিকৃত, এবং ঐ সকল বিশেষ পুরুষ ঈশ্বর বা প্রকৃতি বা কর্ম্মনিদ্দিষ্ট হইয়া যথাকালে জন্মগ্রহণ করেন; তদ্ভিন্ন কোনও বিষয়ে জ্ঞান লাভের আর কোন উপায় নাই,” এইটি স্থির সিদ্ধান্ত হইলে, সমাজ হইতে উদ্যোগ উৎসাহাদি অন্তহিত হয়, উদ্ভাবনী শক্তি চর্চ্চাভাবে ক্রমশঃ বিলীন হয়, নুতন বস্তুতে আর কাহারও আগ্রহ হয় না, হইবার উপায়ও সমাজ ক্রমে বন্ধ করিয়া দেন। যদি ইহাই স্থির হইল যে, সর্ব্বজ্ঞ পুরুষবিশেষগণের দ্বারার মানবের কল্যাণের পন্থা অনন্ত কালের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা হইলে, সেই সকল নির্দ্দেশের রেখা-মাত্র ব্যতিক্রম হইলেই সর্ব্বনাশ হইবার ভয়ে সমাজ কঠোর শাসন দ্বারা মনুষ্যগণকে ঐ নির্দ্দিষ্ট পথে লইয়া যাইতে চেষ্টা করে। যদি সমাজ এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হয়, তবে মনুষ্যের পরিণাম, যন্ত্রের ন্যায় হইয়া যায়। জীবনের প্রত্যেক কার্য্যই যদি অগ্র হইতে সুনির্দ্দিষ্ট হইয়া রহিয়াছে, তবে চিন্তা-শক্তির পর্য্যালোচনার আর ফল কি? ক্রমে ব‍্যবহারের অভাবে উদ্ভাবনী-শক্তির লোপ ও তমোগুণপূর্ণ জড়তা আসিয়া পড়ে; সে সমাজ ক্রমশঃই অধোগতিতে গমন করিতে থাকে।

 অপরদিকে, সর্ব্বপ্রকারে নির্দ্দেশবিহীন হইলেই যদি কল্যাণ হইত, তাহা হইলে চীন, হিন্দু, মিশর, বাবিল, ইরাণ, গ্রীস, রোম ও তাহাদের বংশধরদিগকে ছাড়িয়া সভ্যতা ও বিদ্যাশ্রী, জুলু, কাফ্রি, হটেণ্টট্, সাঁওতাল, আন্দামানি ও অষ্ট্রেলীয়ান্ প্রভৃতি জাতিগণকেই আশ্রয় করিত।

 অতএব মহাপুরুষদিগের দ্বারা নির্দ্দিষ্ট পথেরও গৌরব আছে, গুরু-পরম্পরাগত জ্ঞানেরও বিশেষ বিধেয়তা আছে, জ্ঞানে সর্ব্বান্তর্য্যামিত্বও একটা অনন্ত সত্য। কিন্তু বোধ হয়, প্রেমের উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হইয়া, ভক্তেরা মহাজনদিগের অভিপ্রায় তাঁহাদের পূজার সমক্ষে বলিদান করেন এবং স্বয়ং হতশ্রী হইলে মনুষ্য স্বভাবতঃ পূর্ব্বপুরুষদিগের ঐশ্বর্য্য-স্মরণেই কালাতিপাত করে, ইহাও প্রত্যক্ষ সিদ্ধ। ভক্তিপ্রবণ-হৃদয় সর্ব্বপ্রকারে পূর্ব্বপুরুষদিগের পদে আত্মসমর্পণ করিয়া, স্বয়ং দুর্ব্বল হইয়া যায়, এবং পরবর্ত্তী কালে ঐদুর্ব্বলতাই শক্তিহীন গর্ব্বিত হৃদয়কে পূর্ব্বপুরুষদিগের গৌরব-ঘোষণারূপ জীবনাধার-মাত্র অবলম্বন করিতে শিখায়।

 পূর্ব্ববর্ত্তী মহাপুরুষেরা সমুদয়ই জানিতেন, কাল বশে সেই জ্ঞানের অধিকাংশই লোপ হইয়া গিয়াছে, একথা সত্য হইলেও ইহাই সিদ্ধান্ত হইবে যে, ঐ লোপের কারণ, পরবর্ত্তীদের নিকট ঐ লুপ্ত জ্ঞান থাকা না থাকা সমান; নূতন উদ্যোগ করিয়া পুনর্ব্বার পরিশ্রম করিয়া, তাহা আবার শিখিতে হইবে।

 আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে বিশুদ্ধচিত্তে আপনা হইতেই স্ফুরিত হয়, তাহাও চিত্তশুদ্ধিরূপ বহু আয়াস ও পরিশ্রমসাধ্য। আধিভৌতিক জ্ঞানে, যে সকল গুরুতর সত্য মানব-হৃদয়ে পরিস্ফুরিত হইয়াছে, অনুসন্ধানে জানা যায় যে, সেগুলিও সহসা উদ্ভূত দীপ্তির ন্যায় মনীষীদের মনে সমুদিত হইয়াছে; কিন্তু বন্য অসভ্য মনুষ্যের মনে তাহা হয় না—ইহাই প্রমাণ যে, আলোচনা ও বিদ্যাচর্চ্চারূপ কঠোর তপস্যাই তাহার কারণ।

 অলৌকিকত্বরূপ যে অদ্ভুত বিকাশ, চিরোপার্জ্জিত লৌকিক চেষ্টাই তাহার কারণ; লৌকিক ও অলৌকিক কেবল প্রকাশের ভারতম্যে।

 মহাপুরুষত্ব, ঋষিত্ব, অবতারত্ব বা লৌকিক-বিদ্যায় মহাবীরত্ব সর্ব্বজীবের মধ্যে আছে, উপযুক্ত গবেষণা ও কলাদিসহায়ে তাহা প্রকাশিত হয়। যে সমাজে ঐ প্রকার বীরগণের একবার প্রাদুর্ভাব হইয়া গিয়াছে, সেথায় পুনর্ব্বার মনীষিগণের অভ্যুত্থান অধিক সম্ভব। গুরুসহায় সমাজ অধিকতর বেগে অগ্রসর হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু গুরুহীন সমাজে কালে গুরুর উদয় ও জ্ঞানের বেগপ্রাপ্তি তেমনই নিশ্চিত।