ময়ূখ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
যমুনাতীরে আগ্রা দুর্গের সম্মুখে একজন গৌরবর্ণ যুবা পুরুষ একখানি নৌকার সম্মুখে বসিয়াছিল। তখনও যমুনা কিল্লা হইতে দূরে সরিয়া যায় নাই, দুর্গের সম্মুখে একটিও বৃক্ষ জন্মায় নাই। ভীষণ রৌদ্র, বাদশাহ তখন আগ্রায়; সুতরাং দুর্গের সম্মুখে ছত্র ব্যবহার করিবার উপায় নাই। যুবক মধ্যে মধ্যে রুমাল দিয়া রৌদ্র হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেছিল, আবার তৎক্ষণাৎ দুর্গের দিকে চাহিয়া তাহা নামাইয়া লইতেছিল। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি নামিয়াছে, তথাপি রৌদ্রের তেজ অতীব প্রখর। দুর্গ মধ্যে শুভ্র মর্ম্মরনির্ম্মিত অসংখ্য প্রাসাদশ্রেণীর অগণিত বাতায়নপথ সুবর্ণখচিত বহুবর্ণের যবনিকায় আবৃত। বাদশাহ তখন দুর্গমধ্যে, সেইজন্য হরিৎ বর্ণের পতাকা উড়িতেছে, দুর্গের চারিপার্শ্বে এক একজন সেনাপতি সহস্র হস্ত ব্যবধানে সেনানিবাস স্থাপন করিয়াছেন। সর্ব্বদা সুসজ্জিত সৈন্যগণ দুর্গের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। দুর্গমধ্যে যমুনাতীরে প্রাসাদের অন্তঃপুর, সে স্থানে তাতারী ও তুর্কী প্রতীহারীগণ ভীষণ রৌদ্রে শূন্যমস্তকে দশহস্ত ব্যবধানে দাঁড়াইয়া আছে। দুই তিন জন প্রহরী আসিয়া যুবককে অপেক্ষা করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু যুবকের নিকটে বাদশাহী পঞ্জা দেখিয়া দূরে সরিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে দুই দণ্ড অতীত হইয়া গেল, যুবকের নিদ্রাকর্ষণ হইল। এই সময়ে দুর্গমধ্যে জহাঙ্গীরি মহলে সেতার বাজিতে আরম্ভ হইল। যুবক মনে করিল যে, বহুদূর বঙ্গদেশে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী-সঙ্গমে সে একখানি বৃহৎ বজরার কক্ষে গজদন্তনির্ম্মিত খট্টায় শয়ন করিয়া আছে, আর তাহার পার্শ্বে বসিয়া এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী সেতার সিন্ধু ভূপালী বাজাইতেছে। ক্ষণকাল পরে যুবকের তন্দ্রার ঘোর ছাড়িয়া গেল; সে চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু তথাপি সেতারের আওয়াজ আসিতে লাগিল; যুবক চক্ষু মার্জ্জনা করিল। তখনও সিন্ধু ভূপালী বাজিতেছিল। হঠাৎ জহাঙ্গীরি মহলের একটি গবাক্ষের যবনিকা সরিয়া গেল, তাহাতে তাতারী প্রতীহারী ও একটি যুবতীর মুখ দৃষ্ট হইল। যুবক সেই দিকে চাহিল, মুহূর্ত্তের জন্য রমণীদ্বয়ের মুখমণ্ডল তাহার নয়নগোচর হইল। তাতারী নিমক্হারাম্ নহে, সে তৎক্ষণাৎ যবনিকা টানিয়া দিল, যুবকের মনে হইল যে দ্বিতীয়ার মুখ তাহার নিকট অপরিচিত নহে। গবাক্ষের যবনিকা সরিল না। ক্ষণকাল পরে দরিয়াই ফটক হইতে একজন খোজা ও একটি পরিচারিকার সহিত এক প্রৌঢ়া বাহির হইয়া আসিল। তাহাকে নৌকায় তুলিয়া লইয়া যুবক মাঝিদিগকে নৌকা ছাড়িয়া দিতে বলিল। আগ্রার কিল্লা দূরে সরিয়া গেলে, প্রৌঢ়া অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া কহিল, “বাবা, আজি সংবাদ শুভ; বাদশাহ বেগমকে রাজি করিয়া আসিয়াছি, তুমি কল্য নবাব আসফ্ খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিও, তিনি তোমাকে দেওয়ান-ই-খাসে লইয়া যাইবেন।”
যুবক প্রফুল্লবদনে কহিল, “মা, এতদিনে বোধ হয় ভগবান্ মুখ তুলিয়া চাহিলেন।”
“আর এতদিনে বোধ হয় ললিতার দুঃখ ঘুচিল।”
“আসদ্খাঁর কোন সংবাদ পাইলে?”
“না, তবে শুনিলাম যে ফিদাই খাঁ নিকট হইতে খাজনা লইয়া দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় আগ্রায় আসিতেছেন।”
“আসদ্ খাঁ না আসিলে বাদশাহের দরবারে সুবিধা হইবে না।”
“দেখ বাবা, এইবার তুমি ললিতাকে বিবাহ কর।”
“বাঙ্গালী পুরোহিত পাইব কোথায়?”
“বাদশাহ বেগম বলিয়াছেন যে বৃন্দাবন হইতে একজন বাঙ্গালী গোস্বামী আনাইয়া দিবেন। তিনি ললিতাকে দেখিতে চাহিয়াছেন, আমি বলিয়াছি যে বিবাহের পরে লইয়া আসিব।”
যুবক উত্তর দিল না, তাহা দেখিয়া প্রৌঢ়ার নয়নদ্বয় আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নৌকা সহরের দিকে চলিয়া গেল। তখন জহাঙ্গীরি মহলে শুভ্র মর্ম্মরাচ্ছাদিত গৃহতলে বসিয়া পূর্ব্ব পরিচিতা যুবতী তাতারীর সহিত পরামর্শ করিতেছিলেন। যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, “যে স্ত্রীলোকটা নৌকায় গিয়া উঠিল, তাহাকে তুই চিনিস?” তাতারী কছিল “চিনি।” “ও কে?” “ও বাঙ্গালী, ভাল সূঁচের কাজ করিতে জানে, দুই দিন অন্তর হজরৎ বাদশাহ বেগমের নিকটে আসে।” “উহার নাম কি?” “সে আমি বলিতে পারিব না, হয় বিন্দিনী নয় বিন্দানী।” “বিনোদিনী কি?” “হাঁ, আপনি ঠিক কাফেরের মত কথা বলিতে পারেন।” “আমি যে, অনেক দিন বাঙ্গালা মুলুকে ছিলাম।” “উহাকে কি আপনি চেনেন?” “না, তোকে যা বলিতেছি শোন, নৌকার কাছে যে বসিয়াছিল সে আমার খসম। তুই তাহার সন্ধান করিতে পারিস্?” “কেন পারিব না? ছুটি পাইলেই হয়, তবে কিছু খরচ আছে।” “যত টাকা লাগে দিব, তুই কি সহরের পথ ঘাট চিনিস্?” “আমি চিনি না বটে, তবে সহরে আমার এক দোস্ত আছে”—তাতারী এই বলিয়া ঈষৎ হাসিল—“সে আগ্রা সহরের প্রত্যেক লোককে চেনে, কিন্তু বেগম সাহেব, তাহার একটু ঘন ঘন তৃষ্ণা পায়!” “আমি খান্সামানের উপরে হুকুমনামা দিতেছি, তুই তাহাকে ইরাণী ও ফিরিঙ্গি আরকে ডুবাইয়। রাখিস।”
তাতারী দীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিল, “তাহা হইলে এক হপ্তামধ্যে বেগম সাহেবের খসমের সন্ধান আনিয়া দিব।”
“তাহাকে ধরিয়া আনিতে হইবে।”
“কোথায় আনিব?”
“কেন, মহল্ সরার মধ্যে।” “তাহা হইলে কাহারও মাথা থাকিবে না।” “কেন?” “শুনিয়াছি, নুরজহাঁ বেগমের আমলে দুই এক জন মরদ্ আওরত্ সাজিয়া মহল্ সরার ভিতরে আসিত, কিন্তু হজরৎ আরজ্মন্দ্ বানু বেগম সাহেবার আমলে তাহা হইবার উপায় নাই।”
“তবে আমি বেগম সাহেবার হুকুম লইয়া রাখিব।”
“দোহাই বেগম সাহেবা, এখন হজরৎ বাদসাহ বেগমকে কিছু বলিও না, তাহা হইলে খসমের দেখা পাইবে না। বেগম সাহেব তোমার খসম্ পলাইয়াছে শুনিলে তাহাকে বাঁধিয়া আনিবার হুকুম দিবেন, সহরে গোল হইয়া যাইবে, কোটওয়ালের ফৌজ সাজিতে সাজিতে তোমার থসম্ সংবাদ পাইয়া পালইবে। তুমি ব্যস্ত হইও না, আমি আগে সন্ধান লইয়া আসি।”
“সেই ভাল।”
“বেগম সাহেব, সর্বতের কিছু খরচা আর বখ্শিসের কিছু বায়না দিলে ভাল হয়।”
“কত দিব?”
“দশটা কি পনেরটা আশ্রফি দিয়া ফেল না?”
“পোড়ার মুখি, অতগুলা টাকা লইয়া কি করিবি?”
“কেন, বেগম সাহেবকে দোয়া করিব, দুই দোস্তে সরাব খাইব, আর গর হাজির খসম্কে সোয়াবগাহে হাজির করিয়া দিব?”
“পনের আশরফির সরাব খাইবি?”
“বেগম সাহেব, এ তোমার কর্ম্ম নয়; এ আগ্রা সহর, কথায় বলে দার্-উল-মুল্ক আগ্রা। বেগম সাহেব, বাদশাহী কিল্লায় বসিয়া কৃপণ হইলে চলিবে না, যদি খসম চাও মুঠ মুঠা আশরফি ছাড়।”
“তোর যত টাকা লাগিবে দিব, কিন্তু তুই পনের আশরাফী কি করিবি?”
“দুইটা আশরাফী দোস্তকে বায়না দিব, একটা আশরাফী এক বেটা ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ্কে ঘুস্ দিয়া দশ কার্ফা আরক চোলাই করিয়া লইব, তাহাতে আন্দাজ দশ আশরাফী খরচ হইবে। সহরের খরচের জন্য মোট দুইটা আশরাফী রহিল।”
যুবতী তাতারীকে কাগজ কলম আনিতে বলিল। কাগজ আসিলে তাহাকে এক পত্র লিখিয়া দিল, মুখে বলিল, “জুম্মা মসজিদের পার্শ্বে আমার আমিল্ নাজীর আহম্মদ খাঁ আছে, তাহাকে এই রোকা দিলে তোকে পনের আশরাফী দিবে।” তাতারী আশরাফী লইয়া সেলাম করিল এবং কহিল, “এইবার হজরৎ বাদশাহ বেগমের নিকট ছুটি পাইলেই হয়।” যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কয় দিনের ছুটি চাই?”
“এক হফ্তা।”
“এক হফ্তা ত মদই খাইবি, তবে আমার খসম্ খুজিবি কখন?”
“বেগম সাহেব, কাল্মক্ তাতারের পেটে ফিরিঙ্গির আরক যতক্ষণ তাজা থাকিবে ততক্ষণ সে অসাধ্য সাধন করিবে, কিন্তু নেশা ছুটিলেই সর্ব্বনাশ! আর নড়িতে চাহিবে না। আরক আর পায় না বলিয়াই যত তাতার ও তাতারী আফিম ধরিয়াছে।” “তুই কি কাল্মক্ না কি?” “না আমি য়াকুৎ, আমার দোস্ত কাল্মক্।”
এই সময়ে চতুর্দ্দশবর্ষীয়া পরম সুন্দরী একটি বালিকা জহাঙ্গীরি মহলে প্রবেশ করিয়া যুবতীকে কহিল, “গুল্রুখ্, মা তোমাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।” যুবতী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “যাই বেগম সাহেব, হজরৎ বাদশাহ বেগম কোথায়?” বালিকা কহিল, “মা যোধবাই মহলে আছেন।” যুবতী তাতারীর সহিত দ্রুতপদে যোধবাই মহলের দিকে গমন করিল।