ভারত পথিক (১৯৪৫)/কেম্ব্রিজে
নবম পরিচ্ছেদ
যখন ভারতবর্ষ ছাড়ি তার কিছুদিন আগেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবের বাইরে তার খবর প্রায় পৌঁছয়নি, কারণ গোটা পাঞ্জাব তখন সামরিক আইনের কবলে, খবরাখবরের ব্যাপারে প্রবল কড়াকড়ি। সুতরাং লাহোর ও অমৃতসরে নানা ভয়াবহ ঘটনার ভাসা ভাসা গুজবমাত্র আমাদের কানে এসেছিল। আমার এক সিমলাবাসী ভায়ের মুখে শুনেছিলাম পাঞ্জাবের ঘটনার, ও ইংরেজ-আফগান যুদ্ধে ইংরেজের পরাজয়ের কথা। কিন্তু এ সমস্তই ছিল গুজব, মোটের উপর উত্তর-পশ্চিম ভারত সম্বন্ধে সাধারণ ছিল অজ্ঞ। সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত মন নিয়ে য়ুরোপ মাত্রা করলাম।
জাহাজে অনেক ভাৱতীয়ের সঙ্গে পরিচয় হল, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্র। সুতরাং সকলে মিলে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবার জন্য একটা আলাদা টেবিলে বসা স্থির করলাম। আমাদের টেবিলে নেতৃত্ব করতেন এক আই. সি. এস, অফিসারের বিধবা, বয়স্কা পত্নী। জাহাজের অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন রোদে-পোড়া উঁচ্কপালে ইংরেজ। তাদের সঙ্গে মেলামেশা ছিল প্রায় অসম্ভব, তাই আমরা ভারতীয়েরা একত্র ঘেষাঘেষি করে থাকতাম। এটা-সেটা নিয়ে প্রায়ই ইংরেজ-ভারতীয়ে ঠোকাঠুকি লাগত, এবং শেষ পর্যন্ত যদিও ব্যাপার তেমন গুরুতর দাঁড়ায়নি, তবু এই ইংরিজি ঔদ্ধত্যে আমাদের গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। একটা মজার জিনিস জাহাজে থাকতে আবিষ্কার করা গেল, সেটা হচ্ছে ভারতের বাইরে আসার পর অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের ভারতপ্রীতি। গত য়ুরোপের কাছে আসে দেশ, অর্থাৎ ভারতবর্ষ, তাদের টানে তত বেশি করে। ইংলণ্ডে তাদের ইংরেজ বলে পার হবার জো নেই, তার উপর আত্মীয়স্বজন নেই, ঘরবাড়ি নেই, বন্ধুবান্ধব নেই। সুতরাং যতই ভারতবর্ষ থেকে দুরে পড়ে ততই বোধ করতে থাকে ভারতবর্ষের টান।
সিটি অফ ক্যালকাটার চেয়ে ঢিমে তালের জাহাজ খুঁজে পাওয়া শক্ত। যেখানে ত্রিশ দিনে তার টিলবারি পৌছনোর কথা সেখানে লাগল সাঁইত্রিশ দিন। বিলেতের কয়লাখনিতে ধর্মঘটের ফলে সিটি অফ ক্যালকাটা সুয়েজখালে কয়েদ হয়ে ছিল কয়েকদিন। যাই হোক, পথে অনেক বন্দরে নামা গিয়েছিল এটাই সান্ত্বনা। পাঁচ সপ্তাহের একঘেয়ে জীবনকে একটু সরস করে তোলার জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছিল হাজার রকমের হাসিঠাট্টার। একজন সহযাত্রীর উপর তার স্ত্রীর হুকুম ছিল বীফ কখনো ছোঁবে না। একদিন মাট্ন কোপ্তা কারি বলে তাকে বীফ খাইয়ে দিল আরেকজন প্যাসেঞ্জার। বেচারা প্রবল ফূর্তির সঙ্গে খেয়ে রাৱো ঘণ্টা পরে যখন আবিষ্কার করল যে সে বীফ খেয়েছে, তখন তার কী দঃখ! আরেকজন প্যাসেঞ্জারকে প্রেয়সীর হকুমে রোজ চিঠি লিখতে হত। দিনরাত্রি তার কাজ ছিল প্রেমের কবিতা পড়া আর তার বাগ্দত্তার কাহিনী অনর্গল বলে যাওয়া। আমাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, শুনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। একদিন বলেছিলাম যে তার প্রিয়ার মুখশ্রী গ্রীক ছাঁদের, তাতে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। দিন যত দীর্ঘই হোক, তারো শেষ আছে। অবশেষে টিলবারি পৌছনো গেল। চারদিক ভিজে, মেঘে ঢাকা আকাশ; একেবারে বিখ্যাত লণ্ডনী আবহাওয়া। কিন্তু বাইরের প্রকৃতির রূপ একঘেয়ে হলে কী হয় আমাদের সামনে এত উত্তেজনার খোরাক ছিল যে অন্যদিকে আমাদের নজরই পড়ল না। প্রথম যখন টিউব-স্টেশনে নেমে গেলাম, তখন নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে স্ফূর্তির অবধি ছিল না।
পরের দিন থেকেই যোরাঘুরি শুরু করলাম। প্রথমেই গেলাম ক্রম্ওয়েল রোডে ভারতীয় ছাত্রদের উপদেষ্টার কাছে। ভদ্রলোকের ব্যবহারটি মধুর, নানা উপদেশও তাঁর কাছে মিলল, কিন্তু কেম্ব্রিজে ঢোকা সম্বন্ধে তিনি আশ্বাস দিতে নারাজ। ভাগ্যক্রমে কেম্ব্রিজের কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গে ওখানেই দেখা হয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন পরামর্শ দিল যে ক্রম্ওয়েল রোডে সময় নষ্ট না করে সোজা কেম্ব্রিজে গিয়ে চেষ্টাচৱিত্র করাই ভালো। পরের দিনই কেম্ব্রিজে হাজির হলাম।
কয়েকজন উড়িষ্যার ছেলেকে অল্পস্বল্প চিনতাম, তাদের কাছ থেকে কিছ সাহায্য পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে একজন ফিজউইলিয়াম হল্ এর ছেলে (এস. এম. ধর) আমাকে তাদের সেন্সর, রেড়েওয়ে সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। রেডেওয়ে অতি সহৃদয় ব্যক্তি, ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে আমার বক্তব্য শুনলেন, অবশেষে জানালেন যে সোজাসুজি আমাকে ভরতি করে নেওয়াই তাঁর অভিপ্রায়। ভরতির সমস্যা চুকে যেতে প্রশ্ন উঠল টার্মের। চলতি টার্ম শুরু হয়ে গেছে দু সপ্তাহ আগে, যদি সেটা আমি ধরতে না পারি তো ডিগ্রি পাবার জন্য অতিরিক্ত এক বৎসর এখানে কাটাতে হবে। নতুবা আমার ডিগ্রি পাবার সময় জুন ১৯২১। কিন্তু এ বিষয়েও রেডেওয়ে সাহেব সাহায্য করলেন অপ্রত্যাশিতভাবে। কয়লাখনির ধর্মঘট ও আমার মিলিটারি শিক্ষা ইত্যাদির কথা তুলে তিনি কর্তৃপক্ষকে নরম করে আনলেন। ফলে সে টার্মেই আমি ভরতি হলাম। রেডেওয়ের সাহায্য ভিন্ন যে বিলেতে বসে কী করতাম জানি না।
২৫শে অক্টোবর লণ্ডনে পৌছই, কিন্তু কেম্ব্রিজে গুছিয়ে বসতে বসতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। আমাকে যেসব বক্তৃতায় উপস্থিত থাকতে হত তার সংখ্যা ছিল অত্যধিক কারণ মেণ্টাল এণ্ড মরাল সায়ান্সেস ট্রাইপস ছাড়াও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ক্লাস ছিল। বক্তৃতার সময়ের বাইরে যথাসাধ্য পড়াশুনো করতে হত। কোনো স্ফূর্তির অবকাশ ছিল না, এক পরিশ্রমের মধ্যেই যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু ছাড়া। সেকালের সিভিল সার্ভিসের নিয়মানুসারে আমাকে আট নয়টি পৃথক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে, তার মধ্যে কয়েকটি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। আমার পাঠ্যতালিকায় ছিল ইংরিজি রচনা, সংস্কৃত, দর্শন, ইংরিজি আইন, রাষ্ট্রনীতি, আধুনিক য়রোপের ইতিহাস, ইংলণ্ডের ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল। এসব বিষয়ে পড়াশোনা ছাড়া সার্ভে করা ও ম্যাপ তৈরি (কার্টোগ্রাফি) ছিল ভূগোলের অন্তর্গত, এবং আধুনিক য়ুরোপ পড়তে গিয়ে কিছুটা ফরাসীও আয়ত্ত করতে হত।
মেণ্টাল এণ্ড মরল সায়ান্সেস ট্রাইপস-এর কাজটা আমার ভালো লাগত বেশি, কিন্তু বক্তৃতায় যোগ দেওয়া ছাড়া ও বিষয়ে অগ্রসর হবার উপায় ছিল না। বক্তৃতা দিতেন পোফেসর সর্লে (এথিক্স), প্রোফেসর মায়ার্স (সাইকলজি) ও প্রোফেসর ম্যাকটেগার্ট (মেটাফিজিক্স)। প্রথম তিন টার্ম প্রায় সমস্ত সময়টাই খরচ হত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য। অবসর-বিনোদনের জন্য ইণ্ডিয়ান মজলিস ও ইউনিয়ন সোসাইটির সভায় যেতাম।
যুদ্ধোত্তর কেম্ব্রিজের মনোভাব ছিল নিতান্ত গোঁড়া। অক্সফোর্ড সবেমাত্র উদারনৈতিক হতে শুরু করেছে। আবহাওয়ার রকম সহজেই বোঝা যেত প্যাসিফিস্ট, সোশ্যালিস্ট, কনসিয়েন্সস অবজেক্টরস প্রভৃতির প্রতি ছাত্রদের অভ্যর্থনায়। কেম্ব্রিজে কোনো সভাসমিতি করে বক্তৃতা দেওয়া তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। আণ্ডার-গ্র্যাজুয়েটরা এসে মিটিং ভেঙে দিত, বক্তামশাইকে ময়দা দিয়ে স্নান করাত, জলে চোবাত। এই ‘র্যাগিং’ ছিল আল্ডার-গ্র্যাজুয়েটদের আমোদ-প্রমোদের অন্তর্গত, আমার তাতে যথেষ্ট সমর্থন ছিল। কিন্তু বক্তার সঙ্গে মত মেলে না বলেই মিটিং ভেঙে ফেলা আমি সমর্থন করতে পারতাম না। আমার মতো বিদেশীকে যে জিনিসটা মুগ্ধ করেছিল সেটা হচ্ছে ছাত্রদের স্বাধীনতা ও সম্মান। এই সম্মানের প্রভাব ছাত্রদের চরিত্রে গভীরভাবে পড়ত। পুলিশ-বোঝাই কলকাতা শহরে সন্দেহভাজন ভাবী বিপ্লবীদের অষস্থা থেকে কী পরিবর্তন! কেম্ব্রিজের আবহাওয়ায় বাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য কারণ এখানে অধ্যাপক ছাত্রের উপর অত্যাচার করা দূরে থাকুক, আল্ডারগ্র্যাজুয়েটদেরই অধ্যাপকদের উপর অত্যাচার করার সম্ভাবনা বেশি। ‘ডন’দের মধ্যে যাঁদের জনপ্রিয়তা কম তাঁদের প্রায়ই আণ্ডারগ্র্যাজুয়েটদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হত, তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট হত। অবশ্য এসবের মধ্যে কোনো শত্রুতার ভাব ছিল না। কারণ জিনিসপত্রের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ করে দিত ছাত্রেরাই। এমন কি কেম্ব্রিজের রাস্তায় ঘাটে যখন এই ‘র্যাগিং’এর উল্লাস, জনসাধারণের সম্পত্তি যখন ধংস হচ্ছে, তখনও পুলিশ যেমন সংযত ব্যবহার করত তেমন ভারতবর্ষে কল্পনা করা অসম্ভব।
বৃটেনে লালিত ইংরেজ সন্তানের চেয়ে কেম্ব্রিজে স্বাধীনতার মাত্রা দেখে আমি বেশি মুগ্ধ হব তাতে আর বিচিত্র কী! বিচিত্র যেটা লাগত সেটা হচ্ছে ছাত্রদের সম্বন্ধে চারদিকে সকলের শ্রদ্ধা এবং বিবেচনা। কেম্ব্রিজে প্য দেওয়া মাত্র যে কোনো নতুন ছাত্র বুঝতে পারত যে চরিত্রের ব্যবহারের অতি উচু মান তার কাছে সবাই প্রত্যাশা করছে। প্রত্যাশার চাপে ব্যবহারও সুগঠিত হত। আণ্ডারগ্র্যাজুয়েটদের প্রতি এই বিবেচনার ভাব কেবল কেম্ব্রিজের একচেটিয়া নয়, সারা দেশেই কমবেশি মাত্রায় এর চল ছিল। ট্রেনে কেউ জিগগেস করলে উত্তরে আপনি যখন বলবেন যে আপনি কেম্ব্রিজে (বা অক্সফোর্ডে) আছেন তখনই তার ধরন-ধারন বদলে যাবে। বন্ধুভাব তো আসবেই, শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠবে। অন্তত এই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ -ওয়ালাদের মধ্যে যেটুকু ঠাট-ঠমকের ভাব থেকে থাকে তার পক্ষপাতী আমি নই। কিন্তু পুলিশ-ঘেরা আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে ছাত্র ও তরুণদের আরো স্বাধীনতা দেওয়া, তাদের প্রতি বিবেচনার সঙ্গে ব্যবহার করার স্বপক্ষে অনেক কিছু বক্তব্য আছে।
কলকাতায় থাকতে একটি ঘটনা ঘটেছিল যা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। নতুন বই কেনার প্রতি আমার তখন প্রবল ঝোঁক ছিল। নতুন বই দেখবামাত্র অস্থির হয়ে উঠতাম, হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারতাম না। একদিন কলেজ স্ট্রিটের একটা বড় দোকানে গিয়ে দর্শনের একখানা বইএর খোঁজ করছি (তখন দর্শনের উপর খুব ঝোঁক ছিল), দামটা যখন শুনলাম তখন পকেটে হাত দিয়ে দেখি কয়েক টাকা কম আছে। ম্যানেজারকে বললাম বাকি টাকাটা কাল দিয়ে দেব, বইটা আমাকে দিন। উত্তর পেলাম যে তা সম্ভব নয়, পুরো দামটা একসঙ্গে আগে দিতে হবে, তারপর অন্য কথা। বইটা না পেয়ে শুধু যে ক্ষুন্ন হয়েছিলাম তা নয়, আমাকে এভাবে অবিশ্বাস করাতে মনে অত্যন্ত আঘাত লেগেছিল। কেম্ব্রিজে যে-কোনো দোকানে যাও, যা খুশি হকুয় কর, 'ফেল কড়ি মাখ তেলে'র কোনো বালাই নেই। আরো একটি জিনিস আমার মনকে টেনেছিল—সে হচ্ছে ইউনিয়ন সোসাইটির সভায় বিতর্ক। তার হওয়ায় যেন কিসের জ্বালা ছিল। যা খুশি বলার, যাকে খুশি আক্রমণ করার অবাধ স্বাধীনতা। অনেক সময় পার্লামেণ্টের প্রধান সভ্যেরা, এমন কি মন্ত্রীমহাশয়রাও, ছাত্রদের সঙ্গে সমান হয়ে বিতর্কে নামতেন। বলা বাহুল্য তাঁদের কপালে প্রায়ই জুটত কঠোর সমালোচনা, আক্রমণ, লাঞ্ছনা। হোরেশিও বটমূলে এম. পি. একবার এক বিতর্কে যোগ দিয়েছিলেন। বিপক্ষের বক্তা তাঁকে এই বলে সাবধান করেছিলেন: “দেয়ার আর মোর থিংস্ ইন হেভেন আল্ড আর্থ, হোরেশিও, দ্যান ইওর জন বুল ড্রিম্স অফ।” প্রখর কৌতুকে এক একদিন বিতর্কসভা মাতোয়ারা হয়ে উঠত। আয়র্লণ্ড সম্পর্কে এক বিতর্কের সময় একদিন এক আইরিশ-সমর্থক সরকারের স্বরূপ দেখাতে গিয়ে বললেন: “ফোরসেস অফ ল অ্যাণ্ড অর্ডার অন ওয়ান সাইড অ্যাণ্ড বনার ল অ্যাণ্ড ডিসঅর্ডার অন দি আদার।”
বিতর্কসভার অতিথিদের মধ্যে পার্লামেণ্টের বিখ্যাত সদস্যেরা ছাড়া ভাবী রাজনৈতিকেরাও থাকতেন। যেমন ডক্টর হিউ ডালটনকে প্রায় এসর সভায় দেখা যেত। তখন তিনি পার্লামেণ্টের সদস্য হননি। ভবিষ্যতে হবার আশায় কোনো কন্স্টিটুয়েন্সির সেবাযত্নে নিযুক্ত আছেন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এক বিতর্কে স্যর অসওয়াল্ড মস্লে (তখন বামপন্থী লিবারেল বা শ্রমিকদলীয়) যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ডায়ার-ও'ডায়ারের নীতিকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিলেন এবং সমগ্র ব্রিটেনে চাঞ্চল্য এনেছিলেন এই বলে যে ১৯১৯ সালের {তারপর তাঁর ভোল কী রকম বদলেছে সেটা সকলেই জানেন) অমৃতসরের ঘটনা জাতিগত বিদ্বেষের পরিচায়ক। গিল্ডহলে কেম্ব্রিজবাসীদের খনিমজুরদের অবস্থা বোঝাতে এলেন স্যর জন সাইমন ও মিস্টার ক্লাইন্স্। স্যর সাইমনকে কিঞ্চিৎ মজা দেখার জন্য আণ্ডারগ্র্যাডরা ভিড় করে এসেছিল। তিনি সহজে পার পেলেন বলাই বাহুল্য। কিন্তু ক্লাইন্স (বোধ হয় নিজেই এক সময় খনিমজুর ছিলেন) এমন আন্তরিকতা ও আবেগের সঙ্গে বক্তৃতা করলেন যে যার ব্যঙ্গ করতে এসেছিল তারাও শেষ পর্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়ল। যে ছয় টার্ম আমি কেম্ব্রিজে ছিলাম তার মধ্যে ব্রিটিশ ও ভারতীয় ছাত্রদের সম্পর্ক ভালোই ছিল কিন্তু বন্ধুত্বের স্তরে খুব কমই উঠেছে। শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকেই একথা বলছি। এর মূলে ছিল একাধিক কারণ। যুদ্ধের প্রভাব ছিল অবশ্যই, তাছাড়া ছিল সাধারণ ব্রিটিশের ব্যবহাৱের বাহ্য রঙচঙের আড়ালে প্রচ্ছন্ন একটা শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার। আর আমরা যুদ্ধপরবর্তী ঘটনাবলী, বিশেষত অমতসরের বিপর্যয়ের পর আত্মসম্মান ও জাতীয় সম্মান সম্বন্ধে স্বভাবতই একটু সজাগ (হয়তো একটু অতিরিক্ত সজাগ) ছিলাম। মধ্যবিত্ত ইংরেজ মহলে জেনারেল ডায়ারের প্রতি সহানুভূতি দেখে আরো দুঃখ হত। মোটের উপর বোধ হয় বৃটিশ ও ভারতীয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের কোনো ভিত্তি ছিল না। রাষ্ট্রনীতিক দিক দিয়ে আমরা পূর্বের চেয়ে অনেক সজাগ, অনেক অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলাম। কাজেই ভারতীয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের গোড়র কথা ছিল তার ধ্যানধারণার প্রতি সহানুভূতি, অন্তত সহিষ্ণুতা। এ দুটি জিনিস মেলা সহজ ছিল না।
রাষ্ট্রনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেবল শ্রমিকদলই ছিলেন ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল। কাজেই শ্রমিকদলীয় বা ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গেই বন্ধুদের সম্ভাবনা ছিল বেশি।
অবশ্য এটা হল মোটামুটি কথা এবং এর বহু হেরফের শুধু সম্ভব নয়, আমার জীবনে অনেক ঘটেছে। ছাত্রদের মধ্যে, ছাত্রসমাজের বাইরে বহু, রক্ষণশীল লোকেদের সঙ্গে আমার বন্ধুতা সমস্ত বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়েও অব্যাহত রয়েছে। আমার মতামতের প্রতি তাদের যথেষ্ট সহিষ্ণু মনোভাব থাকার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। গত কিছুকাল ধরে, বিশেষত গত পাঁচ বৎসৱে বৃটিশ শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটা বিপ্লবের ঝড় বয়ে গেছে। তার ঝাপ্টা লেগেছে কেম্ব্রিজে, লণ্ডনে অক্সফোর্ডে ও অন্য সর্বত্র। তাই হয়তো আমার ১৯১৯-২০ সালের অভিজ্ঞতা আজকের থেকে অন্যরকম।
যুদ্ধের ঠিক পরবর্তী সময়ের ইংরিজি মেজাজকে যে আমি ভুল বুঝিনি তার প্রমাণ দিতে পারি কয়েকটি দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে। প্রায়ই শোনা যায় যে সাধারণ ইংরেজের একটা ন্যায় অন্যায়ের বোধ আছে, খেলোয়াড়ী মনোভাব আছে। আমরা যখন কেম্ব্রিজে ছিলাম তখন ভাৱতীয় ছাত্রেরা এই মনোভাবের আরো কিছু প্রমাণ পেলে খুশি হত। সে বছর টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল একটি ভারতীয় ছাত্র, নাম সুন্দর দাস, ব্লু-ও পেয়েছিল স্বভাবতই। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম যে ইণ্টার-ভারসিটি খেলাগুলোতে তাকেই ক্যাপ্টেন করা হবে। কিন্তু সেটা এড়াবার জন্য একজন পুরনো ব্লুকে এনে একবছর তাকেই চালিয়ে যাবার ভার দেওয়া হল। কাগজপত্রে এতে কিছু দোষ দেবার নেই। টীমের ক্যাপ্টেন হবার জন্য পুরনো ব্লুর দাবিটা ন্যায্য, কিন্তু পর্দার আড়ালে কী ঘটে গেল সেটা জামরা যথেষ্ট জানতাম এবং আমাদের দলে নীরব ঘৃণার ও রাগের কিছুমাত্র অভাব ঘটেনি।
আরেকটা উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করি। একদিন নজর পড়ল আণ্ডার-গ্র্যাজুয়েটদের ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ ভরতি হবার জন্য আবেদনপত্র চেয়ে এক নোটিশের উপর। আমাদের মধ্যে কয়েকজন আবেদন করল। উত্তরে শুনলাম যে আমাদের বিষয়ে উপরওয়ালার পরামর্শ নেওয়ার দরকার পড়েছে। কিছুদিন পরে এই মর্মে চিঠি পেলাম যে ইণ্ডিয়া অফিস নাকি আমাদের ভরতির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। এই নিয়ে ভারতীয় মজলিশে তুমুল আলোচনা উঠল, ঠিক হল ভারতসচিবের সঙ্গে ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করতে হবে এবং দরকার হলে কে. এল. গাউবা ও আমার এ বিষয়ে ভারতসচিবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাবার অধিকার থাকবে। তখনকার ভারতসচির ঈ. এস. মণ্টাগু আমাদের পাঠালেন সহকারী ভারতসচিব আর্ল অফ লিটনের কাছে। লিটন আমাদের সমাদর করে বসালেন, মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন, বললেন যে আপত্তিটা আদৌ ইণ্ডিয়া অফিসের নয়, ওয়ার অফিসের। সেখানে খবর গিয়েছিল যে ভাৱতীয়েরা ও. টি. সিতে ভরতি হলে সেটা ইংরেজ ছাত্রদের সহ্য হবে না। তাছাড়া আরো মুশকিল এইখানে যে ও. টি. সি. থেকে যারা উত্তীর্ণ হয় তারা বৃটিশ সেনাদলে অফিসার পদের অধিকারী। ভারতীয়েরা ও. টি. সিতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে যদি বৃটিশ সৈন্যদলে অফিসার পদ দাবি করে বসে তবে একটা বিসদৃশ অবস্থার সৃষ্টি হবে এটাও ওয়ার অফিসের অন্যতম চিন্তার বিষয়। লর্ড লিটন ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন যে ভবিষ্যতে মিশ্র বাহিনীরও নায়কত্ব আসবে ভারতীয়দেরই হাতে কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের ভাবটা অনেক ইংরেজ মহলে অতি প্রবল, তাকে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। উওরে আমরা জানালাম যে আমরা বৃটিশ সেনাদলে কমিশন চাই না এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে রাজী আছি, আমাদের লক্ষ্য পেশাদার সৈন্যদলে যোগ দেওয়া নয়, শিক্ষাটাই আমাদের কাম্য। কেম্ব্রিজে ফিরে গিয়ে আবার ও. টি. সি-র কর্তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করলাম। শুনলাম আপত্তিটা নাকি ওয়ার অফিসের নয়, ইণ্ডিয়া অফিসেরই। আসল ব্যাপার যাই হোক না কেন, কোনো কোনো ইংরেজ মহলে ভারতীয়-বিদ্বেষ কী রকম প্রবল তার একটা নমুনা পাওয়া গেল। আমি যতদিন ছিলাম ততদিনের মধ্যে উপরওয়ালা আমাদের দাবিতে কর্ণপাত করেননি এবং আমার ধারণা সতের বছর আগে যে অবস্থা ছিল তার কিছুমাত্র বদল হয়নি।
মোটের উপর তখনকার দিনে ভারতীয় ছাত্রেৱা কেম্ব্রিজে বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দিত, বিশেষত লেখাপড়ার ক্ষেত্রে। খেলাধুলোয়ও তাদের স্থান অগৌরবের ছিল না। নৌকোচালানোর ব্যাপারে ভারতীয়দের আরেকটু কৃতিত্ব দেখতে পেলে খুশি হতাম। ভারতবর্ষে বাচখেলা ক্রমশ যেরকম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাতে মনে হয় যে ভবিষ্যতে এ ব্যাপারেও ভারতীয় ছাত্রেরা গৌরব অর্জন করবে।
প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে ভারতীয় ছাত্রদের বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো উচিত কি না এবং পাঠালে কোন বয়সে পাঠানো উচিত। ১৯২০ সালে লর্ড লিটনের গ্রেট ব্রিটেনে ভারতীয় ছাত্রদের অবস্থা আলোচনার জন্য এক সরকারী কমিটির বৈঠক বসেছিল এবং এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনাও হয়। আমার সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে এই যে ভারতীয় ছাত্রদের খানিকটা পরিণত হবার আগে বিদেশে যাওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ বি. এ. পাশ করার পর যাওয়াই ভালো। তা নইলে বিদেশে শিক্ষার সুযোগকে তারা সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে পারবে না। উপরোক্ত ইণ্ডিয়ান স্টুডেণ্ট কমিটিতে আমি যখন কেম্ব্রিজ ভারতীয় মজলিশের পক্ষ থেকে যাই তখনও একথাই বলেছিলাম। বৃটিশ পাবলিক স্কুলের শিক্ষা সম্বন্ধে চারদিকে অজস্র প্রশংসা শোনা যায়। বৃটিশ জনসাধারণ বা বৃটিশ ছাত্রদের উপর এই শিক্ষার কী ফল হয় তা বিচার করতে চাই না। কিন্তু ভারতীয় ছাত্রদের বেলায় যে ফলটা হয় সেটা যে আদৌ প্রীতিকর নয় তা জোর করে বলতে পারি। কেম্ব্রিজে বিলিতি পাবলিক স্কুল বৃক্ষের কয়েকটি ফলের সংস্পর্শে এসেছিলাম, তাদের মোটেই তেমন উচ্চশ্রেণীর জীব মনে হয়নি। যারা বাপমায়ের সঙ্গে বাস করে, স্কুলের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির শিক্ষাটাও পায় তাদের অবস্থা একলা-পড়তে-আসা ছেলেদের চেয়ে শতগুণে ভালো। গোড়ার দিকে শিক্ষাকে হতে হবে “জাতীয়”, তার শিকড় থাকা চাই দেশের জমির ভিতর। মনের পুষ্টিটা ও বয়সে নিজের দেশের সংস্কৃতি থেকেই আহরণ করা দরকার। চারাগাছকে উপযুক্ত সময়ের আগেই অন্য জমিতে চালান করলে সে বাঁচে কেমন করে? না, অল্প বয়সে কাঁচা ছেলেমেয়েদের বিদেশে স্কুলে পাঠানো মোটেই উচিত নয়। শিক্ষা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে কেবল উপরের স্তরে এসে। তখনই ছাত্র দূরদেশে গিয়ে জ্ঞান আহরণের উপযুক্ত হয়, পূর্ব-পশ্চিম মিলতে পারে, পরষ্পরের উপকারে লাগতে পারে।
ভারতবর্ষে সিভিল সার্ভিসের সভ্যদের এককালে বলা হত ‘সবজান্তা'। এর কিছুটা সার্থকতা ছিল কারণ সবরকম কাজেই তাদের নিযুক্ত করা হত। যে শিক্ষা তারা পেত তাতে খানিকটা নিজেকে অদলবদল করে নেবার ক্ষমতা জন্মাত, নানা বিষয়ে অল্প অল্প জানার দরূন শাসনকার্যে সুবিধাও মিলত কিছটা। ন'টা বিষয়ে যখন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে বসলাম তখন একথা হাড়ে হাড়ে বুঝতে হয়েছিল। তার মধ্যে সবকিছু আমার পরবর্তী জীবনে কাজে লাগেনি কিন্তু রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, ইংলণ্ডের ইতিহাস, আধুনিক যুৱোপীয় ইতিহাস যে উপকারী হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশেষত আধুনিক য়ুরোপীয় ইতিহাস পড়বার আগে পর্যন্ত মহাদেশীয় য়ুরোপের রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে কিছুই বুঝিনি। আমরা ভারতীয়রা যে শিক্ষা পাই তাতে য়ুয়োপ হচ্ছে গ্রেট ব্রিটেনেরই বৃহৎ সংস্করণ মাত্র। ফলে য়ুরোপকে বৃটেনের চোখ দিয়ে দেখবার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে এসে পড়ে। এটা অবশ্যই বিরাট ভুল, কিন্তু আধুনিক য়ুরোপীয় ইতিহাস ও বিশেষত বিসমার্কের আত্মজীবনী, মেটারলিঙ্কের স্মৃতিকথা, কাভুৱের চিঠিপত্র ইত্যাদি পড়বার আগে তা জানা ছিল না। কেম্ব্রিজে থাকাকালীন এই মুল বইগুলি পড়াতেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির গূঢ় ধারাকে আমি আয়ত্ত করতে শিখেছিলাম।
১৯২০ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতার পরীক্ষা শুরু হল। একমাস ধরে তার টানা হেচঁড়া চলবার পর অবশেষে যখন শেষ হল তখন শরীর মন ভেঙে পড়তে চায়। যথেষ্ট খেটেছিলাম তবু আশানুরূপ তৈরি হতে পারিনি। কাজেই বিশেষ উৎসাহিত বোধ করতে পারছিলাম না। অসংখ্য কৃতী ছাত্র বহু বছরের প্রস্তুতির পরও এ পরীক্ষায় ডুবেছে, কাজেই তেমন উৎসাহিত হতে হলে বেশ খানিকটা অহঙ্কার দরকার। সংস্কৃত পরীক্ষায় যখন নিশ্চিত ১৫০ মার্ক বোকামি করে হারালাম তখন আশঙ্কার কারণটা আরো বাড়লো। ইংরিজি থেকে সংস্কৃত অনুবাদের পেপার, লেখাটাও আমার ভালোই হয়েছিল। পরে ভালো করে নকল করব মনে করে প্রথমে কাটাকাটি করে একটা খাড়া করেছিলাম। কিন্তু সময়ের হিসেবটা এমন নির্বিবাদে ভুলে গিয়েছিলাম যে যখন ঘণ্টা পড়ল তখন অর্ধেকের বেশি নকল করা বাকি। কিন্তু তখন কোনো উপায় নেই—খাতার মায়া ত্যাগ করে বসে আঙুল কামড়ানো ছাড়া আর উপায় রইল না।
সকলকে জানালাম যে পরীক্ষা ভালো দিতে পারিনি, প্রথম ক’জনের মধ্যে স্থান পাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ট্রাইপসের পড়াশনোর দিকে মন দেওয়া সাব্যস্ত করলাম। কাজেই যেদিন রাত্রে লণ্ডনে বসে এক বন্ধুর টেলিগ্রাম পেলাম—“অভিনন্দন জানাচ্ছি, মর্নিং পোষ্ট দেখো”—সেদিন কেমন আকাশ থেকে পড়েছিলাম তা কল্পনা করা শক্ত নয়। কী মানে বুঝে পেলাম না। সকালে উঠেই এক কপি মনিং পোস্ট জোগাড় করে দেখি আমি চতুর্থ হয়েছি। আনন্দের অবধি রইল না। দেশে এক কেব্ল চলে গেল তৎক্ষণাৎ।
এবার এক নতুন সমস্যা উদয় হল। এই চাকরি নিয়ে কী করি? সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়ে মোটা মাইনের গদিতে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে জীবন কাটিয়ে দেব? নতুন কিছু নয়, পুরনো কাহিনী। তরুণ বয়সে বড়ো কথা বলে অনেকেই, বয়স হলে কাজ করে অন্যরকম। কলকাতার একটি ছেলেকে চিনতাম যার মুখে কলেজজীবনে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের বাণী ছাড়া অন্য কথা শোনা যেত না, পরবর্তী জীবনে সে বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করেছে, এখন সিভিল সার্ভিসের মস্ত কর্ণধার। বোম্বই-এর এক বন্ধু, লোকমান্য তিলকের উপস্থিতিতে শপথ করেছিল যে আই. সি. এস পরীক্ষায় পাশ করলে চাকরি ছেড়ে দেশের কাজে নামবে। কিন্তু জীবনের শুরুতেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে বাঁধা সড়কে চলব না; তাছাড়া বহুকালের আদর্শ ছিল, যেগুলিকে চিরকাল আঁকড়ে ধরে থেকেছি, আজ চাকরি নিলে সেগুলিকে জীবন থেকে বিদায় দিতে হয়।
কিন্তু ইস্তফা দেবার আগে দুটো জরুরি কথা ভাববার ছিল। এক, লোকে কী ভাববে? দুই, আজ ঝোঁকের মাথায় চাকরি না নিয়ে, পরে আবার পস্তাতে না হয়। ঠিক কাজ করছি কি না সে বিষয়ে আমি কী সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ?
মনস্থির করতে দীর্ঘ সাতমাস লেগে গেল। ইতিমধ্যে মেজদার সঙ্গে চিঠিপত্র চলতে লাগল। সৌভাগ্যের বিষয় আমার চিঠিগুলি মেজদা সযত্নে তুলে রেখেছিলেন। আমি যেগুলি পেয়েছিলাম সেগুলি রাষ্ট্রনীতির ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে কোথায় উড়ে গেছে জানি না। আমার মনের অবস্থার সংকেত হিসেবে আমার চিঠিগুলির মূল্য আছে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আই. সি. এস. পরীক্ষার ফল বেরুলো। কয়েকদিন পরে এসেক্স-এ লী-অন-সীতে ছুটি উপভোগ করতে এসে মেজদাকে ২২শে সেপ্টেম্বর লিখলাম:
“আপনার অভিনন্দনসূচক পত্র পাইয়া যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। জানি না আই. সি. এস. পরীক্ষায় পাশ করিয়া আমার কী তেমন লাভ হইয়াছে, কিন্তু এই খবরে যে সকলে খুশি হইয়াছেন এবং পিতামাতার মন এই দুর্দিনে একটু হাল্কা হইয়াছে ইহাতেই আমার আনন্দ।
“আমি এখানে বেট্স্ সাহেবের অতিথিরূপে বাস করিতেছি। বেট্স্ সাহেবের মধ্যে ইংরাজ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ পরিচয় পাই। ভদ্রলোক মার্জিত, মতামতে উদার, ভাবে সর্বদেশিক। রুশ, পোলাণ্ডবাসী, লিথুনীয়, আয়র্লণ্ডীয় ও অন্যান্য বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে তাঁহার আনাগোনা। রাশিয়ান, আইৱিশ ও ভারতীয় সাহিত্যে তাঁহার প্রচুর উৎসাহ, রমেশ দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের রচনায় তাঁহার গভীর অনুরাগ।.. প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হওয়ার জন্য আমি রাশিকৃত অভিনন্দন পাইতেছি। তবু আই. সি. এস. গোষ্ঠীতে প্রবেশ করার চিন্তায় কিছুমাত্র আনন্দ পাইতেছি একথা বলা চলে না। যদি এই চাকুরিতে যোগ দিতে হয় তবে এ পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করিতে যেরূপ অনিচ্ছা লইয়া বসিয়াছিলাম সেরূপ অনিচ্ছার সঙ্গেই তাহা করিতে হইবে। চাকুরিজীবনে মোটা মাহিনা ও তাহার পর মোটা পেনসন আমার বরাদ্দ থাকিবে তাহা জানি। দাসত্বে যদি যথেষ্ট কুশলতা অর্জন করি তো একদিন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত হইবার আশাও রাখা চলে। যোগ্যতা থাকিলে, গোলামিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে হয়ত চীফ সেক্রেটারি হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু চাকুরিকেই কি আমার জীবনের শেষ লক্ষ্য বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে? চাকুরিতে সাংসারিক সুখ পাওয়া যাইবে কিন্তু সেটা কী আত্মার মুল্য দিয়াই ক্রয় করিব? আমার মনে হয় আই. সি. এস. গোঠীর কোনো লোককে চাকুরির আইনকানুনকে যেভাবে মাথা নিচু করিয়া মানিয়া লইতে হয় তাহার সঙ্গে জীবনের উচ্চ আদর্শকে মানাইয়া লইবার চেষ্টা ভণ্ডামি ভিন্ন কিছু নয়।
“সাধারণ লোকের কথায় যাকে বলে ঞ্জীবনে উন্নতি করা তাহার তোরণে দাঁড়াইয়া আমার মনের অবস্থা কী হইয়াছে তাহা আপনি নিশ্চয় বোঝেন। এ চাকুরির স্বপক্ষে বলিবার অনেক কিছু আছে। প্রত্যহ অগণ্য লোকে হাবুডুবু খাইতেছে যে অন্নের চিন্তায় সেই অন্নচিন্তা ইহাতে চিরকালের জন্য মিটিয়া যাইবে। জীবনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সাফল্য অসাফল্য সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই, সংশয় নাই। কিন্তু আমার মত মনোবৃত্তির লোক, যে চিরকাল ‘উদ্ভট' জিনিসেরই পূজা করিয়া আসিয়াছে তাহার পক্ষে স্রোতে গা ভাসাইয়া নিশ্চিন্ত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় নহে। সংগ্রাম ভিন্ন, বিপদ ভিন্ন জীবনের স্বাদই অনেকখানি অন্তর্হিত হইয়া যায়। যাহার অন্তরের মধ্যে সাংসারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দংশন নাই তাহার নিকট জীবনের সংশয়, বিপদ ততটা ভয়াবহ নহে। তাহার উপর, একথা ঠিক যে সিভিল সার্ভিসের শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া দেশের সত্যকারের কাজ কৱা চলে। এক কথায় সিভিল সার্ভিসের আইনকানুনের প্রতি ভক্তি রাখার সঙ্গে জাতীয় ও আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে মেলানো চলে না।
“আমি বুঝিতেছি যে এসব কথা বলিয়া কোনো ফল নাই কারণ আমার ইচ্ছায় কিছু হইবে না। সিভিল সার্ভিস সম্বন্ধে আপনার কোনো মোহ নাই তাহা আমি জানি, কিন্তু আমার চাকুরি ছাড়ার কথাতে পিতৃদেব যে খড়্গহস্ত হইয়া উঠিবেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তিনি আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখিবার জন্য উদগ্রীব।
“সুতরাং দেখিতেছি যে অর্থনৈতিক কারণে ও স্নেহের বন্ধনের ফলে আমার ইচ্ছাকে আদৌ আমার বলিয়া দাবি করিতে পারি না। কিন্তু একথা বিনা দ্বিধায় বলিতে পারি যে আমার ইচ্ছাই যদি চড়ান্ত হইত তবে সিভিল সার্ভিসে আমি কখনোই যোগ দিতাম না।
“আপনি হয়ত বলিবেন যে এ চাকুরি এড়াইবার চেষ্টা না করিয়া ইহার ভিতরে প্রবেশ করিয়া ইহার পাপকে দূর করাই উচিত, এবং সে কথা বলিলে অবশ্যই অন্যায় বলা হইবে না। কিন্তু যদি তাহাই করি তা হইলেও যে-কোনোদিন অবস্থা এমন অসহ্য হইয়া দাঁড়াইতে পারে যে ইস্তফা দেওয়া ভিন্ন আমার গত্যন্তর থাকিবে না। আগামী পাঁচ দশ বৎসরের মধ্যে যদি এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহা হইলে জীবনে নতুন করিয়া পথ করিয়া লইবার উপায় থাকিবে না। সেক্ষেত্রে আজ আমার সম্মুখে নানা পথ উন্মুক্ত রহিয়াছে।
“সন্দেহবাদী লোকে বলিবে যে চাকুরির প্রশস্ত কোলে একবার ঠাঁই করিয়া লইবার পর আমার সমস্ত তেজ উবিয়া যাইবে। কিন্তু এই ক্ষয়কারী প্রভাব আমার উপর কিছুতেই পড়িতে দিব না এ বিষয়ে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি বিবাহ করিব না, সুতরাং যখন যাহা সত্য বুঝিব তাহাকে পালন করার পথে সাংসারিক বিবেচনার অধীন হইয়া থাকিতে হইবে না।
“আমার মনের গঠন যেরূপ তাহাতে আমার সত্যই সন্দেহ হয় যে সিভিল সার্ভিসের পক্ষে আমার যোগ্যতা আছে কি না। বরং আমার ধারণা, যেটুকু ক্ষমতা আমার আছে তাহা অন্যভাবে আমার নিজের ও আমার দেশের উপকারে লাগাইতে পারিব।
“এ বিষয়ে আপনার মতামত জানিতে পারিলে আনন্দিত হইব। পিতৃদেবকে এ বিষয়ে কিছু লিখি নাই—কেন তাহা ভাবিয়া পাইতেছি না। তাঁহার মত জানিতে পারিলে সুবিধা হইত।”
উপরোক্ত চিঠিতে দেখা যাচ্ছে সংগ্রাম শুরু হয়েছে কিন্তু সমাধানের কোনো নিশানা নেই। ২৬শে জানুয়ারি ১৯২১ সালে আমি আবার এ প্রসঙ্গে মনোনিবেশ করলাম, লিখলাম:
“...আপনি বলতে পারেন যে এই কুৎসিত ব্যবস্থাকে পরিহার না করিয়া ইহার ভিতরে প্রবেশ করিয়া শেষ পর্যন্ত ইহার সহিত সংগ্রাম করাই আমার কর্তব্য। কিন্তু সে সংগ্রাম করিতে হইবে একাকী কর্তৃপক্ষের হুমকির মধ্য দিয়া, অস্বাস্থ্যকর স্থানে বদলি সহ্য করিয়া, উন্নতির পথ বন্ধ করিয়া। চাকুরির মধ্যে থাকিয়া এইভাবে যেটুকু উপকার করা যায় সেটুকু বাহিরে পুরাপুরি কাজে লাগার তুলনায় যৎসামান্য। শ্রীযুত রমেশচন্দ্র দত্ত অবশ্যই সার্ভিসের আওতায় অনেক কাজ সম্পন্ন করিয়াছিলেন, তবু আমার মনে হয় আমলাতন্ত্রের বাহিরে থাকিলে তাঁহার কাজ দেশের পক্ষে অনেক অধিক মঙ্গলজনক হইত। তাহা ভিন্ন এখানে আসল প্রশ্ন নীতির। নীতি অনুসারেই আমি এই শাসনযন্ত্রের অংশ হওয়ার কথা চিন্তা করিতে পারি না। গোঁড়ামিতে, স্বার্থান্ধ শক্তিতে, হৃদয়হীনতায়, সরকারী মারপ্যাঁচের জটিলতায় এই শাসনযন্ত্র বিকল, ইহার প্রয়োজনের দিন বিগত।
“আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি যে আমি দুই পথের সংযোগস্থলে উপস্থিত, মধ্যপথ আশ্রয় করিবার কোনো উপায় নাই। হয় আমাকে এই গলিত চাকুরির মায়া ছাড়িয়া সর্বান্তঃকরণে দেশের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করিতে হইবে, নয় সমস্ত আদর্শ আকাক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়া সিভিল সার্ভিসের কক্ষপটে সমাধিলাভ করাই আমার ভবিষ্য বলিয়া মানিতে হইবে। ... আমি জানি আমার এই বিপজ্জনক হঠকারিতায় আত্মীয়মহলে তুমুল শোরগোল উঠিবে।...কিন্তু তাঁহাদের মতামতে, নিন্দায় প্রশংসায় আমার কিছু আসে যায় না। আপনার আদর্শবাদে আমার আস্থা আছে তাই আপনার নিকট পরামর্শ ভিক্ষা করিতেছি। পাঁচ বৎসর পূর্বে এই সময়ে আমার আরেক বিপজ্জনক প্রচেষ্টায় আপনার নৈতিক সমর্থন পাইয়াছিলাম। সে প্রচেষ্টায় আমার ভবিষ্যৎ কিছুকালের জন্য অন্ধকার বোধ হইয়াছিল, তবু আমি তাহার সমস্ত ফলকে নির্ভয়ে মাথা পাতিয়া নিয়াছিলাম, কখনো নিজের নিকট অভিযোগ করি নাই, সে কথা মনে করিয়া আজো গর্ব অনুভব করিতেছি। সেই স্মৃতির কথা ভাবিয়া মনে বল পাইতেছি, আমার এই বিশ্বাস আরো দঢ় হইতেছে যে আত্মত্যাগের কোনো দাবিতেই আমি পিছপা হইব না। পাঁচ বৎসর পূর্বে আপনি মেচ্ছায় এবং মহৎভাবে আমাকে যে সমর্থন জানাইয়াছিলেন আজও তাহা মিলিবে এ আশা কী করিতে পারি না?
“এবার পিতৃদেবকেও তাঁহার সম্মতিভিক্ষা করিয়া পৃথকভাবে লিখিলাম। আশা করি আপনি যদি আমার মত গ্রহণ করেন তবে পিতৃদেবকেও তাহাতে সম্মত করাইতে চেষ্টা করিবেন। আমার স্থির বিশ্বাস এ বিষয়ে আপনার মতের বিশেষ মূল্য আছে।”
এই চিঠিতে দেখা যায় আমি সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর, কিন্তু এখনো বাড়ির নিদের্শের প্রত্যাশী।
এই বিষয়ে পরবর্তী পত্র লিখি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২১। তাতে লিখেছিলাম:
“...আমার 'বিস্ফোরক' পত্র এতদিনে বোধ করি পাইয়া থাকিবেন। ঐ পত্রে আমার যে কার্যক্রমের উল্লেখ করিয়াছি পরবর্তী চিন্তার দ্বারা তাহাই দৃঢ়তর হইয়াছে।...যদি এই বয়সে চিত্তরঞ্জন সংসারের সবকিছু ছাড়িয়া জীবনের অনিশ্চয়তার ভূমিতে আসিয়া দাঁড়াইতে পারেন তবে আমার সাংসারিক সমস্যাবিহীন তরুণ জীবনে এ ক্ষমতা আরো অধিক। চাকরি ছাড়িলেও আমার কাজের বিন্দুমাত্র অভাব ঘটিবে না। শিক্ষকতা, সমাজ-সেবা, সমবায় প্রতিষ্ঠানাদি, সাংবাদিকতা, সম সংগঠন, ইত্যাদি বহু কাজ রহিয়াছে যাহাতে সহস্র সহস্র কর্মঠ তরুণকে ব্যাপত রাখিতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বর্তমানে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার দিকেই আকৃষ্ট হইতেছি। ন্যাশনাল কলেজ ও নতন সংবাদপত্র 'স্বরাজ' লইয়াই আমি এখন কিছুদিন কাটাইতে পারিব। আত্মত্যাগের আদর্শ লইয়াই জীবন আরম্ভ করিতে চাই, আমার কল্পনায় ও প্রবণতায় অনাড়ম্বর জীবন ও উচ্চ চিন্তারই আকর্ষণ অধিক। তাহা ভিন্ন বিদেশী শাসকের অধীনে চাকুরি করা অতি ঘৃণ্য কাজ বলিয়া বোধ করি। অরবিন্দ ঘোষের পথই আমার নিকট মহৎ, নিঃস্বার্থ অনুপ্রেরণার পথ, যদিও সে পথ রমেশ দত্তের পথ অপেক্ষা কণ্টকাকীর্ণ।
“দারিদ্র্য ও সেবার ব্রত গ্রহণ করার অধিকার ভিক্ষা করিয়া পিতৃদেব ও মাতাঠাকুরাণীর নিকট পত্র দিয়াছি। এই পথে ভবিষ্যতে লাঞ্ছনার ভয় আছে এই চিন্তায় তাঁহারা হয়ত আকুল হইবেন। আমি নিজে দুঃখক্লেশের ভয় করি না, সেদিন আসিলে দুঃখ হইতে সরিয়া আসিবার চেষ্টা না করিয়া অগ্রসর হইয়া তাহাকে গ্রহণ করিব।”
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯২১-এর চিঠিও কৌতুহলজনক। তার মধ্যে বলেছি।
“যেদিন আই. সি. এস পরীক্ষার ফল বাহির হইয়াছে সেদিন হইতে আমার মনে এই প্রশ্ন আন্দোলিত হইতেছে; যদি চাকুরিতে থাকি তাহাতে দেশের অধিক উপকারে আসিব, না চাকুরি ছাড়াটাই দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হইবে। এই প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ছে। এ বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চয় হইয়াছি জনসাধারণের মধ্যে থাকিই আমি দেশের অধিক মঙ্গলসাধন করিতে পারিব, আমলাতন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করিয়া নহে। চাকুরিতে থাকিয়া দেশের কোনো উপকার করা চলে না ইহা আমার বক্তব্য নহে। আমি বলিতে চাই যে তাহাতে যেটুকু মঙ্গল উপজাত হইতে পারে আমলাতন্ত্রের শখলমুক্ত দেশসেবার তুলনায় তাহা অতি নগণ্য। নীতির দিকটাও এখানে দেখিতে হইবে সেকথা পূর্বেই বলিয়াছি। বিদেশী আমলাতন্ত্রের অধীনতাকে মানিয়া লওয়া আমার নীতিতে অসম্ভব। জনসেবার প্রথম প্রয়োজন সমস্ত সাংসারিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ। সাংসারিক উন্নতির পথ একেবারে পরিত্যাগ করিলে তবেই জাতীয় কর্মে সম্পূর্ণভাবে আত্মোৎসর্গ করা সম্ভব। আর মনশ্চক্ষুতে অরবিন্দ ঘোষের দৃষ্টান্ত সর্বদা উজ্জ্বল রহিয়াছে। ক্রমেই বোধ করিতেছি যে সেই আত্মত্যাগের দ্বারা সেই দৃষ্টান্তের দাবি মিটাইতে পারিব। আমার চতুষ্পার্শ্বিক অবস্থাও তাহার অনুকূল।”
দেখা যাচ্ছে যে তখন পর্যন্ত অরবিন্দ ঘোষের প্রভাব আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি আবার রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ফিরে আসবেন এ ধারণা তখন চারদিকে অতি প্রবল ছিল।
এর পরের চিঠি ৬ই এপ্রিল অক্সফোর্ড থেকে লেখা। তখন আমি ছুটির সময়টা অক্সফোর্ডে কাটাচ্ছি। ততদিনে আমার পরিকল্পনাকে অগ্রাহ্য করে পিতৃদেবের চিঠি এসেছে। কিন্তু আমি তখন ইস্তফা দেওয়ার সঙ্কল্প পুরোপুরি গ্রহণ করেছি। ৬ই এপ্রিলের চিঠি থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি:
“পিতৃদেবের ধারণা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস চাকুরিয়ার পক্ষে নব্য শাসনব্যবস্থায় জীবন মোটেই দুর্বিষহ হইবে না। দশ বৎসরের মধ্যে এদেশে স্বায়ত্তশাসন অনিবার্য। কিন্তু আমার জীবন নব্য শাসনব্যবস্থায় সহনীয় হইবে কি না ইহা আমার জিজ্ঞাস্য নহে। অপরপক্ষে আমার ধারণা যে চাকুরিতে বহাল থাকিয়াও আমি কিছু কিছু দেশের মঙ্গলসাধন করিতে পারিব। আমার প্রধান প্রশ্ন নীতিগত। বর্তমান অবস্থায় কী আমাদের এক বিদেশী আমলাতন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করিয়া এক কাঁড়ি টাকার জন্য আত্মবিক্রয় করা সমীচীন? যাহারা ইতিমধ্যেই চাকুরিতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বা চাকুরি গ্রহণ করা ভিন্ন যাহাদের গত্যন্তর নাই তাহাদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু আমার অবস্থা অনেক দিক দিয়া সুবিধাজনক থাকিতে আমার কী এত শীঘ্র বশ্যতা স্বীকার করা উচিত? যেদিন আমি চাকুরির প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করিব সেদিন হইতে আমি আর স্বাধীন মানুষ থাকিব না ইহাই আমার বিশ্বাস।
“যদি আমরা উপযুক্ত মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকি তবে দশ বৎসরে কেন তাহার পূর্বেই স্বায়ত্তশাসন আমরা অর্জন করিতে পারিব। সেই মূল্য আত্মত্যাগ ও ক্লেশবহন। কেবল এই আত্মত্যাগ ও দুঃখবরণের ভিত্তিতেই জাতীয় সৌধ প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। যদি আমরা সকলে নিজের নিজের চাকুরির খুঁটি আঁকড়াইয়া বসিয়া থাকি, নিজের স্বার্থের অন্বেষণেই প্রবত্ত থাকি, তবে পঞ্চাশ বৎসরেও আমাদের স্বায়ত্তশাসন মিলিবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব যদি না হয় অন্তত প্রত্যেক পরিবারকে আজ দেশমাতার চরণে অর্ঘ্য আনিয়া দিতে হইবে। পিতৃদেব আমাকে এই আত্মত্যাগ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। আমাকে আমারি স্বার্থে এই দঃখকষ্ট হইতে বাঁচাইবার জন্য তাঁহার ইচ্ছার মধ্যে যে স্নেহ উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছে তাহার মূল্য বুঝিব না এমন নিষ্করুণ আমি নহি। তাঁহার স্বভাবতই আশঙ্কা হয় বুঝিব, আমি তরুণসুলভ উত্তেজনায় ঝোঁকের মাথায় কিছু একটা করিয়া বসিব। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস এ-বলি কাহাকে না কাহাকেও হইতেই হইবে, নতুবা উপায় নাই।
“যদি অন্য কেহ অগ্রসর হইত, তবে আমার পিছপা হইবার, অন্তত আরো খানিকটা ভাবিয়া দেখিবার কারণ বুঝিতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সে লক্ষণ মোটেই দেখা যাইতেছে না, অথচ অমূল্য মুহূর্তগুলি বহিয়া মাইতেছে। সমস্ত আলোড়ন সত্ত্বেও এটুকু ঠিক যে এখন পর্যন্ত একজন সিভিলিয়ানও চাকুরিতে ইস্তফা দিয়া আন্দোলনে নামিতে সাহস করে নাই। ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান আসিয়াছে অথচ কেহ তাহার সমুচিত জবাব দেয় নাই। আৱো অগ্রসর হইয়া বলিতে পারি সমগ্র বৃটিশভারতের ইতিহাসে একজন ভারতীয়ও স্বেচ্ছায় দেশসেবার জন্য সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করে নাই। দেশের সর্বোচ্চ কর্মচারীদের নিম্নতর শ্রেণীর লোকেদের নিকট দুষ্টান্ত দেখাইবার সময় আসিয়াছে। সরকারী উচ্চ চাকুরিয়াৱা যদি বশ্যতার প্রতিজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এমন কি তাহার ইচ্ছাটুকুও প্রকাশ করেন তাহা হইলেই আমলাতন্ত্রের যন্ত্র খানখান হইয়া যায়।
“সুতরাং এই ত্যাগ হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার কোনো পথ দেখিতে পাইতেছি না। এই ত্যাগের অর্থ আমি ভালোরপে জানি। দারিদ্র্য, দুঃখক্লেশে, কঠিন পরিশ্রম তত আছেই, আরো নানা ভোগ আছে যাহার কথা স্পষ্টভাবে বলিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু আপনার পক্ষে বুঝিয়া লওয়া সহজ। কিন্তু এ ত্যাগ করিতেই হইবে, জানিয়া শুনিয়া, বুঝিয়া করিতে হইবে। দেশে ফিরিয়া পদত্যাগ করার যে পরামর্শ আপনি দিয়াছেন তাহা অতি যুক্তিসঙ্গত হইলেও তাহার বিরুদ্ধে -দুই একটি কথা বলিবার আছে। প্রথমত গোলামির প্রতীকস্বরূপ প্রতিজ্ঞাপত্রে সহি করা আমার পক্ষে অতি কঠিন কাজ হইবে। দ্বিতীয় বর্তমানের জন্য যদি চাকুরিতে প্রবেশ করি তাহা হইলে প্রথা অনুসারে আমি ডিসেম্বর বা জানুয়ারির পূর্বে দেশে ফিরিতে পারিব না। এখন যদি পদত্যাগ করি তবে জুলাই মাসেই ফিরিতে পারিব। ছয় মাসের মধ্যে বহু পরিবর্তন ঘটিবে। ঠিক মুহূর্তে যথেষ্ট সাড়া না পাওয়ার ফলে আন্দোলন দমিয়া যাইতে পারে, দেরিতে সাড়া মিলিলে তাহা হয়ত ফলপ্রসূ হইবে না। আমার বিশ্বাস আরেকটি এজাতীয় আন্দোলন আরম্ভ করিতে বহু বৎসর লাগিয়া যাইবে। সুতরাং বর্তমান আন্দোলনের ঢেউকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করাই সমীচীন। যদি আমাকে পদত্যাগ করিতে হয় তবে তাহা দুদিন পরে বা এক বছর পরে করিলেও আমার বা অন্য কাহারো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, কিন্তু দেরি করিলে আন্দোলনের পক্ষে হয়ত ক্ষতি হইতে পারে। আমি জানি যে আন্দোলনকে সাহায্য করিবার ক্ষমতা আমার হাতে অল্পই, তবু যদি নিজের কর্তব্য পালনের সন্তোষ লাভ করিতে পারি তাহাও এক বৃহৎ লাভ বলিতে হইবে।...যদি কোনো কারণে পদত্যাগ সম্বন্ধে মত পরিবর্তন করি তবে পিতৃদেবের নিকট তৎক্ষণাৎ তার পাঠাইব, ভাহাতে তাঁহার আশঙ্কা ঘুচিবে।”
কেম্ব্রিজ থেকে ২০শে এপ্রিলে লিখিত চিঠিতে বলেছিলাম যে ২২শে এপ্রিল পদত্যাগপত্র দাখিল করব।
২৮শে এপ্রিল তারিখের চিঠিতে লিখেছিলাম:
“আমার পদত্যাগ সম্বন্ধে ফিজউইলিয়াম হলের রেডেওয়ে সাহেবের সহিত আলোচনা হইল। আমি তাঁহার নিকট যাহা কিছু প্রত্যাশা করিয়াছিলাম, ঠিক তাহার বিপরীত ঘটিল। তিনি আমার ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে সোৎসাহে সমর্থন জানাইলেন। আমি মত পরিবর্তন করিয়াছি শুনিয়া নাকি তিনি আশ্চর্য, এমন কি হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন, কারণ কোনো ভারতীয়কে নাকি তিনি এ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করিতে দেখেন নাই। আমি তাঁহাকে বলি যে পরে আমি সাংবাদিকতাকেই আশ্রয় করিব। তাঁহার অভিমতে সাংবাদিক-জীবন সিভিল সাভির্স অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ।
“এখানে আসিয়া শেষ সিদ্ধান্ত করিবার পূর্ব পর্যন্ত আমি তিন সপ্তাহ অক্সফোর্ডে ছিলাম। শেষ কয় মাস যে চিন্তায় আমাকে অহরহ পীড়ন করিয়াছে তাহা শুধু, এই যে আমার পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের মনে যাহাতে ক্লেশ হয় সেরুপ কার্য আমার করা উচিত কি না।... সুতরাং নতুন পথের কিনারায় দাঁড়াইয়া আজ আমি পিতামাতার এবং আপনার (যদিও আপনি আমি যেকোনো পথেই যাই না কেন আমার জন্য সাদর অভিনন্দন জানাইয়া রাখিয়াছেন) সুস্পষ্ট ইচ্ছার বিরোধিতা করিতে হইতেছে। সার্ভিসে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে আমার প্রধানতম যুক্তির ঙিত্তি ছিল এই যে প্রতিজ্ঞাপত্রে সহি করিয়া আমাকে এমন এক বৈদেশিক আমলাতন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করিতে হইবে যাহার এদেশ শাসন করিবার বিন্দুমাত্র অধিকারকে আমি স্বীকার করি না। একবার প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করিলে আমি তিন বৎসর বা তিনদিন কাজ করি তাহাতে কিছু আসে যায় না। আমি বুঝিয়াছি যে আপোষে মানুষকে অপজাত করে, ভাহাৱ আদর্শকে মলিন করিয়া দেয়...সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে জীবনান্তে উপাধির মুকুট পরিয়া মন্ত্রিত্বের গদিতে আসীন হইতেছেন তাহার কারণ তিনি বার্ক বর্ণিত সুবিধাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী। ঐ দর্শন গ্রহণ করিবার মতো অবস্থা আমাদের আজো আসে নাই। আমরা জাতি গঠন করিতে আসিয়াছি, এবং হ্যাম্পডেন ও ক্রমওয়েলের আপোষহীন আদর্শবাদ ভিন্ন তাহা সম্ভব নহে।...আমার এই বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে বৃটিশ সরকারের সহিত সকল সম্পর্ক ছেদ করিবার সময় আজ উপস্থিত। প্রতি সরকারি কর্মচারী, সে তুচ্ছ চাপরাশিই হোক বা প্রাদেশিক গভর্নরই হোক, নিজের কাজের দ্বারা কেবল বৃটিশ সরকারের বনিয়াদকে পাকা করিতেছে। সরকারের অবসান করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় তাহার নিকট হইতে সরিয়া আসা। আমি টলস্টয়ের নীতির কথা শুনিয়া বা গান্ধীর প্রচারে মুগ্ধ হইয়া একথা বলিতেছি না, নিজে উপলব্ধি করিয়া বলিতেছি।...কয়েকদিন হইল আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করিয়াছি। গৃহীত হওয়ার সংবাদ এখনো হস্তগত হয় নাই। “আমার চিঠির উত্তরে চিত্তরঞ্জন সম্প্রতি দেশে যে কাজ চলিতেছে তাহার বিষয়ে লিখিয়াছেন। বর্তমানে আন্তরিকতাপণ কর্মীদের অভাব সম্বন্ধে তিনি অভিযোগ করিয়াছেন। সুতরাং দেশে ফিরিবার পর অনেক প্রীতিপ্রদ কাজ আমার হাতের কাছে পাইব।...আর কিছু আমার বলিবার নাই। আমার হাতের কড়ি আমি ফেলিয়াছি, এখন আশা করা যাউক যে ইহা হইতে কেবল সুফলই জন্মিবে।”
১৮ই মে কেম্ব্রিজ থেকে লিখলাম:
“স্যর উইলিয়ম ডিউক আমাকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে রাজী করাইতে চেষ্টা করিতেছেন। তিনি এ বিষয়ে বড়দাদার সহিত পত্রালাপও করিয়াছেন। রবার্টস্ সাহেবও আমাকে আমার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করিতে পরামর্শ দিয়াছেন। ইণ্ডিয়া অফিসের নির্দেশ অনুসারে তাঁহার এই হস্তক্ষেপ। আমি স্যর উইলিয়মকে জানাইয়াছি যে পূর্ণ বিবেচনার পরই আমি পথ বাছিয়া লইয়াছি।” এই চিঠির খানিকটা ব্যাখ্যা করা দরকার। আমি পদত্যাগ করবামাত্র ইণ্ডিয়া অফিসের কামরায় কামরায় শোরগোল উঠল। তৎকালীন সহকারী ভারতসচিব স্যর উইলিয়ম ডিউক আমার বাবার উড়িষ্যাকমিশনারত্বের কালে তাঁকে চিনতেন। তিনি কালবিলম্ব না করে আমার বড়দা সতীশচন্দ্র বসুকে (তখন লণ্ডনে ব্যারিস্টারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন) এ বিষয়ে জানালেন এবং বড়দার মধ্যস্থতায় আমাকে পদত্যাগ করার বিরুদ্ধে পরামর্শ দিলেন। কেম্ব্রিজের অধ্যাপকেরাও আমাকে অনুরোধ করলেন। তখনকার কেম্ব্রিজের সিভিল সার্ভিস বোর্ডের সম্পাদক মিষ্টার রবার্টসএর তরফ থেকেও এক অনুরোধ এল। এত রকমের অনুরোধ উপরোধ পেয়ে কৌতুক বোধ করলাম। শেষোক্ত অনুরোধটাই তার মধ্যে সবচেয়ে মজার। ইণ্ডিয়া অফিসের দ্বারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রচারিত কতকগুলি ছাপা নির্দেশ নিয়ে একবার মিস্টার রবার্টস্-এর সঙ্গে আমার লড়াই বেধেছিল। এই নির্দেশপত্রের নাম ছিল “ভারতবর্ষে ঘোড়ার যত্ন করার নিয়ম” এবং তাতে এই ধরনের মন্তব্য ছিল যে ভারতবর্ষে সাহসেরা ঘোড়ার খাদ্যই খায়, ভারতবর্ষের বানিয়ারা {ব্যবসায়ীরা) জোচ্চুরির জন্য বিখ্যাত, ইত্যাদি। আমি এই ফতোয়া পাবামাত্র রাগে জ্বলতে জ্বলতে সহপাঠীদের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। সকলে মিলে স্থিৱ করলাম যে এইসব নির্দেশ ভুল এবং অপমানজনক, অতএব সকলে মিলে যুক্ত প্রতিবাদ জানাব। লিখবার সময় যখন এল তখন অবশ্য আর কেউ এগোতে চাইল না, আমি মরিয়া হয়ে নিজেই যা পারি করব স্থির করলাম...