মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ


মণিপুরের

সেনাপতি।


দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ।


সন্ধির প্রস্তাব।

 এই সময়ে মণিপুরিগণের আক্রমণ হইতে রেসিডেন্সি যে নিরাপদে ছিল, তাহাও নহে। দিবা ১০ টার সময় কেল্লা হইতে গুলি সকল রেসিডেন্‌সি-অভিমুখে আসিতে লাগিল। ক্রমান্বয়ে গুলি আসিয়া রেসিডেন্‌সি আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। ওদিকে দিন ১২টার সময় কতকগুলি মণিপুরী নাগা-সৈন্যের সহিত মিলিত হইয়| টিকেন্দ্রের কর্ত্তৃত্বাধীনে রেসিডেন্‌সির অপর পার্শ্ব আক্রমণ করিল। সেই স্থানে যে অল্প পরিমাণ ব্রিটিশ-সৈন্য ছিল, যুদ্ধ করিতে করিতে তাহাদিগের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতে লাগিল। দিবা দুই ঘটিকার সময় টিকেন্দ্রের নেতৃত্বে মণিপুরিগণ ২টা প্রকাণ্ড তোপ আনিয়া রেসিডেনসির সম্মুখে ও রাজবাটীর, তোরণের নিকট স্থাপিত করিল; এবং তাহা হইতে ব্জ্রনাদে গোলা-সকল বহির্গত হইয়া রেসিডেনসির উপর পড়িতে লাগিল। সেই স্থানে যে সকল সামান্য ইংরাজ-সৈন্য ছিল, তাহারা ক্রমে নির্বীর্য্য হইয়া পড়িল। তখন সেনাপতির বাড়ির ভিতর যে সকল সৈন্য ছিল এবং যে সকল সৈন্য ঐ বাড়ী বেষ্টন করিয়াছিল, তাহারাও রেসিডেনসিতে আসিয়া কর্ণেল স্কেনের সৈন্যের সহিত মিলিত হইয়া সম্মুখ-সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। উভয় পক্ষে তখন ঘোরতর সংগ্রাম চলিতে লাগিল। উভয় পক্ষ হইতেই অসংখ্য গুলিবর্ষণ হইতে লাগিল। যতই দিবা অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল, মণিপুরিগণের বিক্রম ততই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; কামানদ্বয় ততই প্রচণ্ড নাদে গোলা উদগীরণ করিতে লাগিল। রেসিডেনসির ঘর-সকল ক্রমে চূর্ণ বিচূর্ণ হইতে লাগিল। সেনাপতি যখন দেখিলেন, সমস্ত ইংরাজ-সৈন্য আসিয়া একত্রিত হইল, তখন তিনি তাহার কেল্লার প্রাচীরের ভিতর হইতে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। এই প্রাচীরে যে সকল ছিদ্র প্রস্তুত ছিল, ঐ ছিদ্র দিয়া অনবরত গুলি আসিয়া ইংরাজ সৈন্যের উপর পড়িতে লাগিল। ইংরাজ-সৈন্য মরিতে লাগিল; কিন্তু মণিপুরিগণ যে কোথা হইতে গুলিবর্ষণ করিতেছে, তাহা কেহই দেখিতে পাইল না। এইরূপে দিবা ৫টা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে উভয়ক্ষে গুলিবর্ষণ হইতে লাগিল। ইংরাজদিগের গুলি-বারুদ ক্রমেই কম পড়িতে লাগিল।

 এই সময়ে চিফ-কমিশনর দেখিলেন, বড়ই বিপদ। একবার ভাবিলেন, সমস্ত সৈন্ত লইয়া রেসিডেন্সি পরিত্যাগপূর্ব্বক একটা ময়দানে গমন করি, ও সেই স্থানে মণিপুরিগণ আসিলে অদৃষ্টে যাহাই থাকুক, একবার সম্মুখ-সংগ্রাম করিয়া মরি। সে পরামর্শ কিন্তু হইল না। তখন, সন্ধ্যা ৭টার সময়, চিফ কমিশনর রাজাকে এক পত্র লিখিলেন; কি লিখিলেন, তাহা তিনিই জানেন। কিন্তু অনেকে বলিয়া থাকেন, এই পত্রের মর্ম সন্ধির প্রস্তাব। সেই সময় ইংরাজগণ সন্ধি-স্থাপনের ‘বিউগিল’ বাজাইলেন; দেখিতে দেখিতে, মণিপুরী সৈন্যগণও গুলিবর্ষণে নিরস্ত হইল। ইহার অর্ধ ঘণ্টা পরে রাজার নিকট সেই পত্রের বাঙ্গালা ভাষায় উত্তর আসিল। তাহাতে অনেক কথা লেখা ছিল। মণিপুরিগণ ইংরাজকে যে কতবার সাহায্য করিয়াছে, তাহাতে ইহারও উল্লেখ ছিল। পরিশেষে মহারাজ লিখিয়াছিলেন,—“যদি অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া দিবা,” তাহা হইলে মণিপুরিগণও নিরস্ত হইবে।

 ইতিমধ্যে একজন মণিপুরী দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে, সেনাপতি চিফ-কমিশনরের সহিত দেখা করিয়া এই সম্বন্ধে কথাবার্ত্তা কহিবার নিমিত্ত রাজবাটীর অর্দ্ধপথে দণ্ডায়মান আছেন। সেই স্থানে যদি চিফ কমিশনর সাহেব বিনা অস্ত্রে গমন করেন, তাহা হইলে কথাবার্তা ও বন্দোবস্ত শেষ হইতে পারে। অনেক ইতস্ততঃ করিয়া ও পলিটিকেল এজেণ্টের পরামর্শমতে, পরিশেষে চিফ-কমিশনর সাহেব সেই স্থানে গমন করিতে সম্মত হইলেন; স্কেন, গ্রিমউড, কলিনস্ ও সিনকে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে বিনা-অস্ত্রে ও বিনা-সৈন্যে গমন করিলেন।

 কেল্লার নিকট সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতের সহিত সাক্ষাৎ হইল। উভয়ের মধ্যে কি কথাবার্তা হইল। পরিশেষে সকলে কেল্লার ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে সেনাপতি ইংরাজ-কর্ম্মচারি, গণকে সমস্ত অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া সেই রাত্রেই মণিপুর হইতে প্রস্থান করিতে কহিলেন। কিন্তু চিফ কমিসনর সাহেব সেই প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলেন না। এ সম্বন্ধে নানারূপ আলোচনা প্রায় দুই ঘণ্টাকাল চলিতে লাগিল। সেই সময় পুনরায় মণিপুরী সৈন্যের কোলাহল উথিত হইল। তাহার ভিতর হইতে কেহ কেহ বলিল,—“আমাদিগের ধর্মশাস্ত্রে আছে যে, মণিপুরে একটী ভয়ানক যুদ্ধ উপস্থিত হইবে, ও সেই যুদ্ধে ৫ জন শত্রুপক্ষীয় কর্মচারীকে দেবী-সম্মুখে বলিদান না দিলে সেই যুদ্ধে মণিপুরিগণ জয়লাভ করিতে সমর্থ হইবে না। এই ব্যবস্থা দেখিয়া সেনাপতি সৈন্যগণকে নিরস্ত হইতে কহিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহার কথা শুনিল না; বরং কহিল,—“আমরা কেবল তোমার নিমিত্তই আমাদিগের প্রাণ অর্পণ করিতেছি, ও তুমিই এ যুদ্ধের মূল। যদি তুমি এখন আমাদিগের ইচ্ছার প্রতিবন্ধক হও, তাহা হইলে জানিও যে, তুমিও আমাদিগের হস্তে হত হইবে।” সৈন্যগণের এই কথা শুনিয়া সেনাপতি, কুইণ্টন প্রভৃতি ইংরাজ কর্ম্ম চারিগণকে সেই সময় বহির্গত হইতে নিষেধ করিলেন। কিন্তু তাহারা তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন।

 *They all went to the road-side and had a talk with the Senapati, and after a few minutes entered into the palace where the Chief did not agree with the terms, viz, to leave Manipur by night, leaving arms behind. Arguments went on for two hours.