বধূ

‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্!’
পুরানো সেই সুরে  কে যেন ডাকে দূরে—
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল!
কোথা সে ধাঁধা ঘাট, অশথতল!
ছিলাম আনমনে  একেলা গৃহকোণে,
কে যেন ডাকিল রে ‘জলকে চল্’।

কলসী লয়ে কাঁখে পথ সে বাঁকা—
বামেতে মাঠ শুধু  সদাই করে ধু ধু,
ডাহিনে বাঁশবন হেলায়ে শাখা।
দিঘির কালো জলে  সঁঝের আলো ঝলে,
দু ধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা।
গভীর থির নীরে  ভাসিয়া যাই ধীরে,
পিক কুহরে তীরে অমিয়মাখা।
পথে আসিতে ফিরে  আঁধার তরুশিরে
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।

অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি,
সেখানে ছুটিতাম সকালে উঠি।
শরতে ধরাতল   শিশিরে ঝলমল,
করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি।
প্রাচীর বেয়ে বেয়ে  সবুজে ফেলে ছেয়ে
বেগুনি-ফুলে-ভরা লতিকা দুটি।

ফাটলে দিয়ে আঁখি  আড়ালে বসে থাকি,
আঁচল পদতলে পড়েছে লুটি।

মাঠের পরে মাঠ, মাঠের শেষে
সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে।
এ ধারে পুরাতন   শ্যামল তালবন
সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায় ঘেঁষে।
বাঁধের জলরেখা   ঝলসে যায় দেখা,
জটলা করে তীরে রাখাল এসে।
চলেছে পথখানি  কোথায় নাহি জানি,
কে জানে কত শত নূতন দেশে।

হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া!
বিরাট মুঠিতলে   চাপিছে দৃঢ়রলে
ব্যাকুল বালিকারে, নাহিকো মায়া।
কোথা সে খোলা মাঠ,  উদার পথঘাট,
পাখির গান কই, বনের ছায়া!

কে যেন চারি দিকে দাঁড়িয়ে আছে—
খুলিতে নারি মন, শুনিবে পাছে।
হেথায় বৃথা কাঁদা,  দেয়ালে পেয়ে বাধা
কাঁদন ফিরে আসে আপন-কাছে।

আমার আঁখিজল কেহ না বোঝে।
অবাক্ হয়ে সবে কারণ খোঁজে—

‘কিছুতে নাহি তোষ,   এ তো বিষম দোষ,
গ্রাম্যবালিকার স্বভাব ও যে।
স্বজন প্রতিবেশী   এত যে মেশামেশি,
ও কেন কোণে বসে নয়ন বোজে?’

কেহ বা দেখে মুখ, কেহ বা দেহ—
কেহ বা ভালো বলে, বলে না কেহ।
ফুলের মালাগাছি  বিকাতে আসিয়াছি—
পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।

সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!
ইঁটের ’পরে ইঁট,   মাঝে মানুষ-কীট;
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।

কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো,
কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁ গো!
উঠিলে নবশশী   ছাদের ’পরে বসি
আর কি উপকথা বলিবি না গো!
হৃদয়বেদনায়    শূন্য বিছানায়
বুঝি, মা, আঁখিজলে রজনী জাগো—
কুসুম তুলি লয়ে   প্রভাতে শিবালয়ে
প্রবাসী তনয়ার কুশল মাগো।

হেথাও উঠে চাঁদ ছাদের পারে,
প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে।
আমারে খুঁজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে,
যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে।

নিমেষতরে তাই আপনা ভুলি
ব্যাকুল ছুটে যাই দুয়ার খুলি।
অমনি চারি ধারে  নয়ন উঁকি মারে,
শাসন ছুটে আসে ঝটিকা তুলি।

দেবে না ভালোবাসা, দেবে না আলো।
সদাই মনে হয়   আঁধার ছায়াময়
দিঘির সেই জল শীতল কালো,
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।

ডাক্ লো ডাক্ তোরা, বল্ লো বল্—
‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্।’
কবে পড়িবে বেলা,  ফুরাবে সব খেলা,
নিবাবে সব জ্বালা শীতল জল—
জানিস যদি কেহ আমায় বল্।


১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

সংশোধন ও পরিবর্ধন:

শান্তিনিকেতন। ৭ কার্তিক