ভারত পথিক (১৯৪৫)/স্কুল-জীবন (১)

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

স্কুল জীবন (১)

তখন ১৯০২ সালের জানুয়ারি মাস। আমার পাঁচ বছর পর্ণ হতে তখনো কিছু বাকি, এমনি সময়ে একদিন শুনলাম আমি নাকি কুলে ভৱতি হব। খবর পেয়ে আমি তো আনন্দে আত্মহাৱা হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন চোখের উপর দেখতাম দাদা দিদির সেজেগুজে স্কুলে যেত—ছোটো বলে আমিই শুধু বাড়িতে পড়ে থাকাতাম—এতে মেজাজ বিগড়ে যেত। কাজেই স্কুলে যাবার নামে আমি নেচে উঠলাম।

যেদিন প্রথম স্কুলে যাবার কথা সেদিনটির কথা আজও আমার মনে আছে। শেষটায় আমিও বড়দের মতো স্কুলে যেতে পারবো, শুধু ছুটির দিন ছাড়া বাড়িতে থাকবো না! স্কুল বসত ঠিক দশটায়, কাজেই দশটার একটু আগেই আমাদের রওনা হতে হবে। আমারই বয়সী আমার দুজন কাকারও সেদিন ভরতি হবার কথা ছিল। সবাই প্রস্তুত হয়ে নিয়ে গাড়িতে ওঠবার জন্য মাত্র ছুট্ লাগিয়েছি, এমন সময়ে পা পিছলে এক বিশ্রী রকম আছাড় খেলাম। মাথায় চোট লেগেছিল, কাজেই ব্যাণ্ডেজ জড়িয়ে সেদিনকার মতো আমাকে শয্যাশায়ী থাকতে হল। আমার কাকাদের ভাগ্য ছিল ভালো, ওরা দিব্যি স্কুলে চলে গেল, আর আমি ভগ্নহৃদয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলাম।

পরের দিন আমার মনোবাঞ্ছা পর্ণ হল।

আমাদের স্কুলটা ছিল মিশনারিদের, আর এখানকার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই ছিল য়ুরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ন। ভারতীয়দের জন্য গোনাগুনতি কয়েকটা (শতকরা বোধ হয় ১৫টা) সীট ছিল। আমার অন্য ভাইবোনেরাও এই স্কুলেই পড়ত, কাজেই আমিও এখানে ভরতি হলাম। বেছে বেছে এই স্কুলেই আমাদের কেন ভরতি করা হয়েছিল জানিনে, হয়তো অন্য সব স্কুলের চাইতে এখানে ইংরিজিটা তাড়াতাড়ি এবং ভালো শেখা যেত বলেই—আর তখনকার দিনে ইংরিজিজ্ঞানের বিশেষ কদরও ছিল। এখনো মনে আছে ভরতি হবার সময়ে আমার ইংরিজি বিদ্যের দৌড় বর্ণপরিচয়ের বেশি ছিল না। একটাও ইংরিজি কথ্য না জেনেও আমি কি করে যে চালিয়ে নিতাম এখন ভাবলে আশ্চর্য মনে হয়। প্রথম প্রথম ইংরিজি বলতে গিয়ে যে কি বিভ্রাট হত ভাবলে হাসি পায়। একটা ঘটনা মনে পড়ে। একবার আমাদের সকলের হাতে একটি করে স্লেট পেনসিল দিয়ে আমাদের শিক্ষয়িত্রী বলেছেন সেগুলোকে ছুঁচোলো করে নিতে। আমি দেখলাম কাকার চাইতে আমার পেনসিলটা বেশি ছুঁচোলো হয়েছে—অমনি ইংরিজিতে শিক্ষয়িত্রীকে সেটা জানিয়ে দেবার জন্য বললাম—“রনেন্দ্র মোট, আই শোর” বলেই মনে মনে নিজের ইংৱিজিজ্ঞানের তারিফ না করে পারলাম না।

আমাদের মাস্টারদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান—তার মধ্যে আবার শিক্ষয়িত্রীর সংখ্যাই ছিল বেশি। শ‍ুধু প্রধান শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষয়িত্রী মিস্টার এবং মিসেস্ ইয়াং ইংলণ্ড থেকে এসেছিলেন। এদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকেই আমরা পছন্দ করতাম। মিষ্টার ইয়াংকে আমরা ভক্তি করতাম ঠিকই, কিন্তু ভয়ও করতাম সাংঘাতিক, কারণ তিনি বেতটা একটু বেশিই ব্যবহার করতেন। মিস্ ক্যাডোগানকে আমরা কোনোরকমে বরদাস্ত করতাম। আর, মিস্ স্যামুয়েলকে তো আমরা দস্তুরমতো ঘৃণা করতাম—কোনোদিন যদি তিনি অনুপস্থিত থাকতেন আমাদেৱ মধ্যে হুল্লোড় পড়ে যেত। মিসেস্ ইয়াংকে অবশ্য আমরা অপছন্দ করতাম না। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগত মিস্ সারা লরেন্স-কে, তিনি ছিলেন আমাদের প্রথম শিক্ষয়িত্রী। এমন আশ্চর্য সহানুভূতিশীল ছিল তাঁর মন এবং শিশ‍ুমন তিনি এমন অন্তৱঙ্গভাবে বুঝতেন যে আমরা সকলেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারিনি। গোড়ার দিকে যখন আমি এক বর্ণও ইংরিজি বলতে পারতাম না তখন তাঁর সাহায্য না পেলে আমি অত সহজে ক্লাসের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারতাম কি না সন্দেহ।

অধিকাংশ শিক্ষকশিক্ষয়িত্রী এবং ছাত্রছাত্রী অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান হলেও আমাদের স্কুলটা ছিল বিলিতী ছাঁচে গড়া এবং যতদূর সম্ভব বিলিতী-ভাবাপন্ন। এর ফলে এমন কয়েকটা জিনিস আমরা শিখেছিলাম যা সাধারণ দেশী স্কুলে পড়লে শিখতে পারতাম না। দেশী স্কুলে যেমনটি দেখা যায়, ছাত্রছাত্রীদের ষোলোআলা মনোযোগই বরাদ্দ হয় পড়ার উপরে, এখানে মোটেই তা ছিল না। পড়ার চাইতে বেশি মনোেযোগ দেওয়া হত ভদ্র আচরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সময়ানুবর্তিতার উপরে—দেশী স্কুলে যার একান্ত অভাব। পড়াশোনার ব্যাপারেও প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে ব্যক্তিগত মনোযোগ দেওয়া হত, রোজকার পড়া নিয়মিতভাবে শেখানো হত—দেশী স্কুলে যেটা খুব কমই হয়। রোজকার পড়া এইভাবে হয়ে যাওয়ার ফলে পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়বার কোনো দরকারই হত না। তাছাড়া এখানে দেশী স্কুলের চাইতে অনেক ভালো ইংরিজি শেখানো হত।

কিন্তু এত সব সুবিধে সত্ত্বেও ভারতীয় ছেলেদের পক্ষে এরকম স্কুলে পড়া ভালো কি না বলা মুশকিল। এই জাতীয় স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত শঙ্খলাবদ্ধ হলেও, যে শিক্ষা এখানে দেওয়া হত ভারতীয়দের দিক থেকে তার উপযোগিতা বিশেষ ছিল না। বাইবেল-এর উপরে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত এবং বাইবেল পড়ার ধরনও ছিল অত্যন্ত নীরস। বুঝি বা না বুঝি পুর‍ুতদের মন্ত্রপাঠের মতো আমাদের বাইবেল মুখস্ত করতে হত। সাত বছর ধরে দিবারাত্র এইভাবে বাইবেল পড়লেও বাইবেলের রস প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম আরো অনেক বছর পরে, যখন আমি কলেজে পড়ি।

আমাদের পাঠ্যতালিকা এানভাবে তৈরি হত যাতে মনেপ্রাণে আমরা ইংরেজ হয়ে উঠতে পারি। গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল সম্বন্ধে আমার যতখানি জ্ঞান ছিল ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার সিকিভাগও ছিল কি না সন্দেহ। ভারতীয় নামও আমরা উচ্চারণ করতাম বিদেশীদের মতো বিকৃতভাবে। ল্যাটিন শব্দর‍ূপ মুখস্ত করতে করতে আমরা গলদ‍্ঘর্ম হয়ে উঠতাম, অথচ পি. ই. স্কুল ছাড়বার আগে সংস্কৃত ধাতুর‍ূপ সম্বন্ধে আমাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। গানের ক্লাসে আমরা শিখতাম ডো রে মি ফা; সা রে গা মা নয়। পাঠ্য বইয়ে পড়তাম ওদেশের ইতিহাসের গল্প, র‍ূপকথা—নিজের দেশের ছিটেফোঁটাও তাতে থাকত না। বলাই বাহুল্য দেশী কোনো ভাষাই সেখানে শেখানো হত না, আমরাও দেশী স্কুলে ঢোকবার আগে পর্যন্ত মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়েই বেরিয়েছি। অবশ্য এসব কারণে যে আমাদের স্কুলজীবন নিরানন্দে কেটেছে তা নয়। বরং উল্টোটাই হয়েছে। প্রথম কয়েক বছর তো এখানকার শিক্ষা আমাদের উপযোগী কি না সে সম্বন্ধে আমরা মোটেই সচেতন ছিলাম না। যা আমাদের শেখানো হত সাগ্রহে তাই শিখতাম এবং স্কুলের আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পূর্ণ খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত ভদ্র বলে বাইরে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল—আমরা সেই খ্যাতি কখনো ক্ষুন্ন হতে দিইনি। আমাদের বাপমাও আমাদের শিক্ষাদীক্ষা সম্বন্ধে বেশ নিশ্চিন্ত ছিলেন। আমাদের পরিবার সম্পর্কে স্কুলকর্তৃপক্ষের ধারণা খুব ভালো ছিল, কারণ আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রায় সকলেই নিজের নিজের ক্লাসে বরাবর সর্বোচ্চ স্থান দখল করে এসেছে।

খেলাধুলার ব্যাপারে এখানে যথেষ্ট যত্ন নিলেও বিলিতী আদর্শে পরিচালিত স্কুলে যতটা নেওয়া উচিত ঠিক ততটা নেওয়া হত না। আগাদের প্রধান শিক্ষকমশাই নিজে খেলাধুলায় তত উৎসাহী ছিলেন না বলেই বোধ হয় এদিকে তাঁর দৃষ্টি বিশেষ প্রখর ছিল না। প্রধান শিক্ষকমশাই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক ছিলেন এবং তাঁর প্রভাব স্কুলের সর্বত্র টের পাওয়া যেত। নিয়মানুবর্তিতা ও ভদ্র আচরণকে তিনি শিক্ষার সবচেয়ে বড় অঙ্গ বলে মানতেন। আমাদের প্রগ্রেস রিপোর্টে শুধু, পাঠ্য বিষয়েই নম্বর দেওয়া হত না, (১) স্বভাব, (২) আচরণ, (৩) পরিচ্ছন্নতা, (৪) সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদিতেও নম্বর ছিল। এর ফলে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সকলেই খুব ভদ্র ছিল। দুষ্টুমি করলে বা স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে ছেলেদের বেত মেরে সাজা দেওয়া হত, তবে স্কুলের মধ্যে মাত্র দুজনেরই বেত মারার ক্ষমতা ছিল—একজন আমাদের প্রধান শিক্ষকমশাই আর একজন তাঁরই সুযোগ্য পত্নী মিসেস্ ইয়াং।

মিস্টার ইয়াং-এর অনেকগুলি অদ্ভ‌ুত অভ্যাস ছিল, তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আমরা যথেষ্ট হাসাহাসি করতাম। ইয়াং-এর বড় এক ভাই ছিলেন অবিবাহিত মিশনারি। মিশনারিসুলভ শ্মশ্র‌ুবহুল এই ভদ্রলোক ছোটো ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং প্রায়ই তাদের সঙ্গে খেলায় মেতে যেতেন। এঁর নাম দিয়েছিলাম আমরা ‘ওল্ড ইয়াং’ আর আমাদের প্রধান শিক্ষককে বলতাম ‘ইয়াং ইয়াং’। মিস্টার ইয়ং প্রায়ই সর্দিতে ভুগতেন, তাই গরমের দিনেও তিনি বৃষ্টি পড়লেই দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকতেন, পাছে ঠাণ্ডা লাগে। সর্দির কুফল সম্বন্ধে প্রায়ই তিনি নানাভাবে আমাদের সাবধান করতেন, বলতেন, সর্দি থেকে কলেরা পর্যন্ত হতে পারে। কখনো অসুস্থ বোধ করলে তিনি এমন কুইনিন খেতেন যে কিছুদিন প্রায় কালা হয়ে থাকতেন। এদেশে দীর্ঘ কুড়ি বছর বাস করবার পরও তিনি স্থানীয় ভাষায় একটি কথাও শুদ্ধ করে বলতে পারতেন কি না সন্দেহ। স্কুলের বাইরে তিনি বেড়াবার জন্য কখনো বেরোতেন না। যদি চাপরাশি তার টেবিলে কিছু রাখতে ভুলে যেত মিস্টার ইয়াং ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে ডাকতেন, তারপর যে জিনিসটা দরকার ইশারায় বুঝিয়ে দিয়ে, তার দিকে ক্র‌ুদ্ধদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, দেশীয় ভাষায় তাকে বকুনি দিতে না পারায় বিড়বিড় করে ইংরিজিতেই বলতেন, “এ কাজটা আগে কেন করা হয়নি?” কেউ তাঁর কাছে চিঠি নিয়ে এলে তাকে যদি অপেক্ষা করতে বলার দরকার হত তবে মিস্টার ইয়াং-ছুটে গিয়ে, স্ত্রীর কাছ থেকে অপেক্ষা করতে বলাযর দেশীয় ভাষাটা জেনে নিয়ে সেটাকে আওড়াতে আওড়াতে এসে কোনো রকমে বলে ফেলে ভারমুক্ত হতেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমাদের প্রধান শিক্ষক মশাইয়ের চালচলন ছিল অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন এবং তাঁকে আমরা সকলে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। অবশ্য এই শ্রদ্ধার সঙ্গে বেশ খানিকটা ভয়ও থাকতো। আমাদের প্রধান শিক্ষয়িত্রীও অত্যন্ত স্নেহশীলা ছিলেন, কাজেই আমরা সকলেই তাঁকে ভালোবাসতাম। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি বা ধর্মবিশ্বাসে এঁরা কখনো হস্তক্ষেপ করতেন না।

এইভাবে কয়েক বছর আমাদের বেশ স্বচ্ছন্দেই কেটে গিয়েছিল— স্কুলের আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের আমরা বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রমেই যেন ছন্দপতন ঘটতে লাগল। কোথায় কি যে ঘটল, যার ফলে এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা ক্রমেই আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। স্থানীয় কোনো ঘটনাই এর কারণ, না দেশের নবজাগ্রত রাজনৈতিক চেতনারই এটা একটা ঢেউ, সে আলোচনা আপাতত স্থগিত রাখাই ভালো।

নানা কারণে এই রাজনৈতিক জাগরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তার ফলে যে সংঘর্য দেখা দিয়েছিল তার জন্য আমরা ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। এতদিন পর্যন্ত আমরা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে বাস করছিলাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে লাগলাম এই দুটি জগতের মধ্যে একটা বড় অসংগতি রয়ে গেছে। পরিবার ও সামাজিক জীবন নিয়ে একটি জগৎ, যেটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়। আর, স্কুল, যেটা সম্পূর্ণ বিলিতীভাবাপন্ন না হলেও তার কাছাকাছি যেত—আর একটি জগৎ। আমরা জানতাম আমরা ভারতীয় বলে প্রাইমারি ও মিডল স্কুল পরীক্ষা দিতে পারলেও স্কলারশিপ পরীক্ষা দেবার অধিকার আমাদেৱ নেই—যদিও বাৎসরিক পরীক্ষাগ‍ুলিতে আমরাই সাধারণত সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করতাম। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছেলেরা ভলাণ্টিয়ায় কোর-এ যোগ নিতে পারত, বন্দুক ব্যবহার করতে পারত, কিন্তু আমাদের এসব অধিকার ছিল না। এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলে গেল, বুঝলাম এক স্কুলে পড়লেও আমাদের অর্থাৎ ভারতীয়দের ভিন্ন চোখে দেখা হয়। ইংরেজ বা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছেলেদের সঙ্গে ভারতীয় ছেলেদের প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হত—যার পরিসমাপ্তি ঘটত বক্সিং-এ। এইসব বক্সিং-প্রতিযোগিতায় ভারতীয় এবং অভারতীয়দের পরিষ্কার দুটো দল খাড়া হয়ে যেত। উচ্চপদস্থ একজন ভারতীয় অফিসারের এক ছেলে আমাদের সহপাঠী ছিল—সে প্রায়ই ভারতীয় এবং য়ুরোপীয় ছেলেদের মধ্যে ম্যাচখেলার আয়োজন কৱত—খেলোয়াড়মাত্রেই এইসব প্রতিযোগিতায় যোগ দিত। মনে পড়ে নিজেদের মধ্যে আমরা প্রায়ই বলাবলি করতাম, বাইবেল আর পড়ব না, আর নিজেদের ধর্মও কিছুতেই ছাড়বে না। এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পাঠ্যতালিকা চালু হল। এই তালিকা অনুযায়ী প্রবেশিকা, ইণ্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রী পরীক্ষায় বাঙলা অবশ্য পাঠ্য বলে নির্দিষ্ট হল। এ ছাড়া প্রবেশিকা পাঠ্যতালিকায় আরো অনেকগ‍ুলি পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমরা দেখলাম পি. ই. স্কুলের পাঠ্যতালিকা ভারতীয় ছেলেদের মোটই উপযোগী নয়, কারণ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার জন্য কোনো দেশী স্কুলে ভরতি হলে আমাদের একেবারে গোড়ার থেকে বাঙলা ও সংস্কৃত শিখতে হবে। আমার দাদারা সকলেই প্রবেশিকা, ইণ্টারমিডিয়েট, ডিগ্রী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল এবং তারা যে জগতে চলাফেরা করত তার গল্প শ‍ুনে আমার মনও বিচলিত হয়ে উঠেছিল।

কিন্ত‌ু তাই বলে স্কুল সম্বন্ধে কখনো আমার মনে বিরুদ্ধে ভাব জাগেনি। ১৯০২ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত সাত বছর আমি এই স্কুলে কাটিয়েছি কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমি কোনো কারণে অসুখী হইনি। যেসব অসংগতির কথা উল্লেখ করেছি সেসব আমরা বিশেষ গায়ে মাখতাম না, ফলে আমাদের স্কুলজীবনের স্বচ্ছন্দ ধারা কখনো ক্ষুন্ন হয়নি। শ‍ুধু শেষের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহের ভাব মনে মনে অনুভব করেছি এবং এই পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছি। স্বদেশী আদর্শে গড়া কোনো স্কুলে পড়বার জন্য তখন থেকেই আমার মনে আগ্রহ জেগে উঠেছিল। ভাবতাম ভারতীয় পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব। কিন্তু ১৯০৯ সালে জানুয়ারি মাসে স্কুল ছাড়বার সময়ে যখন আমি ছাত্র ও শিক্ষকশিক্ষয়িত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের কাছে বিদায় নিতে গেলাম তখন আমার মনে বিন্দুমাত্র বির‍ুদ্ধভাবও ছিল না। তখনকার মনোভাব বিশ্লেষণ কররার ক্ষমতা সে সময়ে আমার ছিল না। আজ অভিজ্ঞ মন নিয়ে বিচার করে এই মনোভাবের অনেকগুলি কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পড়াশোনায় আমি বরাবরই ভালো ফল করে এসেছি, কিন্তু খেলাধুলায় নেহাতই আনাড়ী ছিলাম। অথচ আমাদের স্কুলে পড়াশোনার চাইতে খেলার উপরেই বেশি জোর দেওয়া হত, তাই নিজের সম্বন্ধে আমার বরাবরই খুব নিচু ধারণা ছিল। এই ধারণা বহু চেষ্টা করেও মন থেকে সরাতে পারিনি। একেবারে নিচু ক্লাসে ভরতি হয়েছিলাম বলেই বোধ হয় বড়দের তুলনায় নিজেকে তুচ্ছ মনে করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

সব দিক বিচার করে আজকের দিনে এই ধরনের স্কুলে ভারতীয় ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের আমি পক্ষপাতী নই। বিদেশী আবহাওয়ার সঙ্গে তারা কখনোই খাপ খাবে না, পদে পদে অশান্তি ভোগ করবে; বিশেষ করে যদি কেউ একটু চিন্তাশীল হয় তবে তো কথাই নেই। অনেক অভিজাত পরিবারে ছেলেদের বিলেতে পাব‍্লিক স্কুলে রেখে শিক্ষা দেবার রীতি আজও চলে আসছে। এ ব্যবস্থাও আমার মোটেই ভালো মনে হয় না। একই কারণে বিলিতী ছাঁচে গড়া এবং ইংরেজ শিক্ষক পরিচালিত ভাৱতীয় স্কুলের পরিকল্পনাও আমি অনুমোন করি না। অনেক ছেলে হয়তো এই বিজাতীয় পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের বেশ মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু যারা একটু চিন্তাশীল ভাদের পক্ষে এখানকার পরিবেশ মোটেই অনুকূল নয়, একদিন না একদিন তাদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠবেই। এসব কথা ছেড়ে দিলেও এই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আরো বড় আপত্তি এই যে এতে ভারতীয় পরিবেশ, ভারতীয় বৈশিষ্ট্য এবং ভারতীয় ঐতিহ্য ও সমাজনীতিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হত। অল্পবয়সের ছেলেদের উপর জোর করে ইংরিজি শিক্ষা চাপলেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সময় হয় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালোমন্দ বিচার করবার জ্ঞান হলে পর ছেলেদের পাশ্চাত্য দেশে খাঁটি পাশ্চাত্য আবহাওয়া কিছুদিন রাখলে তবে তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার ভালো জিনিসটুকু গ্রহণ করতে পারবে।