মনোরম্য ইতিহাস



মনোরম্য ইতিহাস।


শ্রীযুত বাবু রাধানাথ শীকদার মহাশয়ের

অনুমত্যানুসারে

শ্রীযুত অভয়চরণ দাস বিরচিত।


কলিকাতা নিউপ্রেসের পণ্ডিত মহাশয়
কর্ত্তৃক পরিশোধিত।


কলিকাতা

বাহির সিমুলিয়ার সুকেস ষ্ট্রীটের ৯ সংখ্যক ভবনে
কলিকাতা নিউপ্রেসে মুদ্রিত
সন ১২৬০। ইং ১৮৫৩


এই পুস্তক গ্রহণেচ্ছুগণ কলিকাতা পার্ক ষ্ট্রীটে ৩৫ নং বাটীতে
বা ইটালি কামারডানগার শ্রীযুত অভয়চরণদাসের ভবনে পাইবেন।



 অখণ্ড ব্রাহ্মাণ্ড খণ্ডে যিনি প্রতি দণ্ডে দণ্ডে সৃজন পালন লয় আপন ইচ্ছাতে অনায়সে করিতেছেন। এবং হস্ত, পদ, চক্ষু কর্ণাদি ইন্দিয় এবং মন, বুদ্ধি জ্ঞানাদি সকল আমাদিগকে প্রদান করিয়াছেন। এতাদৃশ যে জগদীশ্বর তাঁহাকে প্রণামান্তর ব্যাস, বসিষ্ট, বাল্মীকি, ভরদ্বাজ, মনু, জৈমিনি, আদি প্রাচীন গ্রন্থ কর্ত্তাদিগকে প্রণাম করিয়া ইদানীং শ্রেষ্ট বিশিষ্ট উৎকৃষ্ট গুণালঙ্কৃত বর্ত্তমান্‌ বিজ্ঞ মহাশয়দিগের প্রতি প্রণতিপূর্ব্বক নিবেদন এই, যে মৎ কর্ত্তৃক এই, মনোরম্য ইতিহাস নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থ বিরচিত হইল। মহাশয়েরা তাচ্ছল্য না করিয়া কৃপাবলোকন পূর্ব্বক বাধিত করবেন।

শ্রীঅভয়চরণ দাস।




মনোরম্য ইতিহাস।

অর্থাৎ

অহি মূষিকের বন্ধুত্ব।


 কোন সময়ে এক সৰ্প আপন আহার অনুসন্ধান করত দৃষ্টি করিল যে এক হৃষ্টপুষ্ট মূষিক শাবক স্বীয় পৈতৃক খাদহইতে বহির্গত হইয়া ভোজন দ্রব্য প্রাপ্তির ইচ্ছায় নিকটস্থিত কোন এক বাটীতে প্রবেশ করিতেছে। ভুজঙ্গম স্বভাবতঃ ক্ষুধার্ত্ত হইয় আপন আহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিল, মূষাকে দর্শন মাত্রেই অতি আনন্দপূর্ব্বক তাহাকে ভক্ষণ করণেচ্ছায় ধৃত করণার্থে তৎপশ্চাৎ ধাবমান হইল। মূষা স্বীয় নাশক দর্শনে এবং তৎভয়ঙ্কর গর্জ্জন শ্রবণে অত্যন্ত বিপত্তি উপস্থিত জানিয়া আপন প্রাণ রক্ষার্থে অতি বেগগামী হইয়া পলায়ন করত ঐ বাটীর একটি কুঠরী মধ্যে প্রবেশ করিয়া স্বীয় প্রাণের নির্ব্বিঘ্নতা জন্মাওনের নিমিত্তে অতি তৎপর হইয়া নিরীক্ষণ করিল, যে ঐ কুঠরীতে একটি পেটরা অনাচ্ছাদিত হইয়া পতিত আছে। তাহাতে ইন্দুর এমত আহ্লাদিত হইল, যেমত্যা মৃত্যুকালোপস্থিত রোগী বৈদ্য দর্শনে সন্তুষ্ট হয় কিন্তু ঐ বৈদ্য জ্ঞানবান্‌ বা অজ্ঞান হউক তাহার কিছুই অনুসন্ধান নাই। যেহেতুক ইতস্ততঃ দৃষ্ট হইতেছে, এতদ্দেশীয় যে সকল লোক সুশিক্ষিত নহেন, তাঁহারা প্রায় কবিরাজ নাম শ্রবণ মাত্রেই বৈদ্য বলিয়া মান্য করেন, কিন্তু (মূর্খ বৈদ্য যমের দোসর) তাহা সকলে জানেন না।

 পরন্তু ইন্দুর অতি আনন্দিত মনে খরতর গমনে ঐ খোলা পেটরা মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তন্মধ্যস্থ দ্রব্যাদির সহিত লুক্কাইত হইল। কিন্তু বিধাতা কর্ত্তৃক সর্পের নাসিকাতে এমন এক ঘ্রাণ শক্তি প্রদত্ত হইয়াছে, যে তদ্দ্বারা সর্প অবিলম্বে জানিতে পারিল, যে তাহার আহার যোগ্য মূষিক ঐ পেটরাতে প্রবিষ্ট হইয়াছে। তৎপরে সর্প আপন দর্পত্যাগ করিয়া এবং গুরুতর গর্জ্জন বর্জ্জন পূর্ব্বক অতি ধীরগমনে সঙ্কোচ বদনে পেটরা মধ্যে লঘুশ্রমে ক্রমে ক্রমে প্রবেশ করিল। ইত্যবসরে গৃহের গৃহিণী আপন রন্ধনশালাহইতে কোনকার্য্য অনুসারে ঐ কুঠরীতে প্রবেশ করিয়া দেখিল, যে পেটরাটির ঢাকনী খোলা রহিয়াছে। এতদ্দর্শনে গৃহিণী মহা রাগান্ধ হইয়া আপন সন্তানদিগের প্রতি অতি কটু কাটব্যে কহিতে লাগিল। হায় হায়! এই হাবাতে ছেলে গুলা যেন আমার এই পেটরাতে কি দেখিয়াছে। এই পেটরাটি আমার দ্বিরাগমনের সময়ে আমার বাপ আপনি বাজার থাকিয়া কিনিয়া দিয়া গিয়াছিলেন। তিনিতো কোন্‌ কালে মরিয়া গিয়াছেন, আমি পেটরাটিকে যত্ন করিয়া রাখিয়াছি তাই আছে, এবং তাঁর নাম আছে। কর্ত্তার ঘর বাড়ী ও অন্য অন্য বহু মুল্য বস্তুতে যেমন যত্ন, আমার ঐ পেটরাটিতে তেমনি যত্ন, (রাজার রাজ্যপাঠ নেড়ার ঝুলি কাঁথা) এ ছেলে গুলা কিছুই বুঝে না। ইহা কহিয়া গৃহিণী অতি দ্রুতগতিতে ঐ পেটরাটিতে ঢাকনী দিয়া তাহাতে তালা চাৰি বদ্ধ করিয়া আপন রন্ধনশালায় পুনরাগমন করিল। এখানে মূষিক এবং সর্প কারাবদ্ধ হইয়া পরস্পর উভয়েতে ঘোরতর সঙ্কটহইতে মুক্ত হইবার সদুপায় অনুমান করিতে লাগিল। সৰ্প মনে মনে স্থির করিল, যে (বিপদ কালে ধৈর্য্য ও সম্পদকালে মাধুর্য্য অবলম্বন করা জ্ঞানবানের অতি কর্ত্তব্য) অতএব এই উপস্থিত বিপত্তিতে আমার কি কর্ত্তব্য? যদি এই ইন্দুরটিকে এক্ষণে ভক্ষণ করি তবে আমার বর্ত্তমান ক্ষুধা নিবারণ হইবার সম্ভাবনা বটে, কিন্তু এই পেটরাহইতে নির্গত হইবার কোন উপায় দেখি না। অতএৰ এই ক্ষুদ্র জীবের দ্বার কারাবদ্ধ হইতে আমার মুক্ত হইবার চেষ্টা করা অতি কর্ত্তব্য। ইহা বিচারসিদ্ধ করিয়া কহিতেছে, সখে সখে ওহে সখে তোমার কেমন বিবেচনা, তোমাকে অনুসন্ধান করিয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করত আমার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত হইয়াছে। এবং দেখ যেমন (খোঁড়ার পা খালে বই আর পড়ে না) তেমনি আমার হইয়াছে। একে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্তে পথশ্রম, আবার দুঃখের উপরে এক্ষণে তেমনি দুঃখ, একেবারে পেটরার মধ্যে বদ্ধ হইয়াছি। (দেখ তাবৎ পথ দৌড়াদৌড়ী, খেয়া ঘাটে গড়াগড়ী) সে যাহা হউক এক্ষণে তুমি কেমন আছ, মৌন হইয়া কেন রহিলে? ওহে (কথাটি কহিলে ব্যথাটিতো যায়) তুমি প্রসন্ন হইয়া আমার সহিত আলাপ কর। সর্পের সখ্যরস পূরিত প্রিয় বাক্য এবং সদালাপ মূষিকের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইব মাত্র সে বিবেচনা করিতেছে, যে হায়, যাহার ভয়ে পলায়ন করিয়া এই সংগোপন স্থানে লুক্কায়িত হইয়াছি, বিধাতার কি আশ্চর্য্য ঘটনা তাহাকেই নিকটস্থ করিয়া একেবারে আমার সহিত প্রগাঢ়ৰূপে বদ্ধ করিয়াছেন। সে যাহা হউক ইনি যে বড়ই শ্রেষ্ঠের ন্যায় মিষ্টলৈাপ আরম্ভ করিয়াছেন, আমিও তদনুৰূপ প্রত্যুত্তর করিব। পশ্চাৎ যাহা হউক তাহাই হইবেক, কেননা (জন্ম মৃত্যু এবং বিবাহ ইহা বিধাতার লিপি) এবং এক্ষণে আমি যদি সর্পের সহিত সাহসীক হইয়া বাক্যালাপ করি, ও ইহার কথানুযায়ি বন্ধুত্ব করিতে পারি, তবে তাহাও এক অতি আশ্চর্য্য সুদৃশ্য হইবেক। কেননা (খাদ্য খাদকের এবং নাশ্য নাশকের প্রণয় অতি আশ্চর্য্য) ইহা বিবেচনা করিয়া মূষিক সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতেছে, হে ফণিরাজ, কিজন্য তুমি আমাকে এমত সমাদর করিতেছ? সর্প কহিতেছে, আমি অগ্রে আমার মনোভীষ্ট সকলি প্রকাশ করিয়াছি, অতএব বারম্বার কি কহিব, আমি তোমার সহিত বন্ধুত্ব করিতে বাঞ্ছা করিয়াছি। ইহা শ্রবণান্তর মূষিক কহিলেক, যে আজ্ঞা, আমিও তাহাতে প্রস্তুত আছি। ইহা কহিয়া পরস্পর সম্মত হইয়া উভয়েতে কোলাকুলি করত ধর্ম্ম সাক্ষি করিয়া বন্ধুত্ব করিল। তৎপরে উভয়েতে পরস্পরের পরিচয় প্রদান করিতেছে, মূষা অগ্রভাগে কহিতেছে, ওহে বন্ধু আমার পৈতৃক গর্ত্তের মধ্যে ধন ধান্য এবং অন্য অন্য বহুবিধ শস্য আছে। তাহার অধিকাংশ আমার পিতার সঞ্চিত, এবং তিনি যে সকল গোলা এবং ক্ষেত্রহইতে শস্যাদি আনতেন, আমিও তাঁহার মৃত্যুর পরে তাহা সেই সকল স্থানহইতে আনিতেছি। এবং তদ্দ্বারা আমার পরিবার প্রতিপালিত হইয় আরো উদ্বর্ত্ত হয়। ইন্দুরের ধন ধান্যের এই পরিচয় শুনিয়া সৰ্প মনে মনে উপহাস করিয়া বিবেচনা করিতেছে, যে (ইতরের ধন এবং কুলটার যৌবন ইহা অত্যন্ত প্রকাশ পায়) এ মান্য হইবার নিমিত্তে অগ্রভাগে ধনের পরিচয় দিতেছে। সে যাহা হউক এ যাহাতে সন্তুষ্ট থাকে তাহাই করা শেয়। মূষা পুনরায় কহিতেছে, হে বন্ধু সর্প, তোমার কি কোন ধন আছে? কেননা (ধন ব্যতীত গৃহস্থের গৃহস্থালী বৃথা) এবং (ধনে কুল অন্নে বসতি) ইহা এক্ষণে বিলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছে, যে ধন হইলেই অতিসামান্য লোকেরাও ধন্য মান্য হয়, এবং প্রায় সকলেই ধনের বশীভূত। দেখ দৈবাৎ কোন ব্যক্তি যদি ধনী হইয়া উঠে তবে সে (লক্ষ্মীর বর যাত্র) অনেকানেক লোকপ্রায় তাহার বশীভূত হয়, এবং তাহার মতে অনেক কহে। কিন্তু (পণেক পেলে ক্ষণেক গায়, আর কাহনেক পেলে দিনেক গায়) অতএব ধন অতি উত্তম বস্তু। আর (থাকে যদি ধন, বসে পায় মুনিজন) অতএব সংসারের মধ্যে ধন অতি আবশ্যক। এক্ষণে ধনেতেই প্রায় সকল হইবার সম্ভাবনা। ইহা শ্রবণে ভুজঙ্গ অতি মনোভঙ্গ হইয়া কহিতেছে, হে বন্ধু (তোমার যেমন মন, তেমন ধন) জগদীশ্বর দিয়াছেন, আমার ঐ ৰূপ ধন ধান্য কিছুই নাই। কেবল এই যে উজ্জ্বল বর্ণ বস্তুটি আমার মস্তকেতে দৃষ্ট হইতেছে ঐটি মাত্র আছে। মূষা কহিতেছে, উহা কি খাইলে মিষ্ট লাগে? সর্প হাস্য বদনে কহিতেছে, বন্ধু, ওটি আমাদিগের (ফণির মণি ভূষণ) এই (এক মণি সপ্ত রাজার ধন) ইহা শ্রবণে অতি ক্ষুণ্ণমনে মূষিক কহিতেছে, উহা যদি আমার গর্ত্তে থাকিত তবে আমিও বন্ধুর ন্যায় ধনী হইতাম। কিন্তু উহা খাইবার নহে, অতএব আমার বড় একটা আবশ্যক নাই। কেনন (যাহার যেমন অনুধাবনা বিধাতা তাহাকে তেমনি দেন। কিম্ব। (যে বা ধেয়ায়, সে তা পায়)।

 পরে ইন্দুর গর্ব্বপূর্ব্বক কহিতেছে হে বন্ধো, আমারা ইন্দুর জাতি, আমাদিগের অতি সুন্দর শরীর ও হস্ত পদসংযুক্ত স্থূলকায়; এবং আমরা পরিবারের সহিত বাস করি। আর আমরা অহিংসক (অহিংসা পরমোধর্ম্মঃ) আমরা মনুষ্যের হিংসা করি না, তবে তাহাদিগের শস্যাদি অপহরণ করিয়া আনি; এবং গৃহাদি চ্ছেদ করিয়া বাস করি এই মাত্র। দেখ আমরা অহিংসক; কিন্তু আমাদিগের প্রতি সকলেই হিংসা করেন, কেননা (ঊন পেলে ঊনপঞ্চাশ ধায়) দেখ কাক, চিল, কুকুর, বিড়াল, মনুষ্য এবং তোমরা সর্পাদি সকলেই আমাদিগের হিংসাকারি। কিন্তু আমরা কাহারও হিংসা করি না। (আপনি ভালতো জগৎ ভাল) এই কথা সকলেই বলেন, কিন্তু তাহা আমাদিগের প্রতি বিপরীত হইয়াছে। সে যাহা হইক সকলি ভাগ্যের ফল, কেননা (ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র নচ বিদ্যা ন পৌরুষং) আমরা তথাচ দুঃখিত নই। মূষিকের বাক্যান্তরে সর্প কহিতেছে, হে বন্ধো, আমরা সর্প জাতি অতি ভয়ঙ্কর, কিন্তু অতি সুন্দর চিত্র বিচিত্র রেখা আমাদিগের তাবৎ গাত্রে আছে। আমাদিগের হস্ত পদ নাই, তথাচ গমন ও গ্রহণ শক্তি আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব সকলকে ভক্ষণ করি, ইহা বিধাতার বিধি, কেননা তাহারা অধিক হইলে জগতস্থ সকলের মন্দ হইবার সম্ভাবনা। এবং সকলেই আমাদিগকে খল বলিয়া ঘোষণা করে, তাহা কেবল বিবেচনার ভ্রম মাত্র। দেখ আমাদিগের হস্ত পদ কিছুই নাই, তাহাতে যদি কেহ আমাদিগের প্রতি আক্রমণ করে, তবে আমাদিগকে ফণা বিস্তারপূর্ব্বক দংশনের ভাব দেখাইয়া সুতরাং শঙ্কা জন্মাইতে হয়। এবং যদি কেহ আমাদিগের প্রাণের প্রতি হন্তারক হইতে চেষ্টা করে, তবে সুতরাং আমাদিগের বিষাক্ত দন্তে তাহাদিগকে দংশন করিতে হয়। কেননা (যে যেমন তাকে তেমন) না করিলে হয় না। আর দেখ এমত কোন্‌ ব্যক্তি আছে, যে আপনার প্রাণহন্তারকের প্রতি আক্রমাণ না করে। আর যদি কহ যে বিনা অপরাধেতেও অনেক২ প্রাণি সৰ্পকর্ত্তৃক নষ্ট হইয়াছে, তাহা বিধাতার লিপি ইহাই নিতান্ত জানিবে। কেননা (সাপের লেখা বাঘের দেখা) ইহাতে কোন ব্যত্যয় নাই। এবং দেখ সর্পকে বিষাক্ত বলিয়া সকলেই অপবাদ দেয়। কিন্তু এই সর্পের বিষেতে মহৌষধী হইয়া থাকে, তাহাতে অনেক২ প্রাণির জীবন রক্ষণ হইয়া মহা মঙ্গল হয়। এবং সামান্য বৈদ্যেরা যাহারা মূর্খ, বিশেষতঃ তাহারা ঐ বিষাক্ত ঔষধীর প্রাদুর্ভাবে সামান্য স্থানে মান্য গণ্য হইয়া অনায়াসে কালযাপন করিতেছে। পরন্তু সর্পের বাক্যান্তরে মূষিক বিবেচনা করিতেছে, যে (বিপদ কালে সিংহ শৃগালের ভাগ্যকে পান) এই সর্প বিপদগ্রস্ত হইয়া এক্ষণে আমার সহিত বন্ধুতা করিল, হায়, সময়ের কি আশ্চার্য্য ঘটনা, আর (মহতের বিপত্তিতে লঘুদিগের প্রভুত্ব বাড়ে)। আমি মুষিক এক্ষণে ভাগ্যক্রমে সর্পের বন্ধু হইলাম। কিন্তু এই বন্ধুতাকে পরীক্ষা করিতে হইবেক। ইহা মনে২ বিবেচনা করিয়া কহিতেছে, হে সৰ্প বন্ধু, আমি এক্ষণে তোমার নিকট একটি প্রার্থনা করি, আপনি একবার অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বন্ধুর ভাবে স্কন্ধে করহ, আমি তোমার স্কন্ধে আরোহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি। মূষিকের এই আশ্চর্য্য বাক্য শ্রবণে সর্প একেবার শীহরিয়া উঠিল। কেননা (অমনুষ্যের বোল, আর অদিনের বাদোল, অতি অসহ্য) কিন্তু সময়ানুক্রমে ক্রোধান্বিত না হইয়া মনে২ বিবেচনা করিতেছে, হায়২ (নীচ লোকের কিঞ্চিৎ উচ্চ পদ হইলে একেবারে জগৎটাকে তুচ্ছ করে) কি আশ্চর্য্য, এই ইন্দুর আমার আহার দ্রব্য, কেবল ধৈর্য্যেই ইহার প্রাণ রক্ষা হইয়াছে। কিন্তু কি সময়ের গুণ, (বামন হইয়া চাঁদে হাত) ইহা অতি অসম্ভব যে সর্পের স্কন্ধে আরোহণ করিবার ইন্দুরের ইচ্ছা হইল। ইহাতে কেবল সময়কে ধন্যবাদ করা কর্ত্তব্য। অতএব আমার এক্ষণে আশ্চর্য্য হওয়া কর্ত্তব্য। কেননা (কূয়াতে কি পাথর পড়েচে) আমি ইহার বাক্যে রাগ না করিয়া সাম্য ভাবে আপন কার্য্যসাধন করিব। এবং (ইতরের বাক্য হেসে উড়াইতে হয়) অতএব আমি উহার বাক্য কলে কৌশলে অগ্রাহ্য করিব, যেহেতুক সময়ানুক্রমে বিপদগ্রস্ত হইয়া ইতরের সহিত বন্ধুত্বও করিয়াছি, ইহাই অতি লজ্জাকর। আবার ইহাকে যদি স্কন্ধে করি তবে আমার এই অপকর্ম্মে একেবারে মর্ম্মে ব্যথা পাইব। আর (ক্ষুদ্র লোকের পেটে কথা থাকে না) অতএব এই বিপদ হইতে যখন উদ্ধার হইব, তখন কোন সময়ে যদি এই ক্ষুদ্র বুদ্ধি ইন্দুর আপন মহত্ব প্রকাশ করণার্থে ইহা প্রকাশ করে যে আমি সর্পের সহিত বন্ধুতা করিয়া তাহার স্কন্ধে আরোহণ করিয়াছিলাম, তবে ইহাতে আমাদিগের সর্প জাতির এক মহা অপকলঙ্ক স্থাপিত হইবেক। আর তাহাতে সকলেতেই আমাকে অতিশয় অবজ্ঞা করিবেক। তখন আমার সেই লজ্জাহইতে মরণ শ্রেয়। কেননা (সরম হইতে মরণ ভাল) অতএব ইন্দুরকে স্কন্ধে করা কোন মতে কর্ত্তব্য নহে। আর ও যে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিতে চাহিয়াছে, তাহাতেও আমার ক্রোধান্বিত হওয়া সমুচিত নছে। কেননা ছোট লোককে নাই দিলে কাঁধে উঠে) আমি যে সৰ্প হইয়া ইন্দুরের সহিত মিত্রতা করিয়াছি ইহা তাহারি প্রতিফল, সে যাহা হউক এক্ষণে এই পেটরাহইতে নির্গত হইলেই বুঝিতে পারি যে সর্প আর ইন্দুরের কেমন মিত্রতা। হায় হায়! (আকাশের চাঁদে আর বানরের পোঁদে) এক্ষণে সময়ানুসারে সমতুল্য হইবার সম্ভাবনা হইতেছে। কিন্তু (অত্যন্ত গর্হিত যে কর্ম্ম তাহা করা অতি অকর্ত্তব্য) তথাচ এই মূষিক যাহাতে প্রবোধ পায়, এক্ষণে আমার এমত মিষ্ট বাক্য কহা উচিত, আর উহাকে উচিত মত ভর্ৎসনা করা কর্ত্তব্য। কিন্তু এই বিপদকালে তাহা সমুচিত নহে। যেহেতুক (উচিত কহিলে আহাম্মক বেজার) অতএব এসময়ে উহাকে বেজার করা উচিত নহে। আমি উহাকে কেবল মিষ্ট কথা কহিয়াই বশীভূত করিব। কেননা (ক্ষুদ্র লোক কেবল মিষ্ট কথায় বশ) এবং ক্ষুদ্র লোকেরাও মিষ্ট কথাতে বড় মনুষ্যদিগের বশ করিতে পারে। অতএব (জগতের মধ্যে কথা মিষ্ট) এবং মিষ্ট কথাতেই অনেক অনেক কর্ম্ম সিদ্ধ হয়। কিন্তু এক্ষণে আমাকে এমন মিষ্ট বাক্য কহিতে হইবেক যেমন তাহাতে আমার মানের ত্রুটি না হয়। যেহেতুক (কথার নাই খা) যদি এমত কোন কথা হয় যে তাহার দ্বারা আমার মানের লাঘবতা জন্মে, তবে তাহা কহা অতি অকর্ত্তব্য। কেননা (যাক প্রাণ থাক মান) অতএব তাহাহইতে আমার এই পেটরার মধ্যে মরণ শ্রেয়। এই সকল আন্দোলনপূর্ব্বক কিছু প্রকাশ না করিয়া সৰ্প মনোদুঃখে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিল, যেহেতুক (জ্ঞানি লোকের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না) কিন্তু মূষিক সর্পের দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করা দেখিয়া অতিশয় সঙ্কিত হইল; কেননা (ক্ষুদ্র লোক যদিও বড় লোকের প্রতিপন্ন হয়, তথাচ তাহার লঘুতা স্বভাবতঃ সর্ব্বদা সামান্য বিষয়েতেও শঙ্কিত থাকে) সুতরাং সর্পের স্কন্ধে আরোহণ হইতে ইন্দুরের প্রার্থনা করা যে অতি অসম্ভব ইহা তাহার মনে বিলক্ষণ দৃঢ়তা ছিল। আর (সামান্য ব্যক্তির গুরুতর ইচ্ছা হইলে সে আপন মনের ক্ষীণতাক্রমে সর্ব্বদা উদ্বিঘ্ন থাকে) পরে মূষিক মনে মনে স্থির করিলেক, যে (ইতরের মরণ কাতরে) হায় হায় বুঝি আমার মরণ এক্ষণে উপস্থিত হইল (কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ) আমি সাহসিক হইয়া উপস্থিত বিপত্তিহইতে উদ্ধার হওনে সচেষ্টিত হইব। এবং (সকলেই এক্ষণে স্তবের বশ) যদি এই সর্প রাগান্বিত হইয়া থাকে, আমি উহাকে স্তব স্তুতিদ্বারা সাম্য করব। ইহা বিবেচনা করিয়া ইন্দুর অতি মৃদুস্বরে ধীরে২ কহিতেছে, ওহে বন্ধ ফণিরাজ! আমি অনুমান করি, আপনি আমার প্রতি ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, নতুবা আপনি নিঃশব্দে থাকিয়া এক্ষণে অকস্মাৎ কেন দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। সে যাহা হউক আমি যে মহাশয়ের স্কন্ধাৰূঢ় হইবার প্রার্থনা করিয়াছিলাম তাহা আমার নিতান্ত ব্যঙ্গ জানিবেন। কেননা বন্ধুবান্ধবের সহিত কোন সময়ে ব্যঙ্গ করিতে হয়। আমি আপনকার স্কন্ধাৰূঢ় হইবার কোনক্রমে যোগ্য নহি। আর ঐ বাক্যেতে আমার যে অপরাধ হইয়াছে, তাহা আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক আমাকে মার্জ্জনা করুন, আমি মহাশয়ের নিতান্ত আশ্রিত। দেখ (আশ্রিত ব্যক্তির অপরাধে ক্ষমা দানে মানের বৃদ্ধি হয়) অতএব আপনি সদয় হইয়া আমার অপরাধ ক্ষমা করুন এই বাক্য শ্রবণান্তর সর্প মনে২ বিবেচনা করিতেছে, যে হায় কি আশ্চর্য্য! এই ইন্দুর আমার স্কন্ধাৰূঢ় হইবার প্রার্থনা করিয়া আবার আপনি পুনরায় অপরাধ স্বীকার করিতেছে, সে যাহা হউক (মানির মান জগদীশ্বর রক্ষা করেন) আমি যে উহাকে কোন বাক্য না কহিতেও সাম্য হইয়াছে, ইহা অতি আহ্লাদের বিষয়। পরে সর্প কহিতেছে, হে বন্ধু! তোমার বিদ্রুপ বাক্যেতে আমি কোনক্রমে তোমার প্রতি ক্রোধিত নহি। সুতরাং (বন্ধু তাতে উভয়ে সমভাব) তাহাতে ন্যূনাধিক নাই। আর ছোট বড় জ্ঞান করিলে বন্ধুতা হয় না। কিন্তু এই বন্ধতা পঞ্চ প্রকার আছে, অর্থাৎ সত্ববন্ধু, নিত্যবন্ধু, ক্ষোভিবন্ধু, লোভিবন্ধু, এবং কপট বন্ধু। মূষিক কহিলেক সে কি প্রকার, বন্ধুতা যে কেবল এক ৰূপ ইহা শ্রুত আছি। পঞ্চম প্রকার এক্ষণে কেবল তোমার স্থানে শ্রবণ করিলাম, তাহা কেমন প্রকার আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক বিশেষ ৰূপে ব্যক্ত করুন, আমি শুনিতে বাঞ্ছা করিয়াছি। তাহাতে সৰ্প কহিতেছে, হে মূষিক বন্ধু! পঞ্চম প্রকার বন্ধুতা কেমন তাহা শ্রবণ করহ। প্রথমতঃ—সত্ব বন্ধু এই যে বিপদ সম্পদেতে সমভাবে থাকেন, এবং কণ্ঠাগত প্রাণাবধি বন্ধু তাতে ক্রটি করেন না। দ্বিতীয়তঃ—নিত্য বন্ধু তাঁহাকে বলা যায়, যিনি পরমার্থ পথে সর্ব্বদা লইয়া যান। তৃতীয়তঃ—ক্ষোভি বন্ধু, সেই যে আপনার সর্ব্বস্ব হারাইয়া এক জনের সহিত ক্ষোভ প্রযুক্ত বন্ধুতা করিয়াছে। চতুর্থ—লোভি বন্ধু ঐ ব্যক্তি যে কেবল পরের বিষয় ও সুখ সম্পদ দেখিয়া পাকে প্রকারে বন্ধুতা করিয়া ঐ সুখ সম্পদের ভোগী হইয়া খোসামোদ বরামদ অকর্ম্মাদি সকলি স্বীকার করিয়া বন্ধুত্বকে বজায় রাখিয়াছে। আর বন্ধুর সুখ সম্পদের বৃদ্ধি দেখিয়া (কালনিমের লঙ্কা ভাগ করিতেছে) এবং পরধনে ধনী এবং পরপিণ্ডে আপন পিতৃশ্রাদ্ধ সমাধা করিতেছে। পঞ্চম—কপট বন্ধু, তাহার বিবরণ এই যে (কপট বন্ধুর পেটে এক মুখে আর) কেবল স্বীয় সাহায্য সাধনার্থে বন্ধুত্ব স্বীকার করিয়া পাকে প্রকারে বন্ধুত্বটিকে বজায় রাখিয়াছে। এবং আপন কর্ম্মে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া বন্ধুর বিষয়ে ভ্রান্তিক্রমেও বিন্দু মাত্র যত্ন করে না। এবং বন্ধুর বিপত্তি কিম্বা বিষয়ের ত্রুটি অথচ আপনার সুসময় হইলে বন্ধুত্ব ব্রতকে একেবারে উজ্জাপন করিয়া প্রস্থান করে। কিন্তু (দৈন্য কষ্ঠি পাথরের ন্যায়) দৈন্য হইলেই বন্ধুত্বকে পরীক্ষা করা যায়। কেননা সুমময় হইলে অনেকেই সখ্যতা করেন; দুঃসময় হইলে তাহা থাকে না। আর দুঃসময়ে যে ব্যক্তি সখ্যতাকে বজায় রাখেন, সেই ব্যক্তিটিই বন্ধু,এবং তাঁহাকেই যথার্থ বন্ধু বলা যায়। আর অন্য২ যে সকল বন্ধু তাহারা কেবল বন্ধু শব্দ মাত্র, বাস্তবিক বন্ধু নহে। সে যাহা হউক এক্ষণে আমাদিগের যে বন্ধুত্ব ইহা উভয়ের বিপদকালেতে হইয়াছে। অতএব আমাদিগের বন্ধুতাকে অতি আশ্চর্য্য বোধ করিতে হইবেক। এবং এই বিপদহইতে যদি উদ্ধার হইতে পারি তবে আমাদিগের যাবজ্জীবন এই বন্ধুতাকে প্রাণপণে আমরা অতি যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করিব। কিন্তু হে বন্ধু! এক্ষণে এই কারাবদ্ধ হইতে আমাদিগের মুক্ত হইবার কি যুক্তি করা যায়। কেননা (বিপদগ্রস্ত হইলে বন্ধু বান্ধব লইয়া যুক্তি করিতে হয়) এবং সকলে ঐক্য হইয়া বিপদকে ধ্বংস করিতে হয়। কিন্তু আমরা এক্ষণে দুইটি বন্ধুমাত্র আছি, আমাদিগের তৃতীয় আর নাই। অতএব এই দুই জনকেই যুক্তি এবং চেষ্টা করিতে হইবেক। যাহাতে এই পেটরাহইতে নির্গত হইতে পারি। এই বাক্য শ্রবণান্তর ইন্দুর কহিতেছে হে সর্প মিত্র! (বিপদকালে অনেক মিত্র লইয়া পরামর্শ করা কর্ত্তব্য নহে) যেহেতুক আপনি এক্ষণে আমাকে পঞ্চম প্রকার বন্ধুর বিবরণ বিশেষ ৰূপে কহিয়াছেন। তাহাতে আমার বিবেচনা হয় যে অন্য অন্য বন্ধু অপেক্ষা কেবল সত্ববন্ধু কে লইয়া বিপদ সম্পদের বিষয়ে যুক্তি করা কর্ত্তব্য। আর (অনেক সন্ন্যাসিতে গাজন নষ্ট) অতএব যুক্তি করণার্থ কেবল যথার্থ বন্ধুটি লইবে। আর অন্য২ সমারোহ বিষয়েতে আত্ম বন্ধু জ্ঞাতি কুটুম্ব অপর সাধারণ আদি সকলকে লইয়া পরামর্শ করিবে। কিন্তু সকলের অভিপ্রায় জানিয়া কেবল সত্ব বন্ধুর সহিত আপন ক্ষমতার সহ ঐক্য করিয়া কার্য্য করণে প্রবর্ত্ত হইবে।

 অতএব (বিপদ কালে কোন ক্রমে অনেকের সহিত পরামর্শ করিবে না) সে যাহা হউক এক্ষণে আমাদিগের বর্ত্তমান বিপদের কি কর্ত্তব্য? কেননা (বিপদকে অবহেলা করিলে বিলম্বেতে প্রাণকে সংশয় করে) অতএব বিপদকে কোন প্রকারে নষ্ট করা অতি কর্ত্তব্য। অতএব আমাদিগের এক্ষণে কি কর্ত্তব্য। সর্প কহিতেছে হে বন্ধ মূষিক! এক্ষণে আমাদিগের এই পেটরাহইতে অবিলম্বে নির্গত হইবার চেষ্টা করা অতি কর্ত্তব্য। আর কারাবদ্ধ হইয়া নিশ্চিন্ত থাকা কর্ত্তব্য নহে, বিলম্ব হইলে আপদের বুদ্ধি হওনের সম্ভাবনা। যেহেতুক (জ্বরকে অবহেলা করিলে বিকার প্রাপ্ত হইতে পারে) অতএব হে মূষিক বন্ধু! এক্ষণে আমরা এই কারাবদ্ধহইতে মুক্ত হওনের কি সদুপায় করি? আমি সর্প আমার দীর্ঘ নিশ্বাসেতে মৃত্তিকা চ্ছেদ হইতে পারে। কিন্তু এই বেত্রনির্ম্মিত পেটরা বিশেষতঃ চর্ম্ম মণ্ডিত, ইহাকে চ্ছেদ করণের সামর্থ্য আমার নাই। আর জগদীশ্বর আমাকে যে দন্ত দিয়াছেন, তাহাও অতিশয় ক্ষীণ, বিশেষ তদ্দ্বারা উহা চ্ছেদ হওনের সম্ভাবনা নাই। অতএব হে বন্ধু! আমি সর্প বটি, কিন্তু এক্ষণে আমার দর্প একেবারে জগদীশ্বর চূর্ণ করিয়াছেন। তদন্তরে মূষিক কহিতেছে, হে বন্ধু সর্প! তাহাতে তোমার দুঃখিত হওয়া কোন প্রয়োজন নাই। এক্ষণে এই পেটরাটিকে চ্ছেদ করণের ভার আমার হইল, কিন্তু এই সন্দেহ মাত্র যে আমার দন্ত অতি দুর্ব্বল এবং আপনিও কারাবদ্ধ হইয়া অতি শঙ্কিত আছি। যদি এই দন্ত গুলি ভগ্ন হয়, তবে আমাদিগের প্রাণ রক্ষা হওনের কোন উপায় নাই। সে যাহা হউক (শঙ্কা এবং সন্দেহকে পরাজয় না করিলে পুরুষার্থ প্রকাশ পায় না) অতএব আমি সাহসিক হইয়া এই পেটরা কাটিয়া মিত্রকে উদ্ধার করিব, আর এই পেটরাচ্ছেদ করণে যদিও আমার এই দন্ত এবং শরীরের বিনাশ হয়, তথাচ আমি দুঃখিত হইব না। কেননা এই সামান্য শরীর যদিও পতন হয়, তথাচ আমার সাহসের উদাহরণ থাকিবেক। এবং (এইক্ষণ ধ্বংসি শরীরের আশ্রয়েতে যদি দুর্ল্লভযশকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তবে তাহাহইতে আর কি লভ্য আছে?) অতএব হে মিত্র! আপনি প্রসন্ন হইয়া আমাকে অনুমতি করুন আমি এই পেটরাকে চ্ছেদ করিব। মূষিকের সাহসিক বাক্য শ্রবণান্তরে সর্প অতি আহ্লাদপূর্ব্বক কহিতেছে, হে মিত্র মূষিক! তোমার সাহসিক বাক্য শ্রবণে আমি এক্ষণে যেন নির্জ্জীব হইতে সঞ্জীৰ হইলাম। কেননা (বিপদ নষ্ট হইবার বার্ত্তাতে যেমন তুষ্ট হওয়া যায় বিপদ নষ্ট হইলে তেমন হয় না) সে যাহা হউক এক্ষণে তুমি মনোযোগী হইয়া এই বিপদকে নষ্ট করহ। তবে আমরা উভয়েতে পরম সুখী হইব। এবং তোমার এই যশকে জীবনাবধি ঘোষণা করিব। আর (কীর্ত্তির্যস্য সজীবতি) আমার জ্ঞাতি কুটুম্ব অন্য২ বন্ধু বান্ধবেরাও তোমার যশকে স্মরণ করিবেক। অতএব হে মূষিক মিত্র! তুমি এক্ষণে আপন কর্ম্মে তৎপর হও। মূষিক এতদ্বাক্যশ্রবণে মনে২ গুরু গণেশকে প্রণামান্তরে সর্প মিত্রকে নমস্কার করিয়া তদন্তরে পেটরা চ্ছেদ করিতে আরম্ভ করিলেক। মূষিক আপন তীক্ষ্ণ দন্ত ঘন ঘর্ষণে অবিলম্বে ঐ পেটরাকে চ্ছেদ করিয়া এক অতি উত্তম পথ নির্ম্মাণ করিল, যেহেতুক (যার কর্ম্ম তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠী বাজে) আর সর্প যদিও মূষিক অপেক্ষ অতি শ্রেষ্ঠ এবং বলবান্‌ তথাচ পেটরা চ্ছেদ করণের ক্ষমতা হইল না। এবং মূষিকের ভয় ভক্তি এবং মনোযোগেতে তাহার কর্ম্ম অতি ত্বরায় সমাধা হইল। কেননা (কার্য্যকারকের ভয় ভক্তি এবং মনোযোগ থাকিলে তাহার কর্ম্ম উত্তম ৰূপে সমাধা হয় এবং তাহাতে যশস্বী হইতে পারে) তদন্তর মূষিক পরম আহ্লাদপূর্ব্বক আপন সর্প মিত্রের নিকট নিবেদন করিতেছে,যে হে মিত্র! আপনার আজ্ঞানুসারে আমি এক্ষণে আপন ক্ষুদ্র শক্তিতে এবং ক্ষীণ দন্তের সহায়তাক্রমে এই কঠিন বেত্রনির্ম্মিত পেটরা তাহার চর্ম্ম সহিত চ্ছেদ করিয়া আমাদিগের বহির্গমনের পথ নির্ম্মাণ করিয়াছি, আপনি গাত্রোত্থান করিয়া দৃষ্টি করুন। এই শুভ সংবাদ সর্পের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবাতে সর্প একেবারে আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইল। কেনন (সুসম্বাদের মিথ্যাও ভাল) এবং কহিল হে মূষিক মিত্র! তুমি ধন্য, এবং তোমার দন্তও ধন্য যাহাকে ক্ষীণ বলিয়া তাচ্ছিল্য করিতেছিলে। হায় হায়! (এই দুর্ল্লভ দন্ত, ইনি বাল্য ও বৃদ্ধকালে থাকেন না, কেবল যৌবনাবস্থাতে ভোগের কারণ হয়েন, এবং ভোগ সম্পূর্ণ করিয়া প্রস্থান করেন) সে যাহা হউক তোমার দন্ত আমাদিগের প্রাণকে রক্ষা করিল। এক্ষণে এই স্থানহইতে প্রস্থান করিয়া আমাদিগের স্বস্থানে শুভগমন করা কর্ত্তব্য। হে মিত্র! আইস আমরা এই পেটরাহইতে নির্গত হই। সর্পের বাক্যশ্রবণে মূষিক কহিতেছে হে মিত্র! বটে, এই কারাবন্ধ হইতে আমাদিগের অবিলম্বে মুক্ত হওয়া কর্ত্তব্য। কিন্তু আমি যে পথ নির্ম্মাণ করিয়াছি তাহাতে উভয়ের একেবারে নির্গত হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব আমাদিগের একে একে নির্গত হইতে হইবে। হে সর্প মিত্র! আপনি অগ্রে নির্গত হউন, আমি তোমার পশ্চাৎগামী হইব। কিন্তু মনে মনে বিচার করিতেছে, যে এই সর্প এক্ষণে আপনার পথ পাইয়া স্বাধীন হইয়াছে। যদি বন্ধত্বকে তাচ্ছল্য করিয়া এক্ষণে আমাকে নষ্ট করে তবে কি হইবেক? আমি অগ্রে গমন করিলে যদি রুষ্ট হয় যে মূষিক আমাকে ছাড়িয়া অগ্রে গমন করিলেক। আর পশ্চাৎ থাকিলে কহিবেক, যে ভয় প্রযুক্ত মূষিক অগ্রে যাইতে অস্বীকৃত হইল। অতএৰ (দুর্ব্বলের এগোলেও দোষ, পেছোলেও দোষ) সে যাহা হউক উনি আমাকে যাহ আজ্ঞা করবেন আমি তাহাই করিব (আজ্ঞানুবর্ত্তির দোষ নাই) সর্প কহিলেক হে মিত্র! আমাদিগের অগ্র পশ্চাতে কোন দোষ নাই, কিন্তু তুমি অগ্রসর হইলে পরে যদি এই পথ আমার নির্গত হওনের মত প্রশস্ত না হয় তবে আমাকর্ত্তৃক প্রশস্ত হওনের উপায় নাই। বরং তুমি পশ্চাৎ থাকিলে আপন দন্তদ্বারা পুনরায় কিঞ্চিৎ প্রশস্ত করিতে পারিবে। দেখ (কার্য্যক্ষম ব্যক্তিতেই কার্য্য হইতে পারে, আর অন্যেতে হয় না) অতএব হে মিত্র! আমি অগ্রগামী হইব। ইহা কহিয়া সর্প ধীরে ধীরে পেটরাহইতে বহির্গত হইয়া তন্নিকটে রহিল। এবং মনে২ মূষিকের নিরাপদে বহির্গত হওনের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা করিতে নাগিল। এবং কিয়ৎক্ষণান্তরে মূষিকও পেটরাহইতে বাহির হইল। তখন সর্প তাহাকে দেখিয় পরমাহ্লাদিত হইয়া তাহার নিকট দ্রুতগমন করিল, যেহেতুক (শ্রেষ্ট লোকেরা আপনার মঙ্গলেতে যেমন তুষ্ট ইন, তেমনি অন্যের মঙ্গলেতেও সন্তুষ্ট হন) এবং আহ্লাদ প্রযুক্ত আপন মুখ বিস্তারপূর্ব্বক মূষিক বন্ধুকে ধৃত করিয়া উভয়ে শীঘ্র পলায়নের নিমিত্তে দ্রুত গমনে ঐ বাটীহইতে বাহির হইল। এবং কিছু দূরে এক নির্জ্জন স্থানে গমন করিয়া মূষিক বন্ধুকে মুখহইতে পরিত্যাগ করিয়া আপনিও স্থির হইল। তাহাতে মূষিক পরমাপ্যায়িত হইয়া সৰ্প বন্ধু কে কহিতেছে, হে বন্ধু! আপনি বিষাক্ত দন্তহইতে আমাকে রক্ষা করিয়া যখন পরিত্যাগ করিলেন, তখন আপনার যে বন্ধুত্ব তাহা বিশ্বাসজনক বটে। এক্ষণে আমাদিগের প্রণয়কে জগদীশ্বর রক্ষা করুন, আর আইস আমরা পরস্পর স্বস্থানে প্রস্থান করি। তাহাতে সৰ্প কহিতেছে, হে বন্ধু! আমাকর্ত্তৃক ধৃত হইয়া এক্ষণে তুমি সর্পের ন্যায় বিষাক্ত হইলে, তুমি ঐ দন্তে যাহাকে দংশন করিবে, সে সর্পের দংশনের ন্যায় হইবেক। তখন মূষিক কহিতেছে; হে বন্ধু সৰ্প! (নীচলোক যদি মহতের সহিত সংসর্গ করে, তবে তাহার নীচত্ব ঘুচিয়া প্রায় মহত্বকে পায়) ইহা কহিয়া উভয়ে পরস্পর কোলাকুলি এবং নমস্কার করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল ইতি।

মনোরম্য ইতিহাস সমাপ্ত।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।