ময়ূখ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সপ্তগ্রামে পৌঁছিয়া ময়ূখ নিত্য প্রভাতে একবার বন্দরে আসিতেন। তাঁহার মনে হইত যে হয় ত ভীমেশ্বর হইতে কেহ না কেহ তাঁহার সন্ধান করিতে আসিবে, কারণ ভুবন ফিরিয়া গিয়াছে। আর কেহ আসুক আর না আসুক ভুবন যে আসিবে সে বিষয়ে তাঁহার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। সেই জন্য তিনি প্রভাতে একবার করিয়া বন্দর অর্থাৎ সরস্বতী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে আসিতেন। গৌরীপুরে ও ভীমেশ্বরে তাঁহার পিতার সভাপণ্ডিত জগদীশ তর্করত্ন তাঁহার সাহায্যের জন্য যে বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন, তিনি তাহার কিছুই জানিতেন না।
দিবসের দ্বিতীয় প্রহর আরম্ভ হইয়াছে দেখিয়া ময়ূখ বন্দর হইতে দ্রুতপদে গৃহে ফিরিতেছিলেন। গোকুলবিহারীর গৃহ হইতে সপ্তগ্রামের বন্দর প্রায় দুই ক্রোশ দূরে অবস্থিত, নগরের পথে ভীষণ জনতা, দ্রুতপদে চলা অসম্ভব, তথাপি ময়ূখ যথাসম্ভব দ্রুতবেগে চলিতেছিলেন। বন্দরের বাজার পার হইয়া ময়ূখ সপ্তগ্রাম দুর্গের নিম্নে উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান দুর্গদ্বার হইতে নির্গত হইয়া ময়ূখের সঙ্গে চলিতে আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে একটি গৃহের সম্মুখে তিনজন ফিরিঙ্গি দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদিগের মধ্যে একজন কৃষ্ণবস্ত্রাবৃত ও অপর দুইজন সাধারণ সেনা। গৃহের সম্মুখে বসিয়া একজন যুবক কাতর কণ্ঠে কহিতেছে যে, সে হিন্দু, সে খৃষ্টান হয় নাই এবং হইবে না; সে ব্যক্তি মধ্যে মধ্যে কৃষ্ণবসনপরিহিত ফিরিঙ্গীর পদযুগল ধরিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিবার জন্য মিনতি করিতেছে। ফিরিঙ্গি বলিতেছে যে সে কল্য খৃষ্টীয় ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছে, গৃহে থাকিলে তাহার আত্মীয় স্বজন দীর্ঘ নরকবাসের পথ সুগম করিয়া দিবে, সেইজন্য তাহাকে হুগলী যাইতে হইবে। এই সময়ে ময়ূখ ও তাঁহার মুসলমান সঙ্গী সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। মুসলমান ফিরিঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে?” ফিরিঙ্গী কহিল, “আমি ধর্ম্মযাজক, এই হিন্দু কল্য পবিত্র খৃষ্টীয় ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছে, কিন্তু তাহার আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে অদ্য পলাইয়া আসিয়াছে। সেই জন্য আমি তাহাকে হুগলীতে লইয়া যাইতে আসিয়াছি।” মুসলমান যুবককে জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দু, তুমি ইসাই হইয়াছ?” যুবা মুসলমানের পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া কছিল, “দোহাই হুজুরের, হিন্দু ও মুসলমানের ঈশ্বরের দিব্য আমি খৃষ্টান হই নাই। এই পাদ্রী আমাকে জোর করিয়া খৃষ্টান করিতে চাহিয়াছিল বলিয়া আমি হুগলী হইতে সপ্তগ্রামে পলাইয়া আসিয়াছি।”
“পাদ্রী কি মিথ্যা কথা বলিতেছে?” “হাঁ। হুজুর আমাকে রক্ষা করুন।”
তখন মুসলমান পাদ্রীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ফিরিঙ্গি, হিন্দু যাহা বলিল তাহা শুনিলে? তুমি বল প্রয়োগ করিও না, কাজীর নিকটে যাও, এই হিন্দুর উপরে যদি তোমার অধিকার থাকে, তাহা হইলে, কাজী ইহাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিবেন।” পাদ্রী উদ্ধত ভাবে কহিলেন, “আমরা কাজীর বিচারাধীন নহি। এই হিন্দু খৃষ্টান হইয়াছে, আমি এখনই ইহাকে হুগলী লইয়া যাইব।”
“ইহা শাহান শাহ বাদশাহের এলাকা ফিরিঙ্গি,—এখানে, বল প্রয়োগ করিলে তুমি দণ্ডনীয় হইবে।” “আমাকে দণ্ড দিবার ক্ষমতা তোমার বাদশাহের পিতৃপিতামহেরও নাই। তুমি অধিক কথা কহিলে তোমাকে চাবুক লাগাইব।”
ক্রোধে মুসলমানের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, সে নিজের কটিবন্ধ স্পর্শ করিয়া দেখিল যে তাহাতে কোন অস্ত্র নাই। তখন মুসলমান চাহিয়া দেখিল, তাহার সহযাত্রী হিন্দু যুবা তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে। মুসলমান পুনরায় পাদ্রীকে কহিল, “ফিরিঙ্গি তোমার অপরাধ মার্জ্জনা করিতেছি। শাহনশাহ বাদশাহের নামে কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিলে হিন্দুস্থানের আইন অনুসারে শূলে যাইতে হয়। তুমি বিদেশীয়, সম্ভবতঃ আইন কানুন জান না। এই দণ্ডে সপ্তগ্রাম পরিত্যাগ কর নতুবা মরিবে।” ফিরিঙ্গি ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হইয়া কহিল,— “তোর মত বিধর্ম্মী কুক্কুরকে আমরা কারাগারে রাখিয়া শূকর মাংস খাইতে দিই।” মুসলমান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, “ফিরিঙ্গি, তোমার কি মরিতে ইচ্ছা হইয়াছে?” উত্তরস্বরূপ পাদ্রী মুসলমানের শ্মশ্রু ধরিয়া আকর্ষণ করিলেন, মুসলমান ক্ষিপ্ত হইয়া পাদ্রীর প্রশস্ত গণ্ডস্থলে এক বিরাট চপেটাঘাত করিল, স্থূল ক্ষুদ্রকায় লম্বোদর পাদ্রী আঘাতের বেগ সহিতে না পারিয়া গড়াইয় পড়িল। ফিরিঙ্গি সেনাদ্বয় তৎক্ষণাৎ মুসলমানকে আক্রমণ করিল। তখন ময়ূখ একজনের পশ্চাদ্দেশে ভীষণ বেগে পদাঘাত করিলেন, ফিরিঙ্গি তাহার ফলে ভূমি হইতে উঠিয়া পাঁচ হাত দূরে গিয়া পড়িল। তাহা দেখিয়া তাহার সঙ্গী মুসলমানকে ছাড়িয়া বন্দুক ধরিল। পথে অনেক লোক দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা বন্দুক দেখিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। এমন কি, যে হিন্দু যুবার উদ্ধারের জন্য মুসলমান পাদ্রীর সহিত বিবাদ করিয়াছিল সেও গৃহে প্রবেশ করিয়া কবাট রুদ্ধ করিয়া দিল। ফিরিঙ্গি বন্দুক ছুড়িল, ময়ূখ পাশ কাটাইয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিমেষের মধ্যে মুসলমানকে টানিয়া লইয়া পথি-পার্শ্বের এক অশ্বত্থ বৃক্ষের আশ্রয় লইলেন। দ্বিতীয় ফিরিঙ্গির বন্দুকের গুলি তৎক্ষণাৎ আসিয়া বৃক্ষকাণ্ডে বিদ্ধ হইল। ময়ূখ তখন বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে রজত নির্ম্মিত একটি ক্ষুদ্র বন্দুক বাহির করিল। মুসলমান তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা কি?” ময়ূখ বন্দুকটি একজন ফিরিঙ্গী সেনার দিকে ধরিয়া কহিলেন, “ইহা নূতন ধরণের বন্দুক, ইহার নাম পিস্তল।”
তখন বিলাতে পিস্তলের ব্যবহার অল্পদিন আরম্ভ হইয়াছে, একটি দুইটি মাত্র হিন্দুস্থানে আসিয়াছে। পিস্তলের আওয়াজ হইল, একজন ফিরিঙ্গি আহত হইয়া পড়িয়া গেল; তাহা দেখিয়া পাদ্রী ও দ্বিতীয় ফিরিঙ্গি দূরে আর এক বৃক্ষকাণ্ডের পার্শ্বে আশ্রয় লইল। ময়ূখ ছুটিয়া বাহির হইয়া আহত ফিরিঙ্গির বন্দুক কাড়িয়া লইয়া পুনরায় বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময়ে দ্বিতীয় ফিরিঙ্গির বন্দুকের আর একটী গুলি আসিয়া তাঁহার বামহস্তে বিদ্ধ হইল। ময়ূখ তাহা গ্রাহ্য না করিয়া মুসলমানকে কহিলেন, “আপনার বন্দুক ধরা অভ্যাস আছে?” মুসলমান হাসিয়া কহিল, “আছে, আমি যুদ্ধ ব্যবসায়ী।” মুসলমান বন্দুক হাতে লইয়া কহিল, “গুলি ও বারুদ কই?” ময়ূখ কহিলেন, “অপেক্ষা করুন লইয়া আসি।” মুসলমান তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিয়া কহিল, “কাফের, তুমি আহত হইয়াছ, এই বার আমার পালা। ফিরিঙ্গি যদি মুখ বাড়ায় তাহা হইলে গুলি চালাইও। যদি আমি মরি তাহা হইলে ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁকে বলিও যে জহাঙ্গীরী আমলের একজন আমীর ফিরিঙ্গির হাতে মরিয়াছে।” মুসলমান উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া ছুটিয়া বাহির হইল; তাহা দেখিয়া ফিরিঙ্গি যেমন মুখ বাড়াইল অমনই ময়ূখের পিস্তলের গুলি তাহার ললাটে বিদ্ধ হইল। তখন হিন্দুর পরিত্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া স্থূলকায় লম্বোদর পাদ্রী হুগলীর দিকে পলায়ন করিল।
যুদ্ধ শেষ হইয়াছে দেখিয়া ময়ূখ বৃক্ষকাণ্ডের আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া মুসলমানকে কহিলেন, “সাহেব, এখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে গমন করুন, আমি গৃহে চলিলাম।” মুসলমান বন্দুকে বারুদ ভরিতে ভরিতে কহিলেন, “কাফের, তুমি বীর, অদ্য তুমি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ; সুতরাং তুমি আমার দোস্ত। তোমাকে এখন ছাড়িব না, তুমি আমার সহিত কিল্লায় ফিরিয়া চল। তুমি ফিরিঙ্গির রক্তপাত করিয়াছ, সুবা বাঙ্গালা তোমার পক্ষে নিরাপদ স্থান নহে। তুমি কে? কোথা হইতে আসিতেছ?” “সাহেব, বিশেষ কারণে আপনাকে পরিচয় দিতে পারিব না। ফিরিঙ্গি আমার দুষমন্, তাহারা আমার এক আত্মীয়াকে হরণ করিয়া অনিয়াছে; আমি তাহারই উদ্ধারের চেষ্টায় সপ্তগ্রামে আসিয়াছি।”
“যুবক, আমি তোমার পিতার বয়সী, আমার নিকট সত্য গোপন করিয়া ভাল করিতেছ না। তুমি আমার জন্য ফিরিঙ্গি হত্যা করিয়াছ, সুবা বাঙ্গালায় বাস করিতে হইলে, তোমাকে আমার সহিত বাস করিতে হইবে। আমি বাদশাহী নাওয়ারার আমীর, আমার নাম আসদ্ খাঁ।”
যুবা বিম্মিত হইয়া আমীরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, এবং ক্ষণকাল পরে কহিলেন, “খাঁ সাহেব, আপনি আমার পিতৃবন্ধু, আপনার নিকট পরিচয় গোপন করিব না। আমার নাম ময়ূখ, পরগণা বারবক্ সিংহের ভূতপূর্ব্ব জমীদার মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণ রায় আমার পিতা—”
“তুমি দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র! সপ্তগ্রামে আসিয়াছ, আমাকে সংবাদ দাও নাই কেন? অনুপনারায়ণ খানাজাদ্ খাঁর আমলে বারবক সিংহ বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছে, তখন যদি তোমার তরফের কোন উকিল জহাঙ্গীর নগরে উপস্থিত থাকিত, তাহা হইলে তুমি তোমার পিতার জমীদারী পাইতে। তুমি এখন কি করিতেছ?” “সাহেব, শৈশবে মাতৃহারা হইয়াছি, আমার ভ্রাতা ভগিনী কেহই নাই। পিতার মৃত্যুর সময়ে আমার বয়স মাত্র চতুর্দ্দশ বৎসর ছিল, তখন খুড়া মহাশয় গোপনে বাদশাহের সনন্দ আনাইয়া সম্পত্তি দখল করিয়াছেন। পিতার মৃত্যুর পরে চারি বৎসর শাস্ত্র ও শস্ত্র শিক্ষা করিয়াছি, ভাবিতেছিলাম জীবিকা অর্জ্জন চেষ্টায় বাহির হইব, এমন সময়ে ফিরিঙ্গির সহিত বিবাদ বাধিল।”
ময়ূখ ললিতার হরণবৃত্তান্ত আমূল আসদ্ খাঁকে শুনাইলেন। ময়ূখ গোকুলবিহারীর আশ্রয় পাইয়াছেন শুনিয়া আসদ্ খাঁ সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “উত্তম করিয়াছ, গোকুলের ন্যায় পরাক্রান্ত হিন্দু সপ্তগ্রামে কেহ নাই। কিন্তু তুমি এখন একাকী মীনাবাজারে ফিরিতে পাইবে না। আমার সহিত কিল্লায় চল, সেখান হইতে সঙ্গে পাহারা দিয়া পাঠাইয়া দিব।”
ময়ূখ ও আসদ্ খাঁ কিল্লায় ফিরিলেন। ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ আহারান্তে অহিফেণ সেবন করিয়া ঝিমাইতেছিলেন; ময়ূখকে আসদ খাঁ লইয়া ফৌজদারের বারদুয়ারীতে প্রবেশ করিলেন। ভয় পাইয়া বুড়া ফৌজদার চৌকি হইতে পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেল। আসদ্ খাঁ প্রবেশ করিয়াই কহিলেন, “খাঁ সাহেব, এখনই একদল আহদী ও দশটা ভারি তোপ বন্দেলের পথে পাঠাইয়া দাও।” বুড়া আফিম্চী কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “যো হুকুম খোদাবন্দ, কি হইয়াছে?”
“শাহনশাহ বাদশাহ দীন ও দুনিয়ার মালিক নূরুদ্দিন জহাঙ্গীর বাদশাহের রাজ্যে প্রকাশ্য পথে দিনের আলোকে ফিরিঙ্গি আমার উপরে গুলি চালাইয়াছে।” বৃদ্ধ ফৌজদার কাঁপিতে কাঁপিতে পড়িয়া গেল।