লগ্ন

প্রথম মিলনদিন, সে কি হবে নিবিড় আষাঢ়ে,
যেদিন গৈরিকবস্ত্র ছাড়ে
আসন্নের আশ্বাসে সুন্দরা
বসুন্ধরা?
প্রাঙ্গণের চারিধার ঢাকিয়া সজল আচ্ছাদনে
যে দিন সে বসে প্রসাধনে
ছায়ার আসন মেলি’;
পরি’ লয় নূতন সবুজ-রঙা চেলি,
চক্ষুপাতে লাগায় অঞ্জন,
বক্ষে করে কদম্বের কেশর রঞ্জন।
দিগন্তের অভিষেকে
বাতাস অরণ্যে ফিরি’ নিমন্ত্রণ যায় হেঁকে হেঁকে।
যেদিন প্রণয়ী বক্ষতলে
মিলনের পাত্রখানি ভরে অকারণ অশ্রুজলে,
কবির সঙ্গীত বাজে গভীর বিরহে,—
নহে, নহে, সেদিন তো নহে॥

সে কি তবে ফাল্গুনের দিনে,
যেদিন বাতাস ফিরে গন্ধ চিনে চিনে
সবিস্ময়ে বনে বনে,
শুধায় সে মল্লিকারে কাঞ্চন রঙ্গনে
তুমি কবে এলে!
নাগকেশরের কুঞ্জ কেশর ধূলায় দেয় ফেলে
ঐশ্বর্য্য গৌরবে।
কলরবে
অজস্র মিশায় বিহঙ্গম
ফুলের বর্ণের রঙ্গে ধ্বনির সঙ্গম;
অরণ্যের শাখায় শাখায়
প্রজাপতি-সঙ্ঘ আনে পাখায় পাখায়
চিত্রলিপি, কুসুমেরি বিচিত্র অক্ষরে;
ধরণী যৌবনগর্ব্বভরে
আকাশের নিমন্ত্রণ করে যবে
উদ্দাম উৎসবে;
কবির বীণার তন্ত্র যে-বসন্তে ছিঁড়ে যেতে চাহে
প্রমত্ত উৎসাহে।
আকাশে বাতাসে
বর্ণের গন্ধের উচ্চহাসে
ধৈর্য্য নাহি রহে,—
নহে, নহে, সেদিন তো নহে॥

যেদিন আশ্বিনে শুভক্ষণে
আকাশের সমারোহ ধরণীতে পূর্ণ হয় ধনে।
প্রাচুর্য্য-প্রশান্ত তট পেয়েছে সঙ্গিনী
তরঙ্গিনী—
তপস্বিনী সে-যে, তা’র গম্ভীর প্রবাহে—
সমুদ্র-বন্দনা গান গাহে।
মুছিয়াছে নীলাম্বর বাষ্পসিক্ত চোখ,
বন্ধ-মুক্ত নির্ম্মল আলোক।
বনলক্ষ্মী শুভব্রত।
শুভ্রের ধেয়ানে তা’র মেলিয়াছে অম্লান শুভ্রতা
আকাশে আকাশে
শেফালি মালতী কুন্দে কাশে।
অপ্রগল্‌ভধরিত্রী-সে প্রণামে লুণ্ঠিত,
পূজারিণী নিরবগুণ্ঠিত,
আলোকের আশীর্ব্বাদে শিশিরের স্নানে
দাহহীন শান্তি তা’র প্রাণে।

দিগন্তের পথ বাহি’
শূন্যে চাহি’
রিক্তবিত্ত শুভ্র মেঘ সন্ন্যাসী উদাসী
গৌরীশঙ্করের তীর্থে চলিয়াছে ভাসি’।
সেই স্নিগ্ধক্ষণে, সেই স্বচ্ছ সূর্য্যকরে,
পূর্ণতায় গম্ভীর অম্বরে
মুক্তির শান্তির মাঝখানে
তাহারে দেখিব যারে চিত্ত চাহে, চক্ষু নাহি জানে॥

ভাদ্র, ১৩৩৫