ভারতবর্ষ/প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা
ফরাসী মনীষী গিজো য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রকৃতি-সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা আমাদের আলোচনার যোগ্য। প্রথমে তাঁহার মত নিম্নে উদ্ধৃত করি।
তিনি বলেন, আধুনিক যুরোপীয় সভ্যতার পূর্ব্ববর্ত্তী কালে, কি এসিয়ায় কি অন্যত্র, এমন কি, প্রাচীন গ্রীস্রোমেও, সভ্যতার মধ্যে একটি একমুখীভাব দেখিতে পাওয়া যায়। প্রত্যেক সভ্যতা যেন একটি মূল হইতে উঠিয়াছে এবং একটি ভাবকে আশ্রয় করিয়া অধিষ্ঠিত রহিয়াছে। সমাজের মধ্যে তাহার প্রত্যেক অনুষ্ঠানে, তাহার আচারে বিচারে, তাহার অবয়ববিকাশে, সেই একটি স্থায়ী ভাবেরই কর্ত্তৃত্ব দেখা যায়।
যেমন, ইজিপ্টে এক পুরোহিতশাসনতন্ত্রে সমস্ত সমাজকে অধিকার করিয়া বসিয়াছিল; তাহার আচার-ব্যবহারে, তাহার কীর্ত্তিস্তম্ভগুলিতে, ইহারই একমাত্র প্রভাব। ভারতবর্ষেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রেই সমস্ত সমাজকে একভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিল।
সময়ে সময়ে ইহাদের মধ্যে ভিন্ন শক্তির বিরোধ উপস্থিত হয় নাই, তাহা বলা যায় না; কিন্তু তাহারা সেই কর্ত্তৃভাবের দ্বারা পরাস্ত হইয়াছে।
এইরূপ একভাবের কর্ত্তৃত্বে ভিন্ন দেশ ভিন্নরূপ ফললাভ করিয়াছে। সমগ্র সমাজের মধ্যে এই ভাবের ঐক্যবশত গ্রীস অতি আশ্চর্য্য দ্রুতবেগে এক অপূর্ব্ব উন্নতি লাভ করিয়াছিল। আর কোন জাতিই এত অল্পকালের মধ্যে এমন উজ্জ্বলতা লাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু গ্রীস তাহার উন্নতির চরমে উঠিতে না উঠিতেই যেন জীর্ণ হইয়া পড়িল। তাহার অবনতিও বড় আকস্মিক। যে মূলভাবে গ্রীক্ সভ্যতায় প্রাণসঞ্চার করিয়াছিল, তাহা যেন রিক্ত নিঃশেষিত হইয়া গেল; আর কোন নূতন শক্তি আসিয়া তাহাকে বলদান বা তাহার স্থান অধিকার করিল না।
অপরপক্ষে, ভারতবর্ষে ও ইজিপ্টেও সভ্যতার মূলভাব এক বটে, কিন্তু সমাজকে তাহা অচল করিয়া রাথিল। তাহার সরলতায় সমস্ত যেন একঘেয়ে হইয়া গেল। দেশ ধ্বংস হইল না, সমাজ টিঁকিয়া রহিল, কিন্তু কিছুই অগ্রসর হইল না, সমস্তই একজায়গায় আসিয়া বন্ধ হইয়া গেল।
প্রাচীন সভ্যতামাত্রেই একটা না একটা কিছুর একাধিপত্য ছিল। সে আর কাহাকেও কাছে আসিতে দিত না, সে আপনার চারিদিকে আটঘাট বাঁধিয়া রাখিত। এই ঐক্য, এই সরলতার ভাব সাহিত্যে এবং লোকসকলের বুদ্ধিচেষ্টার মধ্যেও আপন শাসন বিস্তার করিত। এই কারণেই প্রাচীন হিন্দুর ধর্ম ও চারিত্র গ্রন্থে, ইতিহাসে কাব্যে সর্ব্বত্রই একই চেহারা দেখিতে পাওয়া যায়। তাহাদের জ্ঞানে এবং কল্পনায়, তাহাদের জীবনযাত্রায় এবং অনুষ্ঠানে, এই একই ছাঁদ। এমন কি, গ্রীসেও জ্ঞানবুদ্ধির বিপুলব্যাপ্তিসত্ত্বেও তাহার সাহিত্যে ও শিল্পে এক আশ্চর্য্য একপ্রবণতা দেখা যায়।
য়ুরোপের আধুনিক সভ্যতা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই সভ্যতার উপর দিয়া একবার চোখ বুলাইয়া যাও, দেখিবে, তাহা কি বিচিত্র, জটিল এবং বিক্ষুব্ধ। ইহার অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রের সকল রকম মূলতত্ত্বই বিরাজমান; লৌকিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি, পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, প্রধানতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজ-পদ্ধতির সকল পর্য্যায়, সকল অবস্থাই, বিজড়িত হইয়া দৃশ্যমান; স্বাধীনতা, ঐশ্বর্য্য এবং ক্ষমতার সর্ব্বপ্রকার ক্রমান্বয় ইহার মধ্যে স্থান গ্রহণ করিয়াছে। এই বিচিত্রশক্তি স্থির নাই, ইহারা আপনা-আপনির মধ্যে কেবলি লড়িতেছে। অথচ ইহাদের কেহই আর সকলকেই অভিভূত করিয়া সমাজকে একা অধিকার করিতে পারে না। একই কালে সমস্ত বিরোধি-শক্তি পাশাপাশি কাজ করিতেছে; কিন্তু তাহাদের বৈচিত্র্যসত্ত্বেও তাহাদের মধ্যে একটি পারিবারিক সাদৃশ্য দেখিতে পাই,—তাহাদিগকে য়ুরোপীয় বলিয়া চিনিতে পারা যায়।
চারিত্রে, মতে এবং ভাবেও এইরূপ বৈচিত্র্য এবং বিরোধ। তাহারা অহরহ পরস্পরকে লঙ্ঘন করিতেছে, আঘাত করিতেছে, সীমাবদ্ধ করিতেছে, রূপান্তরিত করিতেছে এবং পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইতেছে। একদিকে স্বাতন্ত্র্যের দুরন্ত তৃষ্ণা, অন্যদিকে একান্ত বাধ্যতা শক্তি; মনুষ্যে মনুষ্যে আশ্চর্য্য বিশ্বাসবন্ধন, অথচ সমস্ত শৃঙ্খল মোচনপূর্ব্বক বিশ্বের আর কাহারো প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করিয়া একাকী নিজের স্বেচ্ছামতে চলিবার উদ্ধত বাসনা। সমাজ যেমন বিচিত্র, মনও তেমতি বিচিত্র।
আবার সাহিত্যেও সেই বৈচিত্র্য। এই সাহিত্যে মানবমনের চেষ্টা বহুধা বিভক্ত, বিষয় বিবিধ, এবং গভীরতা দূরগামিনী। সেই জন্যই সাহিত্যের বাহ্য আকার ও আদর্শ প্রাচীনসাহিত্যের ন্যায় বিশুদ্ধ, সরল ও সম্পূর্ণ নহে। সাহিত্যে ও শিল্পে ভাবের পরিস্ফূটতা, সরলতা ও ঐক্য হইতেই রচনার সৌন্দর্য উদ্ভূত হইয়া থাকে। কিন্তু বর্তমান য়ুরোপে ভাব ও চিন্তার অপরিসীম বহুলতায়, রচনার এই মহৎ বিশুদ্ধ সারল্য রক্ষা করা উত্তরোত্তর কঠিন হইতেছে।
আধুনিক য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রত্যেক অংশে প্রত্যংশেই আমরা এই বিচিত্র প্রকৃতি দেখিতে পাই। নিঃসন্দেহ ইহার অসুবিধাও আছে। ইহার কোন একটা অংশকে পৃথক্ করিয়া দেখিতে গেলে, হয় ত, প্রাচীনকালের তুলনায় খর্ব্ব দেখিতে পাইব—কিন্তু সমগ্রভাবে দেখিলে, ইহার ঐশ্বর্য্য আমাদের কাছে প্রতীয়মান হইবে।
য়ুরোপীয় সভ্যতা পঞ্চদশ-শতাব্দ-কাল টিঁকিয়া আছে এবং বরাবর অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। ইহা গ্রীক্সভ্যতার ন্যায় তেমন দ্রুতবেগে চলিতে পারে নাই বটে, কিন্তু পদে পদে নব নব অভিঘাত প্রাপ্ত হইয়া এখনো ইহা সম্মুখে ধাবমান। অন্যান্য সভ্যতায় এক ভাব—এক আদর্শের একাধিপত্যে অধীনতাবন্ধনের সৃষ্টি করিয়াছিল, কিন্তু যুরোপে কোন এক সামাজিক শক্তি অপর শক্তিগুলিকে সম্পূর্ণ অভিভূত করিতে না পারায়, এবং ঘাতপ্রতিঘাতে পরস্পরকে সচেতন অথচ সংযত করিয়া রাখায়, য়ুরোপীয় সভ্যতায় স্বাধীনতার জন্ম হইয়াছে। ক্রমাগত বিবাদে এই সকল বিরোধি-শক্তি আপসে একটা বোঝাপড়া করিয়া সমাজে আপন আপন অধিকার নির্দ্দিষ্ট করিয়া লইয়াছে; এইজন্য ইহারা পরস্পরকে উচ্ছেদ করিবার জন্য সচেষ্ট থাকে না, এবং নানা প্রতিকূলপক্ষ আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলিতে পারে।
ইহাই আধুনিক য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলপ্রকৃতি, ইহাই ইহার শ্রেষ্ঠত্ব।
গিজো বলেন, বিশ্বজগতের মধ্যেও এই বৈচিত্র্যের সংগ্রাম। ইহা সুস্পষ্ট যে, কোন একটি নিয়ম, কোন এক প্রকারের গঠনতন্ত্র, কোন একটি সরলভাব, কোন একটি বিশেষ শক্তি, সমস্ত বিশ্বকে একা অধিকার করিয়া, তাহাকে একটিমাত্র কঠিন ছাঁচে ফেলিয়া, সমস্ত বিরোধী প্রভাবকে দূর করিয়া, শাসন করিবার ক্ষমতা পায় নাই। বিশ্বে নানা শক্তি, নানা তত্ত্ব, নানা তন্ত্র, জড়িত হইয়া যুদ্ধ করে, পরস্পরকে গঠিত করে, কেহ কাহাকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে না, সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় না।
অথচ এই সকল গঠন, তত্ত্ব ও ভাবের বৈচিত্র্য—তাহাদের সংগ্রাম ও বেগ, একটি বিশেষ ঐক্য—একটি বিশেষ আদর্শের অভিমুখে চলিয়াছে। য়ুরোপীয় সভ্যতাই এইরূপ বিশ্বতন্ত্রের প্রতিবিম্ব। ইহা সঙ্কীর্ণরূপে সীমাবদ্ধ, একরত ও অচল নহে। জগতে সত্যতা এই প্রথম নিজের বিশেষ মূর্ত্তি বর্জ্জন করিয়া দেখা দিয়াছে। এই প্রথম ইহার বিকাশ বিশ্বব্যাপারের বিকাশের ন্যায় বহুবিভক্ত, বিপুল এবং বহুচেষ্টাগত। য়ুরোপীয় সভ্যতা এইরূপে চিরন্তন সত্যের পথ পাইয়াছে, তাহা জগদীশ্বরের কার্য্যপ্রণালীর ধারা গ্রহণ করিয়াছে, ঈশ্বর যে পথ নির্ম্মাণ করিয়াছেন, এ সভ্যতা সেই পথে অগ্রসর হইতেছে। এ সভ্যতার শ্রেষ্ঠতাতত্ত্ব এই সত্যের উপরেই নির্ভর করে।
গিজোর মত আমরা উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।
য়ুরোপীয় সভ্যতা এক্ষণে বিপুলায়তন ধারণ করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। য়ুরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া—তিন মহাদেশ এই সভ্যতাকে বহন পোযণ করিতেছে। এত ভিন্ন ভিন্ন বহুসংখ্যক দেশের উপরে এক মহাসভ্যতার প্রতিষ্ঠা, পৃথিবীতে এমন আশ্চর্য্য বৃহদ্ব্যাপার, ইতিপূর্ব্বে আর ঘটে নাই। সুতরাং কিসের সঙ্গে তুলনা করিয়া ইহার বিচার করিব? কোন্ ইতিহাসের সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া ইহার পরিণাম নির্ণয় করিব? অন্য সকল সভ্যতাই একদেশের সভ্যতা, এক জাতির সভ্যতা। সেই জাতি যতদিন ইন্ধন যোগাইয়াছে, ততদিন তাহা জ্বলিয়াছে, তাহার পরে তাহা নিবিয়া গেছে, অথবা ভস্মাচ্ছন্ন হইয়াছে। য়ুরোপীয় সভ্যতাহোমানলের সমিধ্কাষ্ঠ যোগাইবার ভার লইয়াছে—নানা দেশ নানা জাতি। অতএব এই যজ্ঞ-হুতাশন কি নিবিবে, না, ব্যাপ্ত হইয়া সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করিবে? কিন্তু এই সভ্যতার মধ্যেও একটি কর্ত্তৃভাব আছে,—কোন সভ্যতাই আকারপ্রকারহীন হইতে পারে না। ইহার সমস্ত অবয়বকে চালনা করিতেছে, এমন একটি বিশেষ শক্তি নিশ্চয়ই আছে। সেই শক্তির অভ্যুদয় ও পরাভবের উপরেই এই সভ্যতার উন্নতি ও ধ্বংস নির্ভর করে। তাহা কি? তাহার বহুবিচিত্র চেষ্টা ও স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ঐক্যতন্ত্র কোথায়?
য়ুরোপীয় সভ্যতাকে দেশে দেশে খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখিলে, অন্য সকল বিষয়েই তাহার স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য দেখা যায়, কেবল একটা বিষয়ে তাহার ঐক্য দেখিতে পাই। তাহা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ।
ইংলণ্ডে বল, ফ্রান্সে বল, আর সকল বিষয়েই জনসাধারণের মধ্যে মতবিশ্বাসের প্রভেদ থাকিতে পারে, কিন্তু স্ব স্ব রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রাণপণে রক্ষা ও পোষণ করিতে হইবে, এ সম্বন্ধে মতভেদ নাই। সেইখানে তাহারা একাগ্র, তাহারা প্রবল, তাহারা নিষ্ঠুর, সেইখানে আঘাত লাগিলেই সমস্ত দেশ একমূর্ত্তি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান হয়। জাতিরক্ষা আমাদের যেমন একটা গভীর সংস্কারের মত হইয়া গেছে, রাষ্ট্রীয়স্বার্থরক্ষা য়ুরোপের সর্ব্বসাধারণের তেমনি একটি অন্তর্নিহিত সংস্কার।
ইতিহাসের কোন্ গৃঢ়নিয়মে দেশবিশেষের সভ্যতা ভাববিশেষকে অবলম্বন করে, তাহা নির্ণয় করা কঠিন; কিন্তু ইহা সুনিশ্চিত যে, যখন সেই ভাব তাহার অপেক্ষা উচ্চতর ভাবকে হনন করিয়া বসে, তখন ধ্বংস অদূরবর্ত্তী হয়।
প্রত্যেক জাতির যেমন একটি জাতিধর্ম্ম আছে, তেমনি জাতিধর্ম্মের অতীত একটি শ্রেষ্ঠধর্ম্ম আছে, তাহা মানবসাধারণের। আমাদের দেশে বর্ণাশ্রমধর্ম্মে যখন সেই উচ্চতর ধর্ম্মকে আঘাত করিল, তখন ধর্ম্ম তাহাকে আঘাত করিল—
এক সময় আর্য্যসভ্যতা আত্মরক্ষার জন্য ব্রাহ্মণশূদ্রে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান রচনা করিয়াছিল। কিন্তু ক্রমে সেই ব্যবধান বর্ণাশ্রমধর্ম্মের উচ্চতর ধর্ম্মকে পীড়িত করিল। বর্ণাশ্রম আপনাকে রক্ষা করিবার জন্য চেষ্টা করিল, কিন্তু ধর্ম্মকে রক্ষার জন্য চেষ্টা করিল না। সে যখন উচ্চ অঙ্গের মনুষ্যত্বচর্চ্চা হইতে শূদ্রকে একেবারে বঞ্চিত করিল, তখন ধর্ম্ম তাহার প্রতিশোধ লইল। তখন ব্রাহ্মণ্য আপন জ্ঞানধর্ম্ম লইয়া পূর্বের মতো আর অগ্রসর হইতে পারিল না। অজ্ঞানজড় শূদ্রসম্প্রদায় সমাজকে গুরুভারে আকৃষ্ট করিয়া নীচের দিকে টানিয়া রাখিল। শূদ্রকে ব্রাহ্মণ উপরে উঠিতে দেয় নাই, কিন্তু শূদ্র ব্রাহ্মণকে নীচে নামাইল। আজিও ভারতে ব্রাহ্মণপ্রধান বর্ণাশ্রম থাকা সত্ত্বেও শূদ্রের সংস্কারে, নিকৃষ্ট অধিকারীর অজ্ঞানতায়, ব্রাহ্মণসমাজ পর্যন্ত আচ্ছন্ন আবিষ্ট।
ইংরাজের আগমনে যখন জ্ঞানের বন্ধনমুক্তি হইল, যখন সকল মনুষ্যই মনুষ্যত্বলাভের অধিকারী হইল, তখনই ব্রাহ্মণধর্মের মূর্ছাপগমের লক্ষণ প্রকাশ পাইল। আজ ব্রাহ্মণ শূদ্রে সকলে মিলিয়া হিন্দুজাতির অন্তর্নিহিত আদর্শের বিশুদ্ধ মূর্তি দেখিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। শূদ্রেরা আজ জাগিতেছে বলিয়াই ব্রাহ্মণধর্মও জাগিবার উপক্রম করিতেছে।
যাহাই হউক, আমাদের বর্ণাশ্রমধর্মের সংকীর্ণতা নিত্যধর্মকে নানা স্থানে খর্ব করিয়াছিল বলিয়াই তাহা উন্নতির দিকে না গিয়া বিকৃতির পথেই গেল।
য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলভিত্তি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ যদি এত অধিক স্ফীতিলাভ করে যে, ধর্মের সীমাকে অতিক্রম করিতে থাকে, তবে বিনাশের ছিদ্র দেখা দিবে এবং সেই পথে শনি প্রবেশ করিবে।
স্বার্থের প্রকৃতিই বিরোধ। য়ুরোপীয় সভ্যতার সীমায় সীমায় সেই বিরোধ উত্তরোত্তর কণ্টকিত হইয়া উঠিতেছে। পৃথিবী লইয়া ঠেলাঠেলি কাড়াকাড়ি পড়িবে, তাহার পূর্বসূচনা দেখা যাইতেছে।
ইহাও দেখিতেছি, য়ুরোপের এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থপরতা ধর্মকে প্রকাশ্যভাবে অবজ্ঞা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ’জোর যার মুলুক তার’এ নীতি স্বীকার করিতে আর লজ্জা বোধ করিতেছে না।
ইহাও স্পষ্ট দেখিতেছি, যে ধর্মনীতি ব্যক্তিবিশেষের নিকট বরণীয় তাহা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আবশ্যকের অনুরোধে বর্জ্জনীয় এ কথা একপ্রকার সর্ব্বজনগ্রাহ্য হইয়া উঠিতেছে। রাষ্ট্রতন্ত্রে মিথ্যাচরণ, সত্যভঙ্গ, প্রবঞ্চনা, এখন আর লজ্জাজনক বলিয়া গণ্য হয় না। যে-সকল জাতি মনুষ্যে মনুষ্যে ব্যবহারে সত্যের মর্যাদা রাখে, ন্যায়াচরণকে শ্রেয়োজ্ঞান করে, রাষ্ট্রতন্ত্রে তাহাদেরও ধর্ম্মবোধ অসাড় হইয়া থাকে। সেইজন্য ফরাসি, ইংরাজ, জর্ম্মাণ, রুশ, ইহারা পরস্পরকে কপট, ভণ্ড, প্রবঞ্চক, বলিয়া উচ্চস্বরে গালি দিতেছে।
ইহা হইতে এই প্রমাণ হয় যে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে য়ুরোপীয় সভ্যতা এতই আত্যন্তিক প্রাধান্য দিতেছে যে, সে ক্রমশই স্পর্ধিত হইয়া ধ্রুবধর্ম্মের উপর হস্তক্ষেপ করিতে উদ্যত হইয়াছে। এখন গত শতাব্দীর সাম্য-সৌভ্রাত্রের মন্ত্র য়ুরোপের পরিহাসবাক্য হইয়া উঠিয়াছে। এখন খ্রীস্টান্ মিশনারিদের মুখেও ‘ভাই'কথার মধ্যে ভ্রাতৃভাবের সুর লাগে না।
জগদ্বিখ্যাত পরিহাসরসিক মার্কটোয়েন গত ফেব্রুয়ারি মাসের ‘নর্থ আমেরিকান রিভিয়ু’ পত্রে ‘তিমিরবাসী ব্যক্তিটির প্রতি’ (To The person sitting in darkness) নামক যে প্রবন্ধ লিখিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে আধুনিক সভ্যতার ব্যাধিলক্ষণ কিছু কিছু চোখে পড়িবে। তীব্র পরিহাসের দ্বারা প্রখরশাণিত সেই প্রবন্ধটি বাঙলায় অনুবাদ করা অসম্ভব। লেখাটি সভ্যমণ্ডলীর রুচিকর হয় নাই; কিন্তু শ্রদ্ধেয় লেখক স্বার্থপর সভ্যতার বর্ব্বরতার যে-সকল উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছেন, তাহা প্রামাণিক। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার এবং হানাহানি-কাড়াকাড়ির যে চিত্র তিনি উদ্ঘাটন করিয়াছেন, তাহার বিভীষিকা তাঁহার উজ্জ্বল পরিহাসের আলোকে ভীষণরূপে পরিস্ফুট হইয়াছে।
রাষ্ট্রীয় স্বার্থপরতা যে য়ুরোপের সাহিত্য ও ধর্ম্মকে ক্রমশ অধিকার করিতেছে তাহা কাহারও অগোচর নাই। কিপ্লিং এক্ষণে ইংরাজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানে, এবং চেম্বর্লেন ইংরাজ রাষ্ট্রব্যাপারের একজন প্রধান কাণ্ডারী। ধূমকেতুর ছোটো মুণ্ডটির পশ্চাতে তাহার ভীষণ ঝাঁটার মতো পুচ্ছটি দিগন্ত ঝাঁটাইয়া আসে—তেমনি মিশনরির করধৃত খ্রীস্টান ধর্মালোকের পশ্চাতে কী দারুণ উৎপাত জগৎকে সন্ত্রস্ত করে তাহা এক্ষণে জগদ্বিখ্যাত হইয়া গেছে। এ সম্বন্ধে মার্ক্ টোয়েনের মন্তব্য পাদটীকায় উদ্ধৃত হইল।[১] প্রাচীন গ্রীক্ ও রোমক সভ্যতারও মূলে এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছিল। সেই জন্য রাষ্ট্রীয়-মহ্ত্ব-বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রীক্ ও রোমক সত্যতার অধঃপতন হইয়াছে। হিন্দুসভ্যতা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত নহে। সেই জন্য আমরা স্বাধীন হই বা পরাধীন থাকি, হিন্দুসভ্যতাকে সমাজের ভিতর হইতে পুনরায় সঞ্জীবিত করিয়া তুলিতে পারি, এ আশা ত্যাগ করিবার নহে।
‘নেশন’ শব্দ আমাদের ভাষায় নাই, আমাদের দেশে ছিল না। সম্প্রতি য়ুরোপীয় শিক্ষাগুণে ন্যাশনাল্ মহত্বকে আমরা অত্যধিক আদর দিতে শিখিয়াছি। অথচ তাহার আদর্শ আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে নাই। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ধর্ম্ম, আমাদের সমাজ, আমাদের গৃহ, কিছুই নেশনগঠনের প্রাধান্য স্বীকার করে না। য়ুরোপে স্বাধীনতাকে যে স্থান দেয়, আমরা মুক্তিকে সেই স্থান দিই। আত্মার স্বাধীনতা ছাড়া অন্য স্বাধীনতার মাহাত্ম্য আমরা মানি না। রিপুর বন্ধনই প্রধান বন্ধন—তাহা ছেদন করিতে পারিলে রাজামহারাজার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠপদ লাভ করি। আমাদের গৃহস্থের কর্ত্তব্যের মধ্যে সমস্ত জগতের প্রতি কর্ত্তব্য জড়িত রহিয়াছে। আমরা গৃহের মধ্যেই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডপতির প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। আমাদের সর্ব্বপ্রধান কর্ত্তব্যের আদর্শ এই একটি মন্ত্রেই রহিয়াছে—
এই আদর্শ যথার্থভাবে রক্ষা করা ন্যাশনাল্ কর্ত্তব্য অপেক্ষা দুরূহ এবং মহত্তর। এক্ষণে এই আদর্শ আমাদের সমাজের মধ্যে সজীব নাই বলিয়াই, আমরা য়ুরোপকে ঈর্ষা করিতেছি। ইহাকে যদি ঘরে ঘরে সঞ্জীবিত করিতে পারি, তবে মউজর্ বন্দুক্ ও দম্দ,ম্ বুলেটের সাহায্যে বড় হইতে হইবে না; তবে আমরা যথার্থ স্বাধীন হইব, স্বতন্ত্র হইব, আমাদের বিজেতাদের অপেক্ষা ন্যূন হইব না। কিন্তু তাঁহাদের নিকট হইতে দরখাস্তের দ্বারা যাহা পাইব, তাহার দ্বারা আমরা কিছুই বড় হইব না।
পনেরো ষোলো শতাব্দী খুব দীর্ঘকাল নহে। নেশন্ই যে সভ্যতার অভিব্যক্তি, তাহার চরম পরীক্ষা হয় নাই। কিন্তু ইহা দেখিতেছি, তাহার চারিত্র আদর্শ উচ্চতম নহে। তাহা অন্যায় অবিচার ও মিথ্যার দ্বারা আকীর্ণ এবং তাহার মজ্জার মধ্যে একটি ভীষণ নিষ্ঠুরতা আছে।
এই ন্যাশনাল্ আদর্শকেই আমাদের আদর্শরূপে বরণ করাতে আমাদের মধ্যেও কি মিথ্যার প্রভাব স্থান পায় নাই? আমাদের রাষ্ট্রীয় সভাগুলির মধ্যে কি নানাপ্রকার মিথ্যা, চাতুরী ও আত্মগোপনের প্রাদুর্ভাব নাই? আমরা কি যথার্থ কথা স্পষ্ট করিয়া বলিতে শিখিতেছি? আমরা কি পরস্পর বলাবলি করি না যে, নিজের স্বার্থের জন্য যাহা দূষণীয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য তাহা গর্হিত নহে। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে কি বলে না?—
আমাদের হিন্দুসভ্যতার মূলে সমাজ, য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলে রাষ্ট্রনীতি। সামাজিক মহত্ত্বেও মানুষ মাহাত্ম্য লাভ করিতে পারে, রাষ্ট্রনীতিক মহত্ত্বেও পারে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি, য়ুরোপীয় ছাঁদে নেশন্ গড়িয়া তোলাই সভ্যতার একমাত্র প্রকৃতি এবং মনুষ্যত্বের একমাত্র লক্ষ্য, তবে আমরা ভুল বুঝিব।
- ↑ The following is from the New York Tribune of Christmas Eve. It comes from that Journal's Tokio Correspondent. It has a strange and impudent sound, but the Japanese are but partially civilized as yet. When they become wholly civilized they will not talk so:
‘The missionary question, of course, occupies a foremost place in the discussion. It is now felt as essential that the Western Powers take cognizance of the sentiment here that religious invasions of Oriental countries by powerful Western organizations are tantamount to filibustering expeditions, and should not only be discountenanced but that stern measures should be adopted for their suppression. The feeling here is that the missionary organizations constitute a constant menace to peaceful international relations.
Shall We? That is, shall we go on conferring our Civilization upon the People that Sit in Darkness, or shall we give those poor things a rest? Shall we bang right ahead in our old-time loud, pious way and commit the new century to the game; or shall we sober up and sit down and think it over first? Would it not be prudent to get our Civilization-tools together, and see how much stock is left on hand in the way of Glass Beads and Theology, and Maxim Guns and Hymn Books, and Trade Gin and Torches of progress and Enlightenment (patent adjustable ones good to fire villages with, upon occasion), and balance the books, and arrive at the profit and loss, so that we may intelligently decide whether to continue the business or sell out the property and start a new Civilization Scheme proceeds?Extending the Blessings of Civilization to our Brother who Sits in Darkness has been a good trade and has paid well, on the whole; and there is money in it yet, if carefully worked—but not enough, in my judgment, to make any considerable risk advisable. The people that Sit in Darkness are getting to be too scarce—too scarce and too shy. And such darkness as is now left is really of but an indifferent quality, and not dark enough for the game. The most of those People that Sit in Darkness have been furnished with more light than was good for them or profitable for us. We have been injudicious.