মানিনী/প্রথম পরিচ্ছেদ
মানিনী।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
◇◇◇◇◇◇
মানিনী ও রাজকিশোরী দু’জনেই এখন এক বাড়ীর বউ। উভয়েই দুইটী সহোদর ভ্রাতার পত্নী। রজনীকান্তের পিতা বর্ত্তমান থাকিতে রাজকিশোরীর সহিত রজনীর বিবাহ দিয়া যান। রজনীকান্তের বিবাহের অতি অল্পদিবস পরেই রজনীকান্তের পিতা ইহলোক পরিত্যাগ করেন; মাতাও বহুপূর্ব্বে স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন। রজনীর পিতা পরম হিন্দু ছিলেন, দেব-দেবীর পূজা না করিয়া কখনও জলগ্রহণ করিতেন না। সুতরাং অনেক দেখিয়া শুনিয়া হিন্দুর ঘর হইতে হিন্দুর কন্যা রাজকিশোরীকে বাছিয়া আনিয়া আপনার প্রথম পুত্র রজনীকান্তের সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন। যে সময় রজনীকান্তের বিবাহ হয়, সেই সময় পিতার মত ধর্ম্ম কর্ম্ম লইয়া রজনীকান্ত সর্ব্বদা ব্যস্ত না থাকিলেও হিন্দুর আচরণ-বিরুদ্ধ কার্য্যে কখনই লিপ্ত থাকিতেন না।
পিতার মৃত্যুর পর রজনীকান্তের উপরই সমস্ত সংসারের ভার পড়িল। সংসারের মধ্যে অপর কেহই ছিল না; কেবল মাত্র রজনীকান্ত, তাহার পত্নী রজকিশোরী, এবং তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিপিন।
পিতা বর্ত্তমান থাকিতে বিপিন সামান্যমাত্র লেখাপড়া শিখিয়াছিল; এণ্ট্রেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এক বৎসর কাল এল-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিবার পরই তাহার পিতার মৃত্যু হয়। কিন্তু রজনীকান্তের সংসারের বিশেষরূপ অনাটন থাকিলেও তিনি অতিকষ্টে বিপিনের লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া আসিতে লাগিলেন। বিপিন ক্রমে এল-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রজনীকান্ত আপনার স্ত্রী রাজকিশোরীর দুই একখানি অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া বিপিনের পুস্তক সকল ক্রয় করিয়া দিলেন।
বিপিনের বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিবার কালে রজনীকান্ত তাহার বিবাহের চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। ভদ্রবংশের একটী সুরূপা কন্যা যাহাতে প্রাপ্ত হইতে পারা যায়, তাহার নিমিত্ত অনেক স্থানে চেষ্টা করিতে লাগিলে। কিন্তু মনোমত একটী কন্যাও দেখিতে পাইলেন না। তথাপি চেষ্টা করিতেও নিরস্ত হইলেন না।
বিপিনের বিবাহের নিমিত্ত রজনীকান্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতেছেন, এই কথা ক্রমে বিপিনের কর্ণগোচর হইল। তিনি এই বিষয় জানিতে পারিয়া একদিবস রাজকিশোরীকে কহিলেন, “শুনিলাম যে, দাদা আমার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন। ইহা যদি প্রকৃতই হয়, তাহা হইলে আপনি দাদাকে কহিবেন যে, এখন আমার বিবাহ করিবার ইচ্ছা নাই। বি-এ পাস করিয়া কোনরূপে একটী চাকরীর যোগাড় করিয়া লইতে পারিলে তাহার পর বিবাহ করিব। এখন বিবাহের গোলযোগে আমার পড়া শুনার সবিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। অথচ দেখিতে পাইতেছি, আমাদিগের অবস্থাও ভাল নহে।”
বিপিন রাজকিশোরীকে যেমন বুঝাইলেন, রাজকিশোরীও সেইরূপ বুঝিয়া সময়-মত স্বামীর নিকট বিপিনের মনের ভাব ব্যক্ত করিলেন। রজনীকান্ত স্ত্রীর নিকট সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে। বিপিন যে সময়ে বিবাহ করিতে চাহিবে, সেই সময়েই তাহার বিবাহ দিব। বিপিন এখন লেখাপড়া শিখিয়াছে, নিজের ভাল মন্দ সে এখন নিজেই বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে। সুতরাং তাহার অনভিপ্রায়ে কোনরূপ কার্য্য করা কোনমতেই যুক্তিসঙ্গত নহে।”
রজনীকান্ত আপন স্ত্রীকে যাহা যাহা কহিলেন, স্ত্রীও তাহাই ভাল বিবেচনা করিয়া সময়মত স্বামীর সেই কথা বিপিনকে জানাইলেন। রাজকিশোরীর কথা শুনিয়া বিপিন সবিশেষ সন্তুষ্ট হইল।
বিপিন যখন বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, সেই সময়ে রজনীকান্ত মনে করিয়াছিলেন যে, বিপিনের লেখাপড়ার ব্যয়ের সংস্থান করা ভিন্ন তাহার দিকে দৃষ্টি রাখিবার আর প্রয়োজন নাই। কারণ, যখন সে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন জ্ঞান উপার্জ্জন করিতেছে, তখন তাহার কিসে ভাল হইবে, আর কিসেই বা মন্দ হইবে, তাহা নিজে উত্তমরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে। রজনীকান্ত কিন্তু কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, বিপিনের মতিগতি ক্রমে অন্যদিকে ধাবিত হইতেছে, এবং তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনরূপ কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিতে সে সমর্থ হইয়াছে।
কলেজের যে ক্লাসে বিপিন অধ্যয়ন করিতেন, সেই ক্লাসে আরও কয়েকজন ছাত্র পাঠ করিত। তাহাদিগের মধ্যে সকলে না হউক, কয়েকজন ছাত্র একটু স্বাধীনভাবে চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইত। বিপিন ক্রমে তাহাদিগের সঙ্গেই মিলিত হইয়া তাহাদিগের ন্যায় একটু স্বাধীনভাবে চলিতে লাগিলেন।
যে স্থানে সভাসমিতি হয়, যে স্থানে দেশের উন্নতিকল্পে দুই চারি কথা হয়, সেই স্থানেই বিপিন উপস্থিত হইয়া সেই সকল কার্য্যের উদ্যোক্তাগণের সহিত যোগ দিতে লাগিলেন। ক্রমে বিপিন দেশহিতৈষীগণের মধ্যে যাহাতে একজন প্রধান ব্যক্তি হইতে পারেন, সর্ব্বদা তাহার চেষ্টাতে নিযুক্ত হইলেন। দেশের হিতকর কার্য্য সকলের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটী বিষয়ের দিকে সর্ব্বপ্রথম তাঁহার মন আকৃষ্ট হইল।
১ম। অবরোধ-রুদ্ধা স্ত্রীলোকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা প্রদান করা।
২য়। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে এখন যেরূপ অবরোধ-প্রথা প্রচলিত আছে, তাহার মত অন্যায় প্রথা আর কিছুই হইতে পারে না। সুতরাং সেই অবরোধ প্রথা সমূলে নির্ম্মূল করা।
৩য়। স্ত্রীলোকদিগকে পুরুষের মত সর্ব্বতোভাবে স্বাধীনতা দেওয়া।
৪র্থ। আমাদিগের দেশে বিধবা স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ ভাবে আজীবন কষ্ট সহ্য করিতে হয়, সেই কষ্ট হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার করিয়া যাহাতে তাহারা পুনরায় বিবাহ করিতে সমর্থ হয়, তাহার উপায় বিধান করা।
নিজের লেখাপড়ার দিকে বিপিনের এখন যত দৃষ্টি থাকুক বা না থাকুক, উপরোক্ত বিষয় কয়েকটীর দিকে তিনি সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে লাগিলেন।
এই সময়ে সমাজের দুই চারিটী প্রধান প্রধান লোকদিগের সহিতও তাঁহার আলাপ পরিচয় হইল। তাঁহারা বিপিনের মতের সর্ব্বতোভাবে পোষকতা করিতে লাগিলেন। সুতরাং বিপিনও প্রথম প্রথম মধ্যে মধ্যে ও পরিশেষে সর্ব্বদাই সেই সকল সমাজে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইতে লাগিলেন; ক্রমে তাঁহাদিগের আচার ব্যবহার ও চাল-চলন শিক্ষা করিতে লাগিলেন।
যে সকল সমাজে তিনি গমন করিতে লাগিলেন, সকল সমাজের পুরুষদিগের সহিত যে কেবল তাঁহার আলাপ পরিচয় হইল, তাহা নহে; স্ত্রীলোকদিগের সহিতও তাঁহার বিশেষরূপে আলাপ পরিচয় হইতে লাগিল। কারণ, এই সমাজস্থ শ্রীলোকগণ অবরোধ প্রথার ধার ধারেন না, এবং পরপুরুষের সহিত আলাপ পরিচয় করিতে তাঁহাদিগের কোনরূপ আপত্তি বা প্রতিবন্ধক নাই; যেহেতু তাঁহারা শিক্ষিতা ও জ্ঞানালোকিতা।
বিপিন যে এইরূপ ভাবে দেশহিতৈষিতার ভান করিয়া সমাজে সমাজে বেড়াইতে লাগিলেন, দেশহিতৈষিণীদিগের সহিত মিলিতে লাগিলেন, তাহা কিন্তু রজনীকান্ত বা রাজকিশোরী কিছুমাত্র জানিতে পারিলেন না।
এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত ইয়া গেল। বিপিনের পরীক্ষার সময় আসিয়া উপস্থিত হইল। বিপিন ইতিপূর্ব্বে সকল পরীক্ষায় ভালরূপে উত্তীর্ণ হইয়া আসিয়াছিলেন। এবার কিন্তু কোনরূপে পাস হইলেন মাত্র।
রজনীকান্তের যাহা কিছু সংস্থান ছিল, বিপিনকে বিদ্যা শিক্ষা করাইবার নিমিত্ত ক্রমে ক্রমে সমস্তই ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তিনি যে সামান্য বেতনে কর্ম্ম করিতেন, তাহা দ্বারা কোনরূপে আপনাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন নির্ব্বাহ হইত মাত্র; তাহা হইতে অতিরিক্ত ব্যয় একটীমাত্র পয়সাও হইবার সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং বিপিনের লেখাপড়া শিখাইতে রজনীকান্ত আর সমর্থ হইলেন না। রজনীকান্তের ইচ্ছা ছিল যে, যদি কোন স্থান হইতে কিছু টাকা তিনি কর্জ্জ লইতে পারেন, তাহা হইলে সেই টাকা ব্যয় করিয়া বিপিন যাহাতে আরও কিছু লেখাপড়া শিখিতে সমর্থ হয়, তাহার চেষ্টা করেন। পরিশেষে চাকরী হইলে বিপিন নিজের দেনা নিজেই পরিশোধ করিয়া দিবে। রজনীকান্ত মনে যাহা ভাবিলেন, কার্য্যে তাহা ঘটিল না। কোন স্থান হইতে আর কোন অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলেন না। কারণ, রজনীকান্ত সকলের নিকট ঋণী। বিপিনকে লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত যখন যে টাকার প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই রজনীকান্ত তাহার সংস্থান করিয়া দিয়াছেন। যে পর্য্যন্ত নিজের বিষয়াদি বা অলঙ্কার-পত্র ছিল, সেই পর্য্যন্ত তাহা বিক্রয় করিয়া বা বন্ধক দিয়া তদ্দ্বারা অর্থের সংস্থান হইত। সেই সমস্ত অর্থ যখন নিঃশেষিত হইয়া গেল, তখন অপরের নিকট ঋণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ক্রমে ক্রমে প্রায় সকলের নিকটেই তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়ায় এখন কেহ আর তাঁহাকে ঋণদানে সম্মত হইলেন না; সুতরাং বিপিনের লেখাপড়া এইস্থানে বন্ধ হইল।
অর্থাভাবে বিপিনের লেখাপড়া বন্ধ হইল বলিয়া রজনীকান্ত ও তাঁহার অশিক্ষিতা স্ত্রী রাজকিশোরীর অন্তঃকরণে বিশেষরূপ কষ্ট হইতে লাগিল কিন্তু বিপিন এক দিবসের নিমিত্তও দুঃখিত হইলেন না। কারণ, আর অধিক লেখাপড়া শিখিবার ইচ্ছা তাঁহার মন হইতে এখন দূরে পলায়ন করিয়াছিল। এখন তাঁহার বিষম চিন্তার আবির্ভাব হইয়াছে। এখন তিনি বিধবাদিগের বৈধব্যযন্ত্রণায় রোদন করিতে শিক্ষা করিয়াছেন। সেই অবরোধ প্রথার নিমিত্ত বৃদ্ধ সমাজপতিগণকে শত সহস্র গালি দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। স্ত্রীলোকদিগকে অশিক্ষিতাবস্থায় রাখা হইয়াছে বলিয়া সমাজের বৃদ্ধগণের সহিত নানা তর্ক করিতে শিখিয়াছেন! এরূপ অবস্থায় তাঁহার আর লেখাপড়া ভাল লাগিবে কেন?
বিপিনের লেখাপড়া বন্ধ হইল সত্য; কিন্তু সংসারের কার্য্যেও তাঁহাকে উদাসীন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। চাকরী প্রভৃতির চেষ্টা করিয়া সংসারের উন্নতির দিকে লক্ষ্য করিবার সময় তাঁহার নাই। তিনি সর্ব্বদাই “দেশ দেশ” করিয়া নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। রজনীকান্ত এ সকল বিষয় বুঝিয়াও বুঝিলেন না, দেখিয়াও দেখিলেন না। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল; তথাপি রজনীকান্ত আপন ভ্রাতাকে এক দিবসের নিমিত্ত অনুযোগ করিলেন না।