মাধবীকঙ্কণ/পঁচিশ
সেই তিন দিন নরেন্দ্রনাথ কি চিন্তাজালে বেষ্টিত ও ব্যথিত হইয়াছিলেন তাহা বর্ণনা করা যায় না। শত চিন্তা নরেন্দ্রনাথকে শত বৃশ্চিক-দংশনাপেক্ষা অধিক ক্লেশ দিতে লাগিল।
সেই পর্বতগহ্বরে শৈলেশ্বর যে আদেশ করিয়াছিলেন, তাহা নরেন্দ্রের হৃদয় হইতে তিরোহিত হইল না। শ্রীশচন্দ্রের সহিত হেমলতার বিবাহ হইয়াছে, অনেকদিন হইল, নরেন্দ্র তাহা শুনিয়াছেন। হেমলতা পরের গৃহিণী, তাহার চিন্তা, তাহার প্রতি ভালবাসা কি উচিত কার্য? নরেন্দ্রনাথ, এই কি বীরের উপযুক্ত কার্য? শৈবের উন্নত আদেশ গ্রহণ কর, প্রেম-চিন্তা উৎপাটন কর, যশের পথ পরিষ্কার কর, দেশের গৌরবসাধন কর, ইহা অপেক্ষা বীরের উপযুক্ত কার্য আর কি আছে? নরেন্দ্র স্থির করিলেন, শৈবের আদেশ শিরোধার্য।
আবার সেই গঙ্গাতীরে বিদায়ের কালে নক্ষত্রের আলোকে যে পাণ্ডুবর্ণ শুষ্ক মুখখানি দেখিয়াছিলেন ধীরে ধীরে সেই দুঃখিনী হেমলতার কথা মনে পড়িল, নরেন্দ্রের সমস্ত শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সেই হেম বাল্যকালে নরেন্দ্রের সহিত খেলা করিয়াছে, যেদিন নরেন্দ্র গৃহত্যাগী হয়, সেদিন হেম যেন আপন জীবনকে বিদায় দিতেছিল, তাহা নরেন্দ্রের মনে পড়িল। বাল্যকালে হেম নরেন্দ্র ভিন্ন আর কাহাকেও জানিত না, যৌবনের প্রারম্ভে প্রাতঃ সন্ধ্যা নরেন্দ্রের মুখ দেখিলে যেন হেম উদ্বেগশূন্য ও শান্ত হইত। বাল্যকালের সহস্র কথা অজস্র বারিতরঙ্গের ন্যায় নরেন্দ্রের হৃদয় ব্যথিত ও আলোড়িত করিতে লাগিল, নরেন্দ্র আর সহ্য করিতে পারিলেন না, একাকী মন্দিরপার্শ্বে উপবেশন করিয়া নিঃশব্দে রোদন করিতে লাগিলেন।
আবার চিন্তা আসিতে লাগিল। নরেন্দ্রের দেশ নাই, গৃহ নাই, বন্ধু নাই, পরিজন নাই, নরেন্দ্র একাকী দেশে দেশে পরিভ্রমণ করিতেছেন, কেবল হেমের চিন্তাস্বরূপ নক্ষত্রের উপর দৃষ্টি রাখিয়া সংসারসমুদ্রে বিচরণ করিতেছেন। নিদারুণ শৈব! অভাগার একমাত্র সুচিন্তা, একমাত্র সুখস্বপ্ন দূর করিও না, এ নিদারুণ আদেশ করিও না। নরেন্দ্র অনেক ক্লেশ সহ্য করিয়াছে, আরও যে ক্লেশ আদেশ কর, সহ্য করিতে প্রস্তুত আছে। নরেন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিবে, বীরমর্যাদা ত্যাগ করিবে, অন্নকষ্ট ভোগ করিতে সম্মত আছে, জগতের নিন্দাভার বহন করতে সম্মত আছে, অথবা সংসার পরিত্যাগ করিয়া সিংহ ব্যাঘ্রাদি জন্তুর সহিত ঘোর অরণ্যে জীবন অতিবাহিত করিতে সম্মত আছে শৈলেশ্বর। আদেশ কর, ইহাতে যদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, নরেন্দ্র আজ্ঞা শিরোধার্য করিবে, ইহাতে যদি নরেন্দ্র মুহূর্তের জন্য সঙ্কোচ করে, করালবদনার সম্মুখে তাহার মস্তকচ্ছেদন করিও কিন্তু বাল্যকাল অবধি যে চিন্তা অবলম্বন করিয়া নরেন্দ্র জীবন ধারণ করিতেছে, যে আলোকস্তম্ভরূপ চিন্তার জ্যোতিতে নরেন্দ্র দেশে দেশে পরিভ্রমণ করিতেছে, নিদারুণ শৈব! সে চিন্তা দূর করিতে বলিও না। এখন হেম পরের গৃহিণী, তথাপি নরেন্দ্রের ভালবাসা বিস্মৃত হয় নাই, নরেন্দ্র তাহার চিন্তা ত্যাগ করিবে? নরেন্দ্র মুসলমান হইয়া যবনীকে বিবাহ করিবে? হেম তাহা শুনিবে? সে ভাবনা অসহ্য! প্রবঞ্চক শৈব! হিন্দু পুরোহিত হইয়া তুমি যবনীর পানিগ্রহণ করিতে উপদেশ দাও? বিধর্মী! কপটাচারিন্! দূর হও!
আবার শৈলেশ্বরের গম্ভীর আদেশ মনে পড়িল, “হা নরেন্দ্রনাথ! আপনাকে ভুলাইও না, আমাকে ভুলাইবার চেষ্টা করিও না। যে ঘোর পাপে লিপ্ত হইয়াছে, তাহা বিশেষ করিয়া আলোচনা কর। শৈব মিথ্যাবাদী? পরনারী চিন্তা কি পাপ নহে? নরেন্দ্রনাথ, সাবধান! আপনি পাপে লিপ্ত হইতেছ, শৈব তোমার দোষ দেখাইয়া দিতেছেন, তাঁহার নিন্দা করিও না। নরেন্দ্রনাথ ভাবিয়া ভাবিয়া, সেদিন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
তিন দিন অতিবাহিত হইল, তৃতীয় দিবস রজনীতে নির্দিষ্ট সময়ের দুই দণ্ড পূর্বে নরেন্দ্রনাথ গহ্বরমুখে একাকী দণ্ডায়মান রহিয়াছেন এক-একবার এদিক ওদিক নিঃশব্দে পদসঞ্চারণ করিতেছেন, এক-একবার অন্ধকার আকাশের দিকে স্থিরদৃষ্টি করিতেছেন, আবার গহ্বরমুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইতেছেন। হস্তে নিষ্কাষিত অসি; আকৃতি স্থির ও গম্ভীর। ক্ষণেক পরে শৈলেশ্বর আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও নরেন্দ্রকে আশীর্বাদ করিলেন।
নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে প্রণাম করিতে বিস্মৃত হইলেন।
শৈলেশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন, “স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়াছ?”
গম্ভীর ও ঈষৎ কর্কশস্বরে নরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হইয়াছি।”
উভয়ে গহ্বরে প্রবেশ করিলেন।
গহ্বরে পূর্বদিনের ন্যায় অতি উজ্জ্বল আলোক জ্বলিতেছিল, সেই আলোকচ্ছটায় শৈলেশ্বর যাহা দেখিলেন, তাহাতে চমকিত হইলেন। নরেন্দ্রনাথের ললাট গণ্ডস্থল, স্কন্ধ, বাহু ও বক্ষস্থল রক্তচন্দনে একেবারে প্লাবিত রহিয়াছে।
শৈলেশ্বর। পাপিষ্ঠ! পরস্ত্রী আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিতে পারিলে না?
নরেন্দ্র। পরস্ত্রী-আকাঙ্ক্ষা রাখিও না।
শৈলেশ্বর। হেমলতাকে এ জীবনে আর দেখিতে চাহ না?
নরেন্দ্র। তাহা স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি।
শৈলেশ্বর। তবে যবনীকে বিবাহ করিতে স্বীকার আছ?
নরেন্দ্র। এ জীবনে নহে।
শৈলেশ্বর ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন; আবার বলিলেন, “তবে প্রতিজ্ঞপালনে প্রস্তুত হও। খড়্গ ত্যাগ কর, কালীর সম্মুখে জীবনদানে প্রস্তুত হও।”
নরেন্দ্র। আমি যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা পালন করিয়াছি। আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব বলিয়াছিলাম।
শৈলেশ্বর। মুঢ়। সিংহের গহ্বরে আসিয়াও জীবনের প্রত্যাশা কর? এস্থলে কে তোমার সহায় হইবে?
নরেন্দ্র। এই অসি আমার সহায়।
শৈলেশ্বর নিঃশব্দে গহ্বরের একস্থান হইতে আপন অসি বাহির করিলেন। উদয়পুরে একবার যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, অদ্য আবার দুইজনে সেইরূপ অসি ও ঢাল লইয়া যুদ্ধ। নরেন্দ্র সেদিন অপেক্ষা অধিক সাবধানে অধিক যত্নে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু সে যত্ন বৃথা। সিংহবীর্য শৈব অল্পক্ষণ মধ্যেই নরেন্দ্রকে পরাস্ত করিয়া তাঁহার অসি কাড়িয়া লইলেন।
শৈলেশ্বর। কেবল পূজা ব্যবসায়ে এই ক্লেশ শুক্ন হয় নাই। রাজস্থান-ভূমি বীরপ্রসবিনী, যুদ্ধকালে শৈব-গোস্বামিগণও বীর্যপ্রকাশে রাজস্থানে অগ্রগণ্য। বালক! তোমার সহিত যুদ্ধ করিলাম, এই আমার কলঙ্ক রহিল।
নরেন্দ্র। আমি তাহার জন্যও প্রস্তুত আছি, তোমার যাহা ইচ্ছা, যাহা সাধ্য কর। শৈলেশ্বর একগাছি রজ্জু বাহির করিলেন, নরেন্দ্রের দুই হস্ত সেই রজ্জু দ্বারা সজোরে বন্ধন করিলেন। এরূপ জোরে বাঁধিলেন যে, হন্তের শিরা স্ফীত হইয়া উঠিল। নরেন্দ্র শব্দমাত্র উচ্চারণ করিলেন না। পরে পুর্বের ন্যায় কলস লইয়া নরেন্দ্রের মুখের নিকট ধরিয়া মদ্যপান করিতে বলিলেন, নরেন্দ্র তাহাই করিলেন। গোস্বামী গহ্বর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
মত্ততাহেতু নরেন্দ্র অচিরাৎ ভূমিতে নিপতিত হইলেন, চক্ষুতে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, গহ্বরপার্শ্বে দুইজন যেন ধীরে ধীরে কথা কহিতেছে, এইরূপ তাহার বোধ হইতে লাগিল; শুনিতে শুনিতে নরেন্দ্র মদিরা প্রভাবে নিদ্রায় অভিভূত হইলেন, পরে কি হইল, স্মরণ রহিল না।
কিন্তু সে নিদ্রা গভীর নহে। নরেন্দ্র সমস্ত রজনী স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন, কখন স্বপ্ন দেখেন, কখন অর্ধেক জাগ্রত হইয়া থাকেন। কখন স্বপ্ন দেখেন, জাগ্রত থাকেন, মত্ততাপ্রযুক্ত কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
অনেকক্ষণ পরে বোধ হইল, যেন পূর্বের একদিনের ন্যায় আবার অন্ধকার হইতে আলোকচ্ছটা প্রকাশ হইতে লাগিল, আর যেন প্রস্তরভিত্তি সরিয়া গেল, মেঘ সরিয়া গেলে যেন চন্দ্রালোক প্রকাশিত হইল। সেই আলোকে সেই উজ্জল রমণী? কিন্তু জেলেখা অদ্য গান গাহিতেছে না, অদ্য বীণাহস্তে আইসে নাই, অদ্য খড়্গহস্তে!
কী ভয়ঙ্করী মূর্তি। নয়ন হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতেছে, সুক্ষ্ম রক্তবর্ণ ওষ্ঠের উপর দন্ত চাপিয়া রহিয়াছে, সমস্ত বদনমণ্ডল ক্রোধপ্রোজ্বলিত ও রক্তবর্ণ। বামার করে সেই শৈশবের দীর্ঘখড়্গ, বামার বক্ষে একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকা। নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন, তাঁহার ললাট হইতে স্বেদ বহির্গত হইতে লাগিল। তিনি উঠিবার উদ্যম করিলেন, কিন্তু স্বপ্নে বিপদাপন্ন ব্যক্তির ন্যায় পলাইতে অক্ষম, উঠিতে অক্ষম।
বামা মৃণাল-করে খড়্গ ধারণ করিয়া গহ্বরে প্রবেশ করিল। একবার দণ্ডায়মান হইল, একবার নরেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া গেল।
এবার সেই তীক্ষ্ণ ছুরিকা বাহির করিল, এবার অকম্পিত-হস্তে সে ছুরিকা নরেন্দ্রের বক্ষস্থলের উপর ধরিল। আবার কি চিন্তা আসিল, ছুরিকা হস্তভ্রষ্ট হইয়া পতিত হইল, বামা ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
নরেন্দ্র চীৎকার শব্দ করিয়া উঠিয়া বসিলেন, তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি দেখিলেন ঘর্মে তাঁহার সমস্ত শরীর আপ্লুত হইয়াছে, উন্মত্ততা গিয়াছে, গহ্বর অন্ধকার ও নিস্তব্ধ। ধীরে ধীরে তিনি গহ্বরের বাহিরে আসিলেন। রজনী অবসানপ্রায়, পূর্বদিকে রক্তিমচ্ছটায় আকাশ রঞ্জিত হইয়াছে। নির্বাণপ্রায় প্রদীপের ন্যায় দুই-একটি তারা এখনও দেখা যাইতেছে প্রত্যুষের শীতল বায়ু সেই পর্বতশ্রেণী ও শিবমন্দিরের উপর বহিয়া যাইতেছে ও নবজাত পুষ্পপরিমল বহিয়া নিদ্রোত্থিত জগৎকে আমোদিত করিতেছে। দুই-একটি নিকুঞ্জবন হইতে দুই-একটি পক্ষী সুন্দর গীত করিতেছে।