ভারতবর্ষে/কলিকাতা, দার্জ্জিলিং ও সিংহল



ভারতবর্ষে।

কলিকাতা, দার্জ্জিলিং ও সিংহল।

 দুই বৎসর হইল আঁদ্রে শেভ্রিয়োঁ নামক একজন ফরাসিস্‌ পর্য্যটক ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্ত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করিয়াছেন। ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান স্থান ও অধিবাসীদিগের আচার ব্যবহার, ধর্ম্ম, রীতিনীতি পরিদর্শন করিয়া তাঁহার মনে যখন যে ভাব উপস্থিত হইয়াছে তাহা তিনি অতি সরস ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহার লেখার ধরণ অতীব মনোরম। তাঁহার বর্ণনাশক্তি চমৎকার। তাহাতে চিত্রকরের নিপুণতা লক্ষিত হয়। দুই একটা সামান্য আঁচড় দিয়া এক-একটা ছবি কেমন জ্বলন্তরূপে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। তাঁহার বাহ্যপ্রকৃতির বর্ণনা কবিত্বরসে পূর্ণ। তাঁহার আর একটি প্রধান গুণ এই, বিদেশীয় আচার ব্যবহার, ধর্ম্ম প্রভৃতির সমালোচনায় তাঁহার লেখায় কোনপ্রকার সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ পায় না। তিনি যতদূর পারিয়াছেন, ভিতর পর্য্যন্ত তলাইয়া দেখিতে চেষ্টা করিয়াছেন, এবং দেশকালপাত্র বিবেচনা করিয়া সহৃদয়ভাবে ও উদারভাবে সমস্ত পর্য্যালোচনা করিয়াছেন। এরূপ উদারতা বোধ হয় ফরাসীদিগের জাতীয় ধর্ম্ম। ইংরাজ পর্য্যটকদিগের লেখায় এরূপ ভাব সচরাচর দেখা যায় না।

 দার্জ্জিলিঙ্গের ইংরাজ-সমাজের উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন— “এই ‘অ্যাসেম্ব্‌লি-রুমস্’-এ সন্ধ্যাকালে নৃত্য হয়—সেই সময়ে স্ত্রীপুরুষের মধ্যে রসালাপ চলে, এবং সেই রসালাপ পরিণামে বিবাহে পর্য্যবসিত হয়। ... ... এই দেখ সৈনিকের দল—রাঙ্গামুখ, ব্যায়াম-গঠিত সবল শরীর, চুল পমেটমলিপ্ত,—উহারা বারিকে জেণ্টল-ম্যানের মত বাস করে—ছড়ি হাতে, অবৈতনিকের ভাবে, বিজেতৃভাবে সদৰ্পে পায়চালি করে। এই দেখ ভদ্র ‘বোর্ডিং হাউস্’। দিনান্ত-ভোজনের উপলক্ষ্যে সবাই কালো কোর্ত্তা পরিয়াছে। বাড়ির কর্ত্রী ভোজনের আরম্ভে দস্তুরমত প্রার্থনা উচ্চারণ করিতেছেন, এবং মাংসের পাৎলা-পাৎলা, চাক্‌লা কাটিয়া ও চাপ্‌ চাপ্‌ ‘পুডিং’-এর টুক্‌রা সকলের পাতে শিষ্টতা-সহকারে চালান করিতেছেন। গৃহস্বামী, যাঁহার অস্তিত্ব বিলুপ্ত বলিলেই হয়, অথচ যাঁহার না থাকাটাও ভাল দেখায় না—তিনি গৃহের সম্ভ্রম মর্য্যাদা রক্ষা করিবার জন্যই যেন অধিষ্ঠিত। ভোজনকালে শান্তভাবে কথাবার্ত্তা আরম্ভ হইল—সে কথাবার্ত্তা সুশিক্ষিত, শান্ত ও সামাজিক লোকদিগেরই উপযুক্ত। আহারের পর বৈঠকখানায় যাওয়া গেল। একটি যুবতী মহিলা পিয়ানো বাজাইতে বসিলেন। কতকগুলি প্রেমের গান ও স্বদেশের গৌরব-সূচক গান বাজান হইল। পরদিনে কোথায় ভ্রমণ করা যাইবে স্থির করিয়া মজ্‌লিস্‌ ভঙ্গ হইল। ইহার সহিত টন্‌কিন ও ট্যুনিস্ প্রভৃতি ফরাসী উপনিবেশের তুলনা করিয়া দেখ। ফরাসী ঔপনিবেশিকেরা প্রায়ই অবিবাহিত। তাঁহাদের যেন সময় কাটে না—প্রবাসের কষ্ট তাহারা কি তীব্ররূপেই অনুভব করে। এখানে ইংরাজেরা যেন ইংলণ্ডেই রহিয়াছে। শুধু যে তাহাদের অনুষ্ঠান, তাহদের অভ্যাস, তাহাদের জাতীয় সংস্কার এখানে আনয়ন করিয়াছে তাহা নহে, নিজ জন্মস্থানের বহির্দৃশ্য ও সাজসজ্জা পর্য্যন্ত যেন এখানে উঠাইয়া আনিয়াছে। ভিন্ন দেশের সংস্পর্শে তাহদের স্বভাবের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় নাই। আসল কথা, ইংরাজেরা যেরূপ দুর্ণম্য এমন কোন জাতিই নহে—নূতন অবস্থার সহিত আপনাদিগকে উপযোগী করিয়া লইতে উহার নিতান্ত অক্ষম। আপনাদের যে ছাঁচ, যে ব্যক্তিগত ভাব, তাহা কিছুতেই তাহারা ছাড়িতে পারে না। ইহা হইতেই তাহাদের এত নৈতিক বল। কতকগুলি অপরিবর্ত্তনীয় সংস্কার থাকাতেই তাহাদের ইচ্ছার এত বল, কিন্তু আবার এই কারণেই তাহাদের সহানুভূতি ও বুদ্ধির বিকাশ সীমাবদ্ধ। ইহারা এদেশীয় লোকদিগকে একেবারেই বুঝে না, এবং বুঝিতে চেষ্টাও করে না। নিজ সভ্যতার উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান হইয়া এদেশীয় লোকদিগকে অৰ্দ্ধ-অসভ্য ‘পৌত্তলিক’ বলিয়া নিরীক্ষণ করে। এই ‘পৌত্তলিক’ শব্দটি কি হিন্দু, কি বৌদ্ধ, কি পার্সী সকলের প্রতি নির্ব্বিশেষে উহারা প্রয়োগ করিয়া থাকে। ... ... এদেশীয় লোকের মধ্যে উহারা কেবল কুলি কিম্বা খানসামার মূর্ত্তিই দেখিতে পায়—উহারা মনে করে, এদেশীয় লোকেরা মোট বহন ও জুতা সাফ করিবার পক্ষেই ভাল। দেশের সম্বন্ধেও উহাদের এই ভাব। উহারা এই দেশকে কেবল ব্যবসা বাণিজ্যের স্থান—কৃষিক্ষেত্ররূপেই দর্শন করে।“

 কলিকাতা দেখিয়া তাঁহার প্রথম সংস্কার কিরূপ হইয়াছিল তাহা এইরূপে বর্ণনা করিয়াছেন।—“কলিকাতায় তিনদিন। লোকের জনতায় হতবুদ্ধি ও গ্রীষ্মের তাপে প্রপীড়িত হইয়া কিছুই দেখি নাই। কেবল একটা সাদা রং-এর অনুভব মনের উপর ভাসিতেছিল। সাদা আলো, সাদা বাড়ি, সাদা-কাপড়পরা লোকের স্রোত রাস্তা দিয়া চলিয়াছে। ... ... দোকান, আফিস, ব্যাঙ্ক, গাড়ি-ঘোড়া, দেয়ালে-মারা বিজ্ঞাপনের সংখ্যা দেখিয়া মনে হয় যেন লণ্ডন কিম্বা প্যারিস-নগরের এক্সচেঞ্জের নিকটে আছি। প্রভেদ এই, বড় বড় কালো কোর্ত্তাপরা, নলাকার-টুপিপরা য়ুরোপীয়ের বদলে সাদা ধুতি-পরা, ক্ষুদ্র, শীর্ণ, সুকুমার স্ত্রীসুলভ মুখশ্রীসম্পন্ন বাঙ্গালীদিগের কলরব। ইহারা সিংহলবাসীদিগের মত অলস ও নিদ্রালু নহে, পরন্তু কর্ম্মশীল, চটুল, দ্রুতগামী ও জীবনউদ্যমে পরিপূর্ণ। পেন্সিলবিক্রেতা ‘হকার’ হইতে ফিটেনে-ঠেসান দেওয়া স্থূলদেহ বাবু পর্যন্ত সবাই অর্থের চেষ্টায় ফিরিতেছে। দেখিয়া বেশ অনুভব হয়, কলিকাতা নগর একটি প্রধান বাণিজ্যের স্থান—পৃথিবীর একটি মহা বিপণি।

 এশিয়া ও লণ্ডনের এই সংমিশ্রণ বড়ই অদ্ভুত। এক-এক সময়ে মনে হয় যেন লণ্ডনের ওয়েষ্টএণ্ডে হাউডপার্কের নিকটে আছি। সেই রকম বড় বড় সোজা রাস্তা, সেই রকম উত্তুঙ্গ প্রাসাদ, সেই রকম গ্রীসীয় স্তম্ভযুক্ত গাড়িবারাণ্ডা, সেই রকম বিস্তৃত পদচারণপথ, সেই রকম রেল-ঘেরা চৌকোণা নগরাঙ্গন, রাস্তার কোণে কোণে প্রতিষ্ঠিত সেই রকম ইংরাজি প্রস্তরমূর্ত্তি।”

 গ্রন্থকার এক স্থানে ইংরাজের সহিত হিন্দুর তুলনা করিয়া বলিয়াছেনঃ—“ইংরাজেরা এরূপ দুর্ণম্য ও কঠিন যে, বিশ কোটি হিন্দুদিগের মধ্যে হারাইয়া গিয়াও উহাদের কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন হয় নাই; পক্ষান্তরে হিন্দুরা লক্ষ ইংরাজের সংস্পর্শেই পরিবর্ত্তিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। কলিকাতায় দেশীয় লোকেরা ইংরাজিতে গ্রন্থ লিখিতেছে, সংবাদপত্র চালাইতেছে দেখিলাম; শুধু যে তাহাদের ইংরাজি চমৎকার তাহা নহে—তাহাতে ইংরাজি ধরণধারণ, ভাব-ভক্তি, ইংরাজি ধরণের ভাবনা, ইংরাজি ধরণের অনুভব সমস্তই বজায় দেখিতে পাওয়া যায়। কোন কোন প্রবন্ধ পাঠ করিয়া মনে হয় যেন লণ্ডনের কোন উৎকৃষ্ট সমালোচনী-পত্রিকার সম্পাদক কোন পাদ্রির লেখনী হইতে নিঃসৃত। এরূপ কতকগুলি ছাঁচ-গ্রাহী আর্টিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় যাহারা নিজত্বসম্পন্ন কোন প্রতিভাশালী ব্যক্তির সহিত কিছুকাল কথা কহিয়াই তাহার ধরণ-ধারণ, হাব-ভাব, কেতার অবিকল নকল তুলিতে পারে। কারলাইল ইঙ্গ-স্যাক্‌সন জাতির উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন—উহারা ‘পাষাণ-গঠিত জাতি’। পাষাণ-গঠিত জাতিই বটে; হিন্দুর কর্দ্দমছাঁচে স্বকীয় পাষাণ-মূর্ত্তির ছাপ বসাইয়া উহারা নিজে অবিকৃত রহিয়াছে, অথচ আপনাদিগের প্রত্যেক খোঁচ্‌ খাঁচ্‌ সেই হিন্দুর সুনম্য ছাঁচে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছে।”

 ভারতবর্ষের কতিপয় প্রধান নগরের স্বরূপ-লক্ষণ গ্রন্থকার কেমন বেশ সংক্ষেপে ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলেন—“কলিকাতা ইংরাজের ভারতবর্ষ; বারাণসী ব্রাহ্মণের ভারতবর্ষ; আগ্রা মোগলদিগের ভারতবর্ষ; আর জয়পুর রাজাদিগের ভারতবর্ষ— উপন্যাসের ভারতবর্ষ।”

 ইলোরা-গুহায় মহাদেবের মূর্ত্তি দেখিয়া গ্রন্থকার হিন্দুধর্ম্ম-সম্বন্ধে নিজ মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলেন;–“সংহার-শক্তি ও সৃজন-শক্তি ব্রাহ্মণদিগের মতে একই শক্তির বিভিন্ন আকারমাত্র; তাঁহাদের সংহারের ও সৃজনের দেবতা পৃথক্‌ নহে, একই। ইহাই ব্রাহ্মণদের মহা নূতনত্ব। অন্যান্য জাতি মনুষ্যভাবে দেবতাকে দেখিতে গিয়া—ভালমন্দ, সুন্দর কুৎসিত—এইরূপ বিভিন্ন পৃথক পৃথক্‌ আপেক্ষিক লক্ষণে আপনাদিগের দেবতাদিগকে লক্ষণাক্রান্ত করিয়াছেন। কিন্তু হিন্দুরা অসীমের দিক্ দিয়া দেখিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের নিকট দেবও নাই দানবও নাই, পরন্তু এক নিরপেক্ষ অসীম শক্তি বর্তমান; তিনিই সৃজন করেন, তিনিই সংহার করেন—তিনিই একমাত্র ‘তৎসৎ’। আরও যথাযথরূপে বলিতে গেলে, হিন্দুদিগের নিকট মৃত্যু একটি পরিবর্ত্তন মাত্র;– যে পরিবর্ত্তনের সমগ্র শ্রেণীপরম্পরাই জীবন। তাঁহারা যাহা বলেন আধুনিক বিজ্ঞানও তাহাই বলে। জীবন বিশিষ্ট জীব-বিশেষ এক-একটি আকারমাত্র—উপাদান-পুঞ্জীকরণের বিভিন্ন প্রণালীমাত্র। আমাদের দেহের কোষাণু লইয়াই আমাদের সমগ্র দেহ; সেই কোষাণু-সমূহ ক্ষণে ক্ষণে মরিতেছে—তাহাতেই আমরা জীবিত আছি। ... ... ... ... সমস্ত জগৎকে মহাসাগরের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। তাহাতে অসংখ্য তরঙ্গের হিল্লোল বহিতেছে; এই প্রত্যেক তরঙ্গ যাহা উঠিতেছে ও পড়িতেছে উহা এক একটি জীবনস্বরূপ—যাহার আরম্ভ ও শেষ আমরা দেখিতে পাই। তরঙ্গসকল যেমন ফেণোচ্ছ্বাসে ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, অমনি এক দুর্দ্দম্য শক্তি আসিয়া আবার উহাদিগকে আলোকের দিকে উর্দ্ধে উঠাইতেছে। কিন্তু কে না দেখিতে পায়, এই নৃত্যশীল তরঙ্গসকল এক-একটি আকার মাত্র, কারণ প্রতিমুহূর্ত্তেই তাহাদের উপাদান ভিন্ন হইয়া যাইতেছে—তাহাদের মধ্যে বাস্তবিক আর কিছুই নহে, যে-এক অদ্বিতীয় সাধারণ শক্তি তাহাদের মধ্যে আছে তাহাই কেবল বাস্তবিক—তাহাই সমস্ত সাগরকে বিচলিত করিয়া তুলিতেছে। কোন জীববিশেষ এই মহাশক্তির ক্ষণিক বিকাশমাত্র। সে জীব পরিবর্ত্তিত হউক, বিকৃত হউক, মৃত্যুমুখে পতিত হউক—সেই শক্তির তাহাতে কিছুমাত্র আইসে যায় না। সেই একই শিবশক্তি যাহা জগতের আদিম নৈহারিক অবস্থায় কাজ করিয়াছিল, তাহ আজও সূর্য্যে গ্রহনক্ষত্রে বিকাশিত হইয়া আমাদের ভূলোকে মহাদেশরূপে, সমুদ্ররূপে, পর্ব্বতরূপে, জীবরূপে, মনুষ্যরূপে, সমাজরূপে, নগররূপে বিকীর্ণ হইতেছে। সেই একই শিবশক্তি, দৃশ্যমান গতিকে আণবিক গতিতে পরিণত করিয়া কালসহকারে গ্রহের উপর গ্রহের পতন সংঘটন করিয়া, পরিণামে আপনার সেই অনির্দ্দেশ্য আদিম শক্তিতে ফিরিয়া যাইতেছে—যাহা হইতে সূর্য্য, গ্রহনক্ষত্র, সমুদ্র, মহাদেশ, উদ্ভিজ্জ, সমস্ত জীবপুঞ্জ পুনর্ব্বার নিঃসৃত হইতে পারে। কে বলিতে পারে, এক সৌর-জগৎ ঘুরিতে ঘুরিতে ক্রমে আর এক সৌরজগতের উপর পড়িয়া কালে সমস্ত সৃষ্টিই বিনাশ প্রাপ্ত হইবে না। হিন্দুর প্রজ্ঞা-চক্ষু এই সম্ভাবনীয় নিয়মের একটু আভাস পাইয়াছে; কারণ, তাহারা বলেন, কত অসংখ্য যুগে ব্রহ্মার একদিন হয়। সেই কালের মধ্যে নির্গুণ ব্রহ্ম অভিব্যক্ত হইয়া, বিকশিত হইয়া, জীব সৃষ্টি করিয়া, সচেতন হইয়া, পুনর্ব্বার আপনাকে সঙ্কুচিত করিয়া নির্গুণ অবস্থায় প্রত্যাবর্ত্তন করেন। এই শক্তির রূপক হিন্দুরা আর কিরূপে কল্পনা করিতে পারে—তাই তাহারা শিবকে ‘সৃষ্টিকর্ত্তা প্রলয়কর্ত্তা’ বলিয়া সম্বোধন করে।”

 গ্রন্থকার হিন্দুধর্ম্মের সর্ব্বাশ্রয়ী ও সর্ব্বসহিষ্ণু উদারভাব ও উহার গঠনপ্রণালী ঠিক ধরিতে পারিয়াছেন। তিনি এক স্থানে এইরূপ বলেনঃ—“কলিকাতায় একজন ইংরাজ আমার নিকট আক্ষেপ করিতেছিলেন, খৃষ্টধর্ম্ম-প্রচারে তেমন সফলতা হইতেছে না। ... ... ব্রাহ্মণেরা ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও কৌতুহলসহকারে খৃষ্টধর্ম্ম প্রচারকদিগের কথা শ্রবণ করে। উহাদের ধর্ম্ম এরূপ বহুভাবাত্মক ও বহুমতাত্মক যে উহাকে একটি পদার্থ মনে করিয়া ধরিতে-ছুঁইতে পারা যায় না। ইংরাজ মিশনরির মুসলমানদিগকে ধর্ম্মের তর্কে যেরূপ পরাস্ত করিতে পারে বলিয়া অভিমান করে, হিন্দুদিগকে সেরূপ পরাস্ত করা অসম্ভব। খৃষ্টীয় প্রচারকেরা যতই কেন প্রতিবন্ধক আনয়ন করুন না, তাহাতে হিন্দুধর্ম্মের গতিরোধ হওয়া দূরে থাক্, হিন্দুধর্ম্মের জীবনী-শক্তি ও উপযোগিনী-শক্তি এত বলবতী যে, সেই সকল প্রতিবন্ধককে অনায়াসে আত্মসাৎ ও পরিপাক করিয়া সে আপনার কায়া বৃদ্ধি করিয়া থাকে। এমন কি, ব্রাহ্মণের বলেন, তাহারা তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে খৃষ্টকেও প্রবিষ্ট করাইতে পারেন যদি খৃষ্টানেরা এই কথাটি মাত্র স্বীকার করেন যে, যুরোপীয়দিগের জন্য বিষ্ণু খৃষ্টের আকারে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। এইপ্রকারে, কলিকাতার আধুনিক ব্রাহ্ম-সম্প্রদায় স্বাধীন চিন্তাশীল ইংরাজ লেখকদিগের নৈতিক একেশ্বরবাদ অবলম্বন করিয়াছেন। সৃষ্টি হইতে বিভিন্ন ঈশ্বরের অনন্ত অসীম ব্যক্তিগত অস্তিত্ব, জগতের পিতৃবৎ শাসনপ্রণালী, আত্মা ও দেহের ভিন্নতা, পরকালের দণ্ড-পুরস্কার প্রভৃতি সাধারণ দার্শনিক তত্ত্বসকল যাহা আজকাল ইংলণ্ডে প্রচলিত তাহা ঐ সম্প্রদায় আত্মস্থ করিয়াছে। পূর্ব্বকালেও হিন্দুধর্ম্ম এইরূপ বৌদ্ধধর্ম্মকে একেবারে অগ্রাহ্য না করিয়া, পরন্তু উহার সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের উপকরণগুলি আস্তে আস্তে পরিত্যাগ করিয়া, কেবলমাত্র উহার সার-রসটুকু লইয়া আপনার দেহ পরিপুষ্ট করিয়াছিল। মাধুর্য্য, বিশ্বজনীন দয়াদাক্ষিণ্য,—যাহা ইতরজীব পর্য্যন্ত প্রসারিত—সন্ন্যাসধর্ম্ম, এই সকল লক্ষণের দ্বারা মনে হয়, শাক্যসিংহের আত্মা এখনও ভারতভূমিতে বিরাজ করিতেছে। এইপ্রকারে ভারতের ধর্ম্ম বাঁচিয়া আছে, ও বৃদ্ধি লাভ করিতেছে। এই ধর্ম্ম সর্ব্বাপেক্ষা সুনম্য ও অবস্থানুগামী; এবং ইহা এত জটিল, এত অসংলগ্ন ও পরিবর্ত্তনশীল উপকরণে গঠিত, উহার আকার এরূপ চঞ্চল, এত অনিশ্চিত যে উহাকে একটি-ধর্ম্ম বলিয়া মনে হয় না। এক হিসাবে, উহাকে এক ধর্ম্ম বলাও যাইতে পারে, যেমন বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জলবায়ুবিশিষ্ট এই বিচিত্র ভৌগোলিক সমষ্টিকে একদেশ বলিতেছি, কিম্বা এই বিচিত্র জাতি ও বর্ণের সম্মিলনকে আমরা এক হিন্দুজাতি বলিতেছি। এ বৈচিত্র্যের মধ্যেও একটা ঐক্যস্থল আছে। ভারতীয় ধর্ম্মের সূত্রস্থানে অদ্বৈতবাদ প্রথমে সুস্পষ্টরূপে লক্ষিত হয়; তাহার পর ত্রিশ শতাব্দী কাল ধরিয়া, জিত, ও বিজেতাদের ধর্ম্মমত মিশ্রিত হইয়া গিয়া সেই অদ্বৈতবাদ একটু তিমিরাচ্ছন্ন হইয়াছে; আজিকার দিনে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নৈতিক ও দার্শনিক মতের জাল হিন্দুধর্ম্মের মধ্যে বিস্তীর্ণ হইয়া এরূপ প্রকাণ্ড আকার ধারণ করিয়াছে যে, উহার শৃঙ্খল আর খুঁজিয়া পাওয়া ভার। এইপ্রকার, ভারতের বিস্তীর্ণ কর্দ্দমময় গঙ্গানদীও বিভিন্ন স্রোতস্বিনীর চিরপ্রবাহী স্রোতে পরিপুষ্ট হইয়া, রাশি-রাশি উদ্ভিজ্জাবশেষের ভারে আক্রান্ত হইয়া—বন, জঙ্গল, পুরাতন জনপদ, আধুনিক ইংরাজ-নগর প্রভৃতির মধ্য দিয়া অনিশ্চিত গতিতে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিয়াছে; এবং বিস্তৃত ভূমি প্লাবিত ও উর্ব্বর করিয়া, নানা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতঃ সাগরে মিলাইয়া গিয়াছে।” পাঠককে মূলগ্রন্থ পড়িতে অনুরোধ করি—তাহাতে যে তিনি আমোদ ও উপদেশ একাধারে প্রাপ্ত হইবেন ইহা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে।

(২)

 ফরাসী পর্যটক আন্দ্রে শেভ্রিয়োঁ সিংহলদ্বীপ প্রথম যখন জাহাজ হইতে দেখেন তখন তাঁহার কিরূপ মনে হইয়াছিল তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। “গত কল্য কোইট্’-খেলা দুই বাজি হইল, তাহার মধ্যে একটি ছোট ইংরাজ বালিকা,—মুখের রঙ ফ্যাঁকাসে ও স্বভাব একগুঁয়ে,—কাপ্তেনের নিকট এই অঙ্গীকার করিল, যদি আজ সন্ধ্যার সময় আমরা কলম্বো নগরে পৌছিতে পারি তাহা হইলে সে তাঁহাকে তাহার একটি মুচ্‌কি হাসি দান করিবে। পাঁচটার সময় পূর্ব্বদিকে কুয়াশার ন্যায় অস্পষ্ট কতকগুলা কালো দাগ দেখা গেল। ছয়টার সময় আকাশে বেগ্‌ণী রঙের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মেঘ-রাশি; সেই মেঘ-ভারাক্রান্ত আকাশের নীচে নারিকেলবৃক্ষসমাচ্ছন্ন একটি নিম্নভূমি দেখা দিল। যতই আমরা অগ্রসর হইতে লাগিলাম, ততই উচ্চ, সরু বৃক্ষকাণ্ডসকল স্পষ্টরূপে লক্ষিত হইল। তাহারা একটু হেলিয়া সবেগে যেন আকাশ ফুঁড়িয়া উঠিয়াছে, এবং তালজাতীয় বৃক্ষের রীত্যনুসারে শিরোদেশে শাখাপত্র বিস্তার করিয়াছে। মনে হয় যেন, একটি বিস্তৃত অরণ্য সাগর-গর্ভ হইতে হঠাৎ সমুত্থিত হইয়াছে। এখনও উপকূল এক ক্রোশ দূরে, এখনও মাটি দেখা যায় না—কেবলই ঘোর হরিৎ বর্ণ রাশি; তীরভূমির নিকটে গিয়াও আর কিছু দেখা যায় না। কেবলমাত্র বিষুবরেখাপ্রদেশ-সুলভ সেই উদ্দাম সরস উদ্ভিজ্জরাশি বর্ষা-সিঞ্চিত ভূমি হইতে সতেজে উত্থিত হইয়া মুক্ত বায়ুর আলিঙ্গনে স্বকীয় হরিৎ করতল প্রসারিত করিয়া আছে।”

 সেখানকার “ওরিএণ্টাল” নামক হোটেলে যুরোপীয় প্রভু ও দেশীয় ভৃত্যদিগের যেরূপ রকম-সকম গ্রন্থকার দেখিয়াছেন তাহা অতিসুন্দররূপে বর্ণনা করিয়াছেন। “ওরিএণ্টাল হোটেলের বাড়িটি প্রকাণ্ড ও বেশ সুখাবাস্য। হোটেল-স্বামীর আদব্‌-কায়দা খুব দুরস্ত; ভৃত্যদের প্রতি তিনি অল্প কথায় আমাকে যথাস্থানে স্থাপিত করিবার আজ্ঞা প্রচার করিলেন; তাহার সেই আজ্ঞা ভৃত্যেরা নীরবে নতমস্তকে গ্রহণ করিয়া আমাকে একটি সৌধ-ধবল বড় কামরা দেখাইয়া দিল। বেশী আসবাব নাই—কেবল একটিমাত্র মশারি-টাঙ্গানো লোহার খাট; আর, একটি বেতে-ছাওয়া গভীর-তল আরাম-চৌকি; নিস্তব্ধ ও দুর্যাপ্য সময়ে সেই চৌকির মধ্যে ডুবিয়া থাকিতে বেশ। কামরার চাঁদোয়া-ছাদে একটি অদ্ভুত দাগ; প্রথম একটি, পরে দুই তিনটি অচল ক্ষুদ্র টিক্‌টিকি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি-সহকারে আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। ঘরের আশ-পাশের দীর্ঘ ঢাকা-বারাণ্ডায় ক্ষীণদেহ কোমলাঙ্গ বাঙ্গালী ও সিংহলী ভৃত্যের পাল নিঃশব্দে ও ত্রস্তভাবে যাতায়াত করিতেছে। দীর্ঘকায় গুরুভার-দেহ য়ুরোপীয়দিগের নিকট, এবং যে সকল প্রশান্ত ও পেশীবহুল ইংরাজ সায়াহ্ন-পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া, ঝকঝকে ফ্রিল-দেওয়া সাদা কামিজ বুকের নিকট বাহির করিয়া, মানব অপেক্ষা যেন কোন উৎকৃষ্টতর দুরধিগম্য জীব এইরূপ ভাণ ও ভাবভঙ্গী-সহকারে সেই বৃহৎ ভোজনশালায় প্রবেশ করিতেছিল,—তাহাদিগের নিকট ভৃত্যেরা অত্যন্ত বিনয়াবনত।”

 কান্দিনগরে যাইবার সময়ে রেলগাড়িতে ইঙ্গ-বঙ্গের ন্যায় একজন ইংরাজ বেশধারী ইঙ্গ-সিংহলীর সহিত গ্রন্থকারের আলাপ হয়। তিনি বলেন,—“কান্দিতে যাইবার জন্য ট্রেণ ধরিলাম, এবং গাড়ির মধ্যে একজন সিংহলী ‘জেন্‌টল্‌ম্যানের’ সহিত আলাপ হইল। এই ‘জেন্‌টল্‌ম্যানটি’ অতি সুসভ্য; তাঁহার ‘টুয়িড্‌’ কাপড়ের ফতুয়ার পরিধানে কোন খুঁৎ নাই, এমন কি, একজন লণ্ডনের ‘ম্যাশর’ তাহা পরিয়া গর্ব্বানুভব করিতে পারেন। তাহার বোদামের ছিদ্র ‘জার্ডিনিয়া’ পুষ্পে ভূষিত; তাঁহার পদদ্বয় কেবল, সাদা সরু কষা পায়জামার মধ্যে আবদ্ধ। তাঁহার মুখশ্রী প্রায় যুরোপীয়। বরং একজন ইটালিয়ান তাঁহার অপেক্ষা অধিক ক্ষীণদেহ, কোমলাঙ্গ ও রৌদ্রদগ্ধ। তাঁহার মুখাবয়ব-সকল বহিরুন্মুখ ও অস্থিময়। তাহার চকচকে শক্ত কালো কোঁক্‌ড়া দাড়ি। সওয়া ঘণ্টা নীরবতার পর, য়ুরোপের রেলগাড়িতে যেরূপ হইয়া থাকে, সেইরূপ কথাবার্তা আরম্ভ হইল। তিনি আমাকে দেশলাই-বাক্‌স দিবার জন্য উদ্যত হইলেন এবং বলিলেন, বড় গরম হইতেছে। ইংরাজের দেশে শীতোত্তাপের কথা পাড়িয়াই আলাপের প্রথম সূত্রপাত হয়, এবং দুই জনে আলাপ করিতে হইলে, কথার আরম্ভে এই গৌরচন্দ্রিমা নিতান্তই আবশ্যক। এক্ষণে তিনি কতকগুলি সুস্পষ্ট কথায় সিংহল দ্বীপের লোকসংখ্যা, শাসনপ্রণালী ও ধর্ম্ম আমাকে বুঝাইয়া দিলেন। ক্রমশঃ যতই তিনি বলিতে লাগিলেন, তাঁহার কথাবার্ত্তায় আমার ধারণা হইল, ইংরাজি ছাঁচের ছাপ তাঁহাতে কতটা গভীর বসিয়াছে। তিনি আশ্চর্য্য বিশুদ্ধতার সহিত ইংরাজি ভাষায় কথা কহেন—তাহাতে কোন প্রকার অযথা উচ্চারণের টান আছে বলিয়া অনুভব হয় না। ইনি খৃষ্টান্‌, কৌসুলি ও এখানকার ব্যবস্থাপক সভার সভ্য। ইনি যেরূপ ঘৃণামিশ্রিত কৃপাকটাক্ষ-সহকারে সিংহলবাসী চাষাদিগের অজ্ঞতা ও পৌত্তলিকতার কথা বলিলেন, তাহা ইংরাজ ঔপনিবেশিকেরই মুখে শোভা পায়। তবে, তিনি বলিলেন, পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে অনেকটা পরিবর্ত্তন হইবে; ইতিমধ্যেই রেল-গাড়ি অনেকটা ভাল কাজ করিয়াছে; লৌহপথের সম্মুখ হইতে অসভ্য প্রদেশসকল যেন পিছু হটিয়া যাইতেছে। কলম্বোতে আমরা কলিকাতা, বোম্বাই ও বারাণসীর ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে ইচ্ছুক হইয়াছি এবং কিছুকাল পরে যখন আমরা উপযুক্ত হইব, জাতীয় নির্ব্বাচনমূলক পার্লামেণ্ট সভা প্রবর্ত্তিত করিবারও আমাদের ইচ্ছা আছে। তাহা অবশ্য অল্পে অল্পে ক্রমশঃ হইবে। ব্রিটিশ-সাম্রাজ্য হইতে আমরা একেবারে বিচ্ছিন্ন হইতে চাহি না—কারণ ইংলণ্ডের প্রসাদেই আমরা সভ্যজগতে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াছি। আরও এই কথা বলেন যে,তিনি ‘আর্য্যজাতীয়’; এবিষয়ে তাহার এতটা ধ্রুব বিশ্বাস, যেমন আমার ধ্রুব বিশ্বাস আমি ফরাসিস্‌। সুতরাং তিনি আপনাকে সকল য়ুরোপীয়দিগের সমকক্ষ এবং অনেক য়ুরোপীয়দিগের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করেন। যাহাই হউক, ইনি বড় বেশী রকম ইংরেজ; প্রত্যক্ষ দেখা যায়, ইঁহার নিকট, ইংরাজই যেন মানবজাতির উৎকৃষ্ট আদর্শস্থল। কিন্তু ইংরাজের এতটা অবিকল ‘কাপি’ বা অনুলিপি আসলে স্বাভাবিক নহে। তা’ছাড়া, তাঁহার পরিহিত সাদা পায়জামা এবং সেই এসিয়াবাসীসুলভ মুখশ্রীর দুই-এক পোঁচ যাহা তাঁহার মুখে জাজ্বল্যমান, তাহার সহিত এই সমস্ত য়ুরোপীয় বাহ্যাড়ম্বর একটু বিসদৃশ বলিয়া মনে হয়। আসল কথা, একজন লম্বিতবেণী ও নীল রঙ্গের আলখাল্লা-পরা চীনেম্যান্‌কে ভাল লাগে, তবু জ্যাকেট-পরা ও বিলাতী টুপীপরা জাপানীকে ভাল লাগে না। এই সকল পীত ও কৃষ্ণচর্ম্মধারী লোকেরা যেরূপ আশ্চর্য নিপুণতার সহিত আমাদিগের অনুকরণ করে তাহাতে একটু সন্দেহ জন্মে; মনে এই প্রশ্ন উপস্থিত হয়, এই অনুকরণ শুধু উপরি-উপরি ভাসা-ভাসা, না, তাহা ছাড়াইয়া আরও কিছু দূর যায়?—বাস্তবিক মূলে কি সেই মোগল কিম্বা কাফ্রির রহস্য প্রচ্ছন্ন নাই?—এই ব্যক্তি যেরূপে ঠাণ্ডাভাবে বাক্যোচ্চারণ করেন, ইঁহার চাল্‌-চোল্‌ যেরূপ খট্খটে ও অনম্য— ইনি যেরূপ সবিলম্ব আগ্রহ-শূন্য তাচ্ছিল্যভাবের ভঙ্গী-সহকারে সাদা ঝিনুকের বাক্স হইতে সিগারেট চুরোট বাহির করেন, তাহাতে আমি ইহার প্রত্যেক ধরণধারণে আশ্চর্য্য হইতেছি।”

 গ্রন্থকার পণ্ডিচারিতে যখন পৌছিলেন, তখন তাঁহার একজন সহযাত্রী ফরাসী-গবর্ণমেণ্টের উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী জাহাজ হইতে নামিতেছিলেন। এই কর্ম্মচারীকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য পণ্ডিচারির দেশীয় ও যুরোপীয় তাবৎ সম্ভ্রান্ত লোক সমবেত হইয়াছিল। আমাদের দেশে গবর্ণর প্রভৃতিকে অভ্যর্থনা করিবার সময় যেরূপ সৈন্যশ্রেণী রাজপথে দাঁড় করাইয়া দিয়া, বিজয়তোরণ নির্ম্মাণ করিয়া মহাসমারোহে নানা অনুষ্ঠান করা হয়, এখানেও তৎসমস্ত অনুষ্ঠিত হইয়াছিল—তবে, পণ্ডিচারিতে ফরাসী গবর্ণমেণ্টের তিন শত মাত্র সৈন্য। এই তিন শত সৈন্য লইয়া অলীক যুদ্ধ প্রদর্শন করা নিতান্ত ছেলেখেলা বলিয়া মনে হয়। গ্রন্থকার বিদ্রূপের ভাবে বলেন যে, এই সমারোহের সময়ে ঐ সকল সৈনিকেরা বন্দুকের গুঁতার দ্বারা দেশীয় লোকদিগকে সরাইয়া দিতে ও য়ুরোপীয় দেখিলেই সসম্ভ্রমে পথ ছাড়িয়া দিতে ক্রটি করে নাই। সেই নবাগত উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারীর নিকট পণ্ডিচারির বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগের দস্তুর-মত পরিচয় দান এবং রাজকর্ম্মচারীদিগের সস্মিত বদনমণ্ডলের ভাব প্রভৃতি গ্রন্থকার বর্ণনা করিয়াছেন। যখন সেই পরিচয়দানের অনুষ্ঠান হইতেছিল, মহা জাঁকজমক করিয়া একজন দেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নবাগত কর্ম্মচারীর নিকট আসিয়া মস্তক নত করিল। ইঁহার হস্তে একটি রৌপ্য-দণ্ড ছিল। পূর্ব্বকালের ইংরাজ-ফরাসীযুদ্ধে, ফরাসীদিগের যখন কামানের গোল ফুরাইয়া যায়, তখন এই ব্যক্তির পূর্ব্বপুরুষেরা রাশি-রাশি খনিজ স্বর্ণপিণ্ড গোলারূপে ব্যবহার করিবার জন্য ফরাসীদিগকে দান করিয়াছিল। তাই তাহার প্রতিদান-স্বরূপ ফরাসী গবর্ণমেণ্ট তাহার সম্মানার্থ একটি রৌপ্য-দণ্ড বক্‌সিস্‌ করেন। ইহা নিঃস্বার্থ রাজভক্তির একটি জলন্ত দৃষ্টান্ত।

 গ্রন্থকার এদেশীয় স্ত্রীলোকদের গঠন-সম্বন্ধে এইরূপ বলেন। “এই সকল স্ত্রীলোক সাদাসিধা অথচ জমকাল পরিচ্ছদ পরিধান করে। ইহার যখন চলা-ফেরা করে তখন যেমন চক্ষের তৃপ্তি হয়, এমন আর কিছুতে হয় না। মাথায় পিতলের ঘড়া লইয়া যেরূপ ইহারা পশ্চাতে একটু হেলিয়া সটান-ভাবে দণ্ডায়মান হয়, তাহাতে তাহাদের সুন্দর গঠন-রেখাসকল দিব্য প্রকাশ পায়। বিচিত্ররঙের উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও, উহাদিগকে দেখিয়া পুরাকালের গ্রীক রমণীদিগকে মনে পড়ে। সেই একই প্রস্তরমূর্ত্তিবৎ দেহভঙ্গী, সেই একই অঙ্গভঙ্গীর প্রশান্ত ভাব—সেই একই মুক্ত বায়ুতে জীবনযাপন—সেই একই ছোট ছোট মৃত্তিকা-নির্ম্মিত ঘরে বাস। এই সকল ঘর নিম্ন, ঠাণ্ডা, সাদা ধব্‌ধবে, চৌকোণা ও আসবাব বিরহিত; এবং তাহাদের ছায়ায় বসিয়া রমণীগণ সুতাকাটা কার্য্যে নিযুক্ত।”

 গ্রন্থকার পণ্ডিচারিতে ডুপ্লের প্রস্তরমূর্ত্তি দেখিয়াছিলেন, এবং তাহার উল্লেখ করিয়া তিনি এই কথা বলেন, “একজন ইংরাজ আমাকে বলেন, ডুপ্লে একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি—তিনি আমাদের কিছু কষ্ট দিয়া গিয়াছেন। সীমান্ত-প্রদেশের চতুর্দ্দিকে শুল্ক-আদায়ের আড্‌ডা স্থাপন করিতে আমরা বাধ্য হইয়াছি, এবং আমাদের যত চোর সব পলাইয়া তোমাদের ওখানে বাস করে। এই উপনিবেশটি রাখিয়া তোমাদের কি লাভ? একজন ফরাসি তাহার উত্তরে এই কথা বলেন,—লাভ আর কিছুই নয়, ইহার অর্থ এই মাত্র, ভারতবর্ষে ডুপ্লের একটি প্রস্তরমূর্ত্তি থাকা আবশ্যক এবং তাহা তাহার নিজ-স্থানেই স্থাপিত হওয়া প্রার্থনীয়।”