ভারত পথিক/শিক্ষাপর্বের পুনরারম্ভ

অষ্টম পরিচ্ছেদ

শিক্ষাপর্বের পুনরারম্ভ

কলেজ থেকে বহিস্কৃত হয়ে যখন কটকে এসে পৌঁছলাম তখন ১৯১৬ সালের মার্চ মাস শেষ হতে চলেছে। সৌভাগ্যের বিষয় বহিষ্কারের কালিমাটা ছাত্রমহলে দেখা দিয়েছিল জয়টিকার‍ূপেই। পরিবারের মধ্যেও সম্পর্কের কোনো হেরফের হল না। আশ্চর্যের বিষয় বাবা কখনো ডেকে জিগগেস করেননি যে কলেজে কী হয়েছিল, বা আমি তার মধ্যে কী করেছিলাম। কলকাতায় আমার বড় দাদারাও ধরে নিয়েছিলেন যে ঐ অবস্থায় আমার যা করণীয় তা আমি ঠিকই করেছি এবং আমার প্রতি তাদের সহানুভূতিতেও তাই ঘাটতি পড়েনি। বাবা ও মায়ের নীরবতার মধ্য দিয়েও ধরা পড়ত ছাত্রদের মুখপাত্রের অনিবার্য পরিণতির প্রতি গোপন শ্রদ্ধা। যাদের সঙ্গে দিনরাত্রি কাটাতে হয় তাদের সহানুভূতির অধিকারী হয়ে ভাবনা ঘুচল। কলেজ থেকে বহিস্কৃত হবার পরও আমার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা অক্ষুন্ন রইল।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তাই ব্যাহত না হয়ে বরং উন্নত হল। কিন্তু আমার দল সম্পর্কে সে কথা বলা চলে না। জানুয়ারি-ফেব্র‌ুয়ারির উত্তেজনার মধ্যে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় কাজ করেছিলাম, দলের সঙ্গে পরামর্শের অপেক্ষা রাখিনি। পরে জানতে, পারি যে আমার কার্যকলাপ তাঁদের সম্প‍ূর্ণ মনোমত হয়নি, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই-এ না নামলেই তারা খুশি হতেন। কলকাতা ছেড়ে যাওয়া যখন স্থির করি তখন তাঁদের খবর পর্যন্ত দিইনি, অথচ কিছুকাল আগেই তাদের সঙ্গে দিনরাত্রি ফাটিয়েছি, তাঁদের সমস্ত পরিকল্পনায় যোগ দিয়েছি। ইতিমধ্যে সেই ছোটো গোষ্ঠী শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। প্রধান সভ্যেরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হলেও থাকতেন একই আস্তানায়। প্রত্যহ বিকেলে বাড়ি বা অন্যান্য ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রেরা এসে জুটতেন আলাপ-আলোচনার জন্য। ঘরোয়া প্রচারের উদ্দেশ্যে হাতে-লেখা মুখপত্রও প্রকাশ করা হত। বিভিন্ন বিষয়ে সভ্যদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষার বিশেষ ঝোঁক ছিল ধার্মিক ও নৈতিক দিকে, সুতরাং গীতাপাঠ স্বভাবতই এই বৈকালিক আসরের নিয়মিত বন্দি হয়ে দাঁড়াল।

ঘরবাড়ি ও আরামের শয্যা ছেড়ে যেদিন গ‍ুর‍ু খুঁজতে বেরিয়েছিলাম সেদিনকার আমি যে হালের ঘটনার পর মনের দিক থেকে অনেক বদলে গেলাম সেটা সহজেই বোঝা যাবে। আচমকা ঝড়ের মতন পরিবর্তন এসে সমস্ত ওলট-পালট করে দিল। কিন্তু ঝড়ের আগেও তলে তলে পরিবর্তন চলেছিল আমার অজ্ঞাতসারে। প্রথমত আমার মন ঝুঁকছিল সমাজসেবার দিকে। দ্বিতীয়ত সমস্ত খামখেয়ালীপনা সত্ত্বেও নৈতিক দঢ়তা আমার মধ্যে ক্রমশই স্থান লাভ করছিল। সুতরাং যেদিন আকস্মিক সঙ্কটে আমার সামাজিক কর্তব্যবোধে টান পড়ল সেদিন আমাকে হার মানতে হয়নি। অবিচলিতভাবে কর্তব্যর সম্মুখীন হয়েছি, মাথা পেতে নিয়েছি প্রতিফলের বোঝা। সমস্ত কুণ্ঠা ও সংশয় মুহূর্তে কোথায় ভেসে গেল জানি না। অতঃপর কিং কর্তব্যম? লেখাপড়ার রাস্তা একরকম বন্ধ, কারণ কোথায় কখন কী ভাবে আরম্ভ করব জানি না। বহিস্কার করা হয়েছিল অনির্দিষ্ট কালের জন্য, অতএব সেটা সারাজীবনের শাস্তিই হয়ে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যে দয়াপরবশ হয়ে আবার লেখাপড়া শ‍ুর‍ু করার সযোগ করে দেবেন তারও কোনো স্থিরতা নেই। বিদেশ যাত্রার সম্পর্কে বাবা-মাকে ইশারা জানিয়ে দেখলাম বাবা তার ঘোর বিরোধী। কপালের কলঙ্ক না ঘুচিয়ে বিদেশযাত্রা চলবে না। অর্থাৎ আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, তারপর যা কিছু।

সুতরাং আমার কাজ হল ধৈর্য ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্বিচারের প্রতীক্ষায় থাকা। সময়টাও কাটানো চাই। খাতাপত্র সরিয়ে পুরোদমে সমাজসেবায় লাগলাম। সেকালে উড়িষ্যায় কলেরা ও বসন্তের মহামারীর উৎপাত ছিল প্রবল। ডাক্তার ডাকার সঙ্গতি অধিকাংশেরই নেই, যাদের আছে তাদের পক্ষে ডাক্তারের উপর নার্স জোটানো অসম্ভব। হস্টেলে বা মেসে কলেরা দেখা দিলে রোগীকে ফেলে সবাই চম্পট দিয়েছে এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ লিওনার্ড রজার্সকৃত গবেষণার ফলে স্যালাইন ইঞ্জেকশন আবিষ্কৃত হবার আগে কলেরা ছিল অতি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। সৌভাগ্যক্রমে একদল ছাত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে শ‍ুশ্র‌ূষা করত, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল আমার পুরনো বন্ধু। আমি সানন্দে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কলেরা বা বসন্ত জাতীয় মারাত্মক রোগের দিকেই আমাদের বিশেষ ঝোঁক ছিল, তবু অন্যান্য রোগেও যে আমাদের সাহায্য না মিলতো এমন নয়। স্থানীয় সরকারী হাসপাতালের কলেরা ওয়ার্ডেও ডিউটি দিতাম আমরাই, কারণ শিক্ষিত নার্সের সেখানে বন্দোবস্ত ছিল না। শ‍ুশ্র‌ূষার ভার ন্যস্ত হয়েছিল অশিক্ষিত অপরিচ্ছন্ন ঝাড়দারদের হাতে। অবশ্য উপযুক্ত শ‍ুশ্র‌ূষার এই অভাব সত্ত্বেও দরছর আগে যেদিন এক বাক্স হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর আধখানা ডাক্তার নিয়ে এই গ্রামে এসেছিলাম, সেদিনকার চেয়ে আজ কলেৱা থেকে মত্যুর হার অনেক কম। স্যালাইন ইঞ্জেকশনের কাজ অলৌকিক, রোগের গোড়ার দিকে দিতে পারলে শতকরা আশী ভাগ সেরে ওঠার সম্ভাবনা।

কলেরা রোগীদের শ‍ুশ্র‌ূষায় অপূর্ব আনন্দ পেতাম, বিশেষত যখন আমাদের শ‍ুশ্র‌ূষায় অনেকে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে আসতো তখন আনন্দের অবধি থাকত না। কিন্তু কোনোরকম সাবধানতার বালাই আমার ছিল না। বাড়ি এসে কখনো জামাকাপড় শ‍ুদ্ধির চেষ্টা করিনি, এতক্ষণ কোথায় ছিলাম সে খবরটা যে এগিয়ে গিয়ে সকলকে জানাইনি তা বলাই বাহুল্য। অথচ নিজের ছোঁয়াচ লাগেনি, অপর কাউকেও ছোঁয়াচ দিইনি। কী করে এমন হল ভেবে পাই না।

কলেরা রোগী ঘাঁটতে, মায় নোংরা জামাকাপড় নাড়াচাড়া করতেও ঘৃণাবোধ হয়নি। মুশকিল বাধত আসল বসন্ত নিয়ে। গ‍ুটিগুলো যখন ভালোরকম পেকে উঠতো তখন রোগীর কাছে বসে থাকার জন্যই মনের সমস্ত জোরটুকু খাটাতে হত। তব এই স্বেচ্ছাকৃত কাজের একটা শিক্ষার দিক ছিল, তাই ফেলতে পারিনি।

শ‍ুশ্র‌ূষার সঙ্গে এসে জটল আরো নানান উপসর্গ। চিকিৎসা সেবা-শ‍ুশ্রূষা পরও যারা মারা যায় তাদের কী গতি হবে? মৃতদেহের ভার নেবার, সৎকার করবার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। যেসব গড়ার দাবিদার কেউ ছিল না সেগুলোকে মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারেরা যেমন তেমন করে পার করে দিত। কিন্তু মৃত্যুর পর এমন ব্যবহার কোন লোকে কামনা করে? গতরাং সৎকারের ভারটাও নিতে হত আমাদেরই। দেশী নিয়ম অনুসারে মড়া ঘাড়ে করে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়াতে হত। যেক্ষেত্রে মৃতের টাকাপয়সা-ওয়ালা আত্মীয়স্বজন থাকতো, অভাব হত শ‍ুধু শ্মাশানবন্ধুর, সেক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান হত সহজেই। কিন্তু সৎকারের পয়সা অনেক ক্ষেত্রে জুটতো না, ঝুলি নিয়ে বের‍ুতে হত চাঁদার ধান্ধায়। আমরা যাদের শ‍ুশ্র‌ূষা করেছি তাদের ছাড়া অন্যদের বেলায়ও সৎকারের জন্য ডাক পড়ত, এবং তাতে সাড়া দিতাম।

সেবা-শ‍ুশ্র‌ূষার কাজ ভালো লাগলে কী হবে, সমস্ত সময় তাতেও কাটতো না। তাছাড়া এ একটা সাময়িক প্রয়োজন। জাতীয় দূর্দৈবের স্থায়ী সমাধান এর মধ্যস্থতায় হবার নয়। দলের আলাপ-আলোচনায় দেশগঠনের কাজকে অবহেলা করে শুধু হাসপাতাল, দুর্ভিক্ষ আর বন্যা নিয়ে মেতে থাকার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচুর মুণ্ডপাত করেছি; তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করি এমন ইচ্ছা ছিল না। সুতরাং যুবসংগঠনে হাত দিলাম। বহু, যুবককে একত্র করলাম, তাদের নানান শিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিভাগসহ এক সংগঠন খাড়া করা হল। যতদিন আমি ছিলাম ততদিন এই কাজ ভালোই চলেছিল। এই সময়ে অস্পৃশ্যতার সমস্যায় পড়তে হল। আমাদের প্রিয় আস্তানা এক হস্টেলে মাঝি নামে একটি সাঁওতাল ছাত্র থাকত। সাধারণত সাঁওতালরা নিচু জাত বলে ছিল অবজ্ঞার পাত্র; কিন্তু ছাত্রদের দিলদরিয়া মেজাজে জাতের শুচিবাই লাগেনি, মাঝিকে হস্টেলে সানন্দে জায়গা দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন বেশ চলল। তারপর একদিন একটি ছাত্রের চাকর মাঝি সাঁওতাল জানতে পেরে অন্য চাকরদের খেপিয়ে তুলে গোলমাল বাধাতে চেষ্টা করল। মাঝিকে না তাড়ালে কোনো চাকর কাজ করবে না এই তার দাবি। সুখের বিষয় এই দাবিতে কান দেবার মেজাজ কারুরই ছিল না, গোলমালটা মিটে গেল ভালো করে শুরু হবার আগেই। আমার যেটা চোখে লাগল সেটা হচ্ছে এই যে উঁচুজাতের ছাত্ররা মাঝিকে নিয়ে আপত্তি তোলেনি, আপত্তি তুলল কি না চাকরটা, যে নিজেই যথেষ্ট নিচু জাতের লোক! এ ব্যাপাৱের অল্পদিন পরেই মাঝি টাইফয়েডে পড়ল। আমরা বিশেষভাবে এর সেবাযত্ন শুরু করলাম। আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম যখন মা এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন।

সময় কাটাবার জন্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিভিন্ন তীর্থস্থান ও বিখ্যাত ঐতিহাসিক জায়গাগ‍ুলি পরিদর্শন করতে শুরু করলাম। খোলা হাওয়া ও যথেষ্ট হাঁটাচলা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, তাছাড়া তাতে অপরের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য লাভের যে সুযোগ মেলে সেটা ঘরের ভিতরে পাবার নয়। ঘরবন্দী জীবনের অখণ্ড আলস্য থেকেও পালিয়ে বাঁচলাম, বইপড়া বা যোগাভ্যাসের প্রতি কোনো আকর্ষণ আর ছিল না। দেশী পুজো-পার্বণের মধ্য দিয়ে দলকে গড়ে তোলার এক পরীক্ষায় নামলাম। আমাদের পুজো-পার্বণ চিরকালই গোটা সমাজের উৎসব। যেমন ধরা যাক দূর্গাপজা। নিছক পূজাটা যদিও পাঁচ দিনের ব্যাপার তবু তার ব্যবস্থা বন্দোবস্তে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটে, সব জাতের, সব ব্যবসার লোকই কাজে লাগে কোনো না কোনো দিকে। এক বাড়িতে পুজো হলেও গোটা গ্রামটা তাতে যোগ দেয়, এমন কি দুপয়সা উপায়ও করে নিতে ছাড়ে না। আমার ছেলেবেলার গ্রামে পুজোর শেষদিনে যে যাত্রা হত তাতে জমায়েৎ হত গ্রামের ছেলেবুড়ো সবাই। গত পঞ্চাশ বছরে গ্রাম্য লোকের দারিদ্র্য বেড়ে গেছে, প্রবাসী হয়েছে বহুলোক, পুজো-পার্বণের আর সে ধ‍ুমধাম নেই। কোথাও কোথাও সে পাট একেবারেই চুকে গেছে। ফলে গ্রামের মধ্যে টাকাপয়সার লেনদেন কম‍্তির দিকে, সমাজজীবন প্রাণহীন, নীরস।

আরেক রকমের পালাপার্বণে সমাজের লোক যোগ দেয় আরো বেশি। সে হচ্ছে বারোয়ারী পুজো। কিন্তু তারও দিল ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। ১৯১৭ সালে আমরা নানান দিক ডেবে এক বারোয়ারী পুজোর আয়োজন করলাম। ধুমধাম হল প্রচুর, লোকের উৎসাহ দেখে অন্যান্য বছরও এ ব্যবস্থা বহাল রইল।

মনের দিক থেকে এ সময় আমার অগ্রগতি হয় যে বিষয়ে সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্লেষণের অভ্যাস। বহুকাল ধরে এ অভ্যাস আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে রয়েছে, এবং সুফল দিয়েছে প্রচুর। আর কিছু নয়, নিজের মনের উপর সন্ধানী আলো ফেলে তাকে ভালো করে দেখবার চেষ্টা করা। রোজ রাত্রে ঘুমের আগে বা ভোরে ঘুমভাঙার পর খানিকটা সময় আত্মচিন্তায় কাটাতাম। দুরকমের বিশ্লেষণ এর অঙ্গ ছিল—এক বর্তমানের যে আমি, তার বিশ্লেষণ, আরেক আমার সমগ্র জীবনের বিশ্লেষণ। প্রথমটা থেকে জানা যেত আমার মনের কামনা-বাসনা, আদর্শ-আকাক্ষা; দ্বিতীয়টা থেকে আমার জীবনকে ভালো করে চিনতাম, তার বিকাশকে প্রত্যক্ষ করতাম। অতীতের ব্যাকুলতার চিন্তা দিয়ে উপলব্ধি করতাম অতীতের ভ্রান্তি, ভবিষ্যতের পথ।

আত্মবিশ্লেষণে বেশি দিন যাবার আগেই নিজের পক্ষে অতি গ‍ুর‍ুত্বপূর্ণ দুটি তথ্য আবিষ্কার করলাম। এক, নিজের মন সম্বন্ধে এতদিন কত অজ্ঞ ছিলাম, জানিনি আমার মনের গোপন অন্ধকারে কত জঘন্য প্রবৃত্তি সাধ বেশ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুই, যে মুহূর্তে নিজের অন্তর্নিহিত হীনতাকে জেনেছি সেদিনই তাকে অর্ধেক জয় করা হয়ে গেছে। মনের দুর্বলতা দেহের রোগের মত নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আড়ালে থাকে ততক্ষণই তার চোটপাট। আলোতে যখনি তাকে টেনে আনে তখনি সে ধেয়ে পালায়।

আত্মবিশ্লেষণের প্রথম প্রয়োেগ হল কতকগুলি স্বপ্নের উপদ্রবের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য। এ জাতের স্বপ্নের বিরুদ্ধে আমার আগেকার লড়াইও বিফল হয়নি, তবে আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সাফল্য এল আরো সহজে, আরো সম্পূর্ণ করে। প্রথম দিকে যেসব অপ্রিয় স্বপ্ন দেখতাম তার মধ্যে প্রধান ছিল সাপ ও বন্য জন্তুর স্বপ্ন। সাপের স্বপ্নের হাত থেকে বাঁচবার জন্য রাত্রে ঘুমোনার আগে কল্পনা করতাম যে আমার চারিদিকে অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে এবং মনে মনে আবৃত্তি করতাম: ‘আমি সাপের ভয় করি না, মত্যুর ভয় করি না’। এই চিন্তার মধ্যে সাধারণত ঘুমিয়ে পড়তাম। কয়েকদিন অভ্যাসের পরই পরিবর্তন টের পাওয়া গেল। সাপের দেখা মিলতো কিন্তু ভয় হত না। ক্রমে ক্রমে সাপও বিদায় নিল। অন্যান্য জন্ত‌ুর স্বপ্নও এই চিকিৎসায় ধীরে ধীরে কেটে গেল। তারপর থেকে আৱ এ বিপদে পড়তে হয়নি। কলেজ থেকে বহিষ্কারের সময়ে স্বপ্ন দেখতাম তল্লাসীর আর গ্রেপ্তারের—অবশ্যই আমার অবচেতন ভাবনা চিন্তা ও গোপন আশস্কার প্রকাশ। কিন্তু কয়েকদিন মানসিক ব্যায়ামের পর এ রোগও সেরে গেল। তল্লাসী আর গ্রেপ্তার চলছে, আমি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছি না, হব না, এই চিন্তাই রোগ সারাবার পক্ষে যথেষ্ট হত।

আরেক জাতের স্বপ্নের উপদ্রব ছিল সে হচ্ছে যে পৱীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেই বা যার ফল খারাপ হয়েছে তার সম্বন্ধে স্বপ্ন। এগুলিকে সামলাবার জন্য অনবরত জপ করতে হত যে, পরীক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত, পাশ করবই, ইত্যাদি। আমি এমন বহ‍ুলোককে জানি যাঁরা শেষ বয়স পর্যন্ত স্বপ্নের উপদ্রবে নাজেহাল হন, এমন কি আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়েন। এঁদের হয়ত বহুকাল অভ্যাসের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু লেগে থাকলে শেষ পর্যন্ত ফল মিলবে ঠিকই। কোনো বিশেষ জাতের স্বপ্ন যদি ক্রমাগতই উত্যক্ত করতে থাকে তবে তার প্রকৃতি জানবার জন্য আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা চাই।

সবচেয়ে কঠিন লড়াই হচ্ছে যৌন স্বপ্নের ব্যাপারে। যৌনপ্রবৃত্তি মানুষের গভীরতম সহজাত সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম। তার উপর যৌনতার ঋতু ঘুরে ফিরে আসে, কিছুদিন পরে পরে স্বপ্নের দরজা খুলে দেয়। তা হলেও অন্তত আংশিক অব্যাহতি পাওয়া শক্ত নয়, এই আমার অভিজ্ঞতা। এক্ষেত্রে উপায় হচ্ছে আকর্ষণের বস্তু‌ুকে কল্পনা করে সেই সঙ্গে জপ করা, এতে আমি উত্তেজিত হই না, হব না, কামকে আমি জয় করেছি। নারীমূর্তিতে যদি কামনা জন্মায় তবে তাকে মা বা বোনের মূর্তির‍ূপে কল্পনা করাই বাঞ্ছনীয়। যৌনতার এমন একটা নিয়মিত জোয়ার-ভাঁটা আছে যা অন্য কোনো প্রবৃত্তিরই নেই একথা জানা না থাকলে যৌন-স্বপ্নের বিরুদ্ধে লড়াইএ সহজেই হার মানার ভয় আছে। সাহস না হারাতে হলে একথাও মনে রাখতে হবে যে যৌনপ্রবৃত্তিকে জয় করা বা তার উদ্গতি করা অনেকখানি ধৈর্যের অপেক্ষা রাখে।

নিজের কাহিনীতে ফিরে যাওয়া যাক। এক বৎসর বনবাসের পর কলকাতায় ফিরলাম। উদ্দেশ্য, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরেকবার বাজিয়ে দেখা। কঠিন কাজ, কিন্তু তাযর চাবিকাঠি ছিল স্যর আশ‍ুতোষের হাতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই তখন হর্তাকর্তা বিধাতা। তাঁর অঙ্গ‌ুলি হেলনে আমার দণ্ডাদেশ রহিত হতে পারে। ব্যাপারটার কিনাৱা হবার অপেক্ষায় বসে বসে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম, আমার শক্তিকে কাজে লাগাবার একটা পথ না পেলে বাঁচি কী করে? ঠিক সে সময় ৪৯তম বাঙালী রেজিমেণ্টে ভরতি চলছে। য়ুনিভার্সিটি ইন‍্স্টিটিউটে এক ফৌজ ভরতির সভায় গিয়ে প্রচুর উৎসাহ সঞ্চয় করা গেল। পরদিন চুপচাপ বিডন স্ট্রীটের আফিসে স্বাস্থ্যপরীক্ষার কামরায় গিয়ে ধর্না দিলাম। ফৌজের স্বাস্থ্যপরীক্ষা অতি জঘন্য ব্যাপার, লজ্জাবোধের ধারকাছ দিয়েও ঘেঁষে না। আমি অবিচলিতভাবে পরীক্ষা দিলাম। আর সব পরীক্ষা পেরোবো জানা ছিল, ভয় ছিল শুধু চোখ সম্বন্ধে, কারণ দৃষ্টিশক্তি যথেষ্ট সরল ছিল না। আই. এম. এস. অফিসারটি ছিলেন ভারতীয়, তাঁকে অনেক অনুনয় বিনয় করলাম যে আমাকে উপযুক্ত বলে চালিয়ে দিন। কিন্তু তিনি সখেদে জানালেন যে চোখ পরীক্ষা করার জন্য আমাকে অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। বাঙলায় বলে যেখানেই বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। দ্বিতীয় ডাক্তার, মেজর কুক, চোখের সম্বন্ধেই আবার বিশেষ খুঁৎখুঁতে। অন্য সব পরীক্ষায় পাশ করেও, চোখের বেলায় আমি তলিয়ে গেলাম। ফৌজে যোগ দেওয়া হল না, ভগ্নহৃদয়ে বাড়ি ফিরলাম।

শোনা গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা এবার প্রসন্ন হয়েছেন, কিন্তু একটা কলেজ খুঁজে বার করতে হবে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে ভরতি হতে পারি। বঙ্গবাসী কলেজ আমাকে ভরতি করতে রাজী হল, কিন্তু দর্শনে অনার্সের বন্দোবস্ত সেখানে ছিল না। অতএব স্থির করলাম স্কটিশ চার্চে গিয়ে হাজির হব। একদিন সকালবেলা কোনো পরিচয়পত্রের অপেক্ষা না রেখে সিধে প্রিন্সিপাল ডক্টর আরকিউহার্টের ঘরে ঢুকে বল্লাম আমি বহিস্কৃত ছাত্র, কিন্ত‌ু বিশ্ববিদ্যালয় আমার দণ্ড রহিত করবেন, আমি তাঁর কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে পড়তে চাই।

বোঝা গেল আমার সঙ্গে কথাবার্তায় তিনি খুশি হয়েছেন, কারণ স্কটিশ চার্চ কলেজে প্রবেশের অনুমতি সহজেই মিলল। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল যদি বাধা না দেন, এবং তাঁর আপত্তি নেই এই মর্মে যদি একটি চিরকুট এখানে উপস্থিত করা যায় তবে পথ উন্মুক্ত। কিন্তু এই আপাতসামান্য বাধা দূর করা আমার পক্ষে নিতান্ত সহজ ছিল না। মেজদা শরৎচন্দ্র বসু তখন কলকাতায় আমার তত্ত্বাবধায়ক, তিনিই অবশেষে এ কাজের ভার নিলেন। আলাপ-আলোচনায় ওয়ার্ডস‍্ওয়ার্থ সাহেবের মনোভাব নাকি মোটামটি প্রসন্নই, তবে কিনা আমার সঙ্গে তাঁর একবার সাক্ষাতের প্রয়োজন। অতএব ওয়ার্ডস‍্ওয়ার্থ সাহেবের দরজায় হাজির হলাম। গত বৎসরের ঘটনা সম্বন্ধে দীর্ঘ জোরার ধাক্কা সামলাতে হল। অবশেষে তিনি মত দিলেন যে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎটাই অধিক জর‍ুরি, অতএব তিনি আমার পথ আগলে দাঁড়াবেন না। এর বেশি আমার আর কিছু প্রয়োজন ছিল না। প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল না বিন্দুমাত্র।

কলেজে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে আবার মেতে উঠলাম। ইতিমধ্যে দুটি বৎসর খুইয়েছি, জুলাই ১৯১৭ সালে যখন আবার থার্ড ইয়ারে ভরতি হলাম তখন আমার পূর্বতন সহপাঠীরা বি. এ.র কোঠা পেরিয়ে এম. এ.তে পা দিয়েছে। কলেজে দিন কাটতে লাগল অখণ্ড শান্তিতে। ডক্টর আরকিউহার্টের মতো বিবেচক প্রিন্সিপ্যাল বর্তমান থাকতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠোকাঠুকির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তিনি ছিলেন দর্শনের পণ্ডিত, কিন্তু দর্শন ছাড়া বাইবেলের উপরও বক্ত‌ৃতা করতেন। তাঁর বাইবেলের পাঠ ছিল আশ্চর্য হৃদয়গ্রাহী। বাইবেল ক্লাসের প্রতি আমার অরুচির ভাবটা কেটে গেল। পি.ই.স্কুলের বাইবেল পাঠ থেকে আৱকিউহার্টের পাঠের তফাতটা আসমান জমিনের তফাত। কলেজ-জীবন মোটের উপর নীরসভাবেই কাটতে লাগল। দর্শনসমিতি ও অন্যান্য সমিতির সভায় অবশ্য আনাগোনা করতাম। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে উত্তেজনার খোরাক জুটল অন্যদিক থেকে।

সরকার তখন সবেমাত্র ডাৱতরক্ষা বাহিনীতে একটি ইউনিভার্সিটি ইউনিট গড়ে তুলতে রাজী হয়েছেন। এক ডবল কম্প্যানি গঠনের উদ্দেশ্যে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। সাধারণ সৈনদলের মতো এখানে শারীরিক পরীক্ষা, বিশেষত চক্ষুপরীক্ষায় কড়াকড়ি কম হবে ভেবে আশা হল নিজের সম্বন্ধে। ভারতীয় পক্ষ থেকে এই পরীক্ষার বিরাট উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত অস্ত্রচিকিৎসক ডক্টর সুরেশচন্দ্র সর্বাধিকারী। বাঙালীদের সামরিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহের সীমা পরিসীমা ছিল না। এবার আর আমার আশাভঙ্গের কারণ ঘটল না। গড়ের মাঠে মুফতি পরে আমাদের শিক্ষানবিশী শ‍ুর‍ু হল। ফোর্ট উইলিয়ম থেকে আমদানি হল লিঙ্কন‍্স রেজিমেণ্টমার্কা অফিসার ও ইন‍্স্ট্রাক্টর। প্রথম দিনের হাজিরায় যে দলটি উপস্থিত হল তার চেহারার বৈচিত্র্য দেখে তাক লাগে। কেউ বাঙালী কামদায় ধুতি পৱা, কারুর বা আধামিলিটারি ঢঙে হাফপ্যাণ্টশোভিত অঙ্গ, কারুর পরনে ট্রাউজার, কেউ খালি মাথায়, কেউ পাগড়ি-ওয়ালা, কেউ হ্যাট-পরা ইত্যাদি। দেখে মনে হত না যে এই বিচিত্র জঙ্গলের ভিতর থেকে শিক্ষিত সৈন্যদল বেরুতে পারে। কিন্তু দুমাস বাদে আমরা যথন ফোর্ট উইলিয়মের কাছে তাঁবু গাড়লাম, মিলিটারি উর্দি পরে কুচকাওয়াজ শ‍ুর‍ু করলাম, তখন সকলের ভোল বদলে গেছে। চার মাস ক্যাম্প-জীবন কাটল বিপুল আনন্দে। কিছুদিন শ‍ুধ‍ু বেলঘরিয়ায় চাঁদমারি চর্চায়ই অতিবাহিত হল। সন্ন্যাসীর পায়ের তলায় সে ভগবৎলীলা শ্রবণ থেকে ইংরেজ আর্মি অফিসারের হুকুমে রাইফেল কাঁধে ঘাড় ফেরানো—কী বিপুল পরিবর্তন!

প্রত্যক্ষ সংগ্রামে, আমরা যাইনি, সত্যিকারের রোমহর্ষক কিছু আমাদের জীবনে ঘটল না। তবু ক্যাম্প-জীবন সম্বন্ধে আমাদের উৎসাহ ছিল অসীম। এর আগে কখনো সৈনিক-জীবনের স্বাদ পাইনি, তব যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের একজোট হয়ে থাকার যে বন্ধন, যাকে বলা হয় ‘এস‍্প্লি দ্য কোর’, তাকে অনেকখানি উপভোগ করেছিলাম ক্যাম্প-জীবনে। কুচকাওয়াজ ছাড়া নানারকম অবসর বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল, সরকারী বেসরকারী দুরকমেরই। খেলাধূলারও চর্চা হত যথেষ্ট। শিক্ষানবিশীর শেষভাগে অন্ধকারে নকল যুদ্ধ হত, তার উত্তেজনা ছিল প্রবল। দলে হাসির খোরাক যোগাবার লোকও ছিল, তাদের ঠাট্টা করে দিন কাটত মন্দ নয়। গোড়ার দিকে তাদের একটা আলাদা দল করে দেওয়া হয়েছিল যার নাম ছিল ‘অকওয়ার্ড স্কোয়াড’, অর্থাৎ কি না ‘গঙ্গারামের দল’। উন্নতি করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়মিত প্ল্যাটুনে ভরতি করে নেওয়া হত। এদের মধ্যে একজনের আমরা নাম দিয়েছিলাম জ্যাক জনসন। সে আর কোনোদিনই হাঁদা গঙ্গারামত্বের মায়া কাটাতে পারল না, শেষ পর্যন্ত তার অঙ্গভঙ্গী ছিল বিচিত্র, অফিসার কমাণ্ডিং-এর পর্যন্ত তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি ছিল না।

আমাদের ও. সি. ক্যাপটেন গ্রে ছিল অদ্ভুত এক চরিত্র। এমনিতে সে রাঙ্কার, বৃটিশ আর্মির অভিজাত সন্তান। তার চেয়ে ভালো শিক্ষক কোথায় মিলবে আমি জানি না। রুক্ষপ্রকৃতির স্কচ্, মোটা কর্কশ গলা, প্যারেডের মাঠে তার মুখে একটা ভেংচি লেগেই আছে। কিন্তু তার মনটা একেবারে খাঁটি। উদ্দেশ্য তার কখনো এতটুকু মন্দ থাকত না, দলের লোকেরা সেটা জানত, তাই র‍ুক্ষ ব্যবহার সত্ত্বেও তার প্রতি সকলের প্রীতি ছিল অক্ষ‍ুন্ন। ক্যাপ্টেন গ্রের জন্যে জান কবুল—এই ছিল তখনকার মনোভাব। যখন সে আমাদের হাতে নিয়েছিল তখন ফোর্ট উইলিয়মের অন্যান্য অফিসারেরা বলেছিল যে আমাদের দ্বারা পল্টনগিরি কখন হবে না। ক্যাপ্টেন গ্রে দেখিয়ে দিল যে তাদের হিসাব কত ভুল। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত লোক হওয়ায় আমরা সহজেই শিখে নিলাম। সাধারণ সৈনিকের যা শিখতে লাগত কয়েকমাস, সেটা কয়েক সপ্তাহেই ধাতস্থ হয়ে যেত। তিন সপ্তাহের চাঁদমারি চর্চার পর আমাদের সঙ্গে ইন‍্স্ট্রাক্টরদের এক প্রতিযোগিতা হল এবং তাতে ইন‍্স্ট্রাক্টররা হেরে ভূত হয়ে গেল। তারা বিশ্বাসই করতে চাইল না যে আমরা আগে কখনো রাইফেল ছুঁইনি। একদিন প্লাটুন—ইন‍্স্ট্রাক্টরকে জিগগেস করেছিলাম যে সৈনিক হিসাবে আমাদের সম্বন্ধে তার সত্যিকারের ধারণাটা কী। উত্তরে সে বলেছিল যে প্যারেডে আমাদের খুঁত ধরা শক্ত, কিন্তু আমাদের লড়াই-এর হাড় কতখানি মজবুত সেটা সত্যিকারের যুদ্ধ ছাড়া বোঝা যাবে না। আমাদের র‍ূপান্তর দেখে ও. সি. খুশি হয়েছিল, অন্তত ক্যাম্প যখন ভাঙল তখন তাই বলেছিল আর যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি সভায় আমরা বাঙলার লাটকে গার্ড অফ অনার দিলাম সেদিন লাটসাহেবের মিলিটারি সেক্রেটারি আমাদের প্যারেড দেখে অভিনন্দন জানানোতে তার গর্বের অবধি ছিল না। নববর্ষের প্রোক্ল্যামেশন-প্যারেডে যেদিন আমরা উত‍‌রে গেলাম সেদিন তার খুশির মাত্রাটা আরো বেশি।

সৈনিক-জীবনে যেদিন এত আনন্দ পেতাম সেদিন থেকে কতদূর বদলে গেছি নিজেই জানি না। শ‍ুধু যে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাওয়াতে অসুবিধা হয়নি তা নয়, সত্যিকারের আনন্দ পেয়েছিলাম। এই ট্রেনিং আমার কী যেন একটা অভাব পূর্ণ করল, আমার আত্মবিশ্বাস আরো দঢ় হল। সৈনিক হিসাবে আমাদের কতকগ‍ুলি অধিকার দিল, যেগ‍ুলি ভারতীয় হিসাবে পাওয়া যেত না। ভারতীয় হিসাবে আমাদের কাছে ফোর্ট উইলিয়মের দরজা ছিল বন্ধ, কিন্ত‌ু সৈনিক হিসাবে সেখানে ঢুকতে পেতাম, এবং প্রথম যেদিন রাইফেল আনবার জন্য ফোর্টে আমাদের প্রবেশ, সেদিন একটা আশ্চর্য তৃপ্তির অনুভূতি হয়েছিল, যেন আমাদের নিজেদের কোনো বস্ত‌ু থেকে আমাদের এতদিন বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল, এবার সেই অধিকার পেয়েছি। শহরের মধ্য দিয়ে রুটমার্চগ‍ুলোও ভালো লাগত, কারণ তাতে নিজেদের জাহির করার একটা আনন্দ ছিল। পুলিশ ও অন্যান্য যেসব সরকারী লোকেদের লাঞ্ছনা গঞ্জনায় আমরা অভ্যস্ত তাদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার সুখটা পেতাম পুরোমাত্রায়।

সারা থার্ড ইয়ারটা কাটল পল্টনগিরির উত্তেজনার মধ্যে। ফোর্থ ইয়ারে উঠে সত্যিকারের লেখাপড়া আরম্ভ হল। ১৯১৯ সালের বি. এ. পরীক্ষায় ফল ভালো হলেও আশানুর‍ূপ হল না। দর্শনে ফার্স্ট ক্লাস জুটল, কিন্তু স্থান পেলাম দ্বিতীয়। আগেই বলেছি দর্শন সম্বন্ধে আমার মোহ অনেকটা কেটে এসেছিল। এম. এ.তে দর্শন পড়ার ইচ্ছা আদৌ ছিল না। দর্শনে বিচারবুদ্ধি খোলে, সন্দেহবাদ বাড়ে, চিন্তাকে সংহত করে, কিন্তু আমার সমস্যার সমাধান কই? নিজের সমস্যার সমাধান হয় নিজের দ্বারাই। এ সমস্ত চিন্তা ছাড়া আরো কারণ ছিল। গত তিন বৎসরে আমার মনেও রুপান্তর হয়ে গিয়েছে। স্থির করলাম এম. এ.তে পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্ব (এক্সপেরিমেণ্টাল সাইকলজি) নিয়ে পড়ব। এই নতুন বিজ্ঞানে আমার ঝোঁক চেপে গেল সহজেই, কিন্তু এই নিয়ে লেগে থাকা কপালে হল না।

বাবা তখন কলকাতায়। একদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠাতে গিয়ে দেখি একটা ঘরে মেজদার সঙ্গে বসে আছেন। জিগগেস করলেন আই. সি. এস. দেবার জন্য বিলেতে যেতে চাই কি। যদি যাবার ইচ্ছা থাকে তো যত শিগগির সম্ভব রওনা হতে হবে। প্রস্তাব চিন্তা করে দেখার জন্য সময় মিলল চব্বিশ ঘণ্টা। আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। কয়েক ঘণ্টা চিন্তার পর যাওয়াই স্থির করলাম। মনস্তত্ত্বের গবেষণা মাথায় উঠল। যা কিছু ভেবে চিন্তে স্থির করতে যাই সবই ঘটনার দুবরি স্রোতে ভেসে যায়। মনস্তত্ত্বকে বিদায় দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু আই. সি. এস. বনে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করাটা সহজে মনঃপুত হতে চায় না। নিজেকে প্রবোধ দিলাম যে বিলেতে গিয়ে গুছিয়ে বসতে বসতে পরীক্ষার আর আট মাস থাকবে, যা আমার বয়েস তাতে সুযোগ মিলবে একটি মাত্র, সুতরাং ও পরীক্ষায় পাশ করে ব্রিটিশের অধীনতা করার ভরসা কম। আর যদি বা কোনোক্রমে উত‍রে যাই, কী করব না করব স্থির করার অপর্যাপ্ত সময় থাকবে।

এক সপ্তাহের নোটিশে কলকাতা ত্যাগ। সারা পথ জাহাজে খাবার মতো ব্যবস্থা কোনোক্রমে করা গেল। মুশকিল বাধল পাসপোর্ট নিয়ে। বাঙলার মতো প্রদেশে এ ব্যাপারে গোয়েন্দা বিভাগের উপর একান্তভাবে নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। এবং পুলিশের দষ্টিতে আমার ইতিহাস নিতান্ত নির্দোষ না হবারই কথা। সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ বিভাগে আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের সাহায্যে
বিদেশযাত্রার প্রথম পাসপোর্ট
পাসপোর্টের আংশিক প্রতিলিপি
ছদিনের মধ্যেই আমার পাসপোর্ট আদায় হয়ে গেল। বিচিত্র ব্যাপার বটে!

আমার জীবনে আবার অপ্রত্যাশিত মোড় ঘুরে গেল আমারি ইচ্ছায়। দলের কাছে যখন বিলেত যাত্রার কথা তুলেছিলাম তখন তারা সেটাকে মোটে আমলই দেয়নি। ইতিপূর্বে দলের একজন উৎসাহী কর্মী বিলেত গিয়ে সেখানেই বিয়ে করে বসবাস করছেন। এমন নমুনার পর আবার ঝুঁকি নেওয়া কেন? কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা অটল। দলের একজন বিপথে গেছে তাতে কী? অন্যেরাও যে তার পথই অনুসরণ করবে তার কোনো স্থিরতা নেই। কিছুদিন যাবৎ দলের সঙ্গে আমার যোগটা ঢিলে হয়ে আসছিল। ইউনিভার্সিটি ট্রেনিং কোর-এ যোগ দেবার সময় আমি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করিনি। এবার একেবারে যবনিকাপাত। মুখে কেউই কিছু বললাম না বটে, কিন্তু নিজের আলাদা পথ তৈরির স্বপ্নে আমি এতই মশগ‍ুল হয়ে উঠেছিলাম যে মিলিত পথের শেষ এখানেই, এটা বুঝতে কার‍ুর সময় লাগেনি।

এরপর ইংলণ্ডে শিক্ষালাভ সম্পর্কে প্রাদেশিক উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আবার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। আমাকে তিনি দেখেই চিনলেন। কলেজ-খেদানো ছাত্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণাটা যে তেমন উঁচু ছিল না সেকথা বলাই বাহুল্য। আমি আই. সি. এস. পরীক্ষা দিতে চাই শোনামাত্র তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন আমাকে নিবৃত্ত করার জন্য। অক্সফোর্ড-কেব্রিজের নিখুঁত ছাত্রদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আশাই বাতুলতা, সুতরাং দশ হাজার টাকা আর জলে ফেলে দেওয়া কেন? বারবার এই কথাটারই তিনি পুনরাবৃত্তি করছেন দেখে আমি নিরুপায় হয়ে বললাম, “বাবা চান যে আমি দশ হাজার টাকা নষ্ট করি।” তারপর দেখলাম ভদ্রলোক আমার কেম্ব‍্রিজে ভৱতি হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য কিছুমাত্র ব্যস্ত নন, সুতরাং বিনাবাক্যব্যয়ে প্রস্থান করলাম।

সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল হয়ে ইংলণ্ডে ভাগ্যপরীক্ষার পণ করে ১৯১৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর রওনা হলাম।