ঊনত্রিশ

 ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমলতা ও শৈবলিনী গৃহের সমস্ত কার্যাদি সমাপন করিল। পরে দুইজনে একটি ঘরে বসিলে হেম বলিল, “দিদি। অনেকদিন অবধি গল্প শুনি নাই, আজ একটু অবসর আছে, একটি গল্প বল।”

 শৈবলিনী সস্নেহ বচনে উত্তর দিল, “বলিব বৈকি বৌ, কোন্ গল্পটি বলিব বল।”

 হেম বলিল “রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্প অনেকদিন শুনি নাই, সেই গল্প বল।”

 শৈবলিনী হরিশ্চন্দ্রের গল্প বলিতে লাগিল। মহাভারতের কথা যথার্থই অমৃতের তুল্য, তাহার গল্প কী মিষ্টি, কী সুললিত, কী হৃদয়গ্রাহী। রাজার রাজ্য গেল, ধন গেল, মান গেল, স্ত্রী পুত্র লইয়া রাজা বনে বনে বিচরণ করিতে লাগিলেন। রাজমহিষী শৈব্যা এক্ষণে বাজার একমাত্র রত্ন। সুখের সময়, সম্পদের সময়, রমণী অস্থিরা চঞ্চলচিত্তা, মানিনী। কত আব্দার করে, কত অভিমান করে, কত মিথ্যা ক্রোধ করে। কিন্তু যখন জীবনাকাশ ক্রমশঃ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া আইসে, যখন পৃথিবীর সমস্ত সুখ নাট্যাভিনয়ের শেষে দীপশ্রেণীর ন্যায় একে একে নির্বাপিত হইতে থাকে, যখন আশা মরীচিকারূপে আমাদিগকে অনেক পথ লইয়া যাইয়া শেষে মরুভূমিতে রাখিয়া অদৃশ্য হয়, যখন বন্ধুগণ আমাদিগকে ত্যাগ করে ও লক্ষ্মী বিমুখ হয়, তখন কে অনন্যমনা ও অনন্যহৃদয়া হইয়া অভাগার শুশ্রূষা করে? মাতা ব্যতীত আর কে হতভাগার শয্যা রচনা করে? দুহিতা ব্যতীত আর কে রোগীর শুষ্ক ওষ্ঠে জলদান করে? ভার্যা ব্যতীত আর কে নিদ্রা বিস্মৃত হইয়া ক্লান্তি বিস্মৃত হইয়া দিবানিশি হতভাগার সেবায় রত থাকে? রমণীর প্রেম অগাধ, অপরিসীম। দারিদ্র্যে দুঃখে-কষ্টেও শৈব্যা হরিশ্চন্দ্রকে সেবা করিতে লাগিলেন। সে দুঃখের কথা শুনিয়া হেমলতার চক্ষুতে জল আসিল।

 তাহার পর আরও দুঃখ। রাজা শৈব্যাকে ও পুত্রটিকে বিক্রয় করিলেন, আপনাকে চণ্ডালের নিকট বিক্রয় করিলেন, অভাগিনী শৈব্যা স্বামীবিরহে কায়িক পরিশ্রমে আপনার ও পুত্রটির ভরণ-পোষণ করিতে লাগিলেন। আহা! সেই পুত্রটি অকালে কালপ্রাপ্ত হইল।—হেমমলতা আর থাকিতে পারিল না, ননদিনীর হৃদয়ে মস্তক স্থাপন করিয়া দরবিগলিত ধারায় রোদন করিতে লাগিল।

 গল্প সাঙ্গ হইল, রাজা রাজ্ঞীকে ফিরিয়া পাইলেন, পুত্রকে ফিরিয়া পাইলেন, রাজ্যসম্পদ সমস্তই ফিরিয়া পাইলেন। হেমলতার হৃদয় শান্ত হইল। অনেকক্ষণ প্রায় এক দণ্ডকাল উভয়েই নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। অনেকক্ষণ পর হেমলতা ধীরে ধীরে উঠিয়া একটি বাতায়ন খুলিল। বাহিরে চন্দ্রকরে জগৎ উদ্দীপ্ত হইয়াছে, নৈশ বায়ুতে বৃক্ষসকল ধীরে ধীরে মস্তক নাড়িতেছে, দূর হইতে গঙ্গার জলের কুলকুল শব্দ শুনা যাইতেছে।

 শৈবলিনী ধীরে ধীরে হেমলতার নিকট আসিয়া ভগিনীর ন্যায় সস্নেহে তাহার হস্ত ধারণ করিল। হেম কি ভাবিতেছিল? ভাবিতেছিল ঐ বৃক্ষের পাতায় পাতায় কত জোনাকি পোকা দেখা যাইতেছে উহাদেরও জীবন আছে, সুখ দুঃখ বা ইচ্ছা আছে। যে ভগবান রাজা হরিশ্চন্দ্রকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন, তিনিই এই নিশায় অনিদ্র হইয়া ঐ পোকাগুলিকে খাদ্য যোগাইতেছন, উহাদিগের মনোবাঞ্ছা পুর্ণ করিতেছেন। এই বিপুল বিশ্বসংসারে সকল জীবজন্তুকে তিনিই রক্ষা করিতেছেন, তাঁহাকে নিবিষ্টমনে পূজা করি, আমাদিগকে তিনি রক্ষা করিবেন।

 হেমলতা বালিকাসুলভ সরলতার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি যিনি দয়ার সাগর, তিনি তোমাকে অল্পবয়সে বিধবা করিলেন কেন?”  শৈবলিনী। সকলের কপালে কি সকল সুখ থাকে? তিনি আমাকে বিধবা করিয়াছেন, কিন্তু দুঃখিনী করেন নাই। দেবতুল্য ভ্রাতা দিয়াছেন, তোমার ন্যায় সুশীলা ভ্রাতৃজায়া দিয়াছেন এই সোনার সংসারে স্থান দিয়াছেন। আমার আর কিছুই কামনা নাই, কেবল একবার তীর্থভ্রমণ করিয়া পূজা করিব, এই ইচ্ছা আছে।

 হেমলতা। আমাদের কাশী বৃন্দাবন যাওয়ার কথা স্থির হইয়াছিল না?

 শৈবলিনী। হ্যাঁ, শ্রীশ আমার উপরোধে সম্মত হইয়াছে, বোধ হয় শীঘ্রই যাওয়া হইবে।

 হেমলতা। দিদি, তোমার সঙ্গে তীর্থে যাইব, ভাবিলে আমার বড় আহ্লাদ হয়; কত দেশ দেখিব কত তীর্থ করিব। আর শুনিয়াছি নরেন্দ্র নাকি পশ্চিমে আছেন হয়ত তাঁহার সঙ্গেও দেখা হইবে।

 শৈবলিনী। হইতে পারে।

 এমন সময়ে শ্রীশচন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিলেন। শৈবলিনী একপার্শ্ব দিয়া বাহির হইয়া যাইল। তাহার ললাট চিন্তাকুল।

 শৈবলিনীর কি চিন্তা? বাহিরে দণ্ডায়মান হইয়া শৈবলিনী ভাবিতেছিল, “হেম! তুমি আমাকে বিধবা ভাবিয়া অভাগিনী বল, কিন্তু নারীতে যাহা কখনও সহ্য করিতে পারে না, বালিকা! তুমি তাহা সহ্য করিয়াছ। সে আঘাতে তোমার হৃদয় চূর্ণ হইয়াছে, তোমার জীবন শুদ্ধ হইয়াছে, এ বয়সে তোমার দুর্বল শরীর ও নীরস ওষ্ঠ দেখিলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়। এ বিষম চিন্তার কথা ভ্রাতা কিছুই জানে না, তুমি বালিকা, তুমিও ভাবিয়াছ, এ চিন্তা নির্বাপিত হইয়াছে, কিন্তু নরেন্দ্রের সহিত আবার সাক্ষাৎ হইলে কি হয় জানি না। ভগবান অনাথার নাথ, অসহায়ের সহায় হইবেন।