ময়ূখ/চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
মুক্তিলাভ করিয়া ময়ূখ কাশেমখাঁর সহিত বাঙ্গালায় ফিরিয়া আসিলেন। বাঙ্গালার সুবাদারী গ্রহণ করিয়া কাশেম ইয়ার খাঁ হুগলীর পর্ত্তুগীজগণের বিনাশের উদ্যোগ আরম্ভ করিলেন। সুবাদারের পুত্র এনায়েৎউল্লা, সেনাপতি আল্লা ইয়ার খাঁর সহিত হিজ্লী আক্রমণ করিবার ছলে সসৈন্য বর্দ্ধমানে পৌঁছিলেন। হুগলী আক্রমণের উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে পাছে হুগলীর পর্ত্তুগীজগণ জলপথে পলায়ন করে, সেই জন্য মখ্সুসাবাদে বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও নাওয়ারার সমস্ত কোশা ও গরাবের সহিত খাজা শের শ্রীপুর হইতে সুন্দরবনে প্রেরিত হইলেন। স্থির হইল যে, নাওয়ারা পর্ত্তুগীজগণের জাহাজ যাইবার পথ রুদ্ধ করিলে, আল্লা ইয়ার খাঁ বর্দ্ধমান হইতে এবং বহাদর খাঁ কাম্বোহ মখ্সুসাবাদ হইতে হুগলীর দিকে অগ্রসর হইবেন।
এই সময়ে ফিরিঙ্গিগণ একদিন সপ্তগ্রামে গোকুলবিহারী শেঠের গৃহ আক্রমণ করিল। প্রতিশোধ লইবার জন্য গোকুলবিহারী ও সপ্তগ্রামের ফৌজদার হুগলী আক্রমণ করিলেন। যে দিন হুগলীর দুর্গ আক্রান্ত হইল, তাহার পরদিন রাঢ় হইতে ময়ুখ এবং বাগ্ড়ী হইতে বহাদর খাঁ গোকুলবিহারীর সহিত মিলিত হইলেন। এই সময়ে খাজা শের কোশা ও গরাব দিয়া সুন্দরবনের জলপুথ রুদ্ধ করিয়া হুগলীর দিকে অগ্রসর হইলেন। তখন বর্দ্ধমান হইতে এনায়েৎ উল্লা খাঁ ও আল্লা ইয়ার খাঁ হুগলী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ১৯৪০ হিজরায় অর্থাৎ ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে হুগলীর পর্ত্তুগীজ দুর্গ চারিদিক্ হইতে আক্রান্ত হইল। পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ও ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের অত্যাচারে প্রপীড়িত দক্ষিণ বঙ্গের অধিবাসিগণ দলে দলে বাদশাহী ফৌজে প্রবেশ করিল। বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও খাজা শের নৌকা সংগ্রহ করিয়া হুগলীর নিম্নে একটি নৌসেতু নির্ম্মাণ করিলেন, ইহার ফলে হুগলী বন্দরের সমস্ত গরাব কোশা ও জালিয়া ডিঙ্গা বাদশাহী নাওয়ার কর্ত্তৃক ধৃত হইল। এইবার স্থলপথে পদাতিক ও জলপথে নৌসেনা হুগলী বন্দর ও দুর্গ আক্রমণ করিল, দুর্গের বহির্দ্দেশে অবস্থিত নগর ও বন্দর আল্লা ইয়ার খাঁর দখলে আসিল।
তিন মাস যুদ্ধের পরে গোকুলবিহারী দুর্গ অধিকারের এক নূতন পথ আবিষ্কার করিলেন। গির্জ্জার নিকটে হুগলী দুর্গের পরিখা সঙ্কীর্ণ ছিল, গোকুল বিহারীর নৌসেন সুড়ঙ্গ কাটিয়া সেই স্থানের জল বাহির করিয়া দিল। তখন বাদশাহী সেনা ভীষণ বেগে সেই স্থান আক্রমণ করিল।
এই সময়ে আল্লা ইয়ার খাঁর শিবিরে পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গীর এক নূতন শত্রু আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন আংরেজ বণিক্ পর্ত্তুগীজ দস্যুর আক্রমণে হৃতসর্ব্বস্ব হইয়া গোয়ায় আসিয়াছিল; তথায় পর্ত্তুগীজ পাদ্রীগণের অত্যাচারে তাহার চক্ষুদ্বয় নষ্ট হইয়াছিল। দৈবচক্রে হুগলী দুর্গ অবরোধের সময় সেই অন্ধ আংরেজ বণিক্ সপ্তগ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে স্বদেশে যুদ্ধব্যবসায়ী ছিল, সুড়ঙ্গ কাটিয়া বারুদ প্রয়োগে কিরূপে দুর্গপ্রাকার ধ্বংস করিতে হয় সে তাহা ফরাসী দেশে শিক্ষা করিয়াছিল। তাহার সাহায্যে ময়ূখ গির্জ্জার নিম্নে সুড়ঙ্গ কাটিয়া দুর্গপ্রাকার ধ্বংসের চেষ্টা করিতে আরম্ভ করিলেন। দুইতিন বার ব্যর্থমনোরথ হইয়া অন্ধ আংরেজ অবশেষে এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিল; তাহাতে শত শত মণ বারুদ সঞ্চিত হইল। ভয়ে কোনও মুসলমান বা হিন্দু সেনা সেই বারুদ রাশিতে অগ্নি সংযোগ করিতে স্বীকৃত হইল না। তখন সুবাদারের একজন দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ আহদী স্বেচ্ছায় সেই ভার গ্রহণ করিল।
চারিদিকে বাদশাহী ফৌজ দুর্গ আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল, তখন সেই আহদী হলদীপুরের শিবিরে আসিয়া ময়ূখের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিল। ময়ুখ তখন আল্লা ইয়ার খাঁ, এনায়েত উল্লা খাঁ, খাজা শের ও বহদির খাঁ কাম্বোহের সহিত পরামর্শ করিতেছিলেন। একজন সওয়ার আসিয়া তাহাকে কহিল, “মহারাজ, সেই হিন্দু শহীদ আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন।”
ময়ূখ তাম্বুর বাহিরে আসিলেন। সেই আহদী তাঁহাকে কহিল, “ময়ূখ, আমাকে চিনিতে পার?” সামান্য সৈনিকের মুখে এইরূপ সম্বোধন শুনিয়া ময়ূখ বিম্মিত হইলেন।
আহদী পুনরায় কহিল, “ললিতাহরণের দিনে গৌরীপুরের ঘাট স্মরণ হয়?”
ময়ূখ অধিকতর বিস্মিত হইয়। কহিলেন, “হয়।”
“আমি সেই সন্ন্যাসী।”
“আপনি?”
“হাঁ আমি। আমি ললিতার মাতুল, বিনোদিনীর ভ্রাতা। চতুর্দ্দশ বর্ষ-পূর্ব্বে গঞ্জালীস্ খড়দহ হইতে আমার যুবতী পত্নী ও বিনোদিনীকে বলপূর্ব্বক লইয়া আসিয়াছিল। আমার পত্নী আত্মহত্যা করিয়াছে, আমি জানিতাম বিনোদিনীও মরিয়াছে। আগ্রায় বিনোদিনীকে দেখিয়া আমি পূর্ব্ব সঙ্কল্প বিস্মৃত হইয়াছি। মনে করিয়াছিলাম যে পর্ত্তুগীজের হুগলী শ্মশান করিয়া তথায় বাস করিব। কিন্তু বিনোদিনীর জার জীবিত আছে। অদ্য হুগলী দুর্গ অধিকৃত হইবে, তখন আমি জীবিত থাকিব না। যদি গঞ্জালীস্কে ধরিতে পার, তাহা হইলে স্বহস্তে তাহার শিরচ্ছেদ করিয়া তাহার রক্তসিক্ত মৃত্তিকায় আমার চিতাশয্যা রচনা করিও। অনূপনারায়ণ মরিয়াছে, কল্য বারবক্ সিংহের অধিকার পাইবে।”
আহদী উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। অর্দ্ধদণ্ড পরে ভীষণ শব্দে হুগলীর পর্ত্তুগীজ গির্জ্জা ও দুর্গ-প্রাকার আকাশে উত্থিত হইল এবং দুইদণ্ড পরে হুগলীর পর্ত্তুগীজ অধিকার লুপ্ত হইল।
ময়ূখ অসিহস্তে ফিরিঙ্গীপ্রধানের প্রাসাদের নিকটে আসিয়া দেখিলেন যে, মুষ্টিমেয় সেনা লইয়া ডিসুজা তখনও যুদ্ধ করিতেছেন। চতুর্দ্দিক্ হইতে আক্রান্ত হইয়াও ডিসুজা আত্মসমর্পণ করিলেন না। ক্ষণকাল মধ্যে পর্ত্তুগীজ বীরগণ স্বজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিল।
গঞ্জালীস জলপথে পলায়নের চেষ্টা করিতেছিল। সে বন্দী হইয়া ময়ূখের নিকটে আনীত হইল। গঙ্গাতীরে গঞ্জালীসের রক্তসিক্ত বালুকায় চিতা রচিত হইল, তাহাতে সন্ন্যাসীর দগ্ধাবশিষ্ট দেহ স্থাপিত হইল। বোধ হয় পরলোকে ব্রাহ্মণের আত্মা তৃপ্ত হইয়াছিল।