গৃহ

মুক্তা, সুধা, অমৃত, মৎস্যজীবী ও নন্দ

স্থান—সমুদ্রতীর; কাল—অপরাহ্ন।

দৃশ্য—মৎস্যজীবীর সমুদ্রতীরস্থ কুটীরের অভ্যন্তর;

মুক্ত দ্বারপথে সূর্য্যোদয়ের অপূর্ব্ব শােভা দেখা যাইতেছে, সমুদ্রের নীল জলে সেই সূর্য্যাস্ত-রঞ্জিত আকাশের ছায়া স্বপ্নপুরীর মত মনােহর দেখাইতেছিল, গৃহের মধ্যে এক পার্শ্বে মলিন শয্যা বিছান রহিয়াছে এবং তাহার অপর প্রান্তে দ্বারের দিকে ফিরিয়া মুক্তা চরকা কাটিতেছিল। হঠাৎ স্বপ্নাবিষ্টের মত উঠিয়া সে একেবার দ্বারের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল এবং উজ্জ্বল আকাশের দিকে চাহিয়া সমুদ্রের বক্ষে দৃষ্টি স্থির করিল।

 মুক্তা। (উৎকর্ণ হইয়া) এখনও—এখনও সে—সে ডাক্ ভুল্‌তে পারিনি, ঐ আবার ডাক্‌ছে। “ফিরে এসাে” বলে দুই বাহু তুলে ডাক্‌ছে। নিশ্বাস ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া আবার চরকার নিকট বসিল। তার পর একটুখানি বিষন্ন হাসি হাসিয়া কাজ করিতে করিতে গাহিতে লাগিল—

সিন্ধুর তলে, রয়েছে অতলে আমার আপন জন,
কেমনে হেথায় রহিব, সেথা যে রয়েছে হৃদয় মন।
নাচে তরঙ্গ তালে তালে
ডাকে আয়, ফিরে আয় ব’লে
সুখস্মৃতিময় গৃহেতে সে যেরে করিছে আকর্ষণ,
ঐ শুনা যায়, গর্জ্জন গানে তাহাদেরি আবাহন।

 সুধা ম্লান মুখে প্রবেশ করিল। মুক্তার নিকটে আসিয়া সে কপালে হাত দিয়া কাঁদো কাঁদো হইয়া কহিল, “মা! আমার বড় মাথা ধরেছে, মা আমায় কোলে নে না, মা।”

 মুক্তা চরকা সরাইয়া রাখিয়া সুধাকে কোলে লইয়া চুম্বন করিয়া কহিল, “রৌদ্রে বুঝি খেলা করছিলে মা আমার, কাছে এস।”

 সুধা। তােমার কোলে মাথা রেখে একটু শুই, তা’হলেই সব ভাল হয়ে যাবে, (নীরবে শুইয়া থাকিয়া কিছুক্ষণ পরে) যদি তুমি একটী গল্প বল মা, তা হ’লে এখনি আমার মাথা ধরা ভাল হয়ে যায়।

 মুক্তা। (হাসিয়া) মাথা ধরার ওষুধ বুঝি এই?

 সুধা। (মার হাত ধরিয়া কাজ বন্ধ করিয়া দিল) সত্যি ভাল হয়ে যাবে মা, সত্যি বল্‌ছি। তুমি ত সেই দুপুর বেলা থেকে সূতো কাটছ—এখন থাক্।

 মুক্তা কাজ বন্ধ করিয়া আবার কন্যাকে চুম্বন করিল। সুধা দুই হাতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল। মুক্তা কহিল, “কিসের গল্প বল্‌বো সুধা?”

 সুধা। জল-কন্যার গল্প বল।

 মুক্তা। (চমকিয়া উঠিয়া) ঐ কথা, ঐ গল্প কতবার বল্‌বো সুধা? না না—

 সুধা (মাতার কণ্ঠলগ্ন হইয়া) অন্য কোন গল্প তাে বল না, ওটিই যে জান, বড়ই কিন্তু দুঃখের গল্প, শুন্‌তে গেলে কান্না পায়। আচ্ছা মা! ওর শেষকালটাতে সুখ হবে?

 মুক্তা। (স্বপ্নবিষ্টের মত) শেষ, শেষতো নেই—

 সুধা। (হাসিয়া) কখনও তো শেষ হবে! আচ্ছা এখন তুমি আরম্ভ কর।

 মুক্তা। জলের নীচে জল-কন্যাদের দেশ আছে। এক সময়ে সেই জল-রাজ্যে একটি মেয়ে— খুব সুখী, খুব চঞ্চল একটা মেয়ে, তার সঙ্গীদের সঙ্গে তার নিজের প্রবাল নির্ম্মিত গৃহ হ’তে বাহির হয়ে এসেছিল। এই সমুদ্রের জলেরউপর খেলা করতে তার এত ভাল লেগেছিল যে, সে নিত্যই নির্জ্জন সমুদ্রকূলে, পর্ব্বতের উপরে ও ঢেউয়ের মুখে খেলা করবার জন্য ভেসে উঠতে লাগলাে।”

 সুধা। (বাধা দিয়া) মেয়েটি কার মত মা? তােমার মত সুন্দর? ওমনি সমুদ্র-জলের মত চোখ? মেঘের মত চুল, আর বিদ্যুতের মত রং? তারপর—

 মুক্তা। (স্বপ্নাবিষ্টের মত) হ্যাঁ তারপর—তারপর এমনি ক’রে কতদিন কেটে গেল। কি সুখের দিন সে সব! হাতে বীণ, গলায় অম্লান ফুলের শতনর মালা, ঢেউয়ের উপর ঢেউয়ের তালে পা ফেলে হাত ধরাধরি করে ভাই বােনের আনন্দ-নৃত্য; কখনও বা জ্যোৎস্নারাত্রে তরঙ্গ-দোলায় শুয়ে দোল খাওয়া; ওঃ কি সে সুখের প্রস্রবণ—(চিন্তা)

 সুধা। তারপর?

 মুক্তা। তারপর সহসা একদিন সেই হতভাগিনী জলকন্যার অদৃষ্ট ভাঙ্গিল। সমুদ্রতীরে এক পর্ব্বতের উপরে আনন্দনৃত্যের অবসরে তার গায়ের প্রবালের ওড়না কেমন ক’রে যে খ’সে প’ড়েছিল, তা আর সে কোথাও খুঁজে পেলে না। সমস্ত রাত সকলে মিলে পাতি পাতি খুঁজেছিল, কিন্তু কোন খোঁজই পাওয়া গেল না। তখন সকলে মিলে তাকে ঘিরে শােক করতে লাগল, কেননা সেই প্রবালের ওড়নার সঙ্গে তার জলের নীচে যাবার শক্তিও ফুরিয়ে গেছে।

 সুধা। (সাগ্রহে মার মুখের দিকে চাহিল) তার পর, সেই জলকন্যার কি হােল?

 মুক্তা। (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) সূর্য্যোদয় হ’তেই সমস্ত জলবাসী সঙ্গীরা সমুদ্রে ডুবে গেল। কেবল সেই অভাগিনী জলকন্যা জলের ধারে বসে ডুবে মরবার কথা ভাবছে, এমন সময়— (নীরব।

 সুধা। (অসহিষ্ণু ভাবে মাকে ঠেলিয়া) এমন সময় কি মা?

 মুক্তা। (সচকিতে) এমন সময় একজন ধীবর এসে তাকে আশ্রয় দিলেন, তিনি খুব দয়ালু, তাই তাকে তাঁর স্ত্রী করলেন।

 সুধা (সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল) সে ধীবরও বুজি বাবার মত? আর সেই জলকন্যার একটি মেয়ে ছিল, না? আর একটী ছেলে?

 মুক্তা। (মস্তক আন্দোলন করিয়া) ছিল, ছিল বই কি, না হ’লে সে কি করে বাঁচল!

 সুধা। (হাসিয়া মার দিকে দুই হাত বাড়াইল) তা হলে সে খুব সুখী হয়েছিল তো?

 মুক্তা। (সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকিয়া উঠিয়া অধীর ভাবে দ্বারের নিকট গিয়া আকুল নেত্রে সমুদ্রের দিকে চাহিয়া দেখিতে দেখতে চঞ্চল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল) তােমরা বুঝতে পারবে না, সুধা, কিছুতেই তার মনের ভাব তােমরা বুঝতে পারবে না, এখনও সে তার সেই ওড়না খুঁজে বেড়াচ্ছে, এখনও নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য প্রতি মুহূর্ত্তে তার বুক ফেটে কামনা ছুটে বেরুতে চাচ্চে, সেকি তার সে সুখের জীবন ভূলতে পেরেছে, না যারা তার সত্যকার আপন, তারাই তাকে বিস্মৃত হয়েছে?

 সুধা। (উৎসুক ভাবে) কিন্তু সে যদি ফিরে যায়, তার ছেলেরা যে কাঁদবে।

 মুক্তা। (কর্ণে অঙ্গুলী দিয়া) চুপ কর্ রাক্ষসি! চুপ কর্। (সুধার ক্রন্দনোদ্যম; মুক্তা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকিয়া কন্যার নিকটে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ও তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া) সুধা, মা আমার, মাণিক আমার! থাম্।

 সুধা। (মাতাকে জড়াইয়া) ভাগ্যে গল্পটা সত্যি নয় মা, আমার এমনি ভয় হচ্ছিল!

 বস্ত্রের মধ্যে কোন বস্তু গোপন করিয়া লইয়া হাসিতে হাসিতে অমৃত প্রবেশ করিল।

 মুক্তা। (স্বপ্নাভিভূতভাবে) আজ পূর্ণিমার রাত্রি, আজ তারা জ্যোৎস্নাতরঙ্গের উপরে গান কর্‌তে আসবে। কি হাসি, কি আনন্দ, কত উৎসাহ—উঃ।

 অমৃত। মা তােমার জন্যে কি এনেছি দেখ। বল্ দেখি কি? সুধা! তুই কখনও বলতে পারবিনি; এরকম জিনিষ তুই কখনাে দেখিস্ নি।

 সুধা—কড়ি, ঝিনুক, ইত্যাদি দু-চারিটা পরিচিত বস্তুর নাম করিল, কিন্তু অমৃত লুকান বস্তু বাহির করিল না। কেবল হাসিতে লাগিল।

 সুধা। (মুখ ভার করিয়া) ভারি জিনিষ! দেখতে চাই না, যাও।

 অমৃত। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একটা গর্ত্তে এইটা ছিল, আমি দেখতে পেয়ে এনেছি, মা! তুমি এই নাও, সুন্দর একখানি ওড়না, প্রবালের ওড়না!

 মুক্তা। (চমকিয়া উঠিয়া সাগ্রহে) আঁ প্রবালের ওড়না! দাও আমায় দাও (হস্ত প্রসারণ)।

 সুধা ছুটিয়া গিয়া অমৃতের প্রসারিত হাত ধরিতে গেল ও বলিয়া উঠিল, “দাদা, দাদা! দিওনা, ছিঁড়ে ফেল, এখনই গল্প সত্যি হয়ে যাবে।”

 অমৃত। (হাত সরাইয়া লইয়া মাতার হস্তে ওড়না প্রদান করিয়া) মেয়েগুলাে এমনি হিংসুকে হয়। আমাদের রাণীর মত মাকে কত সুন্দর দেখাবে তা ভাবলে না, বল্‌লে ছিঁড়ে ফেল।

 ওড়না লইয়া মুক্তা আহ্লাদে অঙ্গে পরিয়া বলিয়া ফেলিল, “এই আমার ওড়না, আমার হারান ধন।”

 অমৃত। (সবিস্ময়ে) তােমার!

 মুক্তা। (তাহার বাক্যে কাণ না দিয়া) আবার এখন আমি আমার নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারব, ঐ সমুদ্রে; ওঃ! ঐ সমুদ্রের অতল জলে ফিরে যাব।

 সুধা। (কাঁদিয়া উঠিয়া) মা, মা!

 মুক্তা। (বাহিরের দিকে চাহিয়া) ঐ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ওঃ কি আনন্দ! কি স্বাধীনতা! তারা এখনও আমার জন্যে প্রতীক্ষা করছে। ঐ যে তারা ডাক্‌ছে মুক্তা, মুক্তা (উচ্চ কণ্ঠে) যাই (গমনােদ্যত)।

 সুধা ছুটিয়া আসিয়া তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিল, আকুল কণ্ঠে ডাকিল, “মা মা, যেও না মা।”

 মুক্তা। (তাহাকে হাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া তাহার দিকে ফিরিয়া না চাহিয়া) স্বপ্ন পুর্ণ হয়েছে, যেতে হবে, ওঃ যেতেই হবে। আমার ঘরে, আমার দেশে ফিরে যাব, আমায় তাতে বাধা দিবি—কে তােরা? (সবেগে গৃহ হইতে বাহির হইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল)।

 অমৃত। ব্যাপার কি সুধা! মা ওরকম সব কথা ব’লে কোথা গেল বল্ দেখি, কি হ’ল কিছুই বুঝতে পারলেম না!

 সুধা। (কাঁদিয়া) মা চ’লে গেছে, জন্মের মত চলে গেছে, দাদা কেন তুমি ওড়না এনে দিলে?

 অমৃত কিছু বুঝিতে পারিল না দেখিয়া সে তাহাকে বুঝাইয়া দিল যে, মা সেই গল্পের জলকন্যা। এই কুটীরে সে ঘৃণার চক্ষেই বাস করছিল, আজ সে আমাদের ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছে, আর আসবে না।

 অমৃত। (তীব্র স্বরে) ঈস্ চ’লে যাবেন, গেলেই অমনি হ’ল; বাবা যেতে দেবেন কেন? হ’লই বা ক্ষুদ্রকুটীর, এই ক্ষুদ্র কুটীরইতো তাঁর বাড়ী। বাবা তাঁকে ধ’রে আনবেন।

 সুধা। (আর্ত্তস্বরে) না দাদা! তার এ বাড়ী নয়, বিশাল সমুদ্রের নীচে তার প্রবালের ঘর আছে। হীরার প্রদীপে সেখানে আলো জ্বলে, মুক্তার ঝালরে চাঁদোয়া খাটায়, সােনার পালঙ্কে সে শুয়ে থাকে, সে আর আস্‌বে না।

 অমৃত ডাকিল—বাবা, ও বাবা।

 (এমন সময় ভিজা জাল কাঁধে লইয়া ধীবর নন্দ ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল)

  নন্দ। মুক্তা! একটা কাঠের গুঁড়ি সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছিল, ধ’রে রেখেছি। কুড়ুল খানা নিয়ে চল তো কেটে আনিগে। (মুক্তাকে না দেখিতে পাইয়া) তােমাদের মা কোথা গেছে?

 সুধা। (কাঁদিতে কাঁদিতে) ফিরে গেছে।

 নন্দ সবিস্ময়ে উভয়ের মুখের দিকে চাহিল।

 অমৃত। আমি কাঁকড়া ধরতে গিয়ে পাহাড়ের গর্ত্ত থেকে একখানা প্রবালের ওড়না পেয়েছিলেম, সেইটে—

 নন্দ। এতদিন পরে! হা নির্ব্বোধ! সেটা কি হ’ল?

 অমৃত। মাকে দিয়েছি। মা সেইটা প’রে—

 নন্দ। জাল ফেলিয়া ছুটিয়া বাহিরে গেল, আবার ফিরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কতক্ষণ?”

 অমৃত। এখনি সমুদ্রের দিকে গিয়েছেন।

 নন্দ মুক্তা মুক্তা করিয়া উন্মাদের ন্যায় সমুদ্রকূলে ছুটিল।

 সুধা। দেরী হয়ে গেছে। সে এতক্ষণ সমুদ্রের নীচে চলে গেছে। আর সে ফিরে আসবে না।

 নন্দ। (পুনঃ প্রবেশ করিয়া) কোথাও নাই, সে চ’লে গেছে। সে ফাঁকি দিয়ে চ’লে গেছে। (দুই হাতে বুক চাপিয়া শয্যার উপর পড়িল) আমি একলা এতদিন ফাঁকি দিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র কুটীরে চুরি করে এনে রেখেছিলাম, আজ সে তার শােধ নিলে, আমার—আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে চ’লে গেল।

 সুধা। (পিতার পিঠের উপর পড়িয়া) বাবা বাবা!

 নন্দ। কত জন্মের তপস্যার ফলে সে দিন পাহাড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি স্বপ্নকন্যার মত সুন্দরী সব জলকন্যার জলক্রীড়া ছেড়ে জ্যোৎস্নালোকে নৃত্য করছে। সে দিনও এমনি পূর্ণিমার রাত; এমনি ঝকঝকে চাদ দিনের মত আলো ক’রে রেখেছিল। সমুদ্রই আকাশের মত স্থির হয়ে প’ড়ে তাদেরই সেই স্বর্গের গান শুনছিল। আমার মাথা ঘুরে গেল, পা টিপে টিপে পেছন থেকে গিয়ে তার ওড়নাখানা টেনে নিলেম। সে এমনি আনন্দে মত্ত, জান্‌তেও পার্‌লে না। তারপর (তীব্র আনন্দের সহিত উঠিয়া বসিয়া) কি সুখ! কি গৌরব! সে স্বর্গের দেবী ধীবরের কুটীরে অধিষ্ঠিতা হ’ল। সে আমার, (পুত্ত্র কন্যার দিকে চাহিয়া) আমাদের হয়ে গেল। সমুদ্র কি এত বড় যে, সে সেই জ্বলন্ত স্মৃতিকে ডুবিয়ে দিতে পারবে? না, সে যে আমাদের, সমুদ্রের তাকে চুরি কর্ব্বার তো আর কোনই অধিকার নেই।

 সুধা। (চোখ মুছিতে মুছিতে) সে নিজে যে আমাদের ছেড়ে গেছে।

 নন্দ। (শুষ্কস্বরে) সে যখন যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে প’ড়ে কাতর কণ্ঠে কাঁদত, আমি আমার কাণ দুটা রুদ্ধ ক’রে রাখতেম। সে যখন তার ঘরে ফিরে যাবার কথা বলত, আমি ভাবতেম কতদিনে আমার এই কুটীরে তার প্রতিষ্ঠা করতে পার্ব্বো। তারপর ক্রমে ক্রমে সে এই কুটীরকেই তার ঘর ক’রে নিয়েছিল।

 সুধা। (বাধা দিয়া) না বাবা, সমুদ্রের জন্যই সে তার ঘর নিতে পারেনি, সমুদ্র তাকে সর্ব্বদা আয় আয় বলে ডাকত, দুষ্ট সমুদ্র!

 নন্দ। সে তার মনের কল্পনা, কিন্তু কি তার হৃদয়। সে এত কঠোর! যতটুকু তাকে আমরা জোর ক’রে ধ’রে রেখেছিলেম, ঠিক ততটুকু রইল, তার চেয়ে আর একটুতাে বেশী নয়; (সুধা ও অমৃত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল) সে আমাদের জন্য কত ক’রেছে, আমাদের স্নেহ, যতন, ভালবাসা দেখিয়েছে। কিন্তু মনে মনে সমস্ত দিনই কেবল ভেবেছে কতক্ষণে আমাদের ত্যাগ ক’রে চ’লে যাবে।

 সুধা। আবার হয়তাে—

 নন্দ। (সাগ্রহে) হয়তো কি?

 সুধা। ফিরে আস্‌তে পারে—

 নন্দ। (কম্পিত পদে উঠিয়া দাঁড়াইল) না, পাষাণী সে, সেতো এ পৃথিবীর নয়। মায়া, দয়া, প্রেম, স্নেহ-এ শুধু যে এই পৃথিবীর মাতৃবক্ষের দান, এর ওপােরে নেই, নীচেও না। কিসের বন্ধনে সে ফিরে আসবে সুধা? সে আর আসবে না, রাত্রি হয়ে পড়েছে, শুতে যাও। দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিও।

 সুধা। (কাতর হইয়া) মা, যে বাহিরে আছে। যদি দোর বন্ধ দেখে ফিরে যায়, খুলে দাও। (নন্দ শিথিল হস্তে দ্বার উদ্ঘাটন করিল) সুধা দ্বারের নিকটে গিয়া উচ্চ কণ্ঠে ডাকিল, “মা, মা, মা গাে!”

 অমৃত তাহার অনুসরণ করিল, “ফিরে এস, ফিরে এস মা, ওমা! আমাদের কাছে ফিরে এস। কই কেউ নেই।”

 নন্দ। (চোখে করাবরণ করিয়া) তােরা কি আমায় স্থির হ’তে দিবিনে? কাকে ডাক্‌ছিস্? সে তোদের মা নয়! যা শুতে যা, সে তােদের ভালবাসত? মিথ্যে কথা, কখনও ভালবাসত না, ভাল ভাল করেছিল। ভালবাসলে কি সে এমন ক’রে তোদের ফেলে চ’লে যেতে পারত? না।

 সুধা ও অমৃত ফোঁপাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বিছানায় গিয়া শুইল। নন্দ বাহিরে চলিয়া গেল। দোর খোলাই রহিল।

 সুধা। (স্বপ্নে) কেমন ক’রে তোমায় ছেড়ে থাকব মা! আমায় ব’লে গেলিনে, আদর করলিনে, চ’লে গেলি।

 সমুদ্রে চাঁদের আলো পড়িয়া উজ্জ্বল রূপার পাতের মত দেখাইতেছিল। জলের মধ্য হইতে মুক্তা উত্থিত হইল। প্রবালের ওড়না তাহার কাঁধের উপরে একখানি সূক্ষ্ম স্বর্ণ জালের মত পড়িয়াছিল, কপালের চুলে উপর হইতে মুক্তার লহর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। বর্ষার জলধৌত লতার মত সৌন্দর্য্য যেন আরও বাড়িয়া উঠিয়াছিল। কুটীরের অভিমুখে যাইতে যাইতে মুক্তা মৃদু স্বরে বলিতে লাগিল, “আমার পা যেন ভারি হয়ে উঠেছে, গলার সুর আর গান গাইবার উপযুক্ত নেই, এ আমার কি হ’ল! একি? তাদের সঙ্গ ছেড়ে এ কোথায় আবার চ’লে এলেম! (চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে) এখানে! কে আমায় এখানে টেনে আনলে! (দ্বারের নিকটে গিয়া) আমার ছেলেরা? (আবদ্ধভাবে গৃহে প্রবেশ করিল ও অনিচ্ছুকপদে অগ্রসর হইয়া শয্যার নিকটে দাঁড়াইল) সুধা নিদ্রার মধ্যেও কাঁপিয়া উঠিয়া ডাকিল, “মা, ওমা ফিরে আয় মা, ফিরে আয়!”

 মুক্তা। (মুহূর্ত্তে নত হইয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া) “আয় আমার সঙ্গে চল্ তবে।”

 সুধা। ঘুমাইয়া স্বপ্ন জড়িত ভাবে কহিল, “না তুমি এস, উঃ বড় শীত, দোর বন্ধ করে আমার কাছে শোও তুমি।”

 মুক্তা। মন্ত্রমুগ্ধ ভাবে দ্বার রুদ্ধ করিতে গিয়া হঠাৎ সচেতন হইয়া উঠিল।

 মুক্তা। না না, আমি ফিরে যাব।

 নন্দ। ধীরপদে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, ডাকিল, “মুক্তা!” মুক্তা সহসা চমকিয়া সরিয়া গেল। ওড়নাখানি সে দুই হাতে চাপিয়া ধরিল।

 নন্দ (প্রশান্তভাবে) ভয় নেই, তোমায় পারলেও আজ আর ধ’রে রাখব না।

 মুক্তা। (বিস্মিত হইয়া তাহার মুখে তাহার দুই চোখ স্থির করিল) ধ’রে রাখবে না।

 নন্দ। না, যদি তুমি আমাদের ছেড়ে গিয়েই সুখী হও, যাও, কেন বাধা দেব?

 মুক্তা। (স্বপ্নবিষ্টভাবে) ওই উত্তাল তরঙ্গমালার উন্মাদ তাণ্ডব শুধু তোমরা দেখতে পাও, গান নাচ ওর নীচে, ওর নীচে কি সুন্দর, কি সুখের রাজ্য আছে। সেখানে আমার গৃহ, তুমি তাদের গান শোননি ত! কি আশ্চর্য্য সে গান, তার সুরে জগতের সমুদয় ফুল ফুটে ওঠে, পাখী গায়, শিশু হাসে!

 নন্দ। না, আমি তোমার গান শুনেছি। কিন্তু গানের চেয়ে কি মানুষ সত্য নয়? তাই তুমি আসবার পর থেকে—(নন্দ চুপ করিল)

 মুক্তা। (উৎসুকে) পর থেকে—

 নন্দ। তোমার অধিষ্ঠানই আমার সঙ্গীত হয়ে গিয়েছিল (তাহার হাত ধরিল)

 মুক্তা। আমার কণ্ঠ তার চিরাভ্যস্ত গান ভুলে গেছে। কিন্তু হয়ত দুদিন পরে আবার মনে পড়বে। তখন আর সব ভুলে যাব।

 (তাহার মুখের দিকে শিহরিয়া চাহিয়া) পার্‌বে মুক্তা?”

 মুক্তা মুখ ফিরাইয়া লইল, তারপর ব্যগ্রস্বরে বলিয়া উঠিল,—“ঐ শােন, মুক্তা! মুক্তা! ঐ তারা আমায় ডাক্‌ছে! আমি যাই।”

 নন্দ। (তীব্রভাবে ফিরিয়া) কেন তুমি ফিরে এলে?

 মুক্তা। (চঞ্চল হইয়া উঠিয়া) কেন ফিরে এলেম? আমি আসতে চাইনি, কে আমায় টেনে আন্‌লে? আমার ছেলেরা——

 নন্দ। (হতাশার্ত্ত কণ্ঠে বাধা দিয়া) ছেলেরা! তােমার ছেলেরা! এই আমার উপযুক্ত! এই শেষ হ’ক, তবে যাও।

 মুক্তা। যাই! আমায় দোষ দিও না; ভেবে দেখ দেখি তখনকার কথা, যখন তুমি আমায় ছলনা ক’রে আমার দুঃখে সহানুভূতি দেখিয়েছিলে। ছলনা ক’রে ওড়না খোঁজার ভান ক’রে আমায় বিশ্বাস করিয়েছিলে।

 নন্দ। (সচকিতে) আমি তােমার ওড়না লুকিয়ে রেখেছি, এ সন্দেহ তােমার মনে কখনও উঠেছিল?

 মুক্তা। (ধীরকণ্ঠে) কখনও না। তুমি নিজের সম্মান নষ্ট ক’রে এমন গর্হিত কাজ কর্‌বে এ সন্দেহ আমি মনে স্থানও দিইনি।

 নন্দ। (নিম্নম্বরে) আমার সম্মানের উপরেও তোমার স্থান।

 মুক্তা। আমার আত্মীয়েরা যদি জানতে পারে তুমি আমার ওড়না লুকিয়ে রেখেছিলে, তাহলে তারা তোমায় হত্যা কর্‌বে।

 নন্দ। (গম্ভীর স্বরে) তোমায় ছেড়ে আমার জীবন যে ঈপ্সিত নয় মুক্তা!

 মুক্তা। (একটু সরিয়া গিয়া) আমার ঘরে আমি যেতে চাই; আপনার লোকেদের কাছে কে না যেতে চায়? আমায় জোর ক’রে ধ’রে রেখেছিলে, মন আমার সেইখানে পড়েছিল; আবার এ কি। হাত ছাড়, যেতে দাও।

 নন্দ। (তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া) যাও।

 মুক্তা বাহিরে গেল, গৃহের পানে চাহিয়া মূক্তকণ্ঠে বলিতে গেল, “আমি জন্মের মত তোমাদের ছেড়ে চল্লেম।” কিন্তু, মুখ দিয়া কান কথা বাহির হইল না। তারপর এক মুহূর্ত্ত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া সহসা সে ফিরিল। তার পর উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমি যেতে পারছিনে, না না, কিছুতেই যে যেতে পারছিনে, আমার স্থান সেখানে খালি নেই, কিন্তু এখানে শূন্য হয়ে যাবে। তারা আমায় ভূলে গেছে। এরা আবার তেমনি ক’রেই ডাক্‌ছে। তারা সবাই, সেই রকমি আছে, কিন্তু আমিত কই সে রকম নেই।”

 নন্দ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, কম্পিত কণ্ঠে কহিল, “গেলে না মুক্তা! যাও যদি—আর দেরী করে কাজ নাই। আমি মনকে বেঁধে রেখেছি। অকস্মাৎ আমার সুখস্বপ্ন ভঙ্গ না করে এই জাগ্রতের মধ্যে বিদায় দাও! সে আঘাত বড় কঠিন, বড় নিষ্ঠুর হবে!”

 মুক্তা। (নিকটে আসিয়া) না যাব না, কোথা যাব? এই যে আমার ঘর—আমি যাব না।

 নন্দ। (সন্দিগ্ধ ভাবে) সে আমি সহ্য কর্ত্তে পার্‌ব না; উঃ কিছুতে না, গুপ্তহত্যা হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করা ভাল। যাবে যদি এখনি তবে যাও।

 মুক্তা। (ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইতে হইতে) বিশ্বাস করছনা, তবে এই নাও প্রবালের ওড়না। স্বেচ্ছায় তোমায় আমি আমার যাবার শক্তি আজ জন্মের মত দান করলেম! এতক্ষণে আমি বুঝতে পারছি কিসের আকর্ষণে আমায় এখানে টেনে এনেছে! শুধু সন্তানের স্নেহ নয়, তা যদি হ’ত তা হ’লে সেখানে আমার মা আছেন, সে আকর্ষণ কিসে রুদ্ধ হ’ত?

 নন্দ সহসা দুই হাতে তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া কহিল, “কি সে মুক্তা? সে কি তবে?”

 মুক্তা জ্যোৎস্নাজালের মধ্যে তাহার প্রবাল ওড়না খানিকে দলিত ও নিক্ষেপ করিয়া স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হইয়া বলিল, “তুমি, তুমিই টেনে এনেছ, তোমার প্রেমই আমায় এখানে এনেছিল, আজ আবার সেইই আমায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, এত দিন ভেবেছি এ তোমার ঘর, আজ আর এ তোমার ঘর নয়, আমাদের।

সমাপ্ত