মরমেত
BENGALI FAMILY LIBRARY
গার্হস্থ্য বাঙ্গালা পুস্তক সঙ্গ্রহ।
মরমেত।
অর্থাৎ
মৎস্যনারীর উপাখ্যান।
শ্রীযুক্ত মধুসূদন মুখোপাধ্যায়
কর্ত্তৃক
ইংরাজী ভাষা হইতে
অনুবাদিত।
CALCUTTA.
PRINTED FOR THE VERNACULAR LITERATURE
COMMITTEE,
By Anund chunder Vodantuvagees.
AT THE TUTTOBODHINEE PRESS.
1857
Price & Pice. মূল্য ৶৫ নয় পয়সা
অল্প বয়স্কা মরমেত অর্থাৎ মৎস্য
নারীর বিষয়।
সমুদ্রের অতি দূরস্থিত যে জল, তাহা চনকাদি শস্য ক্ষেত্রের ন্যায় নীল বর্ণ, এবং স্ফটিকবৎ নির্ম্মল। উহা অতলস্পর্শ, অর্থাৎ এমত গভীর, যে অতি দীর্ঘ রজ্জুতে প্রস্তর বন্ধন করিয়া নিক্ষেপ করিলে তাহা উহার তলায় নিমগ্ন হইতে পারে না। উহার অধোভাগে একটি মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া তচ্চূড়াতে আর একটি, ক্রমশঃ এই রূপ উপর্য্যুপরি সহস্র সহস্র মন্দির নির্ম্মাণ করিলেও পূর্ব্বোক্ত সমুদ্রের উপরি ভাগকে স্পর্শ করিতে পারে না। ইহাই মৎস্য নরের বাসস্থান[১]।
সমুদ্রের নিম্ন ভাগটা যে কেবল শ্বেত বর্ণ বালুকাময় স্থান, এমত বিবেচনা কখনই কর্ত্তব্য নহে। তত্রস্থ ভূমি সকলের মধ্যে এমত আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য বৃক্ষ লতাদি ও পুষ্প সকল জন্মায়, এবং তাহাদের পত্র ও বোঁটা গুলীন এমত নমনীয় যে মদোন্মত্ত লোক দিগের ন্যায় অত্যল্প সমুদ্রের হিল্লোলে তাহারা রক্তিম বর্ণ হইয়া আলোড়িত হইতে থাকে।
পৃথিবীস্থ বৃক্ষ গণের শাখোপরি যেমন পক্ষীর এক ডাল হইতে অন্য ডালে গিয়া নানা প্রকার কেলী করিয়া বেড়ায়, তত্রস্থিত বৃক্ষ গণের উপরিভাগে মৎস্যেরাও সেই রূপ করিয়া থাকে। তত্রস্ত বালুকার মধ্যে যে স্থানটি অতি গভীর, সেই স্থানই সমুদ্রবাসী মহারাজের বাস স্থান। আহা! ঐ রাজ প্রাসাদের শোভার কথা কি বলিব, তাহার প্রবাল নির্ম্মিত প্রাচীর, এবং সুদীর্ঘ জানালা সকল চন্দরূষ অম্বরাদি গন্ধদ্রব্য দ্বারা নির্ম্মিত, নানা প্রকার কস্তূরা দ্বারা ঐ বাটীর ছাদ প্রস্তুত হইয়াছে, সমুদ্র জলের বেগানুসারে ঐ কস্তূরা কখন খোলা থাকে, কখন বা বন্ধ হইয়া যায়। আহা! তাহার কি সৌন্দর্য্য প্রত্যেক কস্তূরার ভিতরে এক একটা মুক্তা শোভিত আছে, সে আবার সামান্য মুক্তা নহে, পৃথিবীস্থ অতি প্রধানা রাজমহিষী দিগের গলদেশস্থ মুক্তার মালাতেও তেমন মুক্তা নাই।
সমুদ্রবাসী মহারাজার স্ত্রী বিয়োগ হওয়াতে অনেক কাল অবধি তিনি বিবাহ করেন নাই, বাটীর সমুদায় গৃহ কর্ম্মের ভার তাঁহার বৃদ্ধা মাতার উপরে অর্পিত ছিল। তিনি যথা নিয়মে কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিয়া সকল বিষয়ে কর্ত্ত্রী হইয়া ছিলেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমতী হইলেও সদ্বংশ জাতা জানাইবার নিমিত্ত অত্যন্ত অভিমানিনী হইয়া চিহ্ন স্বরূপ আপন লাঙ্গূল মধ্যে দ্বাদশটা কস্তূরা ধারণ করিতেন। তন্নিবাসী আর আর ভদ্র লোকে ছয় টা কস্তূরার অধিক ধারণ করিতে পারিত না। কিন্তু আর সকল বিষয়েই রাজ মাতা প্রশংসনীয়া ছিলেন, বিশেষতঃ তাঁহার পৌত্রী অত্যল্প বয়স্কা রাজ কন্যা দিগের প্রতি তাঁহার অতিশয় অনুরাগ ছিল। রাজার ছয় কন্যা, ছয়টিই সুন্দরী; কিন্তু কনিষ্ঠাটি সর্ব্বাপেক্ষা পরম রূপসী ছিল। গোলাপ পুষ্পের পাপড়ি যেরূপ কোমল এবং নির্ম্মল হইয়া থাকে, তাহার চর্ম্মও সেই রূপ কোমল এবং নির্ম্মল ছিল। অতি গভীর সমুদ্রের জল যেরূপ নীলবর্ণ হয়, তাহার চক্ষু দ্বয়ও সেই রূপ নীল বর্ণ ছিল, কেবল অন্যান্য রাজবালাদিগের ন্যায় তাহার পাদ দ্বয় ছিল না, তাহার শরীরের অধোভাগটি মৎস্য পুচ্ছের ন্যায় ছিল।
ঐ রাজ কুমারী গণ রাজ বাটীর বিস্তারিত কুঠরী সকলের মধ্যে সমস্ত দিনই ক্রীড়া করিয়া বেড়াইত, কেহ তাহাতে প্রতিবন্ধক হইত না। সেই কুঠুরীর প্রাচীর মধ্যে উত্তমোত্তম পুষ্প ছিল। আমরা যেমন জানালা খুলিয়া রাখিলে চড়াই পক্ষীরা আমাদিগের গৃহ মধ্যে প্রবেশ করে, সেই রূপ মৎস্যেরাও প্রবাল নির্ম্মিত দ্বার দিয়া তাহাদের গৃহ মধ্যে সন্তরণ করিয়া বেড়াইত। চড়াই পক্ষীগণ আমাদিগের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করত যেরূপ চাউল ধান্য প্রভৃতি শস্য আহার করিয়া পলায়, নিকটে আইসে না। মৎস্যেরা সেরূপ করিত না, তাহারা ঠিক সোজা রাজতনয়া দিগের ক্রোড় পর্য্যন্ত গমন করিয়া তাহাদের হস্ত মধ্যে যে সকল খাদ্য সামগ্রী থাকিত, তাহাই ভক্ষণ করিত। রাজ কন্যারা তাহাদের পৃষ্ঠ দেশে হস্ত বুলাইয়া দিলেও তাহারা কিছু ভয় পাইত না।
রাজ বাটীর সম্মুখ ভাগেই একটা প্রকাণ্ড উদ্যান ছিল, তন্মধ্যে লাল এবং নীলবর্ণের গাছ ছিল, তাহাতে যে সকল ফল ফলে, তাহা স্বর্ণবৎ অর্থাৎ কাঁচা হরিদ্রা বর্ণ, ঝক্ মক্ করিয়া থাকে। মুকুল গুলীন অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় দেদীপ্যমান, দাঁটা এবং পত্র গুলীন সর্ব্বদা ঝন্ ঝন্ শব্দ করিতে থাকে, ভূমির উপরিভাগটা সুকোমল বালুকা দ্বারা আচ্ছাদিত আছে বটে, কিন্তু গন্ধক জ্বালাইলে তাহার শিখা যেরূপ নীল বর্ণ হয়, ঐ বালি সেই রূপ নীল বর্ণ ও সমুদায় আকাশ মণ্ডলও বিশেষ এক প্রকার নীলবর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত আছে, অতএব তাহারা যদি ঐ সমুদ্রের অধোভাগে গমন করিয়া চতুর্দ্দিকস্থ বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তবে জলের অধোদেশে আছি এমন বোধ করিতে পারে না, নীচে নীলবর্ণ এবং উপরেও নীলবর্ণ দেখিয়া তাহাদের বোধ হয়, যেন আমরা অতি উর্দ্ধে শূন্য মার্গে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছি, আমাদের উপরি ও অধোভাগে নীলাক্ত মেঘ সকল রহিয়াছে। তাহারা দেখে যেন দিনকর একটি রক্ত কমলের ন্যায়, উহার পুষ্প কোষ হইতে অল্প অল্প আভা বাহির হইতেছে।
প্রত্যেক রাজকন্যারই উদ্যান মধ্যে এক একটু ক্ষেত্র নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহাতে খনন অথবা বীজ রোপণ যে যাহা ইচ্ছা করিত, তাহাই করিতে পারিত। একদা একজন আমার রোপিত বৃক্ষের ফুল সকলের আকার যেন তিমি মৎস্যের ন্যায় হয়, ইহা বলিয়া বীজ রোপণ করিল, আর একজন মৎস্য নারীর আকারকে শ্রেষ্ঠ বোধ করিয়া তাহাই মনে করিয়া আপনার বীজ গুলীন রোপণ করিল, সর্ব্ব কনিষ্ঠা রাজতনয়া আপনার ক্ষেত্র মধ্যে সূর্য্যমণ্ডলের ন্যায় একটা গোলাকার করিয়া তাহাতে রক্ত বর্ণ ফুল ফুটে এমত বীজ রোপণ করিল, কারণ সমুদ্রের ভিতরে থাকিয়া সে সূর্য্যকে রক্ত বর্ণ দেখিয়া ছিল। ঐ বালিকার চরিত্র আর আর রাজ বালাদিগের ন্যায় নহে। সে অতি ধীরা এবং বুদ্ধিমতী ছিল, অন্যান্য ভগিনীদিগের ন্যায়, সে কোন আশ্চর্য বস্তু প্রাপ্ত হইলে অতিশয় আহ্লাদিতা হইত না। জাহাজ ভগ্ন হইলে যে সকল বস্তু সমুদ্র জলে নিমগ্ন হইয়া যায়, পূর্ব্বে কখন দেখে নাই বলিয়া ঐ সকল বস্তুকে তাহারা আশ্চর্য্য বোধ করিত, কনিষ্ঠা রাজকন্যা আকাশস্থ সূর্য্যের ন্যায়, আপনার রক্ত বর্ণ ফুল সকল লইয়া সর্ব্বদা আমোদ প্রমোদ করিত। একবার একখান জাহাজ চড়ায় লাগিয়া ভগ্ন হওয়াতে তাহার মধ্যস্থিত এক যুবাপুরুষের শ্বেতবর্ণ প্রস্তরে খোদা একটি প্রতিমূর্ত্তি ঐ সমুদ্র জলে নিমগ্ন হইয়া যায়, ঐ প্রতিমূর্ত্তি খানি পরমরূপসী কনিষ্ঠা রাজকন্যার নিকটে ছিল। ঐ প্রতিমূর্ত্তি ব্যতিরেকে সে আর কিছুই চাহিত না। উহারই প্রতি তাহার অত্যন্ত শ্রদ্ধা ছিল।
বালিকা নিজে সমুদ্র বাসিনী অতএব পৃথিবীর উপরিস্থিত জীব জন্তু ও আর আর বস্তু বিষয়ক বিবরণ শুনিতে অত্যন্ত ভাল বাসিত, পিতামহীকে প্রেমভাবে সর্ব্বদা জিজ্ঞাসা করিত, দিদি! তুমি জাহাজ, নগর, লোক এবং জন্তু বিষয়ে যাহা যাহা জান তাহা আমাকে বল। এই কথাতে রাজমাতা বলিলেন, পৃথিবীস্থ পুষ্পগণ হইতে নানা প্রকার রমণীয় সৌরভ নির্গত হয়, ইহা শুনিয়া রাজবালা তথাকার ফুল সকল অবশ্যই পরম সুন্দর হইবে, এই বিবেচনাতে তাহাদের কতই বা প্রশংসা করিল। আর সমুদ্রের অধোভাগস্থ ফুল হইতে সদ্গন্ধ বাহির হয় না বলিয়া মনে মনে কতই দুঃখ করিল। তাহার পিতামহী আরও বলিলেন যে তত্রস্থ অরণ্য সকল হরিদ্বর্ণ, তন্নিবাসী মৎস্যেরা[২] এমনি মধুর স্বরে গীত গায় যে তাহা শুনিয়া পাষাণ চিত্ত মানবের মন আর্দ্র হইয়া উঠে। তুমি পনেরো বৎসর বয়স্কা হইলে তোমার পিতা তোমাকে সমুদ্র হইতে বাহির হইয়া উপরে উঠিতে আজ্ঞা করিবেন, তাহা হইলেই তুমি অনায়াসে কোন চড়ার উপর বসিয়া জ্যোৎস্না কালীন যখন প্রকাণ্ড বৃহৎ বৃহৎ জাহাজ সকল তোমার নিকট দিয়া গমনাগমন করিবে, তাহা দেখিয়া তুমি উল্লসিত হইবে। আর সেই সময়ে পৃথিবীর মধ্যে যে যে নগর ও বন আছে, তাহাও দেখিতে পাইবে।
পর বৎসরে তাহাদের একটি ভগিনী অর্থাৎ সর্ব্ব জ্যেষ্ঠা পনের বৎসর বয়স্কা হইবে, তাহার মধ্যমা ভগিনী তাহা হইতে এক বৎসরের ছোট, তৃতীয়াটি আবার দ্বিতীয়া হইতে বয়সে এক বৎসর ন্যূন, এমতে আর অন্য দুটি ঐরূপ বয়সে এক এক বৎসরের ন্যূন ছিল। অতএব পাঁচ বৎসর বিলম্ব না করিলে সর্ব্ব কনিষ্ঠা রাজকন্যা সাগরের অধোভাগ হইতে বাহির হইয়া আমাদের এ পৃথিবী কি প্রকার তাহা দেখিতে পাইবে না। যাহা হউক জ্যেষ্ঠা ভগিনীর পালা উপস্থিত হইলে, সে অন্য সকলের নিকট স্বীকার করিল, আমি প্রথম দিবস জলের উপরি ভাগে গমন করিয়া যে যে সুন্দর সুন্দর বস্তু দর্শন করিব, তথা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া সে সকল বিষয় আমি অবিকল তোমাদের নিকট বর্ণন করিব, পৃথিবীস্থিত বস্তু বিষয়ে তাহাদের পিতামহী যথেষ্ট বর্ণনা করেন নাই, একারণ অনেক বিষয় তাহাদের জানিবার প্রয়োজন ছিল। কনিষ্ঠা রাজতনয়া একে লজ্জাশীলা ও সদ্বিবেচিকা, অনেক দিন অপেক্ষা করিতে হইবে বলিয়া, করে আমায় পালা আসিবে এই প্রত্যাশায় আত্যন্তিক আকাঙ্ক্ষিণী হইয়া রহিল। তাহার মত কেহই অমন আপেক্ষিণী হইয়া ছিল না। মাসের মধ্যে অনেক বার রাত্রিকালে সে জানালার দ্বার মোচন করিয়া তাহার সমীপে দণ্ডায়মানা হওত ঊর্দ্ধ দৃষ্টে নীলবর্ণ জলের প্রতি অবলোকন করিত, মৎস্যেরা আপনাদিগের পুচ্ছ ও কাণকোয়া দ্বারা চটাৎ চটাৎ শব্দ করত জলে আঘাত করিলে, সে তাহাই নিরীক্ষণ করিত। আমারা পৃথিবীতে বাস করিয়া রাত্রিকালে চন্দ্র এবং তারা সকলকে যত বড় না দেখি, সে জলের মধ্যে বসতি করিয়া আমাদের অপেক্ষা অধিক বড় দেখিতে পাইত। কেবল আমরা যেমন ঐ জ্যোতির্ম্ময় পদার্থ সকলকে পরিদীপ্যমান দেখি সে তেমন দেখিতে পাইত না, কিছুমলিন দেখিতে পাইত। কাল মেঘের ন্যায় কোন বস্তু তাহার এবং তারার মধ্যবর্তী হইয়া গমন করিলে সে মনে মনে বিবেচনা করিত, অবশ্যই ইহা তিমি মৎস্য আমার উপরিভাগে সমুদ্র জল মধ্যে সন্তরণ করিয়া বেড়াইতেছে, অথবা মনুষ্য পূর্ণ জাহাজ সকল সমুদ্রের উপরিভাগে গমনাগমন করিতেছে। কি আশ্চর্য্য! ঐ অর্ণব পোত নিবাসী কোন ব্যক্তি স্বপ্নেও এমন বিবেচনা করে না, যে সাগরের অধোভাগে এক মৎস্যনারী দণ্ডায়মানা হইয়া আপন শ্বেতবর্ণ হস্ত দুটী তাহাদের জাহাজের প্রতি বিস্তারিত করিতেছে।
সম্প্রতি রাজার জ্যেষ্ঠা কন্যা পোনের বৎসর বয়স্কা হইলে মহারাজ আজ্ঞা করিলেন, তুমি সমুদ্রের উপরিভাগে গমন করিয়া তত্রস্থ মনোহর পদার্থ সকল অবলোকন কর, পিতৃ আজ্ঞায় রাজকন্যা সাগল্প তট পর্য্যন্ত যাইয়া তথা হইতে প্রত্যাগমন করত, আপনার ভগিনীদিগের নিকট বর্ণনা করিতে লাগিল, আমি অর্ণব তটে গমন করিয়া যেঽ আশ্চর্য্য বিষয় অবলোকন করিয়াছি, তন্মধ্যে পরমসুন্দর একটি বিষয় এই, বায়ু স্থির হইলেই সমুদ্রস্থ সকল জলই স্থির হইয়া যায়, তখন দূরর্ত্তী নগর সকলকে উত্তমরূপে দর্শন করিবার কোন বাধা থাকে না, বালুকা ময় তটোপরি উপবেশন করিয়া দেখিলাম, আকাশমগুলে সহস্র সহস্র নক্ষত্র উদয় হইলে যেরূপ পরিদীপ্তিমান হয়, সমুদ্রের তটবর্ত্তী একটা বিস্তারিত নগর হইতে সেইরূপ আলোক বহির্গত হইতেছে; তথায় নানা প্রকার অতি মনোরম বাদ্য বাজিতেছে; এত শকট যাইতেছে, যে গাড়ীর শব্দে কাণপাতা যায় না, লোকের এত ভিড়, যে যাতায়াতের ধূম ধামে শরীর লোমাঞ্চিত হইয়া উঠে; আহা! সেখানকার মন্দিরের চূড়া সকলই বা কত উচ্চ, তাহাতে যে ঘণ্টা ধ্বনি হইতেছে, তাহা শুনিতে কেমন সুন্দর, আমি সমুদ্রের বালুকাময় তটে অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত বিলম্ব করিয়া এই সকল আশ্চর্য্য বিষয় দর্শন করণে আপেক্ষিণী হইয়া রহিলাম, কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও নিকটে যাইতে পরিলাম না।
রাজকন্যার কনিষ্ঠা ভগিনী মনঃসংযোগ করত এই সকল বিবরণ শ্রবণ করিয়া সন্ধ্যাকালের কিছু ক্ষণ পরে আপনার জানালার দ্বার উদ্ঘাটন পূর্ব্বক তথায় দাঁড়াইয়া রহিল, প্রগাঢ় নীলবর্ণ সমুদ্র জলের প্রতি দৃষ্টি করিতে করিতে ভগিনী প্রমুখাৎ যে যে বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছে, মনে২ সেই বিস্তারিত নগর, লোকের কলরব এবং বাদ্যের কোলাহল আন্দোলন করিতে লাগিল, আর অনুমান করিল যেন সমুদ্রের অধোভাগে থাকিয়াও আমি মন্দিরস্থ ঘণ্টার শব্দ শুনিতে পাইতেছি।
পর বৎসর রাজা আপন মধ্যমা কন্যাকে অনুমতি করিলেন, তুমি সমুদ্রের উপরিভাগে গমন করিয়া আপন ইচ্ছানুসারে সন্তরণ করিতে পার। পিতৃ আজ্ঞায় রাজতনয়া সূর্য্যাস্ত সময়ে সমুদ্রের উপরিভাগে গেল, গিয়া দেখে যে দিবাকর অস্তাচলে উপবেশন করিতেছেন, তাহাতে যে শোভা হইয়াছে এমত সৌন্দর্য্য সে জন্মাবধি দেখে নাই। সে তথা হইতে প্রত্যাগত হইয়া আপন ভগিনীদিগকে কহিতে লাগিল, আহা! সূর্য্যাস্ত কালীন দেখিলাম যে সমুদায় আকাশটা একেবারে স্বর্ণের ন্যায় অর্থাৎ কাঁচা হরিদ্রার বর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, মেঘ সকলের সৌন্দর্য্যের কথা কি বলিব, বর্ণনে রসনার সাধ্যাতীত হয়, লেখনী ও পরাভব মানে। লোহিত এবং ধূমল বর্ণের মেঘ সকল আমার মস্তকের উপর দিয়া গমনাগমন করিতেছিল, এক পাটা সাদা উড়নীর মত কতক গুলা শুভ্রবর্ণ বকপক্ষী সমুদ্র পার হইয়া অস্তাচল নিবাসী সূর্য্যের নিকট উড়িয়া যাইতেছিল। মনে মনে বাসনা করিলাম, আমিও সন্তরণ করিয়া সূর্য্যের নিকট গমন করি, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ যাইতে যাইতে দিনকর একেবারে অধোগমন করিলেন, তাহাতে তাঁহার অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য আর আমার নয়ন গোচর হইল না, আকাশ এবং জল হইতে সকল বর্ণই এককালীন বিলুপ্ত হইয়া গেল।
পর বৎসর তৃতীয়া কন্যাও ঐ প্রকার আজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া সমুদ্রের উপরিভাগে গমন করিয়াছিল। অন্যান্য ভগিনী অপেক্ষা সে নিজে সাহসিকা ছিল, এজন্য সমুদ্রেতে যে একটা নদীর মুখ মিলিত ছিল, সন্তরণ দ্বারা সে সেই নদী পর্য্যন্ত যাইয়া দেখিল যে হরিদ্বর্ণ পাহাড় সকল আঙ্গুর লতাতে আচ্ছাদিত, এবং নগরস্থিত বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র দুর্গ সকল, বিস্তারিত অরণ্যের মধ্য হইতে অল্প অল্প দেখা যাইতেছে, পক্ষীগণ মধুর স্বরে গান করিতেছে, তৎকালে সূর্য্যের উত্তাপ এমন প্রখর ছিল যে সে তাহাতে তাপিত হইয়া বারম্বার জলমধ্যে অবগাহন করিতে লাগিল, যেন তদ্দ্বারা তাহার তাপিত বদন স্নিগ্ধ হইয়া পড়ে। তৎ সংযুক্ত আর একটি ক্ষুদ্র নদীতে গমন করিয়া দেখে যে কতকগুলীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অল্প বয়স্ক বালক স্রোতো মধ্যে বিবস্ত্র হইয়া জল ক্রীড়া করিতেছে। সে ঐ শিশু দিগকে দর্শন করিয়া তাহাদের সহিত খেলাইবার উদ্যোগ করিলে শিশু গুলীন ভয় পাইয়া পলাইয়া গেল, তাহাতে একটা কাল জন্তু তাহার নিকটে গমন করত উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। সেটা কুকুর, ভেউ ভেউ করিতে ছিল। কিন্তু যাবজ্জীবন মৎস্যনারী কুকুর কখন দেখে নাই, অতএব, ও যে কুকুর সে তাহা কি প্রকারে জানিবে। বোধ হয় তৃতীয়া রাজকন্যা পূর্ব্ব দৃষ্ট এই সকল বস্তু গুলীন কখন ভুলিবে না।
চতুর্থ ভগিনীর পালা উপস্থিত হইলে সে সাহসহীনা প্রযুক্ত সমুদ্রের মধ্যভাগ ভিন্ন অধিক দূর যাইতে পারে নাই, তথা হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া আপন ভগিনী দিগকে বলিল, আমি সাগরের যে অংশে গিয়াছিলাম তাহা অতি রম্য স্থান, সে খান হইতে চতুর্দ্দিকস্থ দূরবর্ত্তী বস্তু সকল দৃষ্টি গোচর হয়, মস্তকের উপরি ভাগে আয়ণার ভিতর ঘণ্টার প্রতিবিম্ব যেরূপ দৃশ্যমান হইয়া থাকে আকাশকেও সেইরূপ দেখিলাম। আমি অনেকানেক জাহাজ দেখিয়াছি বটে কিন্তু তাহা অধিক দূরে ছিল বলিয়া তাহাদিগকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় দেখিয়াছি। আর একটি আশ্চর্য্য বিষয় দেখিলাম, গোটাকতক শিশুনার অর্থাৎ শুশুক লেজ নাড়িয়া ক্রীড়া করিতেঽ জল উলটীয়া কিয়দংশ শরীর দেখাইরার পরে তিলেক মধ্যে ডুবিয়াগেল। কতক গুলা তিমি মৎস্য আসিয়া নাশারন্ধ্র দ্বারা এমনি পিচকারি মারিতে লাগিল, তদ্দৃষ্টে বোধ হইল যেন শত শত ফোয়ারা হইতে জল উঠিতেছে[৩]।
এইবার পঞ্চমা ভগিনীর পালা। শীতকালে তাহার জন্ম দিন, একারণ আর আর ভগিনী সমুদ্রোপরি উত্থিত হইয়া যে যে বস্তু না দেখিয়া ছিল, তাহা তাহার দৃষ্টি গোচর হইল। তথা হইতে প্রত্যাগত হইয়া সে আপন ভগিনী দিগকে বলিল, দেখিলাম সমুদ্রের জল একেবারে সম্পূর্ণ রূপে হরিদ্বর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, জল জমাট হওয়াতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বরফের চাপ সকল সমুদ্রোপরি ভাসিতেছে, প্রত্যেক খণ্ডই মুক্তার ন্যায় উজ্জ্বল, মনুষ্যেরা বুদ্ধি কৌশলে যে মন্দির নির্ম্মাণ করে, ইহা তদপেক্ষাও বৃহৎ। তাহাদের আকৃতি বড় একটা উত্তম নহে বটে, কিন্তু হীরার ন্যায়, ঝিক্ মিক্ করিতেছে। তাহার মধ্যে যেটা অতি প্রকাণ্ড আমি তাহারই উপরে বসিলাম, তথা হইতে দৃষ্ট হইল যেন জাহাজ স্থিত নাবিক গণ ভয় পাইয়া বায়ুভরে নিজ নিজ জাহাজ সকলকে বেগে চালাইতেছে, আমি যে স্থানে বসিয়া ছিলাম, সে স্থানে আসিতে তাহাদের বড় শঙ্কা হইল। পবন দেব সত্বর বেগে আমার দীর্ঘ কেশে পতিত হইয়া, চুল গুলী আলু থালু করিয়া ফেলিলেন। দিবাবসান কালে দেখিলাম শূন্য মার্গ মেঘ দ্বারা আচ্ছন, একেবারে ঘোরাল হইয়াছে, ঘন ঘন সৌদামিনী চপলভাবে দীপ্তিমতী হইতেছে, বজ্রাঘাতের শব্দই বা কি, তাহাতে নীলবর্ণ সমুদ্রবারি আলোড়িত হইয়া ঐ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বরফ চাপকে উর্দ্ধে নিক্ষেপ করিতেছে, বিদ্যুতের লোহিত আভায় ঐ বরফের চাপ সকলও উজ্জ্বল হইয়া অতি সুদৃশ্য হইতে লাগিল। জাহাজের পাল গুটাইয়া মাস্তুলে জড়াইয়া দিল, ভয়েতে আরোহী লোকেরা কম্পিত, আমি স্থির ভাবে পূর্ব্বোক্ত বরফের উপর উপবেশন করিয়া, উজ্জ্বল সমুদ্রের সলিলোপরি বক্র ভাবে যে তড়িৎ পড়িতে ছিল, তাহাই দেখিতে লাগিলাম।
প্রথমতঃ যখন রাজ কন্যারা একে একে সমুদ্র জলের উপরিভাগে উঠে, তখন নূতন নূতন আশ্চর্য্য বস্তুর সৌন্দর্য্যাবলোকনে তাহারা একেবারে মোহিত হইয়া ছিল, কিন্তু বয়োবৃদ্ধি হইলে মহারাজা যখন আজ্ঞা দিয়া কহিলেন, আমি তোমাদিগকে স্বাধীনতা প্রদান করিতেছি, তোমরা যতবার ইচ্ছা ততবার সমুদ্রের উপরিভাগে গমন করিতে পার, তখন তাহাদের ঐ প্রকার ভ্রমণে আর অনুরাগ রহিল না, জলোপরি যাইতে তাহারা বিরক্তি প্রকাশ করিল, সময়ে সময়ে পৃথিবীস্থ পদার্থ দেখিতে উঠিয়া যাইত বটে, কিন্তু গিয়াও তাহাদের সুখ বোধ হইত না। পুনর্ব্বার আধোভাগে গমন করিতে তাহাদের অত্যন্ত বাসনা হইত, একদা তাহারা সকলেই একবাক্য হইয়া বলিল যে উপরিভাগ অপেক্ষা আমাদের বসতি স্থান অধোভাগটি অধিক সুন্দর, অতএব গৃহে বাস করা আমাদের পক্ষে অধিক সুখ জনক হয়।
এক একবার সন্ধ্যা কালে পাঁচটি ভগিনীতে পরস্পর হাতে হাতে বন্ধন করত সারি সারি পাঁচ জনেই একেবারে জলের উপরিভাগে উঠিত। সকলেরই অতি মিষ্ট স্বর, মানব জাতির স্বরের সহিত তাহাদের স্বরের তুলনা করিলে মানব জাতীয় স্বরকে তদপেক্ষা অপকৃষ্ট বলিতে হয়। ঝড় আসিতেছে জানিতে পারিলে তাহারা অগ্রেই অনুমান করিত, এবার একখান জাহাজ ডুবিতে পারে, অতএব সন্তরণ দ্বারা ঐ জাহাজের অগ্রে গমন করিয়া সমুদ্রের অধোদেশে যে যে আনন্দোৎপত্তি হইবে; তদ্বিষয়ে অতি মনোহর গীত গাইত, আর সমুদ্র গামী নাবিকদিগের নিকটে প্রার্থনা করিত তোমরা সমুদ্রের অধোভাগে আসিতে ভয় করিওনা। কিন্তু নাবিকগণ তাহাদের কথা বুঝিতে না পারিয়া ভ্রম বশতঃ বিবেচনা করিত ইহা ঐ ঝড়েরই শব্দ; জলের নিম্ন দেশে কি কি আছে তাহা তাহাৱা কখনই দেখে নাই। কেননা জাহাজ জল নিমগ্ন হইলে মনুষ্যেরা ডুবিয়া মরে, ইহাতে কেবল তাহাদের মৃতদেহ সকল সমুদ্রীয় রাজার বাটীতে পৌঁছে, জীবিত না থাকিলে তাহারা সেখানকার সৌন্দর্য্য কিরূপে অনুভব করিবে।
ভগিনী গুলীন হাতা হাতী করিয়া জলের উপরিভাগে উঠিলেই কনিষ্ঠাটি একাকিনী দণ্ডায়মান হওত তাহাদের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে কতই ক্রন্দন করিত, মৎস্যনারী দিগের চক্ষু হইতে অশ্রু পতন হয় না, এজন্য তাহারা অন্তঃকরণে অধিক দুঃখ সহ্য করিয়া থাকে।
আহা! সে আক্ষেপ করিয়া বলিত পনের বৎসর বয়স্কা হইতে আমার অত্যন্ত বাসনা হয়, আমি নিশ্চিত বলিতে পারি, তাহা হইলেই উপরিস্থিত জগৎ এবং পৃথ্বী বাসী লোকদিগকে আমি অধিক প্রেম করিব।
এইরূপে কিছুকাল পরে ঐ কনিষ্ঠা রাজতনয়া পঞ্চদশ বর্ষ বয়স প্রাপ্ত হইলে তাহার পিতামহী তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ওগো এক্ষণে তুমি বয়স্থা হইয়াছ, আইস তোমার আর আর ভগিনী দিগের ন্যায় তোমাকেও আমি উত্তম পরিচ্ছদ পরাইয়া দি। ইহা বলিয়া কেশ গুলীন বিনাইয়া শ্বেত্ত পদ্মের মালা এক ছড়া তাহাতে পরাইয়া দিলেন, অর্দ্ধ মুক্তা সদৃশ তাহার এক একটি পাবড়ী উজ্জ্বল, আহা! ইহাতে তাহার, কতই শোভা হইল। পরে বৃদ্ধা ভৃত্যকে আজ্ঞা করিলেন, ইনি আমার অতি প্রেয়সী কন্যা অতএব আটটা বৃহৎ বৃহৎ কস্তূরা শঙ্খ আনাইয়া ইঁহার লাঙ্গূলে বাঁধিয়া দেও। ভৃত্য তাহাই করিল। অল্পবয়স্কা মৎস্যনারী কনিষ্ঠা রাজকন্যা কহিল ওগো দিদি ইহাতে আমার যে বড় ক্লেশ বোধ হইতেছে। বৃদ্ধা রাণী কহিলেন, ক্লেশ হইতেছে তা কি হবে, অভিমান সকল ক্লেশের মূল, অভিমান থাকিলেই ক্লেশ সহ্য করিতে হয়।
আহা! ঐ সকল বৃথা জাঁক জমক পরিত্যাগ করিলে সে কতই বা সুখী হইত, অতি ভারি ফুলের মালা ছড়াটা তাহার পক্ষে কি, তাহার বাগানে রক্ত বর্ণের যে সকল ফুল ফোটে তাহাতে তাহার অধিক শোভা হয়। জলবুদ্বুদের ন্যায় সে অল্পেঽ সমুদ্রোপরি উঠিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিল আমি এক্ষণে পিতার নিকট হইতে বিদায় হইয়া আসিয়াছি। পরে ঢেউর উপরে মস্তক তুলিয়া দেখে, সুর্য্যদেব অস্তাচলে গমন করিয়াছেন, তাঁহাকে আর কোন মতেই দেখিতে পাওয়া যায় না, কিন্তু মেঘ সকল অল্প অল্প রক্তিমবর্ণ দেখাইতেছে, আমারদিগের ধুতির ফুঁপিতে যেমন আমরা ভিন্ন ভিন্ন পাড় লাগাইয়া থাকি সেইরূপ মেঘের চতুর্দ্দিকস্থ কিনারাও সোণার বর্ণে বর্ণিত হইয়াছে, সমুদায় শূন্যমার্গটা একেবারে গোলাপী রঙ্গের আভাযুক্ত, কিন্তু তাহা শীঘ্র২ বিলুপ্ত হইতেছে। এতাদৃশ সৌন্দর্য্যে শোভিত হইয়া সন্ধ্যা প্রকাশমানা হইলেন। অল্পঽ শীতল বায়ু বহন হইতেছে, সমুদ্রে স্থির জল, কোন প্রকার উপপ্লব নাই। তিনটা মাস্তুল যুক্ত একটা প্রকাণ্ড জাহাজ জলের উপরিভাগে রহিয়াছে; কিছুমাত্র বায়ু সঞ্চালন না হওয়াতে কেবল একটি মাত্র পাল উঠান আছে, নাবিকগণ মাস্তুলে বাঁধা রদ্ধ নির্ম্মিত শিড়ির উপরে চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া বসিয়াছে। নানা প্রকার যন্ত্র সংমিলন দ্বারা বিবিধ প্রকার বাদ্য বাজিতেছে, গীতের বা কতই মনোহর স্বর; সন্ধ্যাতীত হইলে অন্ধকার হইয়া রাত্রি উপস্থিত হইল, এমন্ত সময়ে আরোহী লোকগণ নীল পীত লোহিত প্রভৃতি বিবিধ বর্ণের শত শত ঝাড় ও লণ্টন জাহাজের চাঁদনির নীচে খাটাইয়া দিল, আহা! তাহার শোভার কথা কি বলিব, ভিন্ন ভিন্ন জাতিরা সমুদ্র পথে যাইবার সময়ে যেমন এক এক প্রকার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের নিশাণ তুলিয়া দেয়, তাহা যেরূপ দেখায়, উহাও সেইরূপ দেখাইতে লাগিল[৪]।
জাহাজ এক প্রকার অট্টালিকার ন্যায়, তাহাতে অনেক গুলীন কুঠরী, এবং জানালা সারসী খড়খড়ী প্রভৃতি সকলই তন্মধ্যে আছে। অল্প বয়স্কা মৎস্যনারী সন্তরণ দ্বারা একটি কামরার নিকটে গিয়া মস্তকোত্তোলন করত স্বচ্ছ সারসীর ভিভর দিয়া দেখিতে পাইল, তাহার ভিতর কতকগুলীন যুবা পুরুষ উত্তম পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। দেখিল তাহাদের মধ্যে এক ব্যক্তি পরম সুন্দর, মৃগ চক্ষুর ন্যায় তাহার চক্ষুর্দ্বয় বড় বড়, ও কৃষ্ণবর্ণ, অনুভবে সে বোধ করিল ইনি অবশ্যই রাজকুমার হইবেন; ষোড়শ বর্ষের অধিক বয়স নহে, সে দিন তাহার জন্মদিন, তৎ প্রযুক্তই এত ধূম ধামে উৎসব হইতেছিল। নাবিকগণ জাহাজের চাঁদনীর উপর দণ্ডায়মান হইয়া নৃত্য করিতেছে, এমত সময়ে রাজপুত্র উপরে উঠিয়া আইলেন, রাজকুমারের আগমনে নাবিকেরা শতাধিক হাউয়ে একেবারে আগুণ লাগাইয়া দিল, তদালোকে শূন্যমার্গ আলোকময় হওয়াতে ঠিক যেন দিনের মত উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সমুদ্রাধো বাসী রাজ তনয়া যাবজ্জীবন কখন এমন দেখে নাই, এজন্য ভয় পাইয়া জল নিমগ্ন হইল। ডুবিয়াও অনেকক্ষণ থাকিতে পারিল না, আর একবার মাথা তুলিয়া উপরিভাগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখে যে শূন্য হইতে তারা সকল তাহার মস্তকোপরি পতিত হইতেছে। সূর্য্যবাজি দ্বারা বারুদ সকল বড় বড় সূর্য্যের মত হইয়া অগ্নির স্ফুলিঙ্গ বাহির করিতেছে, মৎস্যবাজি দ্বারা বারুদ সকল মৎস্যের ন্যায় হইয়া শূন্যমার্গে কেলি করিয়া বেড়াইতেছে, আর ঐ আশ্চর্য্য বস্তুর ছায়া সকল সমুদ্রের স্থিরবারি মধ্যে প্রতিবিম্বিত হইলে উপরে যেরূপ দেখাইতেছিল, নীচেও সেইরূপ দেখা গেল। এমন আশ্চর্য্যবারুদের কর্ম্ম সে পূর্ব্বে কখন দেখে নাই। যখন আকাশ মণ্ডল এরূপ দীপ্তিমান তখন জাহাজ কত আলোকময় হইতে পারে তাহা লিখিবার আবশ্যক রাখেনা। জাহাজ স্থিত প্রত্যেক রসীগুলীন স্পষ্ট রূপে দৃশ্যমান হইতে লাগিল, তখন যাহারা তাহার ভিতর ছিল তাহাদিগকে কিরূপ দেখা যাইতে পারে? পরম রূপবান্ রাজপুত্র আর আর উপস্থিত লোক দিগের হস্তে হস্ত দিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন, ইহাতে তাঁহাকে কেমন সুন্দর দেখাইল, ঐ সুখ জনক রাত্রিকালে বাদ্যের শব্দে সকল লোকই মোহিত, আনন্দের আর পরিসীমা নাই।
অধিক রাত্রি হইয়াছিল তথাপি ঐ মৎস্যাকারা কন্যা রাজপুত্র এবং জাহাজের প্রতি দৃষ্টি করিতে বিরক্তি প্রকাশ করিল না, এক দৃষ্টে তাহাদের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া রহিল, এই রূপ দৃষ্টি করিতে করিতে সে দেখিল যে পূর্ব্ব দৃষ্ট বিবিধ বর্ণের লণ্ঠন সকল নির্ব্বাণ হইতেছে, হাউই ছোড়া বন্ধ হইয়াছে, বন্দুকের শব্দ আর শুনিতে পাওয়া যায় না, কেবল সমুদ্রের গভীর স্থানে ঘোর গর্জনে গুড় গুড় শব্দ হইতেছে। তথাপি সে হেলিয়া দুলিয়া একবার জলের উপরে উঠে, একবার জলের ভিতরে যায় এবং যে কামরাতে রাজপুত্র বসিয়া আছেন, এক একবার সেই কামরার ভিতরটা উঁকি মারিয়া দেখে। ক্ষণকাল বিলম্বেই দেখিল যে জাহাজখান শীঘ্র শীঘ্র লড়িতেছে, পূর্ব্বে যে পালগুলা গুটান ছিল এক্ষণে তাহা প্রসারিত হইয়াছে, জল পূর্ণ মেঘ সকল আকাশ মণ্ডলে ইতস্ততঃ উড়িয়া যাইতেছে, দুর হইতে বিদ্যুৎ আভা দেদীপ্যমান, সমুদ্রের ঢেউ সকল পর্ব্বতাকারে উচ্চে উঠিতেছে। ইহাতে বোধ হইল, অবশ্যই একটা ঝড় আসিতে পারে, তখন নাবিক গণ আর একবার পাল সকল গুটাইয়া ফেলিল। প্রকাণ্ড জাহাজখান দ্রুততর বেগে আলোড়িত হইতে লাগিল সমুদ্র জল মধ্যে একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে যায়; তরঙ্গ সকল বৃহদাকার কৃষ্ণ বর্ণ পর্ব্বত সদৃশ হইয়া এমনি উচ্চে উঠিল যে নাবিক গণ তাহাতে অতিশয় শঙ্কা বোধ করিয়া বিবেচনা করিল, ঢেউ সকল উপরকার মাস্তুল পর্য্যন্ত ঘেরিলেও ঘেরিতে পারে; হংস পক্ষী জলের ভিতরে যেমন ডুবিয়া পড়ে, উচ্চ তরঙ্গের মধ্যে জাহাজখানও সেই রূপ ডুবিয়া গেল, আবার তরঙ্গ ফাঁপিয়া উঠিলে জাহাজখানও তাহার উর্দ্ধভাগে দৃশ্যমান হইল। এই রূপ দেখিয়া মৎস্য রাজ তনয়া বিবেচনা করিল, জাহাজ চালান বুঝি অত্যন্ত সুখ জনক, কিন্তু দুর্ভগা নাবিক লোক তৎসময়ে আপনাদিগকে বিপদগ্রস্ত দেখিয়া সে প্রকার বিবেচনা করিল না। কড়াৎ কড়াৎ শব্দ করিয়া জাহাজ খান ফাটিয়া যাইতেছে, অনবরত তরঙ্গাঘাতে উহার মোটা মোটা তক্তা সকল ক্রমে খসিতেছে, পরে একটা ছিদ্র হইয়া তাহার ভিতর দিয়া জল চোয়াইতে লাগিল। খাকড়া তৃণ যেমন দুইখান হইয়া ভাঙ্গিয়া যায়, জাহাজের মাস্তুলটা সেই রূপ হইয়া ভাঙ্গিয়া যাওয়াতে ঐ অর্ণবয়ান একদিকে হেলিয়া পড়িল, তজ্জন্যই উহার খোলের ভিতরে জল সেঁধিয়া গেল। তখন রাজকন্যার বোধ হইল যে জাহাজস্থিত লোক সকল এবার বিপদে পড়িয়াছে, উহার বড় বড় তক্তা এবং কড়িকাষ্ঠ গুলা চারিদিকে বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িতেছে, পাছে উহাতে আপনাকে আঘাত লাগে এজন্য সকলে বিধিমতে সাবধান হইতে লাগিল। মুহূর্ত্তেকের মধ্যে এমনি অন্ধকার হইয়া উঠিল যে রাজকন্যা আর কিছু দেখিতে পাইল না, পর ক্ষণেই বিদ্যুৎ আভা দ্বারা আকাশ মণ্ডল উজ্জ্বলীকৃত হইলে জাহাজস্থিত তাবৎ বস্তু স্পষ্ট রূপে তাহার দৃষ্টি গোচর হইল, বিশেষতঃ বুঝি যুবা রাজপুত্র জল মধ্যে নিমগ্ন হইতেছেন, এই ভয়ে সে কায়মন চেষ্টায় তাঁহাকে দেখিয়া বেড়ায়, এমত সময়ে জাহাজ খান ভগ্ন হইয়া একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল। এবার বুঝি রাজ কুমার আমার নিকটে আসিবেন, ইহা ভাবিয়া যে কতই আহ্লাদিতা হইল, কিন্তু পরক্ষণেই বিবেচনা করিল, মনুষ্য জাতি জল মধ্যে তিষ্ঠিতে পারে না, অতএব আমার পিতার বাটীতে উত্তরিবার পূর্ব্বেই তাহার প্রাণত্যাগ হইবে। কিন্তু প্রাণ যায় তাহাও স্বীকার, তথাপি আমি তাঁহাকে প্রাণে হত হইতে দিব না, এই প্রতিজ্ঞায় রাজ তনয়া ঐ তরঙ্গ বিস্তীর্ণ কড়ি কাষ্ঠ এবং তক্তার মধ্য দিয়া সন্তরণ দ্বারা তাঁহার নিকটে গমন করিল, উহাদের আঘাতে তাহার মস্তক যে চূর্ণ হইয়া পড়িবে একবারও সে মনে এমন ভয় করিল না। একবার গভীর জল মধ্যে সে নিমগ্ন হইয়া যায়, আবার প্রবল তরঙ্গের উপরিভাগে মস্তকোত্থিত করে, বারম্বার এই রূপ করিয়া অবশেষে রাজ কুমারের সন্নিকটে গিয়া পৌঁছিল। গিয়া দেখে যে সমুদ্রীয় প্রবল তরঙ্গের সহিত যুদ্ধ করিয়া তিনি অচেতন হইয়া পড়িয়াছেন, প্রায় ইন্দ্রিয়াদির স্পন্দ মাত্র নাই। হস্ত পদাদি দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে, অতি সুন্দর চক্ষু দুইটি মুদ্রিত, আর কিছু ক্ষণ মৎস্যকন্যা তাঁহার সাহায্যার্থে না গেলেই তাঁহার প্রাণ বিনাশ হইত। জলের উপরিভাগে সে রাজ পুত্রের মস্তক তুলিয়া ধরিল, আর মনে করিল এখন কিছু সুবিধা হইয়াছে, সম্প্রতি তরঙ্গ আমাদিগকে যেদিকে ইচ্ছা সেই দিকে ভাসিয়া লইয়া যাউক।
উষাকালে ঝড়ের প্রাবল্য দূর হইয়া গেল, জাহাজের যে যে অংশ ভগ্ন হইয়াছিল, আর তাহা দেখা গেল না। উদয়াচলে দিবাকর রক্তিমবর্ণ হইয়া উদিত হইলেন, জল হইতে তাঁহার সুবর্ণ কিরণ দৃষ্ট হইতে লাগিল, রাজ কুমারের কপোল দেশে ঐ আভা লাগিবাতে বোধ হইল বুঝি সূর্য্যদেব দয়া করিয়া রাজপুত্রের শরীরের মধ্যে জীবন সঞ্চার করিতে আসিতেছেন, কিন্তু তাঁহার মুদিত চক্ষু উন্মীলন হইল না। মৎস্যনারী প্রেমভাবে তাঁহার সুপ্রসারিত ললাটোপরি চুম্বনকরিতে করিতে তাঁহার জলসিক্ত কেশ গুলীর উপর হাত বুলাইতে লাগিল। আর মনে করিল আমার উদ্যানে শ্বেতবর্ণ প্রস্তরময় যে প্রতিমূর্ত্তিটি আছে ইনি তাহারই ন্যায়, রাজকুমার যেন জীবন পান এই আকাঙ্ক্ষায় সে বারম্বার তাঁহার মুখ মণ্ডলে কতই চুম্বন করিল।
এইরূপ ভাসিতে ভাসিতে কত দূর যায়, ক্রমে একটা দেশের নিকটে গিয়া দেখে যে তন্মধ্যে অত্যুচ্চ নীলবর্ণের পর্ব্বত রহিয়াছে, তাহার উপরিভাগে বরফ পড়িয়া এমনি শুভ বর্ণ হইয়াছে যে দেখিলেই লোকে বোধ করে বুঝি শত শত শ্বেতবর্ণ রাজহংস আপনাদিগের পাখা গুলীন প্রসারিত করিয়া উহা আচ্ছাদিত করিয়া রহিয়াছে। ভূমির নিম্নভাগে সমুদ্র তটের নিকটবর্ত্তী একটা অতি সুন্দর হরিদ্বর্ণ বন, তৎসম্মুখ ভাগে একটা প্রকাণ্ড মন্দির, কিন্তু তাহা মন্দির বা কোন বড় মানুষের বাগান বাটী, ইহা সে নিশ্চয় রূপে জানিতে পারিল না, যাহা হউক উহা যে একটা বৃহৎ অট্টালিকা তাহার কোন ভুল নাই। আহা! ঐ অট্টালিকার সম্মুখবর্ত্তী উদ্যানের মধ্যে ফলবান্ উত্তমোত্তম বৃক্ষ সকল ফলের ভারে নত হইয়া পড়িয়াছে, কলম্বা কমলা প্রভৃতি কত লেবু রহিয়াছে তাহার সঙ্খ্যা করা যায় না। দ্বারের সম্মুখেই বড় বড় তালের গাছ। ঐ স্থানে একটা উপসাগর অর্থাৎ খাড়ির মত ছিল, সেখানকার জল গভীর বটে, কিন্তু সুস্থির ছিল। এজন্য সে রাজকুমারকে সমভিব্যাহারে লইয়া সন্তরণ দ্বারা তাহার চড়ার নিকটে গেল। তখন স্বেতবর্ণ কোমল বালুকা সকল স্থানে স্থানে রাশি রাশি হইয়া ছিল, মৎস্যনারী ঐ স্থানেই অতি সাবধানে রাজপুত্রকে শয়ন করাইবার জন্য বিশেষ রূপে উদ্যোগ করিতে লাগিল। যেন তাহার মস্তকটি শরীর অপেক্ষা উচ্চীকৃত না হয়, এবং সুর্য্যোত্তাপ যেন উত্তমরূপে লাগে, এই নিমিত্ত সে বড়ই সাবধান হইল! অনন্তর পূর্ব্বোক্ত প্রকাণ্ড অট্টালিকার ভিতর হইতে ঘণ্টাধ্বনি হইবামাত্র কতক গুলীন যুবতী কন্যা উদ্যান মধ্যে আইল। ইহাতে ক্ষুদ্র মৎস্যনারী ভয় পাইয়া সমুদ্রের অনতিদূরে সন্তরণ করিয়া পলাইল, খানিক দূর যাইয়া দেখে যে জলোপরি উচ্চ একখান প্রস্তর ভাসিতেছে। তাহারই পশ্চাতে লুকাইল, পাছে কেহ তাহার বদন মণ্ডল দেখে এজন্য ফেনা দ্বারা মস্তক এবং বক্ষঃস্থল আচ্ছাদিত করিল। দুর্ব্বল রাজপুত্রকে কেহ সাহায্য করিতে আসিয়াছে কি না, সর্ব্বদা এই অবলোকন করিতে লাগিল।
কিছুকাল বিলম্বে এক যুবতী কন্যা যে খানে রাজকুমার পড়িয়াছিলেন; সেই স্থানেই আসিয়া উপস্থিত হইল। এতাদৃশ ভাবে রাজনন্দনকে শয়ান দেখিয়া প্রথমতঃ সে কিছুভয় পাইল বটে, কিন্তু সে শঙ্কা অধিক ক্ষণ রহিল না, অত্যল্পকালের মধ্যেই তাহা দূর হইবামাত্র সে আরও জন কতক স্ত্রীলোক ডাকিয়া আনিল, মৎস্যনারী অন্তরে থাকিয়া এ সমুদায় দেখিতেছে, ক্রমে২ দেখিল যে রাজতনয় পুনর্জীবিত হইয়া চতুর্দ্দিকস্থ লোকদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করত অল্প২ হাস্য করিতেছেন। কিন্তু যে যুবতী কন্যা তাঁহার জন্য এত কষ্টভোগ করিয়াছে; তাহাকে মনে করিয়া তিনি হাস্য করিলেন না, অথবা সে যে তাঁহাকে রক্ষা করিতে এত চেষ্টা করিয়াছিল, তিনি তাহাও জানিলেন না। মনেঽ এই আন্দোলন করিয়া সে বড়ই দুঃখিতা হইল; দেখিতেঽ জন কতক মানুষ রাজকুমার কে বহন করিয়া ঐ প্রকাণ্ড অট্টালিকার ভিতরে লইয়া গেল, মৎস্য রাজকন্যাও ক্ষুব্ধান্তঃকরণে জলের ভিতর ডুব মারিয়া একেবারে পিতৃগৃহে প্রত্যাগমন করিল।
মৎস্য রাজের কনিষ্ঠা কন্যা বড় একটা বাচাল ছিলনা, সর্ব্বদা কোন না কোন বিষয়ের ধ্যান করিয়া কালযাপন করিত। অতএব সে গৃহে আসিয়া বসিয়া রহিয়াছে এমত সময়ে আর আর ভগিনীরা নিকটে আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ভগিনি! তুমি জলোপরি উঠিয়া কি দেখিয়াছ তাহা বল, কিন্তু সে তাহাদিগকে কোন কথাই বলিল না। সে বহু দিবসাবধি একবার সন্ধ্যাকালে এবং একবার প্রাতঃকালে জল হইতে উত্থিত হইয়া যে খানে রাজকুমারকে সে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে, সেই স্থানেই গমন করে, এই রূপ প্রত্যহ গিয়াও তথায় তাহার কোন ফলোদয় হইল না। একদিন দেখিল উদ্যানস্থ ফল সকল পক্ব হওয়াতে লোকেরা পাড়িয়া২ এক স্থানে সংগ্রহ করিতেছে, পর্ব্বত শিখরে যে সকল বরফ জমাট হইয়াছিল, তাহা গলিয়া পড়িয়াছে, ইত্যাদি আর আর সকলই দেখিতে পাইল, কিন্তু কোনমতেই রাজাকুমারকে দেখিতে পাইল না, একারণ অধিক মনোদুঃখে সমুদ্রাধোভাগে পুনরাগমন করিয়া শোক সান্ত্বনা করে, এমন কোন উপায় নাই, আপন উদ্যানে গমন করিয়া তন্মধ্যবর্তী প্রস্তরময় প্রতিমূর্ত্তিকে রাজপুত্রবোধে এক একবার জড়িয়া ধরিত,—মরি মরি অবোধ বালা এতেওকি মনোদুঃখ যায়! যাহা হউক এই চিন্তায় নিমগ্না হইয়া সে উদ্যানস্থিত পুষ্প সকলের প্রতি বড় একটা মনোযোগ না করাতে তাহাদের পত্র এবং দাঁটা সকল ডালে ডালে জড়িয়া বাগানের পথ একেবারে অবরুদ্ধ হইয়া গেল, সুতরাং ছায়ার অধোভাগস্থ কোন বস্তুই আর দেখা যায় না, সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া উঠিল।
অবশেষে সমুদ্র রাজকন্যা আপনার গোপন কথা আর লুকাইতে না পারিয়া এক জন ভগিনীর কাছে অন্তঃকরণের তাবৎ কথাই ব্যক্ত করিয়া ফেলিল, তৎ প্রমুখাৎ আর ২ ভগিনীরাও সেই গুপ্ত কথা শুনিল, তাহারা ঐক্য হইয়া প্রতিজ্ঞা করিল, আমরা এ কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিব না। কিন্তু স্ত্রীজাতির চঞ্চলা বুদ্ধি, গোপন বিষয় অব্যক্ত রাখা তাহাদের পক্ষে সুকঠিন, ঐ রাজকন্যাদের সমবয়স্কা আর যে দুই জন মৎস্যনারী ছিল; তাহারা তাহারদেরই নিকটে বলিল, আর কাহাকেও একথা জানাইল না, উহারাও ঐরূপ আপনাদিগের আর দুই জন অন্তরঙ্গের কাছে একথা প্রকাশ করে, কিন্তু তাহাতে মন্দ ফল ফলে নাই। তাহারদের মধ্যে একজন দৈবক্রমে ঐ রাজার পরিচয় জানিত, রাজপুত্রের জন্মদিনোপলক্ষে জাহাজের উপর যে মহোৎসবাদি হয় সে তাহাও দেখিয়াছিল, কোন্ দেশের রাজা এবং তিনি কোথা হইতে আসিয়াছিলেন, এতাবৎ সমুদায় বৃাত্তান্তই সে রাজকন্যা দিগকে জানাইল।
অনন্তর আর২ রাজকন্যারা আপনাদিগের কনিষ্ঠা ভগিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ভগিনি! আইস দেখি আমরা সকলে একবার রাজকুমারের অন্বেষণ করি, এই বলিয়া হাতে হাতে বন্ধন করত সারি সারি সকলেই একেবারে সমুদ্র হইতে উঠিল, রাজপুত্রের বসদ্বাটী যে স্থানেতে ছিল, তাহা তাহারা উত্তমরূপে জানিত, অতএব সকলেই এক কালে সেই স্থানেই গিয়া পৌঁছিল।
রাজবাটীর শোভার কথা কি বলিব, তাহা উজ্জ্বল পীতবর্ণের চকচক্যা প্রস্তর দ্বারা নির্ম্মিত, সমুদ্র অবধি বাটী পর্য্যন্ত শ্বেতবর্ণ প্রস্তর দ্বারা তাহার সিড়ী নির্ম্মিত হইয়াছে। ছাদের চারিধারে স্বর্ণাভা সংযুক্ত বড় বড় বছরাই গোলাপের গাছ, বাটীর চতুষ্পার্শ্বে এক একটা থামের মধ্যে এক একটি প্রস্তরময় মূর্ত্তি, মনুষ্যের যেমন গঠন তাহাদেরও তেমনি গঠন হওয়াতে ঠিক তাহা জীবিত মনুষ্যের ন্যায় রহিয়াছিল। বড় বড় জানালার স্বচ্ছ সারসীর ভিতর দিয়া বাটীর অভ্যন্তরে যে সকল জমকাল কুঠরী আছে, সে সকলই দেখা যায়, এক একটা কুঠরীর ভিতর এক একটা অতি দামী রেশমী কাপড়ের মশারি, সকলেরই ছাদের নীচে নানা প্রকার নত্ পত্ কাটা চন্দ্রাতপ ঝুলিতেছে, দেওয়ালে বড় রকমের কত ছবি টাঙ্গান, তাহার সংখ্যা করা যায় না। আহা! এবম্বিধ রাজবাটী দৃষ্টি করিলে সকলেরই চক্ষু জড়ায়। যে ঘরটি সর্বাপেক্ষা প্রবল তাহার মধ্যদেশে এক প্রকাণ্ড জলের উৎস, ঐ উৎসের ঝরণা ছাদের নীচের দিকে যে আয়নার খিলান ছিল, সেই খিলান পর্য্যন্ত উঠিত, সূর্য্যদেব তাহারই মধ্যদিয়া সেই জলের উপরে কিরণ প্রদান করিতেন, বড় বড় প্রশস্ত বাসনে যে সুন্দর সুন্দর পুষ্প বৃক্ষ ছিল, তাহারাও ঐ আয়নার মধ্য হইতে দিবাকরের কিরণ প্রাপ্ত হইত।
সমুদ্র রাজকন্যা এক্ষণে রাজার বাটী জানিতে পারিয়া বহুদিবসাবধি সন্ধ্যা এবং রাত্রিকালে তন্নিকটবর্ত্তী জলে যাইয়া কালক্ষেপণ করিত। পূর্ব্বে তাহার আর যে যে ভগিনীরা সমুদ্র মধ্যে গিয়াছিল, তাহারা সাহস করিয়া তটপর্য্যন্ত যাইতে পারে নাই, কিন্তু কিছু ভয় না করিয়া সে তটের অনেক নিকটে গিয়াছিল; সেখানেও রাজকুমারের না পাইয়া বৈঠকখানার বারাণ্ডার নীচে যে একটা অপ্রশস্ত খাল ছিল, সে তাহারও ভিতরে গিয়াছিল, ঐ খাল সেই বারাণ্ডার এত নিকটে ছিল, যে তাহার অতি বিশাল ছায়াটা উহার জল মধ্যে পড়িত। অবলা কন্যা ঐ স্থানেই বসিয়া এক দৃষ্টে সেই হৃদয়ের ধন যুবরাজ কুমারকে নিরীক্ষণ করিয়া বেড়াইত। কিন্তু রাজনন্দন তাহার কিছুই জানেন নাই। মনে করিতেন এমন রমণীয় জ্যোৎস্নার আলোকে আমি একলাই বসিয়া আছি।
অনেকবার দিবাবসান সময়ে সে দেখিত যে রাজপুত্র খালের মধ্যে একখান লৌকারোহণ করিয়া পরমানন্দে ক্রীড়া করিয়া বেড়াইতেছেন, আর ঐ তরণির অভ্যন্তরে কতইবা বাদ্যের শব্দ, ও তাহা কত প্রকার বিচিত্র বর্ণের নিশাণ দ্বারা শোভিত, তাহা বর্ণনা করা যায় না। খালের ধারে যে সবুজ বর্ণ খাগড়ার বন ছিল, যে তাহারই ভিতরে গমন করিয়া ঐ সকল গীত বাদ্য শুনিত; তাহার রৌপ্যবৎ শুভ্র বর্ণের ঘোমটাটি বায়ুদ্বারা উড়িয়া পড়িলেও লোকেরা বোধ করিত বুঝি কোন হংস পক্ষি আপন পাখাদুটি প্রসারিত করিয়া জল মধ্যে পড়িয়া রহিয়াছে।
অনেকবার রাত্রিকালে ধীবরেরা মৎস্য ধরিবার নিমিত্ত বাতি জ্বালিয়া সেই খালের জলে জাল বিস্তারিত করিত। জাল পাতা হইলেই জালিয়ারা তমাক খাইতে খাইতে অনেক কথা কহিয়া থাকে, অতএব তাহারাও রাজ কুমারকে প্রশংসা করিয়া অনেক কথা কহিত; যেরূপে তিনি সাগর তরঙ্গে পতিত হইয়া আলোড়িত সমুদ্রজলে ভাসিতে ভাসিতে অর্দ্ধ মৃতবৎ হইয়াছিলেন, যেরূপে তাঁহার জীবন রক্ষা হইয়াছিল, তাহারা এই সকল কথা কহিত, রাজকন্যা তাহা শ্রবণ করত আপনাকে তাঁহার বিপদোদ্ধারের মূল কারণ জানিয়া বিপুলানন্দে মগ্ন হইতেন।
রাজকুমার সমুদ্র জলে মগ্ন হইলে তন্মস্তকটি আপন বক্ষস্থলে রাখিয়া তাহার মুখমণ্ডলে যে সে শত শত চুম্বন করিয়াছিল, সে সকলই তখন তাহার মনে পড়িত, কিন্তু রাজনন্দন ইহার কিছুই জানেন নাই এবং স্বপ্নেতেও তাহাকে একবার মনে করেন নাই। এইরূপে সে পূর্ব্বাপেক্ষা মনুষ্যজাতিকে অধিক প্রেম করিতে লাগিল, মনে২ বড়ই ইচ্ছা তাহাদের সহিত সর্ব্বদা থাকিয়া এক সঙ্গে ভ্রমণ করিতে পারে, কেননা যে জগতে সে বাস করিত তদপেক্ষা তাহাদের বসতি ভূমণ্ডল সে অতি সুন্দর এবং প্রশস্ত বোধ করিত। এক একবার মনে করিত, আহা! মনুষ্যজাতি কি অদ্ভুত কৌশল জানে, তাহারা জাহাজ দ্বারা এতাদৃশ বিস্তারিত সমুদ্র পার হইয়া যায়, যে সকল পর্ব্বত শিখর মেঘগণের উপরিভাগ পর্য্যন্ত উঠে, তাহাতেও তাহারা অনায়াসে গমনাগমন করে, এবং তদধিকারস্থ ভূমি ময়দান এবং বন সকল এমন বিশাল, যে নানাবিধ যত্ন পূর্ব্বক আমি তাহা দর্শন করিতে চাহিলেও তাহা দর্শনাতীত হয়।
পৃথিবীস্থ অনেক বিষয় জানিত না বলিয়া সে আপন ভগিনীদিগকে তাহা জিজ্ঞাসা করিত, কিন্তু তাহারাও প্রত্যুত্তর দ্বারা তাহাকে সন্তোষ করিতে পারিত না; একারণ বৃদ্ধা পিতামহীর নিকটে গমন করিয়া সে ঐসকল বিষয়ের প্রশ্ন করিত, রাজমাতা উপরিস্থিত জগতের বিবরণ ভালরূপে জানিভ, অতএব যথার্থতঃ উহাকে জগৎ বলা উচিত নয় জানিয়া, সমুদ্রের উপরিভাগস্থিত ভূমি বলিয়া ডাকিতেন।
ক্ষুদ্র মৎস্যনারী জিজ্ঞাসা করিল, যদি মনুষ্য জাতি জলমধ্যে ডুবিয়া মরে না, তবে কি তাহারা চিরকাল বাঁচে? এখানে সমুদ্রের ভিতর বাস করিয়া আমরা যেমন কাল আসিলেই মৃত্যুর হস্তে পতিত হই, তাহাৱা কি তেমন হয় না?
এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদানে বৃদ্ধা রাণী কহিলেন, হাঁ অবশ্য আমাদের ন্যায় তাহারাও মরিয়া থাকে; তাহারা আমাদের অপেক্ষা অধিক দিন বাঁচেনা, অত্যল্পকালের মধ্যেই কালগ্রাসে পতিত হইয়া থাকে। তিন শত বৎসর পর্য্যন্ত আমাদের পরমায়ু, কিন্তু মরিলেই আমরা একেবারে সমুদ্রের ফেনা হইয়া যাই, আমাদের মৃতদেহ পর্য্যন্ত থাকেনা, সকলই ফুরাইয়া যায়। আমাদের আত্মা অমর নহে, এজন্য আমরা মরিলে আর কোন নূতন জীবন প্রাপ্ত হইনা, সবুজবর্ণ খাগড়া গাছের সহিত তুলনা করিলে আমাদের সঙ্গে তুলনা হইতে পারে, তাহাদিগকে একবার কাটিয়া ফেলিলে পুনঃজীবন প্রাপ্ত হইয়া আর তাহারা প্রবল হইয়া উঠে না, আমরাও সেইরূপ মরিলে আমারদের সকলই বিনাশ পায়। কিন্তু মনুষ্যজাতি সেরূপ নহে, তাহাদিগের আত্মা অনন্তকাল পর্য্যন্ত থাকে, মরণের পর তাহাদের মৃত শরীর অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করিয়া ফেলিলেও ঐ নির্ম্মল শূন্যমার্গের উপরিভাগে যে জ্যোতির্ম্ময় নক্ষত্র লোক দেখিতেছ, সে স্থান পর্য্যন্তও তাহাদের অমর আত্মা যায়। আমরা যেমন মনুষ্যজাতির যাতায়াত দেখিতে জলের উপরিভাগে উঠি, তাহারাও তেমনি সেই অজ্ঞাত অপরিচিত আনন্দ স্বরূপ দেশে ভ্রমণ করে।
এই কথাতে দুঃখিতা হইয়া অপবয়স্কা মৎস্যনারী পিতামহীকে জিজ্ঞাসা করিল, তবে আমাদেরও কেন অমর আত্মা নাই? শত শত বর্ষ বাঁচিবার পরিবর্ত্তে মনুষ্যজাতি হইয়া যদি এক দিন বাঁচি তাহাও ভাল, আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক শত বর্ষ পরমায়ুও এক দিনের জন্য পরিবর্ত্ত করিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা হইলেই সেই অনন্ত সুখ সম্ভোগ করণের আশা সফলা হইতে পারিবে। বৃদ্ধা কহিলেন, তুমি এমন বিবেচনা কখনই করিও না, উপরিস্থিত মনুষ্যজাতি অপেক্ষা আমরা এইস্থানে পরম সুখে বাস করিতেছি।
কনিষ্ঠা রাজকন্যা বলিল, আহা! কি দুঃখ মরিলেই আমি সমুদ্রের ফেনা হইয়া জনের উপরে ভাসিয়া ভাসিয়া বেড়াইব, তরঙ্গের যে মধুর শব্দ আর তাহা শুনিতে পাইব না, সুন্দর সুন্দর পুষ্প সকল এবং অতি মনোহর রক্তিম বর্ণের সূর্য্য প্রভৃতি আর আমার চক্ষুর্গোচর হইবে না, ওগো দিদি! তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তাহার পর অমর আত্মা পাইবার কি আর কোন উপায় নাই?
প্রাচীনা সমুদ্ররাণী কহিলেন, না তাহা কখই হইবে না, যদ্যপি কোন মনুষ্য তোমাকে আপন পিতা মাতা অপেক্ষা অধিক প্রেম করে, যদ্যপি তাহার সমুদায় ভাবনা এবং প্রেমাদি সকল স্নেহ তোমারই উপরে বর্ত্তে; যদ্যপি তাহার কুল পুরোহিত মন্ত্রপাঠ দ্বারা তাহার দক্ষিণ হস্ত তোমার মস্তকে প্রদান করাইয়া প্রতিশ্রুত করান যে ইহকালে এবং পরকালে তোমার নিকটে যাথার্থিক ব্যবহার করিয়া তোমাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করিবে, তবেই তাহার আত্মা তোমার শরীরে যাইতে পারিবে; এবং তাহা হইলেই মনুষ্যজাতি যে সুখ সম্ভোগ করে তাহার অংশী হইতে পারিবে। কিন্তু মনে রাখ, সে আপন আত্মা তোমাকে দিলেও তাহার আত্মা তাহাকে একেবারে পরিত্যাগ করিবেনা। তুমি বাছা বালিকা, অধিক কথা কথনের প্রয়োজন কি আছে? যাহা তোমাকে বলিলাম তাহা কখন ঘটিতে পারে না। আমরা সমুদ্রবাসী লোক, মৎস্যলাঙ্গূলে আমাদিগকে যেরূপ সুন্দর দেখাইয়া থাকে, পৃথিবীস্থ লোকেরা তাহার শ্রেষ্ঠত্ব না জানিয়া তাহা অতি অকিঞ্চিৎকর এবং কদর্য্য বোধ করে, তাহাদিগের কাছে রূপবান দেখাইবার নিমিত্ত মোটা মোটা মাংসল দুইটি অবলম্ব প্রয়োজনীয় হয়, যাহাকে তাহারা পদদ্বয় কহে।
ক্ষুদ্রা মৎস্যনারী তখন এই সকল কথা শ্রবণ করত আপনার মৎস্যলাঙ্গূলের প্রতি দৃষ্টি করিয়া অনেক দুঃখ করিতে লাগিল।
প্রাচীনা রাজমাতা বলিতে লাগিলেন, বাছা! তুমি দুঃখ করিওনা, ক্ষোভ করা কোনমতেই উচিত নয়, আইস আমরা আমোদ প্রমোদে কালযাপন করি, বিবেক শক্তি দ্বারা আমার বিবেচনা হইতেছে যে তিন শত বৎসর আমরা ইহলোকে থাকিব, তাহাই আমাদিগের পক্ষে যথেষ্ট, এইকাল যদি লম্ফ ঝম্প দ্বারা আমরা সুখে কাটাইতে পারি, তাহা হইলে ভাবি সুখের বড় একটা আকাঙ্ক্ষা থাকিবে না, একারণ শুন বাছা মনোদুঃখ নিবারণ কর, অদ্য রাত্রিকালে রাজসভাতে একটা ভূরি ভোজ আছে।
এই ভোজের সময়ে সমুদ্রবাসী লোকেরা যে রূপ ঘটা করিয়া আপনাদিগের উৎসব সম্পন্ন করে, আমরা পৃথিবীতে বাস করিয়া তাদৃশ ঘটা কখম চক্ষেও দেখিতে পাইব না। যে দালানের মধ্যে ঐ ভোজ প্রস্তুত হইয়া থাকে তাহার দেওয়াল এবং ছাদের নিম্ন দিকটা অতি স্বচ্ছ মোটা মোটা কাচ দ্বারা নির্ম্মিত, উহার প্রত্যেক দিকেই শত শত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কস্তূরা শঙ্খ সারি সারি ঝুলান হইয়াছে। আহা! তাহার সৌন্দর্য্যের কথা কি কহিব, কতকগুলীন ঘোর রক্তবর্ণ, আর কতকগুলীন তৃণবৎ হরিদ্বর্ণ ছিল, উহা হইতে যে প্রজ্বলিত শিখা বহির্গত হইত, তাহা নীলবর্ণ হওয়াতে সমুদায় দালান টা একেবারে আলোকময় হইয়াছিল, দেওয়ালের উপরিভাগে তাহারা স্থাপিত, এজন্য তাহা দিয়া উহাদের আভাক্রমে প্রজ্বলিত রূপে বাহির হইলে সমুদ্রের চারিদিক ক্রমে আলোক ময় হইয়া উঠিত, অগণ্য বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র মৎস্য ঐ কাঁচ নির্ম্মিপ্ত দেওয়ালের মধ্য দিয়া সন্তরণ করিয়া বেড়ায়, কতক গুলার গাত্র মধ্যে লোহিতবর্ণের আঁইষ, কতক গুলা স্বর্ণ এবং রৌপ্যবৎ শল্ক দ্বারা অতি চকচক্যা হইয়াছিল।
সেই ভোজ গৃহের মধ্য দিয়া একটা স্রোত নিঃসরণ হয়, মৎস্যনর এবং মৎস্যনারীরা তাহারই উপরে দণ্ডায়মান হইয়া আপনাদিগের রীত্যনুসারে নৃত্য গীতাদি করে, তাহাদের কেমনই বা সুমধুর স্বর? মনুষ্যজাতিরা সহস্র২ বৎসর অভ্যাস করিলেও তেমন স্বর পাইতে পারেনা। কনিষ্ঠা রাজতনয়া গায়নীদিগের মধ্যে সর্ব্ব প্রধানা, তাহার মত সুস্বর কোন মৎস্যনারীরই ছিল না, তাহার গানে রাজসভাসদগণ সকলেই অতি মোহিত হইয়া আপনাদিগের হস্ত এবং লাঙ্গূলোত্তোলন পূর্ব্বক কত প্রশংসা করিতে লাগিল; ঐ যুবতী মৎস্যনারী জানিত পৃথিবী এবং সমুদ্রের মধ্যে কেহই আমার ন্যায় গান করিতে পারে না, অতএব তাহাদিগের প্রশংসাতে অত্যল্পকালের জন্য কিছু সুখ বোধ করিল। কিন্তু পর ক্ষণেই উপরিস্থিত জগতের বিষয় তাহার মনে হইলেই সে বিপুল দুঃখে পুনরায় পড়িল; একে রাজকুমার অতি রূপবান তাহাতে আবার তাঁহার অমর আত্মা আছে, যে আত্মা নাই বলিয়া তাহার মনোদুঃখ এত, সে সমুদায় ভুলিয়া আর কতকাল থাকিতে পারে? পিতৃ অট্টালিকায় গীত মহোৎসবাদি পরিত্যাগ পূর্ব্বক লুক্বায়িত ভাবে আসিয়া ক্ষুব্ধান্তঃকরণে আপন ক্ষুদ্র উদ্যানের মধ্যে বসিয়া রহিল। এখানে শুনিতে পাইল যে জলের মধ্য হইতে একটা তুরীর শব্দ আসিতেছে।
বাদ্য শুনিয়া তখন সে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, যে আমার হৃদয়ের ধন, যাহার জন্য দিবারাত্রি আমি ভাবনা করিয়া থাকি, ইহলোকের যত সুখ আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক যাহার হস্তে সমর্পণ করিয়াছি, সেই বুঝি জাহাজারোহণে সমুদ্র মধ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। যে কোন কৌশলে হউক না কেন, কোন না কোন প্রকারে আমি তাহার মন হরণ করিয়া অমর আত্মা প্রাপ্ত হইবার বিশেষ উদ্যোগ করিব। ভগিনীরা সম্প্রতি পিতার দুর্গমধ্যে নৃত্য করিতেছেন, এই সুযোগে আমি সমুদ্র ডাকিনীর নিকটে গিয়া জানাই, এতকাল তাহাকে ভয় করিয়া কখন আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই বটে, কিন্তু বোধ হয় সে আমার পূর্ব্বাবস্থা দেখিয়া অবশ্যই সৎপরামর্শ দ্বারা আমাকে এ বিষয়ে কোন সাহায্য করিতে পারিবে।
ঘূর্ণিত জলের পশ্চাদ্ভাগে সমুদ্র ডাকিনীর বাসস্থান, অবলা মৎস্যনারী স্বীয় উদ্যান পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই স্থানেই গমন করিল। সে পূর্ব্বে ঐ পথে কখন যায় নাই। সেখানে পুষ্প বা সমুদ্রীয় তৃণ কিছুমাত্র জন্মায় না, কুমরের চাকে বলপূর্ব্বক পাক লাগাইলে যেমন তাহা ভোঁ ভোঁশব্দে ঘূর্ণায়মান হয়, সেখানকার বারিও তদনুক্রমে ঘূর্ণিত হইয়া উপরিভাগে যাহা পাইত, অধোভাগের গভীর স্থানে তাহাই নিক্ষেপ করিত। এই সমুদায় ঘূর্ণিত জলের মধ্য দিয়া মৎস্যনারীকে সেই ডাকিনীর রাজ্যে যাইতে হইয়াছিল, হয়তো তাহাকে সে নির্দ্দয় স্থানের করাল কবলে পতিতা হইতে হইত; ভাল উহাও না হয়, পার হইয়া সে নিরাপদে যাউক কিন্তু নিরাপদ কোথায়? তাহা ছাড়াইয়া গেলেও অনেক দূর পর্য্যন্ত কোন পথ ঘাট নাই, সেখান হইতে যত দূর যাইতে হইবে সে সকলই অতিউষ্ণ পঙ্কযুক্ত স্থান বজ্ বজ্ করিতেছিল। তৎপশ্চাতে অত্যাশ্চর্য্য বনের মধ্যে তাহার বসদ্বাটী, তত্রস্থ বন এবং ঝোপ ঝাপ গুলান অত্যদ্ভুত। তাহা অর্দ্ধ জন্তু এবং অর্দ্ধ বৃক্ষবৎ ছিল, দেখিলেই বোধ হইবে যেন শতমুখী সর্প সকল ভূমি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; উহাদের শাখা সকল দীর্ঘ দীর্ঘ বাহুর ন্যায় চক্ চক্ করিতেছিল, কিঞ্চুলুকা যেরূপ স্বাভাবিক নমনীয়, যে দিকে ইচ্ছা সেই দিকেই নোয়ান যাইতে পারে, উহাদের অঙ্গুলীও সেইরূপ ছিল, মূল অবধি আগা পর্য্যন্ত যে সকল গাঁইট আছে, তাহা ইচ্ছাক্রমে যেমনে ইচ্ছা তেমনেই বাঁকান যায়। উহারা সমুদ্রস্থিত বস্তু সকল জড়িয়া ধরিত, কিন্তু পুনর্ব্বার তাহা ছাড়িত না। অল্প বয়স্কা মৎস্যনারী তাহাদিগকে দেখিবাতে ভয়ে তাহার বক্ষস্থলটি টিপ্ টিপ্ করিতে লাগিল, একবার ইচ্ছা করিল আমি ঘরে ফিরিয়া যাই, কিন্তু পরক্ষণেই পরমসুন্দর রাজপুত্র এবং মনুষ্য জাতিদের অমর আত্মা তাহার মনে পড়িলেই সে কিছু সাহস প্রাপ্ত হইল। আপনার পৃষ্ঠস্থিত লম্বা কেশ, গুলীকে বিনাইয়া বিনাইয়া এমনি পেঁচ লাগাইল যেন তাহারা কোন প্রকারে তাহার বেণী ধরিতে না পায়, হাত দুটী জড়ষড় করিয়া আপনার বক্ষস্থলে রাখিল, মৎস্যেরা জলের মধ্যে চোঁ চোঁ শব্দে যেমন বেগে চলিয়া যায়, সেও পূর্ব্বোক্ত বৃক্ষ গণের মধ্যদিয়া সেইরূপ দ্রুত গমন করিল, গাছ সকল আপনাদের অঙ্গুলী ও বাহু বিস্তারিয়া পিছু পিছু তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, যাইতে যাইতে সে দেখিতে পাইল লৌহ মুষ্টি যেরূপ শক্ত, তাহাদেরও হস্তগুলা সেইরূপ, উহাদের শত শত ক্ষুদ্র মুষ্টির মধ্যে কত বস্তু দৃঢ়রূপে ধৃত হইয়া রহিয়াছে। যে সকল মনুষ্য সমুদ্র জলে নিমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে, তাহাদের শুভ্রবর্ণ অস্থি গুলা সে ঐ বৃক্ষগণের হস্ত মধ্যে দেখিল। পৃথিবী সম্পর্কীয় নৌকার হাইল, সিন্দুক, এবং আর আর জন্তুদিগের অস্থি প্রভৃতি সকলই তাহাদের করতল মধ্যে রহিয়াছে, ক্ষুদ্রা মৎস্যনারী পর্য্যন্ত তাহাদের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পায় নাই। সে দেখিল যে ঐ নির্দ্দয় গাছ সকল একটী মৎস্যানারীকে ধরিয়া শ্বাস রোধ করত তাহার প্রাণ সংহার করিয়াছে। বোধ হয় এই ভয়ানক ব্যাপার দেখিয়া আশঙ্কা প্রযুক্ত সে অতিশয় আশ্চর্য্য হইয়াছিল।
বিরহিণী খানিক দূর যাইতে যাইতে বন মধ্যে একটা দল দল্যা কর্দ্দম স্থান পাইল, তথায় বড় বড় জল সর্প সকল পঙ্কেতে অবলুণ্ঠিত হইয়া আপনাদিগের অতি কুৎসিত লালচে শরীরটা দেখাইতেছে। এই জঘন্য স্থানের মধ্যে জাহাজ ভগ্ন দ্বারা যে যে মনুষ্য জলে ডুবিয়া আপনাদিগের জীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহাদেরই অস্থি দ্বারা একটা বাটী নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহার ভিতরেই সমুদ্র ডাকিনীর বাস, আমরা যেমন ময়না পাখীকে ছাতু, চিনি, ঘি মিশ্রিত গুলিপাকাইয়া খাওয়াই, সেও সেইরূপ একটা ভেক লইয়া ভক্ষণ করিতেছিল। কদাকার মোটা মোটা ধোঁড়া সাপ গুলাকে সে কুক্বুট শাবক কহিত, তাহারা তাহার বক্ষস্থল পর্য্যন্ত চলিয়া গেলেও সে কিছু বলিত না।
সমুদ্র ডাকিনী কহিল, মৎস্য কন্যে! তুমি যে জন্যে আমার নিকটে আগমন করিয়াছ, তাহা আমি জানি। শুন বাছা রাজকন্যে তুমি মনোভীষ্ট সিদ্ধ করিতে বাসনা করিলেই ভারি বিপদ গ্রস্তা হইবে, তথাপি তাহা সম্পন্ন করিতে চাহ, ভাল, কর, কিন্তু ইহা অতি নির্ব্বোধের কর্ম্ম। আমি বুঝিয়াছি তুমি আপন মৎস্য লাঙ্গূল হইতে মুক্ত হইয়া যে দুই অবলম্ব দ্বারা মনুষ্যজাতি ইতস্তুতঃ ভ্রমণ করিয়া বেড়ায়, তাহা প্রাপ্ত হইতে চাহ, মনে মনে স্থির করিয়াছ তাহা হইলেই যুবা রাজকুমার তোমাকে প্রেম করিয়া বিবাহ করিবেন, এবং পণ স্বরূপ তাঁহার অমর আত্মাটি তোমাকে যৌতুক দিবেন। এই প্রকার বিদ্রূপ করিতে করিতে বৃদ্ধা ডাকিনী তাহাকে খেদাইয়া দিবার নিমিত্ত এমনি উচ্চশব্দে হাস্য করিয়া উঠিল যে তন্মুখস্থিত ভেক এবং সর্প গুলা ভূমিতে পড়িয়া ছট্ ফট্ করিতে লাগিল। তখন কুহকিনী, রাজতনয়াকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ওগো বাছা রাজকন্যে তুমি অত্যপযুক্ত সময়ে আমার বাটীতে অধিষ্ঠান করিয়াছ, যদি এস্থানে কল্য সূর্য্যোদয়ের পর আসিতে, তবে আমি আর এক বৎসর গত না হইলে তোমার কোন সাহায্য করিতে পারিতাম না। এক মাত্রা ঔষধ প্রস্তুত করিয়া আমি তোমার হস্তেদি; তুমি তাহা লইয়া কল্য সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে সন্তরণ করিতে করিতে সাগর তটবর্ত্তী হইও, পরে সেখানে উপবেশন করিয়া একেবারে তাহা পান করিয়া ফেলিও। তদ্দ্বারা তোমার মৎস্যপুচ্ছ অদৃষ্ট হইলে মনুষ্য জাতি যাহাকে উত্তম পরিষ্কৃত পদ কহে তাহাই প্রাপ্ত হইতে পারিবে, কিন্তু মনে রাখিও অতি তীক্ষ্ণ খড়্গে হৃদয় বিদীর্ণ হইলে যেরূপ বেদনা হয়, তাহাতে তুমি সেইরূপ বেদনা পাইবে। প্রত্যেক লোকেই তোমাকে দেখিবামাত্র কহিবে এমন রূপসী কন্যা আমি জন্মাবধি কখন দর্শন করি নাই, সমুদ্রে ভাসিলে তোমার যে প্রকার রূপ মাধুরী প্রকাশ হইত, ভূমিতে গমনাগমন কালে সেই প্রকার রূপ মাধুরী প্রাপ্ত হইতে পারিবে; কোন নর্ত্তকীই তোমার ন্যায় সুচারুরূপে নৃত্য করিতে পারিবে না। কিন্তু একটি কথা আছে, অতি তীক্ষ্ণচ্ছুরিকার উপরে পদ নিক্ষেপ করিলে রক্ত নির্গত হইবার যেরূপ আশঙ্কা জন্মিয়া থাকে, প্রত্যেক পদ নিক্ষেপ কালীন তোমার সেইরূপ আশঙ্কা হইবে। এখন রাজনন্দিনী! তোমায় জিজ্ঞাসা করি! এতাদৃশ কষ্ট যদি তুমি সহ্য করিতে পার, তবে আমি প্রাণপণে তোমার সাহায্য করিতে পারি।
অল্পবয়স্কা মৎস্যনারী রাজনন্দন এবং অমর আত্মা বিষয়ক চিন্তাতে অভিভূতা হইয়া মৃদুস্বরে উত্তর করিল, আমি এবম্বিধ দুঃখ সহিব তাহার কোন সন্দেহ নাই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে সাহায্য করুন।
অপর ডাকিনী কহিল, তুমি ভালরূপে বিবেচনা করিয়া দেখ, মানবাকৃতি প্রাপ্ত হইলে পুনর্ব্বার তুমি মৎস্যনারী হইতে পারিবে না। জল মধ্যে নিমগ্ন হইয়া স্বীয় ভগিনীদিগের নিকটে অথবা আপন পিতার রাজভবনে কখনই আসিতে পারিবে না। রাজকুমার যদি তোমার নিমিত্ত আপন পিতা মাতাকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হইয়া সমুদায় অন্তঃকরণের সহিত তোমাকে প্রেম না করেন, এবং পুরোহিতকে আনাইয়া মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক আপন হস্ত তোমার হস্তে সংমিলন করত যদি বিবাহ কার্য্য সম্পন্ন না করেন, তবে তুমি অমর আত্মা কখনই পাইবে না, ওগো রাজনন্দিনী! রাজকুমারকে প্রেমরজ্জু দ্বারা বশীভূত করা তোমার অমর আত্মা প্রাপ্ত হইবার একমাত্র উপায় জানিও। যেদিন রাজসুত তোমায় পরিত্যাগ করিয়া অন্য কাহাকেও বিবাহ করিবেন, সেই দিন তোমার অন্তঃকরণ বিদীর্ণ হইয়া একেবারে তুমি তরঙ্গ ফেনায় লীন হইয়া যাইবে।
মৃত ব্যক্তির শব যেমন পাংশুবর্ণ হয়, বিরহিণী মৎস্যনারীও তদ্রূপ পাংশুবর্ণ হইয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, ওগো! আমি স্থির প্রতিজ্ঞ হইয়াছি। ডাকিনী বলিল, আমি যে তোমায় ঔষধ দিব, তৎপরিবর্ত্তে তুমি আমায় কি দিবে, তা বল, আমি ইহার নিমিত্ত যাহা চাহি তাহা বড় একটা সামান্য বিষয় নহে। সমুদ্রবাসী লোকদের মধ্যে তোমার স্বর অতি মিষ্ট, বোধ করিতেছি, এই স্বরেই তুমি রাজপুত্রকে মোহিত করিয়া প্রেমফাঁশি তাহার গলদেশে দিবে, আমি সেই স্বরাভিলাষিণী, যদি কিছু দিবার বাসনা থাকে, তবে ঐ স্বর আমাকে দেও। তুমি ভালরূপে জান যে ঔষধ মাত্রা আমি তোমাকে প্রদান করিতেছি, তাহার মূল্য নিশ্চিত করিয়া কেহ বলিতে পারে না, আমার রক্ত ঐ ঔষধিতে মিশ্রিত হইলেই শাণিত ধার খড়্গবৎ উহা তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিবে। একারণ তোমার সদ্গুণের মধ্যে যেটি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গুণ তাহাই আমি তৎপরিবর্ত্তে পাইতে বাসনা করিয়াছি।
অল্পবয়স্কা মৎস্যনারী কহিল, তুমি আমার স্বর লইলে আর কি থাকিবে তা বল? ডাকিনী কহিল, কেন, তোমার মনোহর রূপ, সুচারু গমন এবং মৃগ নয়নবৎ চক্ষু দ্বারা তুমি মনুষ্যের অন্তঃকরণকে হরণ করিয়া মোহিত করিতে পারিবে। ভাল তোমার কি কোন সাহস নাই? অনেক কথার প্রয়োজন করে না, জিহ্বা বহির্গত কর; আমি আপন ঔষধের মুল্য স্বরূপ তাহার কিয়দংশ কাটিয়া লই, তাহা হইলেই তুমি তোমার অমূল্য ঔষধ মাত্রা পাইবে।
মৎস্যনারী কহিল, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহাই হইবে। ডাকিনী এই কথা শ্রবণ করিয়া ঔষধ প্রস্তুত করণার্থ আপনার লৌহ কটাহ খান আনিয়া অগ্নির উপরে চড়াইল। কটাহ পরিষ্কৃত রাখা আবশ্যক বলিয়া সে গোটাকতক সর্প দ্বারা কড়াইখান উত্তমরূপে মার্জিত করিয়া ফেলিল। আপন বক্ষঃস্থলে কাঁটা মারিয়া কৃষ্ণবর্ণ রুধির বাহির করত ঐ পাত্র মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহাতে সেই কটাহের ধূম শূন্যমার্গে এমনি উত্থিত হইল, যে ভয়ে কম্পমান না হইয়া কোন ব্যক্তিই তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে নূতন সামগ্রী আনিয়া ডাকিনী ঐ কটাহ মধ্যে নিক্ষেপ করিবাতে, সিদ্ধ হইবার কালীন তাহা কুম্ভীরের ন্যায় গর্জ্জন করিতে লাগিল। পরে ঔষধমাত্রা প্রস্তুত হইলে উৎস নির্ঝর স্বভাবতঃ যেরূপ নির্ম্মল হয়, উহা সেইরূপ নির্ম্মল হইল। অনন্তর এই তোমার ঔষধ লও, ইহা বলিয়া ডাকিনী সেই মৎস্যনারীর জিহ্বা কাটিয়া ফেলিবাতে সে একেবারে বোবা হইয়া পড়িল, না গান গাইতে পারে, না কথা কহিতে পারে।
ডাকিনী বলিল, বন দিয়া প্রত্যাগমন কালে যদি জন্তুবৎ সেই বৃক্ষগণ তোমাকে ধরিবার চেষ্টা করে, এই ঔষধির এক ফোঁটা তাহাদের গাত্রে ছিটিয়া দিলেই তাহাদিগের বাহু এবং অঙ্গুলী সকল একেবারে সহস্র খণ্ডে চূর্ণ হইয়া যাইবে। আকাশমণ্ডলে নক্ষত্রগণ উদিত হইলে যেরূপ মিট্ মিট্ করিতে থাকে, মৎস্যনারীর হস্তস্থিত ঔষধি সেইরূপ আভা প্রকাশ করিয়া চিক্ মিক্ করিতেলাগিল, বৃক্ষগণ তাহা দেখিয়া আশঙ্কায় কম্পমান হওত, একধারে হেলিয়া পড়িল একারণ সেই ঐন্দ্রজালিক ঔষধি তাহাদের অঙ্গে প্রোক্ষণ করিবার কোন প্রয়োজন হইল না। বন বাদা এবং ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিত বারির মধ্যদিয়াও সে অনায়াসে শীঘ্র২ পার হইয়া গেল।
পিতার বাটীতে উপস্থিত হইয়া দেখে, যে দালানে লোক সকল উপবেশন করিয়া নৃত্যগীতাদি কর্ম্ম সমাধা করিয়া ছিল, তত্রস্থিত তাবৎ মশালই নির্ব্বাণ হইয়াছে, অন্তঃপুরে সকলেই নিদ্রিত, একে বোবা হইয়াছে, তাহাতে আবার চিরকালের জন্য তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিতে উদ্যত; এজন্য যে সাহস করিয়া তাহাদের কোন অনুসন্ধান লইতে পারিল না। মনের উদ্বেগে তাহার বক্ষস্থলটা যেন ফাটিয়া যাইতেছে। আস্তে আস্তে স্বীয় ভগিনীদিগের উদ্যান মধ্যে করিয়া সে সকল বৃক্ষ হইতে এক একটি পুষ্প চয়ন করিল, বারম্বার হস্ত দুইটি রাজবাটীতে স্পর্শ করে, এবং বারম্বার তাহা চুম্বন করে, এইরূপ করিতে করিতে নীলবর্ণ জলের মধ্যদিয়া উপরিভাগে উঠিল।
রাজপুত্রের প্রস্তরময় সিড়ির নিকটে পৌঁছিয়া যখন সে তাঁহার গড়ের প্রতি অবলোকন করিতে লাগিল, তখন পর্য্যন্তও সূর্য্যোদয় হয় নাই। জ্যোৎস্না দ্বারা চারিদিক উজ্জ্বলীকৃত। মৎস্যনারী তটোপরি উপবেশন করিয়া একেবারে সেই অতি তীক্ষ্ণ প্রজ্বলিত অনলের ন্যায় ঔষধমাত্রা পান করিয়া ফেলিল। গলাধঃকরণ হইবামাত্র যেন শাণিতধারা খড়্গ তাহার কোমল শরীরে বিদ্ধ হইয়া গেল। তাহাতে সে মূর্চ্ছাপন্ন হইয়া একেবারে নির্জীব হইয়া পড়িল। পরে সূর্য্যোদয় হইলে সে চৈতন্য পাইয়া উঠিল বটে, কিন্তু যন্ত্রণায় অস্থির; চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখে, যে রাজকুমার তাহার সম্মুখ ভাগে দণ্ডায়য়ান হইয়া রহিয়াছেন। তিনি মনোভিনিবেশ পূর্ব্বক এক দৃষ্টে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করাতে সে অধোবদন করিয়া ভূমির প্রতি চাহিয়া রহিল, তাহাতে সে দেখিতে পাইল তাহার মৎস্যলাঙ্গুল একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, যুবতী স্ত্রীলোকে যে পদ পাইবার অভিলাষ করিয়া থাকে, এমন দুটি শুভ্রবর্ণের ছোট ছোট অতি মনোহর পদ পাইয়াছে। অঙ্গে কিছুমাত্র পরিধেয় নাই, কি করে আপনার সুদীর্ঘ কেশ দ্বারা তাবৎ অঙ্গটা ঢাকাদিয়া লজ্জাতে অধোমুখে বসিয়া আছে। এমত সময় রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? কোথা হইতে আসিয়াছ,কেনইবা এখানে আইলে! বালিকার রসনা নাই, কিরূপে কথা কহিতে পারিবে, অতএব মনের শোকে আপনার নীলবর্ণ চক্ষুরুন্মীলন করিয়া রাজপুত্রের প্রতি মাধুর্য্যভাবে এক একবার দৃষ্টিপাত করিল, তদ্দ্বারা রাজনন্দনের অন্তঃকরণে দয়ার সঞ্চার হইলে তিনি তাহার হস্ত ধরিয়া রাজপ্রাসাদে আনয়ন করিলেন। পূর্ব্বে ডাকিনী তাহাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল, তীক্ষ্ণ ছুরিকা অথবা সূচির উপরে পদ প্রক্ষেপ করিলে যেরূপ বেদনা বোধ হয়, প্রতিধাপে পা দিলেই তোমার সেই রূপ ক্লেশ হইবে, সিড়ী দিয়া রাজ বাটীতে প্রবেশ কালীন তাহার কথা যথার্থ বোধ হইল, কি করিবে ইচ্ছা পূর্ব্বক কে তাহা সহ্য করিয়া থাকে, রাজনন্দন স্বয়ং তাহার হস্ত ধরিয়া লইয়া যাইতেছেন, একারণ সাবানকে ঘর্ষণ করিলে তাহা যেমন ক্রমশঃ বুদ্বুদ্ কাটিতে থাকে, সেই রূপ সে আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল, তিনি এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহার সুচারু গমন দেখিয়া অতিশয় চমৎকৃত হইলেন।
রাজ বাটীতে নীত হইলে পর ভৃত্যেরা অতি দামি রেশমি বস্ত্র আনাইয়া তাহাকে সুন্দর রূপে পরাইয়া দেওয়াতে এমত শোভা হইল যে তত্তুল্য রূপসী কন্যা কেহই আর রাজ ভবনে দৃষ্ট হইল না, কিন্তু সে বোবা না গান গাইতে পারে, না কথা কহিতেই পারে। সুন্দরী সুন্দরী দাসী সকল স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা হইয়া মনোহর বেশে রাজ পুত্র এবং তাঁহার পিতা মাতার সমীপে নৃত্য গীত করিতে আইল। তন্মধ্যে এক জনের অতি সুমধুর স্বর, রাজ নন্দন তাহা শ্রবণ করিয়া আহ্লাদে করতালি দিয়া ঈষদ্ধাস্য করিতে লাগিলেন। ইহাতে ঐ মৎস্যনারী অন্তঃকরণে বড় শোক পাইল। কেননা সে জানিত আমি কতবার ইহাদিগের অপেক্ষাও মধুর স্বরে গান করিয়া সমুদ্র বাসী লোক দিগকে সন্তুষ্ট করিয়াছি, আহা! কুমার যদি জানিতেন যে তাঁহার নিকটেই আসিবার কারণ অনন্তকালের নিমিত্ত আমার সেই স্বর নষ্ট হইয়াছে, তবে কত ভাল হইত।
পরে দাসীগণ নানাবিধ মতে অঙ্গ ভঙ্গি করিয়া সুচারুরূপে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে লাগিল। মৎস্যনারী নর্ত্তকীদের বেলয় নৃত্য দেখিয়া আপন নৃত্য সম্বরণ আর করিতে পারিল না, আপনার অতি সুন্দর শুভ্রবর্ণ হস্ত দুটি উত্তোলন করিয়া পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে নির্ভর করত দণ্ডায়মানা হইল, একবার দর্শকদিগের প্রতি কটাক্ষ দৃষ্টি করে, এক একবার অঙ্গ ভঙ্গি দ্বারা সুচারুরূপে ইতস্ততঃ মেঝ্যার মধ্যে নৃত্য করিয়া বেড়ায়, দেখিয়া সকলেই মোহিত, এবং সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করিল, যে পূর্ব্বে কখন এমন নৃত্য আমাদের চক্ষুর্গোচর হয় নাই। যতবার চলে ততবারই নূতন সৌন্দর্য্য হয়, তাহাতে আবার অমন সুন্দর মৃগনয়নের কটাক্ষ দৃষ্টি, রাজকুমার আর কতকাল স্থির হইয়া থাকিবেন, দাসীদিগের সংগীত দ্বারা তাঁহার মনে চাঞ্চল্য হয় নাই, কিন্তু মৎস্যনারীর কটাক্ষ বাণ এক বারে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ করিল। দর্শকদিগের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহার নৃত্য দেখিয়া বিপুলানন্দে মগ্ন হইয়াছিল বটে, কিন্তু রাজকুমারের মন আকৃষ্ট হইয়া তাহাতে যে রূপ মুগ্ধ হইয়াছিল, এমত কাহারও হয় নাই। তিনি সাগর তটমধ্যে উহাকে কুড়িয়া পাইয়াছিলেন একারণ স্নেহবশতঃ তাহাকে কুড়নী বলিয়া ডাকিতেন। অঙ্গুলীর অগ্রভাগ দ্বারা যতবার সে মেঝ্যাস্পর্শ করিল ততবারই তীক্ষ্ণ ছুরিকা যেন তাহাতে বিদ্ধ হইয়া গেল, তথাপি সে নৃত্য করিতে বিরাম করিল না। রাজকুমার সকলের কাছে অঙ্গীকার করিলেন আমি যাবজ্জীবন এই কন্যাকে পরিত্যাগ করিব না, একস্থানে একাসনে সর্ব্বদা কালযাপন করিব, আজ্ঞা করিতেছি, অদ্য রাত্রিকালে যেন ইহার অন্তঃপুরের গদি আমার দ্বারের সম্মুখভাগে পাতা থাকে।
অশ্বারোহণ করিয়া ঐ যুবতী যেন তাহার সঙ্গে ভ্রমণ করিতে পারে, এজন্য পুরুষের ন্যায় করিয়া তাহাকে বস্ত্র পরিধান করাইয়া ঘোটকারোহণে উভয়েই সদ্গন্ধযুক্ত অরণ্য মধ্য দিয়া যায়, হরিদ্বর্ণ বৃক্ষ শাখা সকল তাহাদের স্কন্ধদেশ পর্য্যন্ত স্পর্শ করিল। শীতল পত্র মধ্যে ক্ষুদ্র পক্ষীরা বিবিধ স্বরে গান করিয়া কেলী করিতেছে, এমত সময়ে তাহারা একটা পর্ব্বত দেখিতে পাইয়া পাশাপাশি দুই জনেই তাহাতে আরোহণ করিতে লাগিল; যাইতে যাইতে মৎস্যনারীর কোমল পদ হইতে রক্ত বহির্গত হইতেছে, আর আর সঙ্গীগণ তাহা দেখিতে পাইলেও সে তাহাতে দুঃখ বোধ করিল না, বরং তাচ্ছীল্য করিয়া হাস্য করিতে লাগিল। পর্ব্বতটা অতি উচ্চ, রাজকুমারের সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপরিভাগ পর্য্যন্ত উহারা যাইয়া দেখে, দূর দেশে পক্ষীরা উড়িয়া যাইতেছে দেখিলে যেরূপ বোধ হয়, তাহাদের অধোভাগেও মেঘ সকল সেই রূপ চলিয়া যাইতেছে। তথা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া যখন ঐ মৎস্যনারী দেখিল যে রাত্রিকালে রাজবাটীর অন্যান্য লোক সকলেই নিদ্রাবস্থায় আছে, তখন সে বারাণ্ডার অধস্থিত প্রস্তরময় শিড়ীর উপর বসিয়া শরীরশীতল করিবার আশয়ে আপন উত্তাপিত পদদ্বয়কে সমুদ্র জলে ডুবাইল; আর গভীর সমুদ্রের অধস্থলের তাবৎ বিষয় গুলীন মনে করিয়া অতিশয় চিন্তান্বিত হইল।
একদিন রাত্রিকালে দেখে তাহার ভগিনীর পরস্পর হাতে হাতে বন্ধন করতঃ জলের উপরিভাগে উঠিয়াছে, শোকে অতিশয় কাতর, বড় একটা সাঁতার করিতে পারিতেছে না, আস্তে আস্তে ভাসিতেছে। অনেক সঙ্কেত করিবাতে তাহারা উহাকে চিনিতে পারিয়া তাহার নিকট পর্য্যন্ত আইল, এবং তদ্বিরহে তাহারা যেরূপ শোক প্রাপ্ত হইয়াছিল, সে সকলই তাহাকে জানাইল। এইরূপে তাহারা প্রতিরাত্রি জলোপরি আসিয়া আপন ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ করে। একবার সে দূর হইতে আপন বৃদ্ধা পিতামহীকে দেখিতে পাইল, মুকুট মস্তকে সমুদ্র রাজও তাঁহার সহিত আছেন, বহুকাল তাহারা সমুদ্র জলের উপরিভাগে উঠেন নাই, এজন্য তাহার ভগিনীরা যত তটের নিকটে আসিয়াছিল, তাহারা তত নিকটে আসিতে না পারিয়া আপনাদিগের হস্ত গুলীন তাহার প্রতি বিস্তারিয়া ছিল।
প্রতিদিন সে রাজকুমারের প্রতি প্রেমাধিক্য জানাইবাতে আমরা যেমন প্রাণাধিক আপন গুণবান পুত্রকে স্নেহ করিয়া থাকি, তিনিও সেই রূপ বাৎসল্য ভাব প্রকাশ করিয়া তাহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভাল বাসেন, কিন্তু বিবাহ করিয়া তাহাকে রাজমহিষী করিব, এমন বাসনা তাঁহার মনে এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত হয় নাই; আহা! রাজপত্নী না হইলে সে অমর আত্মা প্রাপ্ত হইতে পারিবে না, যে দিনে রাজকুমার অন্য কন্যার পাণি গ্রহণ করিয়া আপন ধর্ম্ম পত্নী করিবেন, তৎপর দিবসেই সে সমুদ্র জলে লীন হইয়া একেবারে ফেনা হইয়া যাইবে।
রাজকুমার তাহার মুখ মণ্ডলে চুম্বন করিয়া তাহাকে আপন হৃদয়োপরি গ্রহণ করিলেই সে কটাক্ষ ঈক্ষণ দ্বারা যেন জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রেম কর কি না। রাজপুত্র বলিলেন, তোমার অন্তঃকরণ সর্ব্বাপেক্ষা সরল এজন্য তোমাকেই আমি সকল হইতে অধিক প্রেম করি। আর একটি আশ্চর্য্য কথা শুন একবার আমি জাহাজে করিয়া সমুদ্র মধ্যে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। দৈবাধীন জাহাহ খানা ঝটিকা দ্বারা জল মধ্যে নিমগ্ন হইয়া যায়, তরঙ্গোপরি ভাসিতে ভাসিতে আমি একটা মন্দিরের নিকটে উপস্থিত হইয়াছিলাম, ঐ পুণ্য ক্ষেত্রে কয়েক জন যুবতী দেবারাধনা করিতেছিল; উহাদের মধ্যে যে অত্যল্প বয়স্কা সেই আমাকে তটোপরি লইয়া আমার জীবন রক্ষা করিয়াছে, আহা! আর বুঝি তাহাকে আমি কখনই দেখিতে পাইব না। কিন্তু তোমার আকার প্রকার সকলই তাহার ন্যায়, এবং আমার প্রতি তুমি অতিশয় অনুরক্তা, বল দেখি প্রেয়সী! তোমাকে আনিয়া আর কি কাহাকেও প্রেম করিতে পারি? প্রিয়ে! আর একটি কথা শুন, আমি সেই রমণীকে দুইবার বই দেখি নাই, তোমা ছাড়া এজগতে যদি আর কাহাকেও প্রেম করিতে হয়, তবে সেই কন্যাই আমার প্রেমের পাত্রী; কিন্তু তোমার অবয়ব সর্ব্ব বিষয়েই তাহার ন্যায়, সেই মুখ, সেই নাক, সেই চক্ষু, সেই প্রকার হস্ত পদাদি সকলই তোমার আছে, তুমি আমার হৃদয় ভাণ্ডার হইতে সেই রূপটি বাহির করিয়া লইয়াছ, সে পবিত্র মন্দির সম্পর্কীয়া নারী এজন্য ভাগ্য ফলে দেবতাগণ বুঝি তোমাকে আমার নিকটে পাঠাইয়াছেন, তুমি আমার সর্ব্বস্ব ধন তোমাকে কখনই আমি পরিত্যাগ করিব না।
মৎস্যনারী রাজনন্দন সুখে এতাবৎ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিল, কি দুঃখ, রাজা জানেন না যে আমি তাহাকে সমুদ্র হইতে উদ্ধার করিয়া তাহার জীবন রক্ষা করিয়াছি, যে পবিত্র মন্দিরের কথা রাজকুমার আমায় কহিতেছেন আমিই তাঁহাকে বহন করিয়া সেই মন্দিরের নিকটে লইয়া যাই, কোন মনুষ্য আসিয়া তাঁহাকে সাহায্য করে কি না, তাহা দেখিবার জন্য আমিই সেই ফেনার নীচে বসিয়াছিলাম, যে রূপসী কন্যাকে রাজা আমা অপেক্ষা অধিক প্রেম করেন, আমি তাহাকে দেখিয়াছি, এই চিন্তায় অভিভূতা হইয়া সে হাহাকার করিতে লাগিল, কেন না নিতান্ত দুঃখিতা ছিল বলিয়া তাহার চক্ষু হইতে অশ্রু পতিত হয় নাই। আপন ভগ্নচিত্তকে সান্ত্বনা করিবার নিমিত্ত মৎস্যনারী বলিল, “রাজকুমার বলিয়াছেন যে সে রমণী পবিত্র মন্দির সম্পর্কীয়া অতএব সে পৃথিবী তলে আর কখন পুনরাগমন করিবে না, আমি কেন তাহার জন্যে এত ভাবিয়া মরি” যদি প্রতিদিন আমি রাজপুত্রের উপর দৃষ্টি রাখিয়া পাশাপাশি দিবা রাত্রি তাঁহার সহিত কাল যাপন করি, তবে ঐ কামিনী পুনরায় আর তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবে না। আমি প্রাণপণে রাজনন্দনকে প্রেম করিবার বিশেষ যত্ন করিব, উহাঁর জন্য যদি আমার জীবন পর্য্যন্ত নষ্ট করিতে হয় তাহাতেও অসম্মতা নহি।
এমন সময় রাজনন্দনের বিবাহ সম্বন্ধোপলক্ষে ভাটেরা রাজ সভাতে কোন অদূরবর্ত্তী রাজার এক পত্র আনয়ন করিল, রাজকন্যা পরমা সুন্দরী এবং সেই দেশ সন্নিহিত এক বিখ্যাত রাজার কন্যা, অতএব পুত্রবধূ যথা যোগ্যা হইবে বলিয়া রাজা-রাণী আনন্দ সাগরে মগ্ন হইলেন, আর ভাটদিগকে শাল দোশালা স্বর্ণাঙ্গুরী প্রভৃতি পুরস্কার দিয়া কহিলেন, তোমরা এক্ষণে বিদায় হও আমরা সম্বন্ধ এক প্রকার স্থির করিলাম, অল্প দিনের মধ্যেই আমার সভা হইতে পাত্র মিত্র গণ যাইয়া রাজকন্যাকে দর্শনী প্রদান করিবেন। রাজকুমার স্বয়ং সেই কন্যা দেখিবার মানসে বিস্তর সমারোহ করিয়া একখান জাহাজে যাত্রা করিলেন, পাছে পিতা মাতা টের পান এজন্য লোক দিগকে কহিয়া দিলেন, তোমরা ঘোষণা করিয়া দেও, রাজনন্দন সন্নিহিত অধিকার সকল একবার দেখিতে যাত্রা করিবেন, কিন্তু বাস্তবিক সে সকলই মিথ্যা, রাজকুমারীকে দেখাই তাঁহার প্রধান সংকল্প ছিল। অনেক লোক সঙ্গে যাইতেছে ইহা দেখিয়া মৎস্যনারীও মস্তক সঞ্চালন করত, ঈষৎ হাস্য করিতে লাগিল। কেহই তাহার মত রাজকুমারের মনোগত ভাব বুঝিতে পারিত না। তখন রাজপুত্র কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ে! ক্ষান্ত হও, আমার সঙ্গে যাইতে এত উদ্যতা হইও না। পিতা মাতা আমার বিবাহ জন্য উদ্যোগ করিতেছেন, সে কেমন সুন্দরী কন্যা আমি অদ্যাবধি দেখি নাই, অতএব স্বচক্ষে তাহাকে একবার দর্শন করা উচিত হয়; কিন্তু মনেও করিও না, বিবাহ না করিলে তাহারা বল পূর্ব্বক আমার সঙ্গে সেই কন্যার বিবাহ দিবে। যদিও দেয়, তথাপি আমি তাহাকে কোন প্রকারেই প্রেম করিতে পারিনা, মন্দিরে যে যুবতীকে আমি দর্শন করিয়াছিলাম, তুমি সর্ব্ব বিধায়ে তাহারই ন্যায়, কিন্তু সে রাজনন্দিনী তদনুরূপ কখন হইতে পারিবে না। ওলো আমার বোবা কুড়ানী! তুমি মৃগচক্ষু দ্বারা মনোগত সকল ভাবই প্রকাশ করিয়া থাক যদি আমাকে বিবাহ করিতে হয়, তবে অত্যল্প কালের মধ্যেই আমি তোমাকে বিবাহ করিব। ইহা বলিয়া রাজনন্দন তাহার মুখচুম্বন করিয়া তাহার দীর্ঘকেশে হস্ত বুলাইতে লাগিলেন, প্রেম ভাবে আপন মস্তকটিও তাহার বক্ষস্থলে দিলেন, তাহাতে মানবীয় সুখ এবং অমর আত্মা পাইবার প্রত্যাশায় মৎস্যনারীর হৃদয়কমল একেবারে গুর গুর করিয়া উঠিল।
সমীপবর্তী রাজার অধিকার মধ্যে গমন সময়ে বিস্তর ঘটা পূর্ব্বক জাহাজ খান প্রস্তুত হইলে রাজকুমার মৎস্যনারীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, অরে আমার বোবা প্রিয়ে, তুমি সমুদ্রে যাইতে ভয় কর কি না? শুন প্রিয়ে সমুদ্র মধ্যে কখন কখন ঝড় উপস্থিত হয়, কখন ইহার জল স্থির ভাবে থাকে, ইহার গভীর স্থানের মধ্যে অত্যাশ্চর্য্য মৎস্য সকল বাস করে, যে ব্যক্তি ইহার জলে ডুবিয়া অধোভাগে গিয়াছে, তত্রস্থিত আশ্চর্য্য বস্তুর বিষয় সেই ভাল জানে; একথা শুনিয়া মৎস্যনারী অল্প অল্প হাস্য করিতে লাগিল, কেননা সমুদ্রের অধস্থিত বস্তু সকলের বিষয় সে যেমন জানে, আর কেহই তেমন জানে না।
রাত্রিকালে শূন্যমার্গে শশধর উদিত হইয়া ছিলেন, জ্যোৎস্নায় চারিদিক দেদীপ্যমান, জাহাজস্থিত তাবল্লোকেই নিদ্রিত, কেবল মাজি হাইলটি ধরিয়া জাগ্রত ছিল, এমত সময়ে সে জাহাজের চাঁদনীর উপর উপবেশন করিয়া নির্ম্মল জলের মধ্যদিয়া দেখিতে দেখিতে তাহর অনুভব হইল, ঐ বুঝি পিতা মহাশয়ের অট্টালিকা হইবে, যে স্ত্রীলোকের মস্তকোপরি রৌপ্য মুকুট দেখিতেছি, তিনিই বুঝি আমার বৃদ্ধা পিতামহী, রাজবাটীর উপরিভাগে দণ্ডায়মানা হইয়া মনঃ সংযোগ করত, ঐ জাহাজ খানার প্রতি দৃষ্টি করিতেছেন, ক্ষণকাল বিলম্বে সে দেখিতে পাইল, যে ভগিনীরাও সমুদ্র জলের উপরিভাগে উঠিয়া এক দৃষ্টে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিতেছে, শোকেতে তাহারা অতিশয় ব্যাকুলা হইয়া আপনাদিগের শুভ্রবর্ণ হস্ত সকলকে মোড়া লাগাইতেছে। সে সঙ্কেত দ্বারা হাস্য বদনে তাহাদিগকে জানাইবার উদ্যোগ করিল আমি এখানে পরমসুখে উত্তমাবস্থায় আছি! এমত সময়ে জাহাজস্থিত একজন নাবিক আসিয়া পড়াতে তাহারা তরঙ্গের অধোভাগে নিমগ্ন হইয়া গেল, নাবিক মনে মনে স্থির করিল যে শ্বেতবর্ণ অবয়ব সকল আমি চক্ষে দেখিয়াছি বুঝি তাহা কেবল জলের ফেনাই হইবে।
পরদিন প্রাতঃকালে জাহাজখান সেই মহাপরাক্রান্ত প্রতাপশালী রাজা মহাশয়ের সুশোভন রাজধানীর বন্দরে আসিয়া লাগিল। বিদেশীয় রাজার জাহাজ আসিয়া বন্দরে লাগিলে দামামার শব্দ ও ঘণ্টার ধ্বনি হয়, সিপাহীরাও নানা বর্ণের পরিচ্ছদ এবং মস্তকে টুপী পরিয়া বিদেশীয় রাজার সম্বর্দ্ধনা করিতে আইসে। রাজকুমারের আগমনে সন্নিহিত রাজা মহাশয় অনেক ঘটাতে এ সকল বিষয় সমাধা করিলেন, প্রতি দিন নূতন নূতন সুখ সেব্য খাদ্য সামগ্রী পাঠাইয়া দেন, রাজধানীতে আহ্লাদের আর পরিসীমা নাই, কোন স্থানে নর্ত্তকীরা নানা প্রকার অঙ্গ ভঙ্গি দ্বারা সুচারুরূপে নৃত্য করিয়া দর্শকদিগের মনোরঞ্জন করিতেছে, কোন স্থানে গায়কেরা নানাবিধ রাগ রাগিনী এবং মূর্চ্ছনাদি দ্বারা স্বর শক্তি প্রকাশ করিয়া রাজ্যস্থিত তাবল্লোককেই হর্ষ প্রদান করিতেছে, প্রধান প্রধান আমীর লোকদিগের সহিত মহারাজ রাজনন্দনকে মহোৎসবে বিবিধ খাদ্য সামগ্রী আয়োজন করিয়া নিত্য নিত্য নূতন নূতন ভোজ্য প্রদান করেন। কিন্তু লোক মুখে রাজকুমার শুনিয়াছিলেন, যে রাজকন্যা এখানে নাই, এই স্থানের অনতিদূরে একটা পবিত্র মন্দির আছে, যে যে রাজকন্যা সেখানে গিয়া বিদ্যাভ্যাস করে, তাহারা রাণীর উপযুক্ত তাবৎগুণেই ভূষিতা হইয়া থাকে, একারণ এতদ্দেশীয় রাজা সেই স্থানেই আপন কন্যা প্রেরণ করিয়াছেন, অত্যল্প দিনের মধ্যে তিনি রাজভবনে আসিবেন। সভামধ্যে বসিয়া রাজকুমার এই সকল কথা মনে মনে আন্দোলন করিতে ছিলেন; ইতি মধ্যে প্রহরীগণ করযোড়ে রাজার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কহিল, মহারাজ! সর্ব্ব বিদ্যায় পারদর্শিনী হইয়া আপনার কন্যা বাটীতে আসিয়াছেন।
সন্ধ্যার সময়ে রাজনন্দন আপন সহচরীকে সঙ্গে লইয়া রাজতনয়াকে দেখিবার নিমিত্ত রাজার অন্তঃপুরে গমন করিলেন, মৎস্যনারী তাঁহার রূপ লাবণ্য দর্শন করিয়া অত্যাশ্চর্য্যা হইল, এবং মনে২ আপনিই স্বীকার করিল, এমন প্রিয় বদন মণ্ডল আমি কখন দর্শন করি নাই। আহা! রাজকন্যার সমুদায় শরীরটাই কোমল, কিবা গৌরাঙ্গী! বিধাতা বুঝি গোপনে বসিয়া তাঁহার মুখমণ্ডল নির্ম্মাণ করিয়াছেন, চক্ষুদুটি কেমন মনোহর; ভ্রু এবং পক্ষ্মগুলীন কি রূপ কৃষ্ণবর্ণ তন্নিম্নভাগে বড় বড় চক্ষুদ্বয় থাকাতে মরি মরি কিশোভাই বা হইয়াছে, বোধ হয় ইনি কটাক্ষবাণে মুনি ঋষির মন হরণ করিতে পারেন। রাজকুমার ঐ যুবতী রমণীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, আমি যখন সাগর তটে নির্জীব হইয়া মৃতবৎ পড়িয়াছিলাম, বোধ হয় তখন তুমিই আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছ। তোমা ভিন্ন অন্য কেহই এমন কর্ম্ম করিতে পারিবে না, ইহা বলিয়া ঐ লজ্জাশীলা কন্যাকে আপন ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। আর অল্পবয়স্কা মৎস্যনারীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ে অদ্য আমি বিপুলানন্দে মগ্ন হইয়াছি, যাহাকে আমি এত দিন স্বপ্নে দর্শন করিতাম, ভাগ্যবশতঃ বুঝি বিধি আজ তাহাকে মিলাইয়া দিলেন। তুমি, আমার সুখে সুখী এবং আমার দুঃখে দুঃখী, সর্ব্বান্তঃকরণের সহিত আমার মঙ্গল প্রার্থনা কর, অতএব এ শুভদিনের সুখে তুমি অবশ্যই সুখী হইবে। এই কথাতে মৎস্যনারী তাঁহার হস্ত চুম্বন করিল, কিন্তু তাহার প্রাণে কিছু সুখ নাই, মনোদুঃখে বক্ষঃস্থলটা ফাটিয়া যাইতেছে, যে রাত্রিতে রাজকুমার বিবাহ করিবেন, তৎপর দিন প্রাতঃকালে তাহাকে কালগ্রাসে পতিত হইয়া সমুদ্র ফেনায় লীনা হইতে হইবে।
এ দিকে রাজকন্যার বিবাহোপলক্ষে রাজধানীর স্থানে স্থানে বাদ্য বাজিতে লাগিল। পাত্রবাহক ভাটেরা আসিয়া সর্ব্বত্র ঘোষণা করিয়া দিল, অমুক দিনে অমুক সময়ে রাজনন্দিনীর শুভ বিবাহ হইবে, বরপাত্র রাজবাটীতে শুভাগমন করিয়াছেন, অতএব হে রাজ্যস্থ লোক সকল মহারাজ কন্যাকে পাত্রস্থা করণ কালীন আপনাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন, পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম। মহারাজ যৌতুক স্বরূপ রাজকুমারকে কত ধন দিলেন, বাহুল্য ভয়ে তাহা লিখিতে পারিলাম না। রূপার প্রদীপে তৈল জ্বালাইয়া কুল পুরোহিত মহাশয় মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক বর কন্যার হস্তে হস্ত সংমিলিত করাইয়া দিলেন। মৎস্যনারী স্বর্ণাভরণ এবং রেশমী বস্ত্র পরিধান করিয়া নবোঢ়ার রক্ত বস্ত্রের অঞ্চলটি ধরিয়া চলিল; কিন্তু বাদ্যের শব্দ তাহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল না, বিবাহের যে এ ঘটা চক্ষুরুন্মীলন করিয়া তাহাও সে দৃষ্টি করিল না। পরদিন প্রাতঃকালে তাহাকে কৃতান্তের করালগ্রাসে পতিতা হইতে হইবে, যাহার জন্য সে এজগতের তাবৎ সুখেই জলাঞ্জলি দিয়াছে, তাহাকেও এবার জন্মের মত পরিত্যাগ করিতে হয়, এই চিন্তায় একেবারে সে অধীরা হইয়া পড়িল, আর বিবাহ দেখিবে কি? রাত্রি এক প্রহর হইলে বর কন্যা উভয়েই সেই জাহাজের ভিতরে গেলেন, তোপের শব্দে কাণ পাতা যায় না, বিবিধ বর্ণের নিশান আনাইয়া জাহাজে তুলিয়া দিল, জাহাজের চাঁদনীর উপর একটা সোণার হলকরা তাম্বু খাটাইয়াতন্মধ্যে অতি সুন্দর একটি গদি পাতিয়া রাখিল, যেন বর কন্যা আসিয়া তাহারই উপর উপবেশন করেন।
পরে সুবাভাস পাইয়া নাবিকেরা পাইল তুলিয়া দিলে জাহাজখান স্থির সমুদ্র বারি মধ্যে আস্তে আস্তে চলিল। বিবিধ বর্ণের ষাড় এবং লণ্ঠন সকল টাঙ্গাইয়া জাহাজস্থিত মল্লা সমূহ নৃত্য করিতেছে, তাহা দেখিয়া মৎস্যনারীর স্মৃতি হইল, প্রথমে যখন পৃথিবীমধ্যে আগমন করিয়াছিলাম, তখন এই রূপ সমারোহ এবং মহোৎসব আমি জাহাজমধ্যে দেখিয়াছি; আহা যদি মরিতেই হইল তবে একবার মনের সাধে নৃত্য করিয়া দর্শকদিগের মনোরঞ্জন করি। এই ভাবিয়া সে নৃত্য দ্বারা সকলেরই মন হরণ করিল, উপস্থিত ব্যক্তি দিগের আহ্লাদের আর পরিসীমা নাই, সকলেই এক বাক্য হইয়া স্বীকার করিল, আমরা এমন মনোহর নৃত্য পূর্ব্বে কখন দর্শন করি নাই। তীক্ষ্ণ ছুরিকা পদে ফুটিলে যেরূপ ব্যথা হয়, তাহার কোমল পদেও সেরূপ বেদনা হইয়াছিল, কিন্তু সে ঐ যাতনাকে যাতনা বোধ করিল না, মনের যাতনাই বড় যাতনা, তাহা তীক্ষ্ণ ছুরিকা হইতেও অধিক ক্লেশকর হয়। সে মনে মনে নিশ্চয় জানিত যাহার জন্য জ্ঞাতি, কুটুম্ব, গৃহ প্রভৃতি সকলই পরিত্যাগ করিয়াছি, যাহার জন্য আমার মধুর স্বরটী জন্মের মত গিয়াছে, যাহার জন্য প্রতিদিন এমন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি, যিনি আমার হৃদয়ের ধন হইয়াও এ সকল বিষয়ের কিছুই জানেন না, রজনী প্রভাতে আর আমি তাহাকে দেখিতে পাইব না। তাঁহার সঙ্গে সহবাস করিয়া যে বায়ু আমি নিশ্বাস প্রশ্বাস দ্বারা ধারণ করিতেছি, যে সমুদ্রের প্রতি আমি সর্ব্বদা অবলোকন করি, যে নক্ষত্র আকাশে দেখিলে আমি অতিশয় পুলকিত হই, রজনীর শেষে সে সকলেরই শেষ হইবে। এই রূপ চিন্তায় দুঃখিনী বালা মনে মনে কতই শোক করিতেছে, যথা এরাত্রি আমার পক্ষে কালরাত্রি স্বরূপ, আমার আত্মা নাই যে পুনর্জীবন প্রাপ্ত হইবার কোন ভরসা আছে, এবং পরমাত্মা পাইবারও কোন আশা নাই, অতএব আমার জন্য বুঝি অনন্তকাল রাত্রি অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে। ক্রমে ক্রমে রজনী ঘোরা হইয়া দুই প্রহর পর্য্যন্ত হইল, তখনও জাহাজস্থিত লোক সকলে আমোদ প্রমোদ করিতেছে, মৎস্যনারী মৃত্যু চিন্তাতে ব্যাকুলা থাকিয়াও মনে মনে ইচ্ছা করিল, আর কিছুকাল এই রূপ হাস্য এবং নৃত্য করিয়া রাত্রি যাপন করি, কিন্তু রাজকুমার আপন প্রাণেশ্বরী সেই নবোঢ়া বালার মুখ চুম্বন করিলে তিনিও অঙ্গ ভঙ্গিতে তাঁহার কন্দর্পানল জাগরূক করিয়াদিলেন এবং পরস্পর হাত ধরিয়া তাম্বুর অধোভাগে যে অপূর্ব্ব শয্যা প্রস্তুত হইয়াছিল তাহাতে শয়ন করিতে গেলেন।
জাহাজস্থিত তাবল্লোকেই নিদ্রিত, প্রাণিমাত্রেরও শব্দ শুনা যায় না। কেবল অর্ণবযান সোজা পথে যাইবে কি না এজন্য প্রধান মাজি হাইল ধরিয়া দণ্ডায়মান ছিল, মৎস্যনারী ইহার এক ধারে হেলানদিয়া পূর্ব্বদিকের প্রতি নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কতক্ষণে উহা রক্তিমবর্ণ হইয়া রাত্রি প্রভাত করিবে। কেননা সে জানিত দিবাকরের প্রথম দীপ্তি আমার জীবন দীপ্তি একেবারে বিনাশ করিবে। কিয়ৎক্ষণপরে সে দেখিতে পাইল যে তাহার ভগিনীরা তরঙ্গ হইতে বহির্গত হইয়া জলোপরি ভাসমান হইয়াছে। আপনি ভাবিয়া ভাবিয়া যেরূপ পাংশুবর্ণ হইয়াছে, তাহাদিগকেও সেইরূপ পাংশুবর্ণ দেখিল, তাহাদের মস্তক স্থিত যে দীর্ঘ কেশ সকল বায়ুভরে প্রবাহিত হইত আর তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না, সকলই কাটা গিয়াছে।
তাহারা বলিল, ভগিনী! তুমি আমাদের মস্তকের প্রতি দৃষ্টি কর কি অদ্যরাত্রি তুমি যেন নিদারুণ মৃত্যুর হস্তে পতিত না হও, এই সাহায্য পাইবার জন্য আমরা ডাকিনীকে তাহা দিয়াছি, এই দেখ তৎপরিবর্ত্তে ডাকিনী আমাদিগকে এক খান তীক্ষ্ণ ছুরিকা দিয়াছেন। সম্প্রতি ভগিনী! আমরা যে কথা বলি তাহা মনদিয়া শুন, সূর্য্যোদয় হইবার পূর্ব্বে এই ছুরিকা হস্তে লইয়া রাজকুমারের হৃদয় কমল বিদীর্ণ করিয়া ফেল, তাহার উষ্ণরক্ত তোমার চরণে ছিটিয়া লাগিলেই তাহা সংযোজিত হইয়া পূর্ব্ববৎ তোমার মৎস্যলাঙ্গূল হইবে, তাহা হইলেই তুমি পুনর্ব্বার মৎস্যনারী হইয়া আমাদের নিকট আসিতে পারিবে, এবং অচেতন লবণ সমুদ্রের ফেনা হইবার পূর্ব্বে আর তিন শত বৎসর আমাদের সঙ্গে সুখে কাল যাপন করিবে। অপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া তাহারা বলিতে লাগিল, ভগিনী! অধিকক্ষণ বিলম্ব করিবার আবশ্যক নাই, শীঘ্র যাও, শীঘ্র যাও, সূর্য্যোদয় হইবার পূর্ব্বে তুমিই হউক, নাহয় রাজপুত্রই হউক, দুইজনের একজনকে অবশ্য মরিতে হইবে। দেখ তোমার জন্য ডাকিনী আমাদের সুন্দর কেশগুলীন যেরূপ কাঁচি দ্বারা কাটিয়া লইয়াছে, বৃদ্ধা পিতামহীরও ঐ দশা, তিনি তোমার নিমিত্তে ভাবিয়া২ একেবারে জীর্ণা এবং শীর্ণা হইয়া পড়াতে তাঁহার মাথার পক্বকেশ সকল উঠিয়া গিয়াছে। অধিক কথায় আবশ্যক নাই, দেখ ভগিনী! আকাশ মণ্ডলে রক্তিমবর্ণের রেখা গুলীন দৃশ্য হইতেছে, আর বিলম্ব করিও না, শীঘ্র যাও শীঘ্র যাও, অত্যল্প ক্ষণের মধ্যে সূর্য্যোদয় হইবে, তাহা হইলে আর তুমি প্রাণে বাঁচিবে না, যমরাজ একেবারে তোমায় গ্রাস করিয়া ফেলিবেন। এই কথা বলিতে বলিতে তাহারা পূর্ব্ববৎ দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া তরঙ্গের অধোভাগে নিমগ্ন হইয়া গেল।
মৎস্যনারী তাম্বুস্থিত লোহিত বর্ণের মশারি তুলিয়া দেখে, নবোঢ়া রাজকন্যা আপন মস্তকটি রাজকুমারের বক্ষঃস্থলে রাখিয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছেন, জন্মের মত নত হইয়া তাঁহার পরম সুন্দর ললাটে চুম্বন করিল, আকাশমণ্ডলের প্রতি নেত্রপাত করিয়া দেখে, প্রভাত, সুন্দরী গোলাপী রঙ্গে আবৃতা হইয়া গমন করিতেছেন, কিয়ৎক্ষপ তীক্ষ্ণ ছুরিকাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, পুনর্ব্বার রাজকুমারকে অবলোকন করিয়া শুনিতে পাইল, তিনি নব বিবাহিতা কন্যার ভাবে মুগ্ধ হইয়া স্বপ্ন কালেও তাহার নাম ধরিয়া ডাকিতেছেন, একবার আপন স্বভাব প্রাপ্ত হইয়া ছুরি খাবা দৃঢ় করিয়া ধরিল, কিন্তু যাহার মঙ্গল সর্ব্বান্তঃকরণের সহিত চিরকাল প্রার্থনা করিয়াছে, তাহার হৃদয় কমল কিরূপে সে ছুরিকা দ্বারা বিদ্ধ করিতে পারে, এজন্য পরক্ষণেই তাহা সমুদ্র তরঙ্গে টান মারিয়া নিঃক্ষেপ করিল। জল মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়িলে যেরূপ শব্দ এবং দৃশ্য হইয়া থাকে, ছুরিখানা যেখানে পড়িল সেখানে সেইরূপ রক্তবর্ণের আভা প্রকাশ করিল। মরিবার সময় যেমন মানুষে বিকট মূর্ত্তিতে শেষ চাউনি চাইয়া মরে, ঐ নারীও রাজনন্দনের প্রতি মুহূর্ত্তেক সেইরূপ নিরীক্ষণ করিয়া এককালে জাহাজ হইতে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়া পড়িল, এবং ক্ষণমাত্রে তাহার বোধ হইল দেহটা ক্রমে সমুদ্র ফেনায় লীন হইয়া যাইতেছে।
তখন সমুদ্রের পূর্ব্বদিকে সূর্য্যদেব স্পষ্টরূপে উদিত হইলেন, উহার উষ্ণ প্রভা সেই শীতল ফেনায় লাগিবাতে মৎস্যনারীকে মৃত্যু যন্ত্রণা কিছুই সহ্য করিতে হইল না। পরমসুন্দর দিবাকরকেও যে চক্ষে দেখিতে পাইল, ঊর্দ্ধ দৃষ্টি করিবামাত্র দেখিল যে উপরিভাগে শত শত স্বচ্ছকায় সূক্ষ্ম জীবগণ অবস্থিতি করিতেছে, তখনও রাজনন্দনের জাহাজস্থ শুভ্রবর্ণ পাইল গুলান তাহার দৃষ্টির অগোচর হয় নাই, এবং ঐ অসংখ্য মনোহর সূক্ষ্ম জীবদিগের মধ্যদিয়াও সে রক্তিমবর্ণের মেঘ সকলকে দেখিল। তাহাদের ভাষা অতি সুমিষ্ট কিন্তু বায়ুবৎ হওয়াতে মনুষ্যজাতি তাহা কর্ণে শুনিতে পায় না, তাহাদের অবয়ব গুলীন মানবদিগের দর্শনাতীত হয়, কোন ব্যক্তিই তাহাদিগকে চক্ষে দেখিতে পায় না। পাখা না থাকিলে ও অতি লঘুকায় প্রযুক্ত তাহারা শূন্য মার্গে অনায়াসে অবস্থিতি করে। মৎস্যনারী ও সেরূপ শরীর প্রাপ্ত হইয়া ক্রমে ক্রমে ফেনা হইয়া উর্দ্ধে উঠিতে লাগিল। কিয়দ্দূরে উত্থিত হইয়া সে উচ্চৈঃস্বরে কহিল আমি এক্ষণে কোথায় আসিতেছি, তাহার সঙ্গী দিগের স্বর যেরূপ নির্ম্মল এবং সূক্ষ্ম তাহার স্বরও সেই রূপ সূক্ষ্ম এবং নির্ম্মল ছিল, পৃথিবীস্থ কোন বাদ্যই তত্তুল্য উত্তম ভাবের মাধুর্য্য উপলব্ধি করাইতে পারে না।
তাহারা প্রত্যুত্তর প্রদান করিল, ওগো মৎস্যনারী! ভাবনা করিওনা, সম্প্রতি তুমি গগন কন্যাদিগের নিকটে আসিয়াছ, তোমাদের মধ্যে কোন স্ত্রীরই অমর আত্মা নাই, সর্ব্বান্তঃকরণের সহিত কোন মনুষ্য তোমাদিগকে আত্যন্তিক প্রেম না করিলে তোমরা কোনমতেই অমর আত্মা পাইতে পার না। পরের হস্তে তোমাদের অনন্ত মঙ্গল, তাহার ইচ্ছাতে তোমরা প্রাপ্ত হও, অনিচ্ছাতে হারাও। কিন্তু গগন কন্যাদের স্বভাবতঃ অমর আত্মা না থাকিলেও সৎকর্ম্ম দ্বারা তাহা প্রাপ্ত হইতে পারে। উষ্ণ দেশে যে উত্তাপিত আকাশ বায়ু মহামারী দ্বারা মনুষ্য জাতির সন্তানদিগের প্রাণ সংহার করে, আমরা সেই দেশে যাই, এবং নানাবিধ পুষ্প সৌরভ দ্বারা তথাকার নাশক বায়ুকে সঞ্চালিত করাইরা তৎপরিবর্ত্তে জীবন বায়ু বিস্তারিত করি, তাহাতেই মারীভয়ের করালগ্রাস হইতে সকল প্রাণীই বিমুক্ত হয়। যদ্যপি তিন শত বৎসর পর্য্যন্ত এই রূপ চেষ্টা করিয়া সাধ্যানুসারে মনুষ্যদিগের হিতান্বেষণ করি, তবেই আমরা অমর আত্মা প্রাপ্ত হইয়া মানব জাতি সম্পর্কীয় অনন্ত সুখের অংশী হইতে পারিব। ওগো অবলা মৎস্যনারী তুমিও আমাদিগের ন্যায় সর্বান্তঃকরণের সহিত মনুষ্যের হিত চেষ্টা করিয়াছ। আহা! কত দুঃখ সহিয়াছ তাহা বলিতে পারা যায় না, তথাপি ভৌতিক দেহ প্রাপ্ত হইয়া তোমার আত্মাকে শূন্যে থাকিতে হইল, ভয় নাই ভয় নাই, তিন শত বৎসর গত হইলে তুমি অমর আত্মা পাইবে।
তখন মৎস্যনারী আপনার সুনির্ম্মল চক্ষু দুটি সূর্য্যের প্রতি ফিরাইল, যাহাতে তাহা প্রথমতঃ অশ্রু পূর্ণা হয়। জন্মাবধি এতকাল পর্য্যন্ত কখনই ঐ চক্ষুদ্বয়ে অশ্রু পতন হয় নাই, এজন্য পূর্ব্বে কতবার যে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া হাহাকার শব্দ করিয়াছে। কিয়ৎক্ষণ পরে রাজকুমারের জাহাজের প্রতি নেত্রপাত করিয়া দেখে, তিনিও তাঁহার পরম রূপসী ভার্য্যা উভয়েই মুক্তাবৎ ফেনার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহাকে অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছেন, শোকে অতিশয় কাতর, মনে মনে যেন স্থির করিয়াছেন বুঝি কন্যা মনের বিষাদে জলে ঝাঁপদিলেন। রাজকুমারের এই অবস্থা দেখিয়া দুঃখিত মনে সে তাঁহার নিকটে গিয়া তাঁহাকে পাখাব্যজন করিতে লাগিল, এবং প্রণাধিকা তৎপত্নীরও মুখ চুম্বন করিল, কিন্তু দুই জনের একজনও তাহাকে দেখিতে পাইল না, পরে আর আর গগন কন্যাদের সহিত শূন্যবার্গে উঠিয়া আকাশমণ্ডলে গোলাপী রঙ্গের যে মেঘ যাইতেছিল, তাহাতেই চলিয়া গেল।
অপর সে আহ্লাদিত হইয়া প্রফুল্লবদনে বলিতে লাগিল, তিন শত বৎসর গত হইলেই আমরা আস্তে আস্তে স্বর্গ রাজ্যে গমন করিতে পারিব। গগন কন্যাদের মধ্যে এক জন কহিল, এতকালও বিলম্ব হইবে না, তদপেক্ষা অল্পকালের মধ্যেই আমরা স্বর্গ রাজ্যে পৌঁছিব। শুন গো মৎস্যনারী! যদি কোন বাটিতে কাহারও সৎপুত্র থাকে, সর্ব্ব বিধায়ে পিতামাতার আনন্দজনক, এবং প্রেমের যোগ্য হয়, আর আমরাও যদি অদৃশ্য ভাবে সেই বাটীতে প্রবেশ করিতে পারি, তাহা হইলে সর্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর যতদিন আমরা সেই প্রকার বাটীতে যাইব ততদিন আমাদের পরীক্ষা কালকে ন্যূন করিয়া দিবেন। আমরা গৃহ হইতে নির্গত কালীন সেই সুসন্তানকে দেখিয়াছি বলিয়া বড়ই আহ্লাদিত হই, কিন্তু বালক তাহা অত্যল্প অনুভব করে, প্রায় কিছুমাত্র জানে না। তবেই যে তিন শত বৎসর আমাদিগকে শূন্যমার্গে বাস করিতে হইবে, তাহার এক এক বৎসর ন্যূন হইয়া যাইবে। যদি কোন অসভ্য দুষ্ট বালককে দেখি, তবেই আমাদের চক্ষু হইতে অশ্রুপাত হয়। যত ফোঁটা শোকাশ্রু আমাদের নেত্র হইতে পড়িবে, ততবার ঈশ্বর এক এক দিন করিয়া আমাদের স্থায়িত্ব কালকে বৃদ্ধি করিয়া দিবেন।
সমাপ্ত
- ↑ পাঠক মহাশয় দিগের প্রতি নিবেদন এই, যেন তাঁহারা পাঠকালীন এবিষয়টি কোন মতে যথার্থ বোধ না করেন, কেন না ইহা সম্পূর্ণ কল্পিত বিষয়। সমুদ্রের অধোভাগে মৎস্য নর, বা কোন প্রকার পশু বাস করে না। এস্থলে অট্টালিকা উদ্যান প্রভৃতি যে সকল বিষয়ের বর্ণনা আছে তাহারও কিছুমাত্র তথায় নাই। কিন্তু বর্ণন কৌশলের যে এক বিশেষ মর্ম্ম এবং তাৎপর্য্য আছে, এই উপাখ্যান আদ্যোপান্ত পাঠ করিলে বুদ্ধিমান পাঠক দিগের তাহা উপলব্ধি হইতে পারিবে।
- ↑ যদি পাঠক মহাশয়েরা সন্দেহ করিয়া মনে কিছু তর্ক করেন যে পৃথিবীস্থ মৎস্যেরা কি রূপে গীত গাইতে পারে? এই হেতু বিবেচনা করিতে হইবে যে সমুদ্রের অধঃস্থিত লোকেরা মৎস্য ব্যতীত অন্য কিছুই জানে না, এজন্য রাজকন্যার পিতামহী এই স্থলে পক্ষীকে মৎস্য রূপে বর্ণন্য করিয়াছেন। তাহা না করিলে ঐ অল্প বয়স্কা বালিকা তাঁহার কথা বুঝিতে পারিবে না।
- ↑ তিমি মৎস্যের একটি আশ্চর্য্য স্বভাব এই, তাহারা সময়ে সময়ে জলের উপরিভাগে উঠিয়া বায়ু ভক্ষণ করিবার নিমিত্ত নাশা রন্ধ্র দ্বারা এমনি জল সেচন করে যে দেখিলেই একটি ফোয়ারার ন্যায় বোধ হয়, তাহাতেই শিকারী লোকেরা স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া তরণীযোগে তথায় গমন করত তাহাদের প্রাণ বধ করে। তিমির শরীর হইতে যে তৈল প্রস্তুত হয়, তাহা অনেক কার্য্যে লাগে।
- ↑ এ বর্ণনার তাৎপর্য্য যিনি না উপলব্ধি করিতে পারেন। কলিকাতাস্থ বাবুর ঘাটে গিয়া জাহাজ সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই উক্তরূপে তাঁহাদের সৌন্দর্য্যানুভব হইবে।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।