ভাব্‌বার কথা (১৯১৯)/শিবের ভূত

শিবের ভূত

 (স্বামীজির দেহত্যাগের বহুকাল পরে স্বামীজীর ঘরের কাগজপত্র গুছাইবার সময় তাঁহার হাতে লেখা এই অসমাপ্ত গল্পটি পাওয়া যায়)।

 জর্ম্মানির এক জেলায় ব্যারণ “ক”য়ের বাস। অভিজাতবংশে জাত ব্যারণ “ক” তরুণ যৌবনে উচ্চপদ, মান, ধন, বিদ্যা এবং বিবিধ গুণের অধিকারী। যুবতী, সুন্দরী, বহুধনের অধিকারিণী, উচ্চকুলপ্রসুতা অনেক মহিলা ব্যারণ “ক”য়ের প্রণয়াভিলাষিণী। রূপে, গুণে, মানে, বংশে, বিদ্যায়, বয়সে, এমন জামাই পাবার জন্য কোন মা বাপের না অভিলাষ? কুলীনবংশজ এক সুন্দরী যুবতী, যুবা ব্যারণ “ক”য়ের মনও আকর্ষণ করেছেন, কিন্তু বিবাহের এখনও দেরী। ব্যারণের মান ধন সব থাকুক, এ জগতে আপনার জন নাই, এক ভগ্নী ছাড়া। সে ভগ্নী পরমা সুন্দরী বিদুষী। সে ভগ্নী নিজের মনোমত সুপাত্রকে মাল্যদান করবেন—ব্যারণ বহুধনধান্যের সহিত ভগ্নীকে সুপাত্রে সমর্পণ করবেন—তার পর নিজে বিবাহ করবেন, এই প্রতিজ্ঞা। মা বাপ ভাই সকলের স্নেহ সে ভগ্নীতে, তাঁর বিবাহ না হলে, নিজে বিবাহ করে সুখী হতে চান না। তার উপর এ পাশ্চাত্য দেশের নিয়ম হচ্ছে যে, বিবাহের পর বর—মা, বাপ, ভগ্নী, ভাই-কারুর সঙ্গে আর বাস করেন না, তাঁর স্ত্রী তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্র হন। বরং স্ত্রীর সঙ্গে শ্বশুরঘরে গিয়া বাস করা সমাজসম্মত, কিন্তু স্ত্রী স্বামীর পিতামাতার সঙ্গে বাস কর্ত্তে কখনও আস্‌তে পারে না। কাজেই নিজের বিবাহ ভগ্নীর বিবাহ পর্য্যন্ত স্থগিত রয়েছে।

* * * *

 আজ মাস কতক হলো সে ভগ্নীর কোনও খবর নাই। দাসদাসীপরিসেবিত নানাভোগের আলয়, অট্টালিকা ছেড়ে— একমাত্র ভাইয়ের অপার স্নেহবন্ধন তাচ্ছিল্য করে—সে ভগ্নী, অজ্ঞাতভাবে গৃহত্যাগ কোরে, কোথায় গিয়েছে। নানা অনুসন্ধান বিফল। সে শোক ব্যারণ “ক”য়ের বুকে বিদ্ধশূলবৎ হয়ে রয়েছে। আহার বিহারে— আর তাঁর আস্থা নাই—সদাই বিমর্ষ, সদাই মলিনমুখ। ভগ্নীর আশা ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়জনেরা ব্যারণ “ক”য়ের মানসিক স্বাস্থ্য সাধনে বিশেষ যত্ন কর্ত্তে লাগ্‌লেন। আত্মীয়েরা তাঁর জন্য বিশেষ চিন্তিত—প্রণয়িনী সদাই সশঙ্ক।

* * * *

 প্যারিসে মহাপ্রদর্শনী। নানাদিগে্দশাগত গুণিমণ্ডলীর এখন প্যারিসে সমাবেশ—নানাদেশের কারুকার্য্য, শিল্পরচনা, প্যারিসে আজ কেন্দ্রীভূত। সে আনন্দতরঙ্গের আঘাতে শোকে জড়ীকৃত হৃদয় আবার স্বাভাবিক বেগবান্ স্বাস্থ্য লাভ কর্‌বে, মন দুঃখচিন্তা ছেড়ে বিবিধ আনন্দজনক চিন্থায় আকৃষ্ট হবে—এই আশায়, আত্মীয়দের পরামর্শে বন্ধুবর্গ সমভিব্যাহারে ব্যারণ “ক” প্যারিসে যাত্রা করিলেন।