মানুষের ধর্ম্ম

 পথ চলেছিল একটানা বাইরের দিকে, তার নিজের মধ্যে নিজের অর্থ ছিল না। পৌঁছল এসে ঘরে, সেখানে অর্থ পাওয়া গেল, আরম্ভ হোলো ভিতরের লীলা। মানুষে এসে পৌঁছল সৃষ্টিব্যাপার, কর্ম্মবিধির পরিবর্ত্তন ঘটল, অন্তরের দিকে বইল তার ধারা। অভিব্যক্তি চলছিল প্রধানত প্রাণীদের দেহকে নিয়ে, মানুষে এসে সেই প্রক্রিয়ার সমস্ত ঝোঁক পড়ল মনের দিকে। পূর্ব্বের থেকে মস্ত একটা পার্থক্য দেখা গেল। দেহে দেহে জীব স্বতন্ত্র; পৃথকভাবে আপন দেহরক্ষায় প্রবৃত্ত, তা নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা। মনে মনে সে আপনার মিল পায় এবং মিল চায়, মিল না পেলে সে অকৃতার্থ। তার সফলতা সহযোগিতায়। বুঝতে পারে বহুর মধ্যে সে এক, জানে তার নিজের মনের জানাকে বিশ্বমানবমন যাচাই করে, প্রমাণিত করে, তবে তার মূল্য। দেখতে পায় জ্ঞানে কর্ম্মে ভাবে যতই সকলের সঙ্গে সে যুক্ত হয় ততই সে সত্য হয়। যোগের এই পূর্ণতা নিয়েই মানুষের সভ্যতা। তাই মানুষের সেই প্রকাশই শ্রেষ্ঠ যা একান্ত ব্যক্তিগত মনের নয়, যাকে সকল কালের সকল মানুষের মন স্বীকার করতে পারে। বুদ্ধির বর্ব্বরতা তাকেই বলে যা এমন মতকে এমন কর্ম্মকে সৃষ্টি করে যাতে বৃহৎকালে সর্ব্বজনীন মন আপনার সায় পায় না। এই সর্ব্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ। মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠচে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব।

ইতিহাসে দেখা যায় মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েচে যে-অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁছেচে বিশ্বমানসলোকে; যে-লোকে তার বাণী, তার শ্রী, তার মুক্তি। সফলতালাভের জন্যে সে মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম্ম নিয়ে বাহ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, অবশেষে সার্থকতালাভের জন্যে একদিন সে বললে, তপস্যা বাহ্যানুষ্ঠানে নয়, সত্যই তপস্যা; গীতার ভাষায় ঘোষণা করলে দ্রব্যময় যজ্ঞের চেয়ে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেয়, খৃষ্টের বাণীতে শুনলে বাহ্য বিধিনিষেধে পবিত্রতা নয় পবিত্রতা চিত্তের নির্ম্মলতায়। তখন মানবের রুদ্ধমনে বিশ্বমানবচিত্তের উদ্বোধন হোলো। এই তার আন্তর সত্তার বোধ দৈহিক সত্তার ভেদসীমা ছাড়িয়ে দেশে কালে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের দিকে প্রসারিত। এই বোধেরই শেষ কথা এই যে, যে-মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে, সেই জানে সত্যকে।

মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর একটা বিশ্বভাব। জীব আছে আপন উপস্থিতকে আঁকড়ে, জীব চলচে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে-সত্তা সে আছে আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয়। এ আদর্শ একটা আন্তরিক আহ্বান, এ আদর্শ একটা নিগূঢ় নির্দ্দেশ। কোন্‌দিকে নির্দ্দেশ? যেদিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যেদিকে তার পূর্ণতা, যেদিকে ব্যক্তিগত সীমাকে সে ছাড়িয়ে চলেচে, যেদিকে বিশ্বমানব। ঋগ্‌বেদে সেই বিশ্বমানবের কথা বলেচেন,—

পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি
ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি,—

তাঁর এক চতুর্থাংশ আছে জীবজগতে, তাঁর বাকি বৃহৎ অংশ ঊর্দ্ধে অমৃতরূপে। মানুষ যেদিকে সেই ক্ষুদ্র অংশগত আপনার উপস্থিতকে প্রত্যক্ষকে অতিক্রম করে সত্য, সেইদিকে সে মৃত্যুহীন, সেইদিকে তার তপস্যা শ্রেষ্ঠকে আবিষ্কার করে। সেইদিক আছে তার অন্তরে, যেখান থেকে চিরকালের সকলের চিন্তাকে সে চিন্তিত করে, সকলের ইচ্ছাকে সে সফল করে, রূপদান করে সকলের আনন্দকে। যে-পরিমাণে তার গতি এর বিপরীত দিকে, বাহ্যিকতার দিকে, দেশকালগত সঙ্কীর্ণ পার্থক্যের দিকে, মানবসত্য থেকে সেই-পরিমাণে সে ভ্রষ্ট, সভ্যতার অভিমানসত্ত্বেও সেই পরিমাণে সে বর্ব্বর।

মানবদেহে বহুকোটি জীবকোষ, তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জন্ম স্বতন্ত্র মরণ। অণুবীক্ষণযোগে জানা যায় তাদের প্রত্যেকের চারিদিকে ফাঁক। একদিকে এই জীবকোষগুলি আপন আপন পৃথক জীবনে জীবিত, আর একদিকে তাদের মধ্যে একটি গভীর নির্দ্দেশ আছে, প্রেরণা আছে, একটি ঐক্যতত্ত্ব আছে, সেটি অগোচর পদার্থ, সেই প্রেরণা সমগ্র দেহের দিকে, সেই ঐক্য সমস্ত দেহে ব্যাপ্ত। মনে করা যেতে পারে, সেই সমগ্র দেহের উপলব্ধি অসংখ্য জীবকোষের অগম্য, অথচ সেই দেহের পরম রহস্যময় আহ্বান তাদের প্রত্যেকের কাছে দাবী করচে তাদের আত্মনিবেদন। যেখানে তারা প্রত্যেকে নিজেরই স্বতন্ত্র জীবনসীমায় বর্ত্তমান সেখানে তার মধ্যে রহস্য কিছুই নেই। কিন্তু যেখানে তারা নিজের জীবনসীমাকে অতিক্রম করে সমস্ত দেহের জীবনে সত্য সেখানে তারা আশ্চর্য্য, সেখানে তারা আপন স্বতন্ত্র জন্মমৃত্যুর মধ্যে বদ্ধ নয়। সেইখানেই তাদের সার্থকতা।

শোনা যায় প্রতি সাত বছর অন্তর মানুষের দেহে এই জীবকোষগুলির পরিবর্ত্তন ঘটে। তারা বিদায় নেয় অর্থাৎ তাদের পৃথক সত্তা থাকে না। কিন্তু তাদের মধ্যে যে-সত্তা সমস্ত দেহের আয়ুর অন্তর্গত অর্থাৎ যেটা তাদের স্বদৈহিক নয় বিশ্বদৈহিক সেই সত্তা সমস্ত দেহের জীবনপ্রবাহে থেকে যায়।

দেহে কখনো কখনো কর্কটরোগ অর্থাৎ ক্যান্সার জন্মায় সেই ক্যান্সার একান্তই স্বতন্ত্র, বলা যেতে পারে তার মধ্যে দেহাত্মবোধ নেই। সমগ্র দেহের সে প্রতিকূল। দেহের পক্ষে এ'কেই বলা যায় অশুভ।

মানুষের দেহের জীবকোষগুলির যদি আত্মবোধ থাকত তাহলে একদিকে তারা ক্ষুদ্রভাবে আপনাদেরকে স্বতন্ত্র জানত, আবার বৃহৎভাবে নিজেদেরকে জানত সমগ্র দেহে। কিন্তু জানত অনুভবে, কল্পনায়,—সমগ্র দেহকে প্রত্যক্ষত ও সম্পূর্ণত জানা সম্ভব হোত না। কেননা এই দেহ শুধু যে বর্ত্তমানে অধিষ্ঠিত তা নয়, এই দেহে রয়েচে তার অতীত, অপেক্ষা করচে তার ভবিষ্যৎ। আরো একটা প্রত্যক্ষাতীত পদার্থ রয়েচে যা সর্ব্বদেহব্যাপী কল্যাণ, যাকে বলি স্বাস্থ্য, যাকে বিশ্লেষণ করা যায় না। তা ছাড়াও সমগ্র জীবনরক্ষার গভীরতর চেষ্টা প্রত্যেক জীবকোষের আছে, যে-চেষ্টা রোগের অবস্থায় সর্ব্বদেহের শত্রুহননে নিজেদের আত্মহানিও ঘটায়, দেশপ্রেমিক যেমন করে দেশের জন্যে প্রাণ দেয়। এই চেষ্টার রহস্য অনুসরণ করলেই বোঝা যেতে পারে এই ক্ষুদ্র দেহগুলির চরম লক্ষ্য অর্থাৎ পরম ধর্ম্ম এমন-কিছুকে আশ্রয় করে, যাকে বলব তাদের বিশ্বদেহ।

মানুষও আপন অন্তরের গভীরতর চেষ্টার প্রতি লক্ষ্য করে অনুভব করেচে যে, সে শুধু ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। সেই বিরাট মানব

অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্‌।

সেই বিশ্বমানবের প্রেরণায় ব্যক্তিগত মানুষ এমন সকল কাজে প্রবৃত্ত হয় যা তার ভৌতিক সীমা অতিক্রমণের মুখে। যাকে সে বলে ভালো, বলে সুন্দর, বলে শ্রেষ্ঠ; কেবল সমাজরক্ষার দিক থেকে নয়, আপন আত্মার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তির দিক থেকে।

ডিমের ভিতরে যে পাখীর ছানা আছে তার অঙ্গে দেখতে পাই ডানার সূচনা। ডিমে-বাঁধা জীবনে সেই ডানার কোনো অর্থই নেই। সেখানে আছে ডানার অবিচলিত প্রতিবাদ। এই অপরিণত ডানার সঙ্কেত জানিয়ে দেয়, ডিমের বাইরে সত্যের যে পূর্ণতা আজো তার কাছে অপ্রত্যক্ষ সেই মুক্ত সত্যে সঞ্চরণেই পাখীর সার্থকতা। তেমনিই মানুষের চিত্তবৃত্তির যে ঔৎসুক্য মানুষের পূর্ণ সত্যের সাক্ষ্য দেয় সেইখানেই অনুভব করি তার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য থেকে মুক্তি। সেইখানে সে বিশ্বাভিমুখী।

জীবকে কল্পনা করা যাক সে যেন জীবযাত্রার একটা রেলগাড়ির মধ্যেই জন্মায়, বেঁচে থাকে এবং মরে। এই গাড়ি সঙ্কীর্ণ লক্ষ্যপথে বাঁধা রাস্তায় চলে। জন্তুর মাথাটা গাড়ির নিম্নতলের সমরেখায়। গাড়ির সীমার মধ্যে তার আহারবিহারের সন্ধান চলচে নীচের দিকে ঝুঁকে। ঐটুকুর মধ্যে বাধাবিপত্তি যথেষ্ট, তাই নিয়ে দিন কাটে। মানুষের মতো সে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতে পারে না। উপরের জানলা পর্য্যন্ত পৌঁছয় না তার দৃষ্টি, তার মনের গতি নেই প্রাণধারণের বাইরে।

মানুষ খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়েচে। সামনে পেয়েচে জানলা। জানতে পেরেচে গাড়ির মধ্যেই সব কিছু বদ্ধ নয়। তার বাইরে দিগন্তের পর দিগন্ত। জীবনের আশু লক্ষ্যপথ উত্তীর্ণ হয়েও যা বাকি আছে তার আভাস পাওয়া যায়, সীমা দেখা যায় না। যেটুকু আলো গাড়ির প্রয়োজনের পক্ষে যথোপযুক্ত, বাইরে তারি বিস্তার অবাধ অজস্র। সেই আলো তাকে ডাকে কেন? ঐ প্রয়োজনাতীত বাইরেটার প্রতি উদাসীন থাকলে ক্ষতি কী ছিল। দিন তো চলে যেত, যেমন চলচে হাজার লক্ষ প্রাণীর। কিন্তু মানুষকে অস্থির করে তুললে যে। বললে, তাকে ছাড়া পেতে হবে সেইখানেই যেখানে তার প্রয়োজন নেই, যার পরিচয় তার কাছে আজো অসম্পূর্ণ। প্রাণশক্তির অতিনির্দ্দিষ্ট সাম্রাজ্যপ্রাচীর লঙ্ঘন করে সে জয় করতে বেরোলো আপন স্বরাজ। এই জয়যাত্রার পথে তার সহজ প্রবৃত্তি তার পক্ষ নেয় না, এই পথে তার আরাম নেই, তার বিশ্রাম নেই, শত শত যাত্রী প্রাণ দিয়ে এই পথকে কেবলি প্রশস্ত করচে, উন্মুক্ত করচে।

দেহের দিকে মানুষকে বিচার করে দেখা যাক। সে উঠে দাঁড়িয়েচে। এমন কথা বলা চলে না-যে দাঁড়াবে না তো কি। দাঁড়ানো সহজ নয়। পাখীর দেহের ছন্দটা দ্বিপদী। মানুষের দেহটা চতুষ্পদ জীবের প্রশস্ত ছন্দে বানানো। চার পায়ের উপর লম্বা দেহের ওজন সামনে পিছনে ভাগ করে দিলেই এমনতরো দেহটাকে একসঙ্গে বহন ও সঞ্চালন তার পক্ষে সহজ হতে পারত। কিন্তু মানুষ আপন দেহের স্বভাবকে মানতে চাইলে না, এ জন্যে সে অসুবিধে সইতেও রাজি। চলমান দীর্ঘ দেহটার ভাররক্ষার সাধনা করলে ঐ দুই পায়ের উপরেই। সেটা সহজসাধ্য নয়, ছেলেদের প্রথম চলার অভ্যাস দেখলেই তা বোঝা যায়। শেষ বয়সে বৃদ্ধকে লাঠির উপর ভর দিতে হয় সেও একটা প্রমাণ। এও দেখা যায় চারপেয়ে জন্তু যত সহজে ভার বহন করতে পারে মানুষ তা পারে না—এই জন্যেই অন্যের পরে নিজের বোঝা চাপাবার নানা কৌশল মানুষের অভ্যস্ত। সেই সুযোগ পেয়েচে বলেই যত পেরেচে ভার সৃষ্টি করেচে। তাকে পরিমিত করবার চেষ্টা নেই। মানুষের এই চালটা যে সহজ নয় তার দৃষ্টান্ত প্রায়ই পাওয়া যায়। ধাক্কা খেয়ে মানুষের অঙ্গহানি বা গাম্ভীর্য্যহানির যে আশঙ্কা, জন্তুদের সেটা নেই। শুধু তাই নয়, ডাক্তারের কাছে শোনা যায় মানুষ উত্ততভঙ্গী নিয়েচে বলে তার আদিম অবতত দেহের অনেক যন্ত্রকে রোগদুঃখ ভোগ করতে হয়। তবু মানুষ স্পর্দ্ধা করে উঠে দাঁড়ালো।

নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে জন্তু দেখতে পায় খণ্ড খণ্ড বস্তুকে। তার দেখার সঙ্গে তার ঘ্রাণ দেয় যোগ। চোখের দেখাটা অপেক্ষাকৃত অনাসক্ত, জ্ঞানের রাজ্যে তার প্রভাব বেশি। ঘ্রাণের অনুভূতি দেহবৃত্তির সঙ্কীর্ণ সীমায়। দেখা ও ঘ্রাণ নিয়ে জন্তুরা বস্তুর যে-পরিচয় পায় সে-পরিচয় বিশেষভাবে আশু প্রয়োজনের। উপরে মাথা তুলে মানুষ দেখলে কেবল বস্তুকে নয়, দেখলে দৃশ্যকে অর্থাৎ বিচিত্র বস্তুর ঐক্যকে। একটি অখণ্ড বিস্তারের কেন্দ্রস্থলে দেখলে নিজেকে। এ'কে বলা যায় মুক্তদৃষ্টি। খাড়া-হওয়া মানুষের কাছে নিকটের চেয়ে দূরের দাম বেশি। অজ্ঞাত অভাবনীয়ের দিকে তার মন হয়েচে প্রবৃত্ত। এই দৃষ্টির সঙ্গে যোগ দিয়েচে অন্তরের কল্পনাদৃষ্টি। শুধু দৃষ্টি নয় সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাতও পেয়েচে মুক্তি। পায়ের কাজ থেকে হাত যদি ছুটি না পেত, তা হলে সে থাকত দেহেরই একান্ত অনুগত, চতুর্থ বর্ণের মতো অস্পৃশ্যতার মলিনতা নিয়ে। পুরাণে বলে ব্রহ্মার পায়ের থেকে শূদ্র জন্মেচে, ক্ষত্রিয় হাতের থেকে।

মানুষের দেহে শূদ্রের পদোন্নতি হোলো ক্ষাত্রধর্ম্মে, পেলে সে হাতের গৌরব, তখন মনের সঙ্গে হোলো তার মৈত্রী। মানুষের কল্পনাবৃত্তি হাতকে পেয়ে বসল। দেহের জরুরী কাজগুলো সেরে দিয়েই সে লেগে গেল নানা বাজে কাজে। জীবনযাত্রার কর্ম্মব্যবস্থায় সে whole-time কর্ম্মচারী রইল না। সে লাগল অভাবিতের পরীক্ষায়, অচিন্ত্যপূর্ব্বের রচনায়, অনেকটাই অনাবশ্যক। মানুষের ঋজুমুক্ত দেহ মাটির নিকটস্থ টান ছাড়িয়ে যেতেই তার মন এমন একটা বিরাট রাজ্যের পরিচয় পেলে যা অন্নব্রহ্মের নয় যাকে বলা যায় বিজ্ঞান ব্রহ্মের আনন্দ-ব্রহ্মের রাজ্য। এ রাজ্যে মানুষ যেকাজগুলো করে হিসাবী লোক জিজ্ঞাসা করতে পারে এ সব কেন? একমাত্র তার উত্তর, “আমার খুসি।” তার বিজ্ঞানে, তার সাহিত্যে, তার শিল্পকলায় এই এক উত্তর, আমার খুসি। মাথা-তোলা মানুষের এত বড়ো গর্ব্ব। জন্তুদেরও যথেচ্ছ খেলার অবকাশ আছে, কিন্তু জীবনে তাদের খেলাটা গৌণ। তা ছাড়া তাদের খেলাও প্রকৃতির অনুগত। বিড়ালছানার খেলা মিথ্যা ইঁদুর মিছামিছি ধরা, কুকুর ছানার খেলা নিজের ল্যাজের সঙ্গে লড়াই করার সগর্জ্জন ভান। কিন্তু মানুষের যে কাজটাকে লীলা বলা যায় অর্থাৎ যা তার কোনো দরকারের আমলে আসে না, কথায় কথায় সেইটেই হয়ে ওঠে মুখ্য, ছাড়িয়ে যায় তার প্রাণযাত্রাকে। সেইটের দ্বারাই তার শ্রেষ্ঠতার পরিচয়। অবকাশের ভূমিকায় মানুষ সর্ব্বত্রই আপন অমরাবতী রচনায় ব্যস্ত, সেখানে তার আকাশকুসুমের কুঞ্জবন। এই সব কাজে সে এত গৌরব বোধ করে যে চাষের ক্ষেতে তার অবজ্ঞা। আধুনিক বাংলা ভাষায় সে যাকে একটা কুশ্রাব্য নাম দিয়েচে কৃষ্টি, হাল লাঙলের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই এবং গোরুকে তার বাহন বললে ব্যঙ্গ করা হয়। বলা বাহুল্য দূরতম তারায় মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন, সেই তারার যে-আলোকরশ্মি চার পাঁচ হাজার এবং ততোধিক বৎসর ধরে ব্যোমবিহারী, গৃহত্যাগী, তারই দৌড় মাপতে মানুষের দিন যায়, তার রাত কাটে। তা ছাড়া মানুষ অকারণে কথার সঙ্গে কথার বিনুনি করে কবিতাও লেখে; এমন কি, যারা আধপেটা খেয়ে কৃশতনু তারাও বাহবা দেয়। এর থেকেই আন্দাজ করি মানুষের অন্নের ক্ষেত প্রকৃতির এলেকায় থাকতে পারে, দেহের দ্বারে পেয়াদার তাগিদে তার খাজনাও দিতে হয়, কিন্তু যেখানে মানুষের বাস্তুভিটে সেই লাখেরাজ দেবত্রভূমি প্রকৃতির এলেকার বাইরে। সেখানে জোরতলবের দায় নেই, সেখানে সকলের চেয়ে বড়ো দায়িত্ব স্বাধীন দায়িত্ব, তাকে বলব আদর্শের দায়িত্ব, মনুষ্যত্বের দায়িত্ব।

দেহের দিক থেকে মানুষ যেমন ঊর্দ্ধশিরে নিজেকে টেনে তুলেচে খণ্ডভূমির থেকে বিশ্বভূমির দিকে, নিজের জানাশোনাকেও তেমনি স্বাতন্ত্র্য দিয়েচে জৈবিক প্রয়োজন থেকে, ব্যক্তিগত অভিরুচির থেকে। জ্ঞানের এই সম্মানে মানুষের বৈষয়িক লাভ হোক বা না হোক আনন্দ লাভ হোলো। এইটেই বিস্ময়ের কথা। পেট না ভরিয়েও কেন হয় আনন্দ? বিষয়কে বড়ো করে পায় বলে আনন্দ নয়, আপনাকেই বড়ো করে সত্য করে পায় বলে আনন্দ। মানবজীবনের যে বিভাগ অহৈতুক অনুরাগের অর্থাৎ আপনার বাহিরের সঙ্গে অন্তরঙ্গযোগের, তার পুরস্কার আপনারই মধ্যে। কারণ সেই যোগের প্রসারেই আত্মার সত্য।

ন বা অরে পুত্রস্য কামায় পুত্রঃ প্রিয়োভবতি, আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়োভবতি।

জীবলোকে চৈতন্যের নীহারিকা অস্পষ্ট আলোকে ব্যাপ্ত। সেই নীহারিকা মানুষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে উজ্জ্বল দীপ্তিতে বললে,

অয়মহং ভোঃ,

এই যে আমি। সেইদিন থেকে মানুষের ইতিহাসে নানাভাবে নানারূপে নানাভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চলল, “আমি কী।” ঠিক উত্তরটিতে তার আনন্দ, তার গৌরব। জন্তুর উত্তর পাওয়া যায় তার দৈহিক ব্যবস্থার যথাযোগ্যতায়। সনাতন গণ্ডারের মতো স্থূল ব্যবহারে গণ্ডার যদি কোনো বাহ্য বাধা না পায় তাহলে আপন সার্থক্য সম্বন্ধে তার কোনো সংশয় থাকে না। কিন্তু মানুষ কী করে হবে মানুষের মতো তাই নিয়ে বর্ব্বরদশা থেকে সভ্য অবস্থা পর্য্যন্ত তার চিন্তা ও প্রয়াসের অন্ত নেই। সে বুঝেচে সে সহজ নয়, তার মধ্যে একটা রহস্য আছে, এই রহস্যের আবরণ উদ্ঘাটিত হতে হতে তবে সে আপনাকে চিনবে। শত শত শতাব্দী ধরে চলেচে তার প্রয়াস। কত ধর্ম্মতন্ত্র কত অনুষ্ঠানের পত্তন হোলো, সহজ প্রবৃত্তির প্রতিবাদ করে নিজেকে সে স্বীকার করাতে চায় যে, বাইরে সে যা, ভিতরে ভিতরে তার চেয়ে সে বড়ো। এমন কোনো সত্তার স্বরূপকে সে মনের মধ্যে গ্রহণ করবার চেষ্টা করচে, আদর্শরূপে যিনি তার চেয়ে বড়ো অথচ তার সঙ্গে চিরসম্বন্ধযুক্ত। এমনি করে বড়ো ভূমিকায় নিজের সত্যকে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে তার অহৈতুক আগ্রহ। যাকে সে পূজা করে তার দ্বারাই সে প্রমাণ করে তার মতে নিজে সে সত্য কিসে, তার বুদ্ধি কাকে বলে পূজনীয়, কাকে জানে পূর্ণতা বলে। সেইখানেই আপন দেবতার নামে মানুষ উত্তর দিতে চেষ্টা করে আমি কী, আমার চরম মূল্য কোথায়। বলা বাহুল্য, উত্তর দেবার উপলক্ষ্যে পূজার বিষয়কল্পনায় অনেক সময়ে তার এমন চিত্ত প্রকাশ পায় বুদ্ধিতে যা অন্ধ, শ্রেয়োনীতিতে যা গর্হিত, সৌন্দর্য্যের আদর্শে যা বীভৎস। তাকে বলব ভ্রান্ত উত্তর এবং মানুষের কল্যাণের জন্যে সকল রকম ভ্রমকেই যেমন শোধন করা দরকার এখানেও তাই। এই ভ্রমের বিচার মানুষেরই শ্রেয়োবুদ্ধি থেকেই, মানুষের দেবতার শ্রেষ্ঠতার বিচার মানুষেরই পূর্ণতার আদর্শ থেকে।

জীবসৃষ্টির প্রকাশ-পর্য্যায়ে দেহের দিকটাই যখন প্রধান ছিল তখন দেহ-সংস্থানঘটিত ভ্রম বা অপূর্ণতা নিয়ে অনেক জীবের ধ্বংস বা অবনতি ঘটেচে। জীবসৃষ্টির প্রকাশে মানুষের মধ্যে যখন আমি এসে দাঁড়ালো, তখন এই আমি সম্বন্ধে ভুল করলে দৈহিক বিনাশের চেয়ে বড়ো বিনাশ। এই আমিকে নিয়ে ভুল কোথায় ঘটে, সে প্রশ্নের একই উত্তর দিয়েচেন আমাদের সকল মহাপুরুষ। তাঁরা এই অদ্ভুত কথা বলেন যেখানে আমিকে না-আমির দিকে জানতে বাধা পাই, তাকে অহং-বেড়ায় বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ করে দেখি। এক আত্মলোকে সকল আত্মার অভিমুখে আত্মার সত্য। এই সত্যের আদর্শেই বিচার করতে হবে মানুষের সভ্যতা, মানুষের সমস্ত অনুষ্ঠান, তার রাষ্ট্রতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম্মতন্ত্র; এর থেকে যে পরিমাণে সে ভ্রষ্ট সেই পরিমাণে সে বর্ব্বর।

মানুষের দায় মহামানবের দায়, কোথাও তার সীমা নেই। অন্তহীন সাধনার ক্ষেত্রে তার বাস। জন্তুদের বাস ভূমণ্ডলে, মানুষের বাস সেইখানে যাকে সে বলে তার দেশ। দেশ কেবল ভৌমিক নয়, দেশ মানসিক। মানুষে মানুষে মিলিয়ে এই দেশ, জ্ঞানে জ্ঞানে, কর্ম্মে কর্ম্মে। যুগযুগান্তরের প্রবাহিত চিন্তাধারায় প্রীতিধারায় দেশের মন ফলে শস্যে সমৃদ্ধ। বহু লোকের আত্মত্যাগে দেশের গৌরব সমুজ্জ্বল। যে-সব দেশবাসী অতীত কালের, তাঁরা বস্তুত বাস করতেন ভবিষ্যতে। তাঁদের ইচ্ছার গতি কর্ম্মের গতি ছিল আগামী কালের অভিমুখে। তাঁদের তপস্যার ভবিষ্যৎ আজ বর্ত্তমান হয়েচে আমাদের মধ্যে, কিন্তু আবদ্ধ হয়নি। আবার আমরাও দেশের ভবিষ্যতের জন্য বর্ত্তমানকে উৎসর্গ করচি। সেই ভবিষ্যৎকে ব্যক্তিগতরাপে আমরা ভোগ করব না। যে তপস্বীরা অন্তহীন ভবিষ্যতে বাস করতেন, ভবিষ্যতে যাঁদের আনন্দ, যাঁদের আশা, যাঁদের গৌরব, মানুষের সভ্যতা তাঁদেরই রচনা। তাঁদেরই স্মরণ করে মানুষ আপনাকে জেনেচে অমৃতের সন্তান, বুঝেচে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যু মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেচেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। ভাবীকালবাসীরা, শুধু আপন দেশকে নয়, সমস্ত পৃথিবীর লোককে অধিকার করেচেন। তাঁদের চিন্তা, তাদের কর্ম্ম, জাতিবর্ণনির্ব্বিচারে সমস্ত মানুষের। সবাই তাঁদের সম্পদের উত্তরাধিকারী। তাঁরাই প্রমাণ করেন সব মানুষকে নিয়ে সব মানুষকে অতিক্রম করে সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত। সেই মানুষকেই প্রকাশ করতে হবে, শ্রেষ্ঠ স্থান দিতে হবে বলেই মানুষের বাস দেশে। অর্থাৎ এমন জায়গায় যেখানে প্রত্যেক মানুষের বিস্তার খণ্ড খণ্ড দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে,—যেখানে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয় সকল কালের সকল মানুষকে নিয়ে।

ভবিষ্যৎকাল অসীম, অতীত কালও তাই। এই দুই দিকে মানুষের মন প্রবলভাবে আকৃষ্ট। পুরুষ এবেদং সর্ব্বং যদ্ভুতং যচ্চ ভব্যম্‌। যা ভূত যা ভাবী এই সমস্তই সেই পুরুষ। মানুষ ভাবতে ভালোবাসে কোনো এককালে তার শ্রেষ্ঠতার আদর্শ পূর্ব্বেই বিষয়ীকৃত। তাই প্রায় সকল জাতীয় মানুষের পুরাণে দেখা যায় সত্যযুগের কল্পনা অতীতকালে। সে মনে করে যে-আদর্শের উপলব্ধি অসম্পূর্ণ, কোনো এক দূরকালে তা পরিপূর্ণ অখণ্ড বিশুদ্ধ আকারে। সেই পুরাণের বৃত্তান্তে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাটি প্রকাশ পায় যে অনাদিতে যা প্রতিষ্ঠিত অসীমে তাই প্রমাণিত হতে থাকবে। যে গানটি পূর্ব্বেই সম্পূর্ণ রচিত, গাওয়ার দ্বারাই সেটা ক্রমশ প্রকাশমান, এও তেমনি। মনুষ্যত্বের আদর্শ এক কোটিতে সমাপ্ত, আর এক কোটিতে উপলভ্যমান। এখনকার দিনে মানুষ অতীতকালে সত্যযুগকে মানে না, তবু তার সকল প্রকার শ্রেয়োনুষ্ঠানের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে অনাগতকালে সত্যযুগের প্রত্যাশা। কোনো ব্যক্তি নাস্তিক হতে পারে কিন্তু সেই নাস্তিক যাকে সত্য বলে জানে দূরদেশে ভাবীকালে সেও তাকে সার্থক করবার জন্যে প্রাণ দিতে পারে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। অগোচর ভবিষ্যতেই নিজেকে সত্যতররূপে অনুভব করে বলেই তার প্রত্যক্ষ বর্ত্তমানকে বিসর্জ্জন দেওয়া সে ক্ষতি মনে করে না।

ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি,

পূর্ণ পুরুষের অধিকাংশ এখনো আছে অব্যক্ত। তাঁকেই ব্যক্ত করবার প্রত্যাশা নিয়ত চলেচে ভবিষ্যতের দিকে। পূর্ণ পুরুষ আগন্তুক। তাঁর রথ ধাবমান, কিন্তু তিনি এখনো এসে পৌঁছননি। বরযাত্রীরা আসচে, যুগের পর যুগ অপেক্ষা করচে, বরের বাজনা আসচে দূর থেকে। তাঁকে এগিয়ে নিয়ে আসবার জন্যে দূতেরা চলেচে দুর্গম পথে। এই যে অনিশ্চিত আগামীর দিকে মানুষের এত প্রাণপণ আগ্রহ, এই যে অনিশ্চিতের মধ্যে অনাগতের মধ্যে তার চিরনিশ্চিতের সন্ধান অক্লান্ত, তারই সঙ্কটসঙ্কুল পথে মানুষ বারবার বাধা পেয়ে ব্যর্থ হয়েও যাত্রা বন্ধ করতে পারলে না। এই অধ্যবসায়কে বলা যেতে পারত পাগলামি কিন্তু মানুষ তাকেই বলেচে মহত্ত্ব। এই মহত্ত্বের আশ্রয় কোথায়? অলক্ষ্য একটা পরিপূর্ণতার দিকে মানুষের মনের আকর্ষণ দেখতে পাই; অন্ধকার ঘরের গাছে তার শাখায় প্রশাখায় যেমন একটা স্বাভাবিক ব্যাকুলতা প্রাচীরের ও-পারের আলোকের দিকে। আলোক যেমন সত্য, পূর্ণের আকর্ষণ নিয়ত যেখান থেকে প্রেরিত সেও যদি তেমনি সত্য না হোত তাহলে জীবিকার প্রয়োজনের বাইরে আত্মার উৎকর্ষের জন্যে মানুষ যা কিছু চিন্তা করে কর্ম্ম করে তার কোনো অর্থই থাকে না। এই সত্যকে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করি আমাদের সঙ্কল্পে, আমাদের ধ্যানে, আমাদের আদর্শে। সেই অভাবনীয় পূর্ণকে দেখতে পাই দুঃখের দীপ্তিতে, মৃত্যুর গৌরবে। সে আমাদের জ্ঞানকে ঘরছাড়া করে বড়ো ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়েচে, নইলে পরমাণুতত্ত্বের চেয়ে পাকপ্রণালী মানুষের কাছে অধিক আদর পেত। সীমাবদ্ধ সৃষ্টিকে মানুষ প্রত্যক্ষ দেখচে, তাকে ব্যবহার করচে কিন্তু তার মন বলচে এই সমস্তেরই সত্য রয়েচে সীমার অতীতে। এই সীমাকে যদি প্রশ্ন করি তার শেষ উত্তর পাইনে এই সীমার মধ্যেই।

ছান্দোগ্য উপনিষদে কথিত আছে, ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণের সামনে দুই ব্রাহ্মণ তর্ক তুলেছিলেন, সামগানের মধ্যে যে-রহস্য আছে তার প্রতিষ্ঠা কোথায়?

দাল্‌ভ্য বললেন, “এই পৃথিবীতেই।” স্থূল প্রত্যক্ষই সমস্ত রহস্যের চরম আশ্রয় বোধ করি দাল্‌ভ্যের এই ছিল মত।

প্রবাহণ বললেন, “তাহলে তোমার সত্য তো অন্তবান হোলো, সীমায় এসে ঠেকে গেল যে।”

ক্ষতি কী তাতে। ক্ষতি এই যে, সীমার মধ্যে মানুষের জিজ্ঞাসা অসমাপ্ত থেকে যায়। কোনো সীমাকেই মানুষ চরম বলে যদি মানত তাহলে মানুষের ভৌতিক বিজ্ঞানও বহুকাল পূর্ব্বেই ঘাটে নোঙর ফেলে যাত্রা বন্ধ করত। একদিন পণ্ডিতেরা বলেছিলেন ভৌতিক বিশ্বের মূল উপাদানস্বরূপ আদিভূতগুলিকে তাঁরা একেবারে কোণ-ঠেষা করে ধরেচেন, একটার পর একটা আবরণ খুলে এমন কিছুতে ঠেকেচেন যাকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না। বললে কী হবে? অন্তরে আছেন প্রবাহণ রাজা, তিনি বহন করে নিয়ে চলেচেন মানুষের সব প্রশ্নকে সীমা থেকে দূরতর ক্ষেত্রে। তিনি বললেন,

অপ্রতিষ্ঠিতং বৈ কিল তে সাম, অন্তবদ্‌ বৈ কিল তে সাম।

আদিভূতের যে-বস্তুসীমায় প্রশ্ন এসে থেমেছিল সে সীমাও পেরোলো। আজ মানুষের চরম ভৌতিক উপলব্ধি পৌঁছল গাণিতিক চিহ্নসঙ্কেতে, কোনো বোধগম্যতার নয়। একদিন আলোকের তত্ত্বকে মানুষ বোধগম্যতার পরপারেই স্থাপন করেছিল। অদ্ভুত কথা বলেছিল, ঈথরের ঢেউ জিনিষকেই আলোকরূপে অনুভব করি। অথচ ঈথর যে কী আমাদের বোধের ভাষায় তার কোনো কিনারা পাওয়া যায় না। আলো, যা আমাদের দৃষ্টির ক্ষেত্রে সকল ভৌতিক জিনিষকে প্রকাশ করে, দাঁড়ালো তা এমন কিছুর প্রকাশ যা সম্পূর্ণই ভৌতিক-ধর্ম্মের অতীত, কেবল ব্যবহারে মাত্র জানা যায় যে তাতে নানা ছন্দের ঢেউ খেলে। কিন্তু প্রবাহণের গণনা থামে না। খবর আসে, কেবল তরঙ্গধর্ম্মী বললে আলোর চরিত্রের হিসাব পূরো মেলে না, সে কণিকাবর্ষীও বটে। এই সব স্ববিরোধী কথা মানুষের সহজ বুদ্ধির সহজ ভাষার সীমার বাইরেকার কথা। তবু বোধতীতের ডুবজলেও মানুষ ভয় পেলে না। পাথরের দেয়ালটাকেও বললে বিদ্যুৎকণার নিরন্তর নৃত্য। সন্দেহ করলে না যে, হয়তো বা পাগল হয়ে গেছি। মনে করলে না, হয়তো প্রজ্ঞা, যাকে বলে reason, সে মানস-সার্কাসের ডিগ্‌বাজি-খেলোয়াড়, সব জিনিষকে একবারে উল্‌টিয়ে ধরাই তার ব্যবসা। পশুরা যদি বিচারক হোত মানুষকে বলত জন্ম-পাগল। বস্তুত মানুষের বিজ্ঞান সব মানুষকে এক-পাগলামিতে-পাওয়া জীব বলে প্রমাণ করচে। বলচে, সে যাকে যে-রকম জানচে বলে মনে করে সেটা একেবারেই তা নয়, সম্পূর্ণই উল্‌টো। জন্তুরা নিজেদের সম্বন্ধে এ রকম লাইবেল প্রচার করে না। তাদের বোধের কাছে যেটা-যা সেটা-তাই অর্থাৎ তাদের কাছে কেবল আছে তথ্য, তাদের অবিচলিত নিষ্ঠ প্রতীয়মানের প্রতি। তাদের জগতের আয়তন কেবল তলপৃষ্ঠ নিয়ে। তাদের সমস্ত দায় ঐ একতলাটাতেই। মানবজগতের আয়তনে বেধ আছে, যা চোখে পড়ে তার গভীরে। প্রত্যক্ষ তথ্যকে উপেক্ষা করলে মানুষের চলে না, আবার সত্যকেও নইলে নয়।

অন্যান্য জন্তুর মতোই তথ্য মানুষের সম্বল, কিন্তু সত্য তার ঐশ্বর্য্য। ঐশ্বর্য্যের চরম লক্ষ্য অভাব দূর করা নয়, মহিমা উপলব্ধি করানো। তাই ঐশ্বর্য্য-অভিমানী মানুষ বলেচে,

ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি।

বলেচে অল্পে সুখ নেই, বৃহতেই সুখ।

এটা নিতান্তই বেহিসাবী কথা হোলো। হিসাবীবুদ্ধিতে বলে যা চাই আর যা পাই এই দুটো মাপে মিলে গেলেই সুখের বিষয়। ইংরেজিতে একটা চলতি কথা আছে, যা যথেষ্ট সেটাই ভূরিভোজের সমান-দরের। শাস্ত্রেও বলচে,

সন্তোষং পরমাস্থায় সুখার্থী সংযতো ভবেৎ।

তবেই তো দেখচি সন্তোষে সুখ নেই আবার সন্তোষেই সুখ এই দুটো উল্‌টো কথা সামনে এসে দাঁড়ালো। তার কারণ, মানুষের সত্তায় দ্বৈধ আছে। তার যে-সত্তা জীবসীমার মধ্যে সেখানে যেটুকু আবশ্যক সেই টুকুতেই তার সুখ। কিন্তু অন্তরে অন্তরে জীবমানব বিশ্বমানবে প্রসারিত, সেইদিকে সে সুখ চায় না, সে সুখের বেশি চায়, সে ভূমাকে চায়। তাই সকল জীবের মধ্যে মানুষই কেবল অমিতাচারী। তাকে পেতে হবে অমিত, তাকে দিতে হবে অমিত। কেননা তার মধ্যে আছে অমিত মানব। সেই অমিত মানব সুখের কাঙাল নয়, দুঃখভীরু নয়। সেই অমিত মানব আরামের দ্বার ভেঙে কেবলি মানুষকে বের করে নিয়ে চলেচে কঠোর অধ্যবসায়ে। আমাদের ভিতরকার ছোট মানুষটি তা নিয়ে বিদ্রূপ করে থাকে, বলে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। উপায় নেই। বিশ্বের মানুষটি ঘরের মানুষকে পাঠিয়ে দেন বুনো মোষটাকে দাবিয়ে রাখতে, এমন কি, ঘরের খাওয়া যথেষ্ট না জুটলেও।

উপনিষদে ভগবান সম্বন্ধে একটি প্রশ্নোত্তর আছে। স ভগবঃ কস্মিন্‌ প্রতিষ্ঠিতঃ, সেই ভগবান কোথায় প্রতিষ্ঠিত। এই প্রশ্নের উত্তর, স্বে মহিম্নি। নিজের মহিমায়। সেই মহিমাই তাঁর স্বভাব। সেই স্বভাবেই তিনি আনন্দিত।

মানুষেরও আনন্দ মহিমায়। তাই বলা হয়েচে, ভূমৈব সুখং। কিন্তু যে স্বভাবে তার মহিমা সেই স্বভাবকে সে পায় বিরোধের ভিতর দিয়ে, পরম সুখকে পায় পরম দুঃখে। মানুষের সহজ অবস্থা ও স্বভাবের মধ্যে নিত্যই দ্বন্দ্ব। তাই ধর্ম্মের পথকে অর্থাৎ মানুষের পরম স্বভাবের পথকে দুর্গং পথস্তৎ করয়ো বদন্তি।

জন্তুর অবস্থাও যেমন স্বভাবও তার অনুগত। তার বরাদ্দও যা, কামনাও তার পিছনে চলে বিনা বিদ্রোহে। তার যা পাওনা, তার বেশি তার দাবী নেই। মানুষ বলে বসল আমি চাই উপ্‌রি-পাওনা। বাঁধা বরাদ্দের সীমা আছে, উপ্‌রি-পাওনার সীমা নেই। মানুষের জীবিকা চলে বাঁধা বরাদ্দে, উপ্‌রি-পাওনা দিয়ে প্রকাশ পায় তার মহিমা।

জীবধর্ম্মরক্ষার চেষ্টাতেও মানুষের নিরন্তর একটা দ্বন্দ্ব আছে। সে হচ্চে প্রাণের সঙ্গে অপ্রাণের দ্বন্দ্ব। অপ্রাণ আদিম, অপ্রাণ বিরাট। তার কাছ থেকে রসদ সংগ্রহ করতে হয় প্রাণকে, মালমস্‌লা নিয়ে গড়ে তুলতে হয় দেহযন্ত্র। সেই অপ্রাণ নিষ্ঠুর মহাজনের মতো, ধার দেয় কিন্তু কেবলি টানাটানি করে ফিরে নেবার জন্যে, প্রাণকে দেউলে করে দিয়ে মিলিয়ে দিতে চায় পঞ্চভূতে।

এই প্রাণচেষ্টাতে মানুষের শুধু কেবল অপ্রাণের সঙ্গে প্রাণের দ্বন্দ্ব নয়, পরিমিতের সঙ্গে অপরিমিতের। বাঁচবার দিকেও তার উপ্‌রি-পাওনার দাবী। বড়ো করে বাঁচতে হবে, তার অন্ন যেমন-তেমন নয়; তার বসন, তার বাসস্থান কেবল কাজ চলাবার জন্যে নয়, বড়োকে প্রকাশ করবার জন্যে। এমন-কিছুকে প্রকাশ যাকে সে বলে থাকে মানুষের প্রকাশ, জীবযাত্রাতেও যে-প্রকাশে ন্যূনতা ঘটলে মানুষ লজ্জিত হয়। সেই তার বাড়তি ভাগের প্রকাশ নিয়ে মানুষের যেমন দুঃসাধ্য প্রয়াস এমন তার সাধারণ প্রয়োজন মেটাবার জন্যও নয়। মানুষের মধ্যে যিনি বড়ো আছেন আহারে বিহারেও পাছে তাঁর অসম্মান হয় মানুষের এই এক বিষম ভাবনা।

ঋজু হয়ে চলতে গিয়ে প্রতি মুহূর্ত্তেই মানুষকে ভারাকর্ষণের বিরুদ্ধে মান বাঁচিয়ে চলতে হয়। পশুর মতো চলতে গেলে তা করতে হোত না। মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে চলাতেও তার নিয়ত চেষ্টা, পদে পদেই নীচে পড়বার শঙ্কা। এই মনুষ্যত্ব বাঁচানোর দ্বন্দ্ব মানবধর্ম্মের সঙ্গে। পশুধর্ম্মের দ্বন্দ্ব অর্থাৎ আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের। মানুষের ইতিহাসে এই পশুও আদিম। সে টানচে তামসিকতায়, মূঢ়তার দিকে। পশু বলচে সহজধর্ম্মের পথে ভোগ করো, মানুষ বলচে, মানবধর্ম্মের দিকে তপস্যা করো। যাদের মন মন্থর, যারা বলে, যা আছে তাই ভালো, যা হয়ে গেছে তাই শ্রেষ্ঠ, তারা রইল জন্তুধর্ম্মের স্থাবর বেড়াটার মধ্যে, তারা মুক্ত নয়, তারা স্বভাব থেকে ভ্রষ্ট। তারা পূর্ব্বসঞ্চিত ঐশ্বর্য্যকে বিকৃত করে, নষ্ট করে।

মানুষ একদিকে মৃত্যুর অধিকারে আর একদিকে অমৃতে;—একদিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর একদিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না। মানুষ নিজেকে জানে

তদ্দূরে তদ্বন্তিকে চ

—সে দূরেও বটে, সে নিকটেও। সেই দূরের মানুষের দাবী নিকটের মানুষের সব কিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। এই অপ্রত্যক্ষের দিকে মানুষের কল্পনাবৃত্তি দৌত্য করে। ভুল করে বিস্তর, যেখানে থই পায় না সেখানে অদ্ভুত সৃষ্টি দিয়ে ফাঁক ভরায়, তবুও এই অপ্রতিহত প্রয়াস সত্যকেই প্রমাণ করে,—মানুষের এই একটি আশ্চর্য্য সংস্কারের সাক্ষ্য দেয়, যে, যেখানে আজো তার জানা পৌঁছয়নি সেখানেও শেষ হয়নি তার জানা।

গাছে গাছে ঘর্ষণে আগুন জ্বলে। জ্বলে বলেই জ্বলে এই জেনে চুপ করে থাকলে মানুষের বুদ্ধিকে দোষ দেওয়া যেত না। জানবার নেই বলেই জানা যাচ্চে না এ কথাটা সঙ্গত নয় তো কী। কিন্তু মানুষ ছেলেমানুষের মতো বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ঘর্ষণে আগুন জ্বলে কেন? বুদ্ধির ব্যাগারখাটুনি সুরু হোলো। খুব সম্ভব গোড়ায় ছেলেমানুষের মতোই জবাব দিয়েছিল; হয়তো বলেছিল গাছের মধ্যে একটা রাগী ভূত অদৃশ্যভাবে বাস করে, মার খেলে সে রেগে আগুন হয়ে ওঠে। এই রকম সব উত্তরে মানুষের পুরাণ বোঝাইকরা। যাদের শিশুবুদ্ধি কিছুতেই বাড়তে চায় না তারা এই রকম উত্তরকে আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু অল্পে-সন্তুষ্ট মূঢ়তার মাঝখানেও মানুষের প্রশ্ন বাধা ঠেলে ঠেলে চলে। কাজেই উনুন ধরাবার জন্যে আগুন জ্বালতে মানুষকে যত চেষ্টা করতে হয়েচে তার চেয়ে সে কম চেষ্টা করেনি আগুন জ্বলে কেন তার অনাবশ্যক উত্তর বের করতে। এদিকে হয়ত উনুনের আগুন গেছে নিবে, হাঁড়ি চড়েনি, পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলচে, প্রশ্ন চলচেই আগুন জ্বলে কেন? সাক্ষাৎ আগুনের মধ্যে তার উত্তর নেই, উত্তর আছে প্রত্যক্ষ আগুনকে বহুদূরে ছাড়িয়ে। জন্তু-বিচারক মানুষকে কি নির্ব্বোধ বলবে না, আমরা পতঙ্গকে যেমন বলি মূঢ়, বারবার যে-পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে?

এই অদ্ভুত বুদ্ধির সকলের চেয়ে স্পর্দ্ধা প্রকাশ পায় যখন মানুষকে সে ঠেলা দিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে তুমি আপনি কে। এমন কথা বলতেও তার বাধে না যে মনে হচ্চে বটে তুমি আছ কিন্তু সত্যই তুমি আছ কি, তুমি আছ কোথায়। উপস্থিত মতো কোনো জবাব না খুঁজে পেয়ে তাড়াতাড়ি যদি বলে বসি, আছি দেহধর্ম্মে, অমনি অন্তর থেকে প্রবাহণ রাজা মাথা নেড়ে বলবেন ওখানে প্রশ্নের শেষ হতে পারে না। তখন মানুষ বললে ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্‌ মানবধর্ম্মের গভীর সত্য নিহিত আছে গোপনে। আমার এই আমি আছে প্রত্যক্ষে, সেই আমি আছে অপ্রত্যক্ষে।

কথাটা স্পষ্ট করে বুঝে দেখবার চেষ্টা করা যাক।

এই যে জল, এই যে স্থল, এই যে এটা, এই যে ওটা, যত কিছু পদার্থকে নির্দ্দেশ করে বলি এই-যে, এ সমস্তই ভালো করে জেনে-বুঝে নিতে হবে নইলে ভালো করে বাঁচা যায় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ বলে, তদ্বিদ্ধি নেদং যদিদম্‌ উপাসতে। তাকেই জানো। কাকে, না ইদং অর্থাৎ এই-যে ব'লে যাকে স্বীকার করি তাকে নয়। “এই যে আমি শুনচি,” এ হোলো সহজ কথা। তবুও মানুষ বললে এর শেষ কথা সেইখানে যেখানে ইদং সর্ব্বনাম পৌঁছয় না। ক্ষ্যাপার মতো সে জিজ্ঞাসা করে কোথায় আছে

শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং

—শ্রবণেরও শ্রবণ। ভৌতিক প্রণালীতে খোঁজ করতে করতে এসে ঠেকে বাতাসের কম্পনে। কিন্তু ওখানেও রয়েচে ইদং, এই-যে কম্পন। কম্পন তো শোনা নয়। যে বলচে, আমি শুনচি, তার কাছে পৌঁছনো গেল। তারো সত্য কোথায়।

উপর থেকে নীচে পড়ল একটা পাথর। জ্ঞানের দেউড়িতে যে-দ্বারী থাকে সে খবর দিলে, এই-যে পড়েচে। নীচের দিকে উপরের বস্তুর যে-টান সেইটে ঘটল। দ্বারীর কর্ত্তব্য শেষ হোলো। ভিতর মহল থেকে শোনা গেল, একে টান, ওকে টান, তাকে টান, বারে বারে “এই-যে।” কিন্তু সব এই-যেকে পেরিয়ে বিশ্বজোড়া একমাত্র টান।

উপনিষদ সকলের মধ্যে এই এককে জানাই বলেন,

প্রতিবোথ বিদিতম্‌

—প্রত্যেক পৃথক পড়ার বোধে একটি অদ্বিতীয় টানকে সত্য বলে জানা। তেমনি, আমি শুনি, তুমি শোনো, এখন শুনি, তখন শুনি, এই প্রত্যেক শোনার বোধে যে-একমাত্র পরম শোনার সত্য বিদিত সেই প্রতিবোধবিদিত এক সত্যই

শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং।

তার সম্বন্ধে উপনিষদ বলেন, অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি। আমরা যা-কিছু জানি এবং জানিনে সব হতেই স্বতন্ত্র। ভৌতিক বিজ্ঞানেও যা গুহাহিত তাকে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে কেবল যে মেলাতে পারিনে তা নয়, বলতে হয় এ তার বিপরীত। ভাষায় বলি ভারাকর্ষণ শক্তি, কিন্তু আকর্ষণ বলতে সাধারণত যা বুঝি এ তা নয়, শক্তি বলতে যা বুঝি এ তাও নয়।

প্রকৃতির গুহাহিত শক্তিকে আবিষ্কার ও ব্যবহার করেই মানুষের বাহিরের সমৃদ্ধি; যে-সত্যে তার আত্মার সমৃদ্ধি সেও গুহাহিত, তাকে সাধনা করেই পেতে হবে। সেই সাধনাকে মানুষ বলে ধর্ম্মসাধনা।

ধর্ম্ম শব্দের অর্থ স্বভাব। চেষ্টা করে সাধনা করে স্বভাবকে পাওয়া কথাটা শোনায় স্ববিরোধী অর্থাৎ স্বভাবকে অতিক্রম করে স্বভাবকে পাওয়া। খৃষ্টানশাস্ত্রে মানুষের স্বভাবকে নিন্দা করেচে। বলেচে, তার আদিতেই পাপ, অবাধ্যতা। ভারতীয় শাস্ত্রেও আপনার সত্য পাবার জন্যে স্বভাবকে অস্বীকার করতে বলে। মানুষ নিজে সহজে যা তাকে শ্রদ্ধা করে না। মানুষ বলে বসল তার সহজ স্বভাবের চেয়ে তার সাধনার স্বভাব সত্য। একটা স্বভাব তার নিজেকে নিয়ে আর একটা স্বভাব তার ভূমাকে নিয়ে।

কথিত আছে

শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।
তয়োঃ শ্রেয়আদদানস্য সাধু হীয়তেঽর্থাৎ য উ প্রেয়োবৃনীতে॥

মানুষের স্বভাবে শ্রেয়ও আছে প্রেয়ও আছে। ধীর ব্যক্তি দুইকে পৃথক করেন। যিনি শ্রেয়কে গ্রহণ করেন তিনি সাধু, যিনি প্রেয়কে করেন তিনি পুরুষার্থ থেকে হীন হন।

এ সব কথাকে আমরা চিরাভ্যস্ত হিতকথা বলে গণ্য করি অর্থাৎ মনে করি, লোক-ব্যবহারের উপদেশরূপেই এর মূল্য। কিন্তু সমাজ-ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য করেই এ শ্লোকটি বলা হয়নি। এই শ্লোকে আত্মাকে সত্য করে জানবার উপায় আলোচনা করা হয়েচে।

প্রবৃত্তির প্রেরণায় আমরা যা ইচ্ছা করি সেই প্রেয়ের ইচ্ছা মানুষের স্বভাবে বর্ত্তমান, আবার যা ইচ্ছা করা উচিত সেই শ্রেয়ের ইচ্ছাও মানুষের স্বভাবে। শ্রেয়কে গ্রহণ করার দ্বারা মানুষ কিছু একটা পায় যে তা নয় কিছু একটা হয়। সেই হওয়াকে বলে সাধু হওয়া। তার দ্বারা ধনী হয় না, বলী হয় না, সমাজে সম্মানিত হতেও পারে, না হতেও পারে, এমন কি, অবমানিত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সাধু হওয়া পদার্থ টা কী, প্রকৃতির রাজ্যে তার কোনো কিনারা নেই। শ্রেয় শব্দটাও তেমনি। অপরপক্ষে প্রেয়কে একান্তরূপে বরণ করার দ্বারা মানুষ আর-একটা কিছু হয়, তাকে উপনিষদ বলচেন আপন অর্থ থেকে হীন হওয়া। নাগর শব্দ বলতে যদি citizen না বুঝিয়ে libertine বোঝায় তাহলে বলতে হয় নাগর শব্দ আপন সত্য অর্থ হতে হীন হয়ে গেছে। তেমনি একান্তভাবে প্রেয়কে অবলম্বন করলে মানুষ বলতে যা বোঝায় সেই সত্য হীন হয়ে যায়। নিজের মধ্যে সর্ব্বকালীন বিশ্বভূমীন মনুষ্যধর্ম্মের উপলব্ধিই সাধুতা, হীনতা সেই মহামানবের উপলব্ধি থেকে বিচ্যুত হওয়া। প্রাকৃতিক স্বভাবের উপরেও মানুষের আত্মিক স্বভাব যদি না থাকত তাহলে এ সব কথার অর্থ থাকত না।

ডিমের মধ্যেই পাখীর প্রথম জন্ম। তখনকার মতো সেই ডিমটাই তার একমাত্র ইদং। আর কিছুই সে জানে না। তবু তার মধ্যে একটা প্রবর্ত্তনা আছে বাইরের অজানার মধ্যে সার্থকতার দিকে। সেই সার্থকতা নেদং যদিদমুপাসতে। যদি খোলাটার মধ্যেই একশো বছর সে বেঁচে থাকত তাহলে সেটাকেই বলা যেত তার মহতী বিনষ্টি।

মানুষের সাধনাও এক স্বভাব থেকে স্বভাবান্তরের সাধনা। ব্যক্তিগত সংস্কার ছাড়িয়ে যাবে তার জিজ্ঞাসা তবেই বিশ্বগতজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হবে তার বিজ্ঞান। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও জড় প্রথাগত অভ্যাস কাটিয়ে যাবে তার প্রয়াস তবেই বিশ্বগত কর্ম্মের দ্বারা সে হবে বিশ্বকর্ম্মা। অহঙ্কারকে ভোগাসক্তিকে উত্তীর্ণ হবে তার প্রেম, তবেই বিশ্বগত আত্মীয়তায় মানুষ হবে মহাত্মা। মানুষের একটা স্বভাবে আবরণ অন্য স্বভাবে মুক্তি।

জ্যোতির্ব্বিদ দেখলেন কোনো গ্রহ আপন কক্ষপথ থেকে বিচলিত। নিঃসন্দেহ মনে বললেন অন্য কোনো অগোচর গ্রহের অদৃশ্য শক্তি তাকে টান দিয়েচে। দেখা গেল মানুষেরও মন আপন প্রকৃতিনির্দ্দিষ্ট প্রাণধারণের কক্ষপথ যথাযথ আবৃত্তি করে চলচে না। অনির্দ্দিষ্টের দিকে স্বভাবের অতীতের দিকে ঝুঁকচে। তার থেকে মানুষ কল্পনা করলে দেবলোক। বললে, আদেশ সেইখানকার, আকর্ষণ সেখান হতে। কে সেই দেবলোকের দেবতা তা নিয়ে মানুষে মানুষে হানাহানি চলেচে। যিনিই হোন, তাঁকে দেবতাই বলি আর যাই বলি, মানুষকে জীবসীমার মধ্যে কিছুতেই স্থির থাকতে দিলেন না।

সমুদ্র চঞ্চল হোলো। জোয়ারভাঁটার ওঠা-পড়া চলচেই। চাঁদ না দেখা গেলেও সমুদ্রের চাঞ্চল্যেই চাঁদের আহ্বান প্রমাণ হোতে। বাঁচবার চেষ্টাতেও মানুষ অনেক সময় মরে। যে-ক্ষুধা তার অন্তরে, নিঃসংশয়,—তার লক্ষ্য যে তার বাইরেও সত্য সে কথাটা সদ্যোজাত শিশুও স্বতই জানে। মানুষের প্রাণান্তিক উদ্যম দেখা গেছে এমন-কিছুর জন্যে যার সঙ্গে বাঁচবার প্রয়োজনের কোনো যোগই নেই। মৃত্যুকে ছাড়িয়ে আছে যে-প্রাণ সেই তাকে দুঃসাহসের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেচে। ভৌতিক প্রাণের পথে প্রাণীর নিজেকে রক্ষা, আর এ পথে আত্মবানের আত্মাকে রক্ষা নয় আত্মাকে প্রকাশ।

বৈদিক ভাষায় ঈশ্বরকে বলেচে আবিঃ, প্রকাশস্বরূপ। তাঁর সম্বন্ধে বলেচে, যস্য নাম মহদ্‌যশঃ তাঁর মহদ্‌ যশই তাঁর নাম, তাঁর মহৎ কীর্ত্তিতেই তিনি সত্য। মানুষের স্বভাবও তাই,—আত্মাকে প্রকাশ। বাইরে থেকে খাদ্যবস্তু গ্রহণ করার দ্বারাই প্রাণী আপনাকে রক্ষা করে, বাইরে আপনাকে উৎসর্গ করার দ্বারাই আত্মা আপনাকে প্রকাশ করে। এইখানে প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে সে আপনাকে ঘোষণা করে। এমন কি, বর্ব্বর দেশের মানুষও নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টায় প্রকৃতিকে লঙ্ঘন করতে চায়। সে নাক ফুঁড়ে মস্ত এক শলা দিয়েচে চালিয়ে। উখো দিয়ে দাঁত ঘষে ঘষে ছুঁচোলো করেচে। শিশুকালে তক্তা দিয়ে চেপে বিকৃত করেচে মাথার খুলি, বানিয়েচে বিকটাকার বেশভূষা। এই সব উৎকট সাজে সজ্জায় অসহ্য কষ্ট মেনেচে। বলতে চেয়েচে সে নিজে সহজে যা তার চেয়ে সে বড়ো। সেই তার বড়ো-আমি প্রকৃতির বিপরীত। যে-দেবতাকে সে আপন আদর্শ বলে মানে সেও এমনি অদ্ভুত, তার মহিমার প্রধান পরিচয় এই যে সে অপ্রাকৃতিক। প্রকৃতির হাতে পালিত তবু প্রকৃতিকে দুয়ো দেবার জন্যে মানুষের এই যেন একটা ঝগড়াটে ভাব। ভারতবর্ষেও দেখি কত লোক, কেউ বা ঊর্দ্ধবাহু, কেউ বা কণ্টক-শয্যায় শয়ান, কেউ বা অগ্নি-কুণ্ডের দিকে নতশীর্ষ। তারা জানাচ্চে তারা শ্রেষ্ঠ, তারা সাধু, কেননা তারা অস্বাভাবিক। আধুনিক পাশ্চাত্যদেশেও কত লোক নিরর্থক কৃচ্ছ্রসাধনের গৌরব করে। তাকে বলে রেকর্ড ব্রেক করা, দুঃসাধ্যতার পূর্ব্ব অধ্যবসায় পার হওয়া। সাঁতার কাটচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বাইসিক্‌লে অবিশ্রাম ঘুরপাক খাচ্চে, দীর্ঘ উপবাস করচে স্পর্দ্ধা করে, কেবলমাত্র অস্বাভাবিকতার গৌরব প্রচারের জন্যে। ময়ূরকে দেখা যায় গর্ব্ব করতে আপন ময়ূরত্ব নিয়েই, হিংস্রজন্তু উৎসাহ বোধ করে আপনার হিংস্রতার সাফল্যে। কিন্তু বর্ব্বর মানুষ মুখশ্রীর বিকৃতি ও বেশভূষার অতিকৃতি নিয়ে গর্ব্ব করে, জানায় আমি ঠিক মানুষের মতো নই, সাধারণ মানুষরূপে আমাকে চেনবার জো নেই। এমনতরো আত্মপ্রকাশের চেষ্টাকে বলি নঙর্থক, এ সদর্থক নয়, প্রকৃতির বিরুদ্ধে স্পর্দ্ধা মাত্র, যা তার সহজ তার প্রতিবাদমাত্র, তার বেশি আর কোনো অর্থ এতে নেই। অহঙ্কারের প্রকাশকে আত্মগৌরবের প্রকাশ বলে মনে করা বর্ব্বরতা, যেমন নিরর্থক বাহ্যানুষ্ঠানকে মনে করা পুণ্যানুষ্ঠান।

এ যেমন দৈহিক দিকে তেমনি আর্থিক দিকেও মানুষের স্পর্দ্ধার অন্ত নেই। এখানেও রেকর্ড ব্রেক করা পূর্ব্ব ইতিহাসের বেড়া-ডিঙোনো লম্ফ। এখানকার চেষ্টা ঠিক অস্বাভাবিকের জন্যে নয়, অসাধারণের জন্যে। এতে আছে সীমার প্রতি অসহিষ্ণুতা, তার বাইরে আর কিছুই নয়। কিন্তু যা কিছু বস্তুগত, যা বাহ্যিক, সীমাই তার ধর্ম্ম। সেই সীমাকে বাড়িয়ে চলা যায়, পেরিয়ে যাওয়া যায় না। যিশুখৃষ্ট বলেচেন সূচীর রন্ধ্র দিয়ে উট যেমন গলে না ধনীর পক্ষে স্বর্গদ্বার তেমনি দুর্গম। কেননা ধনী নিজের সত্যকে এমন কিছুর দ্বারা অনুভব ও প্রকাশ করতে অভ্যস্ত যা অপরিমেয়ের বিপরীত, তাই সে হীয়তেঽর্থাৎ, মনুষ্যত্বের অর্থ হতে হীন হয়। হাতির মতো বড়ো হওয়াকে মানুষ বড়ো লোক হওয়া বলে না, হয়তো বর্ব্বর মানুষ তাও বলে। বাহিরের উপকরণ পুঞ্জিত করার গর্ব্ব করা সম্বন্ধেও সেই কথা খাটে। অন্যের চেয়ে আমার বস্তুসঞ্চয় বেশি, এ কথা মানুষের পক্ষে বলবার কথা নয়। তাই মৈত্রেয়ী বলেছিলেন, যেনাহং নামৃতা স্যাম্‌ কিমহং তেন কুর্য্যাম্‌, তিনি উপেক্ষা করেছিলেন উপকরণবতাং জীবিতম্‌। যে ওস্তাদ তানের অজস্রতা গণনা করে গানের শ্রেষ্ঠতা বিচার করে তার বিদ্যাকে সেই উটের সঙ্গে তুলনা করব। শ্রেষ্ঠগান এমন পর্য্যাপ্তিতে এসে স্তব্ধ হয় যার উপরে আর একটি মাত্র সুরও যোগ করা যায় না। বস্তুত গানের সেই থামাকে সীমা বলা যায় না। সে এমন একটি শেষ যার শেষ নেই। অতএব যথার্থ গায়কের আত্মা আপন সার্থতাকে প্রকাশ করে তানের প্রভূত সংখ্যার দ্বারা নয়, সমগ্র গানের সেই চরম রূপের দ্বারা যা অপরিমেয়, অনির্ব্বচনীয়, বাইরের দৃষ্টিতে যা স্বল্প, অন্তরে যা অসীম। তাই মানুষের যে-সংসার তার অহং-এর ক্ষেত্রে, সেদিকে তার অহঙ্কার ভূরিতায়, যেদিকে তার আত্মা সেদিকে তার সার্থকতা ভূমায়। একদিকে তার গর্ব্ব স্বার্থসিদ্ধিতে, আর একদিকে তার গৌরব পরিপূর্ণতায়। সৌন্দর্য্য, কল্যাণ, বীর্য্য, ত্যাগ প্রকাশ করে মানুষের আত্মাকে, অতিক্রম করে প্রাকৃত মানুষকে, উপলব্ধি করে জীবমানবের অন্তরতম বিশ্বমানবকে। যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।

চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চে অন্য সকল প্রাণী, বাইরে থেকে জীবিকার অর্থ খুঁজে খুঁজে। মানুষ আপন অন্তরের মধ্যে আশ্চর্য্য হয়ে কাকে অনুভব করলে যিনি নিহিতার্থো দধাতি, যিনি তাকে তার অন্তর্নিহিত অর্থ দিচ্চেন। সেই অর্থ মানুষের আপন আত্মারই গভীর অর্থ, সেই অর্থ এই যে মানুষ মহৎ, মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে মহৎ, তবেই প্রমাণ হবে যে, সে মানুষ; প্রাণের মূল্য দিয়েও তার আপন ভূমাকে প্রকাশ করতে হবে, কেননা তিনি চিরন্তন মানব, সর্ব্বজনীন মানব, তিনি মৃত্যুর অতীত, তাঁকে যে-অর্ঘ্য দিতে হবে সে-অর্ঘ্য সকল মানুষের হয়ে সকল কালের হয়ে আপনারি অন্তরতম বেদীতে। আপনারি পরমকে না দেখে মানুষ বাইরের দিকে সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়। শেষকালে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে ক্লান্ত হয়ে সে বলে, কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। মানুষের দেবতা মানুষের মনের মানুষ; জ্ঞানে কর্ম্মে ভাবে যে-পরিমাণে সত্য হই সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে পাই,—অন্তরে বিকার ঘটলে সেই আমার আপন মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাইনে। মানুষের যত-কিছু দুর্গতি আছে সেই আপন মনের মানুষকে হারিয়ে, তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে অর্থাৎ আপনাকেই পর করে দিয়ে। আপনাকে তখন টাকায় দেখি, খ্যাতিতে দেখি, ভোগের আয়োজনে দেখি। এই নিয়েই তো মানুষের যত বিবাদ, যত কান্না। সেই বাইরে বিক্ষিপ্ত আপনাহারা মানুষের বিলাপগান একদিন শুনেছিলেম পথিক ভিখারীর মুখে—

আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।

সেই নিরক্ষর গাঁয়ের লোকের মুখেই শুনেছিলেম,
তোরি ভিতর অতল সাগর।
সেই পাগলই গেয়েছিল,
মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ,—
সেই অন্বেষণেরই প্রার্থনা বেদে আছে
আবিরাবীর্ম্মএধি

পরম মানবের বিরাটরূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ আমারই মধ্যে তাঁর প্রকাশ সার্থক হোক।