ময়ূখ/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
মথুরার পুরোহিত

 সেই দিন তৃতীয় প্রহরে ময়ূখ ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে সিকন্দরপুর মহল্লার একটি ক্ষুদ্র গৃহের দ্বারে করাঘাত করিলেন। ভিতর হইতে বামাকণ্ঠে প্রশ্ন হইল “কে?” “আমি, দুয়ার খোল।”

 পুনরায় বাঙ্গালায় প্রশ্ন হইল “তুমি কে?” “আমি ময়ূখ, ভয় নাই, দুয়ার খোল।”

 এই বার দুয়ার খুলিল, ময়ূখ গৃহে প্রবেশ করিলেন। দ্বারের পার্শ্বে বিনোদিনী দাঁড়াইয়াছিল, সে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, কি হইল?”

 “দেওয়ান-ই-আমে গিয়াছিলাম, বাদশাহ্‌ দেওয়ান ই-খাসে যাইতে হুকুম করিয়াছেন, অদ্য সন্ধ্যাকালে যাইব।” “আমি গোবিন্দজীর পূজা তুলিয়া রাখিয়াছি। বাবা, বাদশাহ্‌ বেগমের বাঁদী আসিয়াছিল, আজি সন্ধ্যাকালে বৃন্দাবন হইতে বাঙ্গালী পুরোহিত আসিবেন। কালি অধিবাস, পরশু বিবাহ।”

 ললিতা দ্বারের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া দরবারের কথা শুনিতে ছিলেন, বিবাহের নাম শুনিয়া ছুটিয়া পলাইলেন। ময়ূখ হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া বসিলেন, তখন বিনোদিনী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, কি বুঝিতেছ?” ময়ূখ বলিলেন, “মা, অদৃষ্ট বোধ হয় ফিরিতেছে, এত দিন আসদ্‌খাঁর সন্ধান করিয়া মরিলাম, আজি দেখি আসদ্‌খাঁ দেওয়ান-ই-আমে উপস্থিত।”

 “কালি দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় আসিবেন।”

 ময়ূখ গৃহে প্রবেশ করিলে, একজন দীর্ঘাকার কাল্‌মক্‌ তাতার ও অবগুণ্ঠনাবৃত এক মুসলমানী গৃহদ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। কাল্‌মক্ দূরে রহিল, রমণী গৃহদ্বারে কান লাগাইয়া কথোপকথন শুনিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণপরে কাল্‌মক্‌ জিজ্ঞাসা করিল, “কি শুনিলি?”

 “বাঙ্গালা মুলুকের বুলি, কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।”

 “মরদ্‌টার নাম কি?”

 “আ মর্‌, তাইত খুঁজিতেছি, সরাবের শিশিটা দে।”

 “আর সরাব খাইলে টলিয়া পড়িয় যাইবি, তখন কোতয়ালীতে ধরিয়া লইয়া যাইবে।”

 রাজধানীর জনাকীর্ণ পথে বহুলোক চলিতেছিল, ক্ষুদ্র গৃহদ্বারে দীর্ঘাকার সশস্ত্র কাল্‌মক্‌কে দেখিয়া কেহ কেহ বিস্মিত হইল; কিন্তু তাহার সহিত রমণীকে দেখিয়া কোনও সন্দেহ করিল না। সেই সময়ে বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “ময়ূখ, তুমি কখন্‌ দেওয়ান-ই-খাসে যাইবে?” ময়ূখ কহিলেন, “সন্ধ্যার পরে।”

 তাহা শুনিয়া দুয়ারের বাহিরে রমণী বলিয়া উঠিল, “দোস্ত, শীঘ্র শিশিটা দে।” কাল্‌মক্‌ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”

 “মোগল বাদশাহের অন্দর মহলের চাকরী, আর বাঙ্গালা মুলুকের জবান, আর মরুভূমি এই তিনই সমান।”

 “কিছু বুঝিলি না কি?”

 “নামটা শুনিয়াছি।” “কি?” “মহুক্‌।” “ঠিক শুনিয়াছিস্ ত?” “ঠিক শুনিয়াছি, তুই শিশিটা দে।” “এখানে দাঁড়াইয়া আর কাজ নাই, তুই পথে চলিয়া আয়।”

 কালমক্ ও তাতারী গৃহদ্বার ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। সন্ধ্যার সময়ে ময়ূখ গৃহত্যাগ করিলেন, কাল্‌মক্ দূরে লুকাইয়া থাকিয়া তাহা দেখিল এবং দূরে থাকিয়া তাহার অনুসরণ করিল। দুই দণ্ড পরে কাল্‌মক্ ফিরিয়া আসিয়া গৃহদ্বারে করাঘাত করিল। ভিতর হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?” কাল্‌মক্‌ কহিল, “হামি।”

 বিনোদিনী প্রশ্ন করিতেছিল, কণ্ঠস্বর শুনিয়া তাহার সন্দেহ হইল, সে দুয়ারের নিকটে আসিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “কে গা?”

 কাল্‌মক্‌ পুনরায় কহিল, “হামি।”

 বিনোদিনী এইবার রাগিল; “তুই কেরে মিন্‌সে?” কাল্‌মক্‌ সাহসে ভর করিয়া কহিল, “হামি মহুক্‌।”

 বিনোদিনী পা টিপিয়া টিপিয়া ফিরিয়া গেল এবং ললিতাকে কহিল, “দেখ ললিতা, এক মিন্সে চোর আসিয়াছে, তুই এক হাঁড়ি পচা গোবর লইয়া ছাদে যা, আমি যখন দুয়ার খুলিব সেই সময়ে মিন্সের মাথায় ঢালিয়া দিবি।”

 ললিতা গোবরের হাঁড়ি লইয়া ছাদে চলিয়া গেলেন। তখন বিনোদিনী গোশালার পুরাতন সম্মার্জ্জনী সংগ্রহ করিয়া আনিয়া দুয়ার খুলিয়া ফেলিল। সেই সময়ে ললিতা বহুদিনের সঞ্চিত কৃমিময় দুর্গন্ধ গোময়রাশি কাল্‌মকের মস্তকে বর্ষণ করিল। তাহার চক্ষু, মুখ ও নাসিকা বন্ধ হইয়া গেল, আর বিনোদিনীর সম্মার্জ্জনী ভীষণবেগে তাহার পৃষ্ঠদেশে পতিত হইল। কাল্‌মক্‌ রণে ভঙ্গ দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 ময়ূখের গৃহের কিঞ্চিৎ দূরে কাল্‌মকের সঙ্গিনী অপেক্ষা করিতেছিল; কালমক্‌ তাহার নিকটে যাইবামাত্র রমণী পূতিগন্ধময় গোময়ের গন্ধে অস্থির হইয়া উঠিল এবং নাকে রুমাল দিয়া কহিল, “পচা গন্ধ লইয়া আসিলি কোথা হইতে? গোরস্থানে গিয়াছিলি না কি?” কাল্‌মক্ নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিতে করিতে কহিল, “বাঙ্গালী বিবি আশিক্‌ করিয়াছে বাঙ্গালা মুলুকের আহল কসমের ইত্তর ঢালিয়া দিয়াছে।”

 গন্ধ সহ্য করিতে না পারিয়া রমণী দূরে সরিয়া দাঁড়াইল এবং কহিল, “তুই তোর বাঙ্গালী বিবির নিকটে ফিরিয়া যা— আমার নিকট আসিলে জুতা খাইবি।”

 কাল্‌মক্ রুমাল দিয়া গোবর মুছিতে মুছিতে কহিল, “তাই ত দোস্ত, এমন মওকাটা মাটি হইয়া গেল। আমি ভাবিয়াছিলাম যে দুয়ার খুলিলেই ঘরে ঢুকিয়া আউরৎ দুইটাকে বাঁধিয়া ফেলিব, রাত্রিতে মরদ্‌টা যখন ফিরিয়া আসিবে তখন তাহাকে ধরিয়া লইয়া অনায়াসে যেখানে খুসী লইয়া যাইব। এখন করি কি?”

 এই সময়ে একজন আহদী মহলসরার একজন পরিচারিকা ও জনৈক বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ ময়ূখের গৃহদ্বারে গিয়া দাঁড়াইল। আহদী গৃহদ্বারে করাঘাত করিল, গৃহমধ্যে বিনোদিনী প্রস্তুত হইয়াই ছিল, সে বলিল, “আবার আসিয়াছিস্?”

 আহদী হিন্দু রাজপুত; সে হিন্দীতে বলিল, “মাইজী, আমি হজরৎ বাদশাহ্‌ বেগমের নিকট হইতে আসিতেছি, বৃন্দাবন হইতে পুরোহিত আসিয়াছেন।”

 ভিতর হইতে বিনোদিনী কহিল, “তুমি যেই হও এখন দাঁড়াও, আমার বেটা বাহিরে গিয়াছে, না আসিলে দুয়ার খুলিব না।”

 পুরোহিত রাত্রি অধিক হইয়াছে দেখিয়া বলিলেন, “মা, তোমার কোন ভয় নাই, আমি বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ; রাত্রি অধিক হইয়াছে, দুয়ার খুলিয়া দাও।” বাদশাহ্‌ বেগমের দাসীও ভরসা দিল, তখন বিনোদিনী দুয়ার খুলিল।

 গৃহদ্বারে দাঁড়াইয়া আহদী জিজ্ঞাসা করিল, “মাইজী, তোমার বেটী কোথায় গিয়াছে?” বিনোদিনী কহিল, “দেওয়ান-ই-খাসে।”

 কাল্‌মক্‌ তাহাদের নিকটে অন্ধকারে লুকাইয়া ছিল। সে এই কথা শুনিয়া সেই স্থান হইতে সরিয়া পড়িল। দূরে বৃক্ষ তলে তাহার সঙ্গিনী লুকাইয়াছিল, সে তাহার নিকটে গিয়া বলিল, “কাজ হাসিল করিয়াছি।”

 রমণী জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে?” “আর কতটা সরাব আছে?” “দুই শিশি।” “একটা শিশি আমাকে দে।” “কেন আগে বল্‌।” “কাজ হাসিল করিয়াছি।” “কি কাজ তাহা বল্‌না।” “মরদ্‌টার পাত্তা পাইয়াছি।” “কি পাত্তা পাইয়াছিস্?” “সে খাস্‌ দরবারে গিয়াছে।” “তবে আর বিলম্ব করিয়া কাজ নাই, তুই আর সরার খাইলে চলিতে পারিবি না। এই বেলা চল্‌, অমরসিংহ ফটকে লুকাইয়া থাকিব।”

 তখন গৃহের মধ্যে বিনোদিনী মথুরার পুরোহিতের অভ্যর্থনা করিতেছিলেন। বিনোদিনী আসন দিলেন, পুরোহিত উপবেশন করিলেন। সেই মুহূর্ত্তে ললিতা পাগলিনীর ন্যায় ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের পদতলে লুটাইয়া পড়িল! সে একবার মাত্র ডাকিল, “তর্করত্ন খুড়া?” তাহার পরে মুর্চ্ছিতা হইয়া পড়িল।