ভীষণ হত্যা/প্রথম পরিচ্ছেদ

ভীষণ হত্যা।


প্রথম পরিচ্ছেদ।


 একটী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ যেরূপ অবস্থায় জঙ্গলময় বাগানের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল ও ঐ মৃতদেহের সুরথহাল করিতে আমাদিগকে যেরূপ ভয়ানক বিপদে পতিত হইতে হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ “সুরথহালে বিপদ”[] নামক প্রবন্ধে বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিয়াছেন।

 ঐ মৃতদেহ যে কাহার, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমরা বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াছিলাম; সহর ও সহরতলীর নানা স্থানে সহস্র সহস্র নরনারীগণকে ঐ মৃতদেহ দেখান হইয়াছিল: প্রত্যেক রাস্তায় রাস্তায়,—গলিতে গলিতে,—পাড়ায় পাড়ায় ঢোল সোহরতের দ্বারা এই সংবাদ প্রত্যেক ব্যক্তিকে জানাইয়া দেওয়ার বিশেষরূপ চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু সেই সময় কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় নাই। ঐ মৃতদেহ যখন কোন রূপেই সনাক্ত হইল না, তখন বাধ্য হইয়া উহা ভস্মে পরিণত করাইতে হইল, কিন্তু আমরা উহার ফটোগ্রাফ লইতে ভুলিলাম না।

 ঐ মৃতদেহ ভস্মে পরিণত হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ মকর্দ্দমার অনুসন্ধানও যে শেষ হইয়া গেল, তাহা নহে; আবশ্যকীয় অনুসন্ধান আমাদিগের সাধ্যমত চলিতে লাগিল। এইরূপে ক্রমে দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিরূপে ও কাহা কর্ত্তৃক ঐ স্ত্রীলোকটী হত হইয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান হওয়া দূরে থাকুক, ঐ স্ত্রীলোকটী যে কে, তাহা পর্য্যন্ত কোনরূপ সন্ধান আমরা করিয়া উঠিতে পারিলাম না। এইরূপে আরও দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এই মকর্দ্দমার কিনারা হইবার আশা ক্রমে আমরা পরিত্যাগ করিতে লাগিলাম। আরও দুই এক দিবস দেখিয়া এই মকর্দ্দমার অনুসন্ধান হইতে আমরা বিরত হইব, মনে, মনে এইরূপ স্থির করিতেছি, এরূপ সময় জানিতে পারিলাম যে, একটী স্ত্রীলোক থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিয়াছে যে, তাহার বাড়ীর ভাড়াটিয়া একটী স্ত্রীলোক আজ কয়েক দিবস হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, এ পর্য্যন্ত তাহার কোনরূপ সন্ধান নাই।

 এই কথা জানিতে পারিয়া, যে থানায় এই সংবাদ প্রদত্ত হইয়াছে সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম ও জানিতে পারিলাম, প্রকৃতই ঐরূপ সংবাদ ঐ থানায় প্রদত্ত হইয়াছে। যে স্ত্রীলোকটী ঐ সংবাদ থানায় প্রদান করিয়াছে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে ঐ থানার একজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া যে স্ত্রীলোকটা ঐ সংবাদ থানায় প্রদান করিয়াছিল, তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ঐ স্ত্রীলোকটীর নাম বেলা। বেলা একটী বেশ্যা, বেশ্যাবৃত্তি করিয়া সে একখানি দ্বিতল পাকা বাড়ী করিয়াছে! ঐ বাড়ীতে কয়েকজন বেশ্যা ভাড়াটিয়া আছে। বেলাও ঐ বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে।

 বেলার নিকট হইতে অবগত হইলাম, তাহার ঐ বাড়ীতে চন্দ্রমুখী নাম্নী অপর আর একটা বেশ্যা অনেক দিবস হইতে বাস করিত। বেশ্যাবৃত্তি করিয়া সেও কতকগুলি তৈজসপত্র ও অলঙ্কারের সংস্থান করিয়াছিল। সে অতিশয় চতুরা ছিল, সহজে সে কাহাকেও বিশ্বাস করিত না, ও অপরের পরামর্শমত সে কখনই চলিত না, নিজে যাহা বুঝিত, ভাল হউক বা মন্দ হউক, সে তাহাই করিত। এরূপও দেখা গিয়াছে যে, তাহার ঘরে যাহাদিগের যাতায়াত ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ উহার নিকট হইতে সময় সময় দুই একখানি অলঙ্কার হস্তগত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই। চন্দ্রমুখিকে তাহারা যেরূপ ভাবে বুঝাইবার চেষ্টা করিত, সে কিন্তু সেরূপ ভাবে বুঝিত না বা কাহার কথায় সে কখন বিশ্বাস করিত না। যত দিবস পর্য্যন্ত সে এই বাটীতে বাস করিয়া ছিল, অপর কোন স্থানে রাত্রি যাপন তাহার মধ্যে তাহাকে বাগান বা করিতে কেহ কখন দেখেন নাই, কিন্তু আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত দেখা যাইতেছে যে, উহার ঘর তালাবদ্ধ রহিয়াছে, ও সে যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারা যাইতেছে না।

 বেলার নিকট হইতে এই কয়েকটা কথা জানিতে পারিয়া তাহাকে কহিলাম, চন্দ্রমুখী সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাস্য আছে, কিন্তু সে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বে একটা কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি ফটোগ্রাফ দেখিয়া চিনিতে পারিবে কি উহা চন্দ্রমুখীর ফটোগ্রাফ কি না?

 বেলা। ফটোগ্রাফ দেখিয়া বোধ হয় আমি বলিতে পারিব যে, উহা চন্দ্রমুখির ফটোগ্রাফ কি না।

 যে মৃতদেহ সম্বন্ধে আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম ও ঐ মৃতদেহ ভস্মীভূত হইবার পূর্ব্বে যাহার ফটোগ্রাফ আমরা উঠাইয়া লইয়াছিলাম, তাহার একখণ্ড আমার নিকট ছিল, উহা বাহির করিয়া আমি বেলার হস্তে প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “দেখ দেখি, ইহা কাহার ফটোগ্রাফ?”

 বেলা ঐ ফটোগ্রাফখানি হস্তে লইয়া অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত দর্শন করিল ও পরিশেষে কহিল, “যেরূপ অবস্থায় এই ফটোগ্রাফ লওয়া হইয়াছে দেখিতেছি, তাহাতে উহা যে, কাহার ফটোগ্রাফ, তাহা চিনিতে পারা নিতান্ত সহজ নহে, তথাপি আমার যেন বোধ হইতেছে যে, উহা চন্দ্রমুখিরই ফটোগ্রাফ, চন্দ্রমুখির ও অবস্থা কে করিল মহাশয়?

 আমি। উহার এরূপ অবস্থা কিরূপে হইল, তাহার সমস্তই ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিবে। এখন আমি তোমাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান কর, ও আমাদিগকে যতদূর সম্ভব সাহায্য কর; তোমার সাহায্য ব্যতীত আমরা কোনরূপেই এই বিষয়ের অনুসন্ধানে কৃতকার্য্য হইতে পারিব না।

 বেলা। আমার নিকট হইতে কি কি বিষয় আপনি জানিতে চাহেন বলুন, আমার দ্বারা যতদূত হইতে পারে, আমি আপনাদিগকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।

 আমি। চন্দ্রমুখী তোমার বাড়ীতে কত দিবস হইতে বাস করিতেছে?

 বেলা। প্রায় ৮৷১০ বৎসর হইবে, আমার বোধ হয়, সে তাহার পিতা মাতার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিবার পর হইতেই আমার বাড়ীতে বাস করিতেছিল।

 আমি। তাহার ঘরে কাহার যাতায়াত ছিল?

 বেলা। তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না, সে একজন লোকের অন্নে প্রতিপালিত হইত না, বা একজনের আশ্রয়ে বাস করিত না। প্রায়ই তাহার ঘরে অপরিচিত লোক দেখিতে পাইতাম।

 আমি। সে যখন তাহার পিতা মাতার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তখন সে একাকী আসিয়াছিল, কি অপর কোন লোক তাহাকে আনিয়াছিল?

 বেলা। সেই সময় অপর একটী লোক উহার সঙ্গে আগমন করে, বোধ করি, সেই তাহাকে বাহির করিয়া আনিয়াছিল। প্রায় এক বৎসরকাল সে নিয়ত চন্দ্রমুখির ঘরে যাতায়াত করিত, সেই সময় অপর আর কাহাকেও উহার ঘরে আসিতে দেখি নাই। এইরূপে প্রায় এক বৎসর অতীত হইয়া যাইবার পর, আর সেই ব্যক্তিকে দেখিতে পাই না। এক দিবস আমি চন্দ্রমুখিকে উহার কথা জিজ্ঞাসা করি, তাহাতে সে কহে যে, সে এত দিবস যাহার অন্নে প্রতিপালিত হইতেছিল, সে মরিয়া গিয়াছে। ইহার পর ৮।৯ বৎসর কাল চন্দ্রমুখিকে একজনের অন্নে প্রতিপালিত হইতে দেখি নাই। মধ্যে মধ্যে অপরিচিত লোককেই তাহার ঘরে জ্ঞাসিতে দেখিয়াছি।

 আমি। সেই সকল অপরিচিত লোক যে কাহারা তাহা এখন আমরা কিরূপে জানিতে পারিব?

 বেলা। ইহা আমি বলিতে পারিব না, তবে আমার বাড়ীতে সরলা নাম্নী একটী ভাড়াটিয়া আছে, তাহার সহিত চন্দ্রমুখির খুব প্রণয় ছিল, সে সর্ব্বদা উহার ঘরে যাতায়াত ও বসা উঠা করিত। সময় সময় সে তাহার ঘরের যে সকল লোক আগমন করিত, তাহাদিগের সহিত আমোদ প্রমোদেও যোগ দিত। সেই যদি কোন সংবাদ আপনাকে প্রদান করিতে পারে; তৎভিন্ন এই বাড়ীর অপর আর কাহার নিকট হইতে বিশেষ কোন কথা অবগত হইতে পারিবেন না।

 আমি। সরলা এখন কোথায়?

 বেলা। সে আমার বাড়ীতেই আছে, বলুন, এখনই আমি তাহাকে আপনার আনিতেছি। আবশ্যক হয়তো সম্মুখে ডাকিয়া

 আমি। কেবল ডাকিয়া দিলে হইবে না, যাহাতে সে সমস্ত কথা বলিয়া আমাদিগের বিশেষরূপ সাহায্য করিতে পারে, তাহার বন্দোবস্ত তোমাকে করিয়া দিতে হইবে। আরও একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ীর ভিতর এই ঘরে যে, সে বাস করে, ও অপরিচিত লোককে সে তাহার ঘরে স্থান প্রদান করে, এ কথা অপরিচিত লোক সকল কিরূপে অবগত হইতে পারিত?

 বেলা। এ অতি সামান, কথা, তাহার ঘর খুলিলেই আপনি দেখিতে পাইবেন যে উহার ঘরের সম্মুখে রাস্তার উপর একটী বারান্দা আছে। প্রায় সদা সর্ব্বদাই সে ঐ বারান্দায় বসি না থাকিত, ও ঐ স্থানে বসিয়া বসিয়াই রাস্তার লোক সংগ্রহ করিয়া আপন ঘরে আনিত।

 আমি। তাহা হইলে কি তোমার অনুমান হয় যে, এইরূপে নবাগত কোন ব্যক্তি তাহাকে এই স্থান হইতে লইয়া গিয়া তাহার এইরূপ দশা করিয়াছে?  বেলা। আমার ত তাহাই বোধ হয়; কিন্তু ইতিপূর্ব্বে তাহাকে কাহারও সহিত কোন স্থানে গমন করিতে দেখি নাই। বিশেষ অর্থলোভ দেখাইলেও সে কাহারও সহিত কোন স্থানে কখন গমন করে নাই।

 আমি। তাহার কি অনেকগুলি গহনা ছিল?

 বেলা। কতকগুলি গহনা ছিল ও সে প্রায়ই উহা পরিধান করিত।


  1. সন ১৩১২ সালের আশ্বিন মাসের ১৫০ সংখ্যা দারোগার দপ্তর দ্রষ্টব্য।