ভূতের বিচার/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
ক্রমে হানিফ খাঁর সময় পূর্ণ হইয়া আসিল, আজ তাহার ফাঁসির দিন, অতি প্রত্যূষে সে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিবে। তাহার ফাঁসি দেখিবার নিমিত্ত নানা লোকের সমাগম হইল। বিচারের শেষ দিবসে যেমন লোকের জনতা হইয়াছিল, আজও ক্রমে সেইরূপ লোকের সমাগম হইল।
লোকের সমাগম হইল সত্য, কিন্তু জেলের বন্দোবস্তের গুণে ফাঁসিতে ঝুলিয়া মরিবার সময় কেহই তাহাকে দেখিতে পাইল না।
ফাঁসিকাষ্ঠ কি? কিরূপে ফাঁসি দেওয়া হয়? তাহা পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই জানেন না। ফাঁসিকাষ্ঠকে ফাঁসিকাষ্ঠ না বলিয়া ইহাকে ফাঁসিমঞ্চ নামে অভিহিত করিলেই বোধ হয় ভাল হইত। কারণ উহা কাষ্ঠের একটী উচ্চ মঞ্চ বিশেষ, তাহার উপর হইতে রজ্জু ঝুলাইয়া দিবার বন্দোবস্ত আছে। ঐ মঞ্চের উপর উঠিয়া যে তক্তার উপর দাঁড়াইতে হয়, তাহা এরূপভাবে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, ইচ্ছা করিলেই উহার খিল ভিতর হইতে খুলিয়া দেওয়া যায়। যাহাকে ফাঁসি দেওয়া হইবে, তাহার আপাদমস্তক বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া ঐ মঞ্চের উপর তোলা হয়। সে তাহার উপর দণ্ডায়মান হইলে ফাঁসিরজ্জু তাহার গলায় পরাইয়া দেওয়া হয় ও পূর্ব্বকথিত তক্তা, যাহার উপর সে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার খিল নিম্ন হইতে যেমন জল্লাদ খুলিয়া দেয়, অমনি সে ঐ মঞ্চের ভিতর ঝুলিয়া পড়ে। ঐ মঞ্চ এরূপ উচ্চ করিয়া নির্ম্মিত যে, ঐ ব্যক্তি ঝুলিয়া পড়িলেই মৃত্তিকা হইতে তাহার পা অনেক দূর উচ্চে থাকে। ঝুলিয়া পড়িবামাত্র ঐ রজ্জুর ফাঁস উহার গলায় এরূপভাবে আঁটিয়া যায় যে, তাহাতেই তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া যায়। এইরূপে যাহাকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সে ঝুলিয়া পড়িলে বাহির হইতে আর কেহই তাহাকে দেখিতে পায় না। যে রজ্জু তাহার গলদেশে আবদ্ধ থাকে, কেবল সেই রজ্জুর উপরিভাগ বাহির হইতে দুই চারিবার নড়িতে দেখা যায়। এইরূপে কোন ব্যক্তিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান হইলে তাহাকে শীঘ্র নামাইয়া ফেলা হয় না, সে বহুক্ষণ পর্য্যন্ত ঐ রজ্জুতে লম্ববান থাকে, পরিশেষে তাহাকে নামাইয়া তাহার সৎকার করা হয়।
হানিফ খাঁকেও ঐরূপে ফাঁসি দেওয়া হইল, তাহার আপাদমস্তক বস্ত্রে আবৃত করিয়া সেই মঞ্চের উপর উঠান হইল, তাহার গলায় রজ্জু পরাইয়া দেওয়া হইল, যে তক্তার উপর সে দাঁড়াইয়াছিল, তাহা ভিতর হইতে হঠাৎ খুলিয়া গেল। হানিফ খাঁ সজোরে তাহার মধ্যে ঝুলিয়া পড়িল, উপরের রজ্জুও দুই একবার নড়িল। ইহা দেখিয়াই একে একে সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। সকলেই বুঝল যে, হানিফ খাঁ এতদিন পরে ইহ-জগত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।
কেহ বা এই অবস্থা দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ করিল, কেহ বা আনন্দিত হইল, কেহ বা তাহার উদ্দেশে সহস্র গালি দিতে দিতে সেইস্থান পরিত্যাগ করিল।
সকলেই জানিতে পারিল যে, হানিফ খাঁর মৃতদেহ সেই মঞ্চের মধ্যে রজ্জুতে লম্ববান রহিল।
এইরূপে সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, সন্ধ্যার সময় জেলাময় প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, হানিফ খাঁ ভূত হইয়াছে; যে রজ্জুতে তাহাকে ফাঁসি দেওয়া হইয়াছিল, ভূত হইয়া সেই রজ্জু হইতে আপন দেহ মুক্ত করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। এই কথা প্রকাশ হইবার সঙ্গে সঙ্গে নানাস্থান হইতে নানা কথা উঠিতে লাগিল। কেহ কহিল, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া, জল্লাদকে মারিয়া ফেলিয়াছে; কেহ কহিল, যে জজ সাহেব তাহার ফাঁসির হুকুম দিয়াছিলেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া তাঁহার ঘাড় মটকাইয়া দিয়া আসিয়াছে। কেহ কহিল, যে পুলিস-কর্ম্মচারী তাহাকে ধরিয়াছিল, ভূত হানিফ খাঁ তাঁহাকে গাছের উপর হইতে ফেলিয়া দিয়াছে। কোনস্থানে কেহ কহিল, জেলের ভিতর একটী লোকও নাই, ভূতে একটী ঝড় তুলিয়া সকলকেই কোথায় উড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। এইরূপে যাহার মুখে যাহা আসিল, সে তাহাই কহিতে লাগিল ও প্রমাণ করিতে প্রবৃত্ত হইল যে, তাহার কথা মিথ্যা নহে। পাড়ায় পাড়ায়, পথে ঘাটে মাঠে, গাড়ীতে কেবল ঐ কথা; উহা ছাড়া আর কোন কথাই নাই। যাহারা হানিফ খাঁর ফাঁসি দেখিতে গিয়াছিল, তাহারা কেহই সন্ধ্যার পর আর ঘর হইতে বাহির হইল না। যাহারা তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, তাহারা আপনাপন স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল। বাতাসের শব্দে তাহারা ভয় পাইতে লাগিল। বৃক্ষ হইতে পত্রাদি পতনের সামান্য শব্দে তাহারা মনে করিতে লাগিল যে, বুঝি হানিফ খাঁর ভূত আসিতেছে। এইরূপে নিতান্ত অশান্তির সহিত সেই রাত্রি অতিবাহিত হইল।
এই সকল জনরবের যে একেবারে কোন ভিত্তি ছিল না, তাহা নহে, প্রকৃতই একটী ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা হইতেই এই সকল জনরবের উৎপত্তি।
যে দিবস প্রাতে হানিফ খাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান হয়, সেই দিবস বৈকালে তাহার মৃতদেহ ফাঁসি-রজ্জু হইতে নমাইবার জন্য যখন জেলের একজন প্রধান কর্ম্মচারী সেইস্থানে গমন করিয়া, ঐ ফাঁসি-মঞ্চের ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময় দেখিতে পান যে, উহার মধ্যে কেবল মাত্র ফাঁসি-রজ্জু ঝুলিতেছে, হানিফ খাঁর মৃতদেহ আদৌ নাই। ইহা দেখিয়া প্রথমতঃ তিনি অতিশয় আশ্চর্য্যান্বিত হন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে করেন, হয়তো অপর কোন কর্ম্মচারী ঐ মৃতদেহ নামাইয়া লইয়া, সৎকারের নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন। যদি অপর কোন কর্ম্মচারীর দ্বারা ঐ কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলেও উহা নিতান্ত অন্যায় কার্য্য হইয়াছে; কারণ তাঁহার আদেশ ব্যতীত ঐ মৃতদেহ ফাঁসি-রজ্জু হইতে অবতরণ করান কাহারও ক্ষমতা নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ ফাঁসি-মঞ্চের উপর যে প্রহরীর সেই সময় পাহারা ছিল, তাহাকে ডাকাইলেন ও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তাহার পাহারাকালীন কোন ব্যক্তি উহার ভিতর প্রবেশ করে নাই, বা মৃতদেহ কেহই বাহির করিয়া লইয়া যায় নাই।
তাহার নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া তিনি, ঐ প্রহরীর পূর্ব্বে যাহার পাহারা ছিল, তাহাকে ডাকাইলেন। সেও ঐরূপ কহিল। তাহার পূর্ব্ববর্ত্তী প্রহরীও সেইরূপ বলিল। ক্রমে জেলের সকল কর্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জেলের মধ্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল, সকলেই ঐ মৃতদেহের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু কেহই ঐ মৃতদেহ বা তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না।
এই অবস্থা হইতেই ক্রমে এই কথা রাষ্ট্র হইয়া পড়িল যে, হানিফ খাঁর মৃত্যুর পর সে ভূতযোনী প্রাপ্ত হইয়াছে ও আপন শরীর লইয়া সেই স্থান হইতে কোথায় প্রস্থান করিয়াছে।
অশিক্ষিত লোকগণ ক্রমে এই কথা বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, আর যাহারা শিক্ষিত বা যাহারা ভূত মানেন না, সেই সকল কর্ম্মচারীগণ, হানিফ খাঁর মৃতদেহের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না।
জেলের প্রধান কর্ম্মচারী এই সংবাদ স্থানীয় পুলিসের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলেন। তিনিও স্বদলে সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া হানিফ খাঁর মৃতদেহ বাহির করিবার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। এইরূপে ক্রমে দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল।