বরষায়।

আইল বরষা ধরায় আবার,
উথলিছে বারি অবনীতলে।
উথলিছে হৃদে শোক-পারাবার,
বিচ্ছেদ-তরঙ্গ প্রাণে উথলে।

ঘোর ঘটাচ্ছন্ন বিমল গগন,
বরষিছে সদা ভীষণ বারি।
হৃদয়-গগন সদা সর্ব্বক্ষণ
বিরহ-মেঘেতে রাখে আঁধারি।

প্রবল বেগেতে বহিছে পবন,
সদা সর্ব্বদাই ভীষণ বেগে।
হু হু স্বন্ স্বন্ রব কি ভীষণ,
শুনিয়া আতঙ্কে শিহরে সবে।

সতত বহিছে জীবনেতে মোর,
দুঃখের ঝটিকা আকুল হয়ে।
বিষাদেতে ঘেরা হৃদয়-অম্বর,
মলিনতা রহে ব্যাপি হৃদয়ে।


সুনীল গগনে দিয়াছে ঢালিয়া,
ঘন গাঢ়তর কালিমা রাশি।
ক্ষণপ্রভা খেলে নাচিয়া নাচিয়া,
উজলিয়া দিক্ মিছে হাসি।

মানসেতে মম পড়েছে কালিমা,
আবরি হৃদয় সদাই রয়।
কি ঘোর আঁধার নাহি তার সীমা,
আঁধারে জীবন হইবে লয়॥

ঘন ঘন ঘন গরজে গগন,
হেরিয়া বিজলী জলদ মাঝে।
শোভে সৌদামিনী নয়নরঞ্জন,
জলদের কোলে মোহন সাজে।

সুখ-স্মৃতি আসে ক্ষণিক হাসিয়া
বিজলীর মত চপলা বালা।
পূর্ব্ব-স্মৃতি মনে উঠে চমকিয়া,
শত গুণ হয় প্রাণের জ্বালা।

রিম্ রিম্ ঝিম্ সারা নিশী দিন
বরষিছে সদা বরষা-ধারা।

কভু ঝম্ ঝম্ হয় বরষণ,
প্রবল বেগেতে ভাসিছে ধরা।

বহে নয়নেতে ধারা অনিবার,
সতত হৃদয় প্লাবন করি।
রোধে তার গতি হেন সাধ্য কার,
ঝরিবে যে হায় জীবন ভরি।

নবীন বরষা হেরিয়া ধরায়,
পুলকে পূরিছে সবার মন।
সাজিয়াছে ধরা অতি শোভাময়,
নদনদীগণে শোভা কেমন।

বরষা-বারিতে হয়েছে পূরিত,
সরোবর ঝিল বিল তটিনী।
সাগরের বারি হয় উদ্বেলিত,
বহে অবিরত দ্রুতগামিনী॥

ধারা প্রস্রবণ প্রপাত নির্ঝর,
বহে খর বেগে উচ্ছ্বসভরে।
নাহি সে সুস্বর মনোমুগ্ধকর
মৃদু মধু স্বর ললিত সুরে।৷


নব নব যত লতা পাতাদল,
বারিসিক্ত হয়ে শোভিতা হয়।
ধূলিধূসরিত নাহি সে সকল,
নবীন নীরেতে ভাসিয়া বয়॥

হেরিয়া অম্বরে শোভা জলদের,
নাচে ওই শিখী শাখীর পরে।
শিখিনীর সহ হরিষ অন্তর,
প্রেমে ভরা প্রাণ গরবভরে॥

করে কেকারব থাকিয়া থাকিয়া,
নব জলধরে হেরিয়া ওই।
উন্মত্ত ডাহুক ডাহুকী লইয়া,
সুখনীরে ভাসে প্রিয়ারে লই।

ভ্রমে হংসবর হংসী সাথে মিলি,
পশি জলাশয়ে মাতি ক্রীড়ায়।
করে সন্তরণ হয়ে কুতূহলী,
সুখনীরে রহে ভাসায়ে কায়।৷

নবীন নীরেতে পূরিত ধরণী,
নবীন বাসনা হৃদয়ে জাগে।

যেন প্রেমাবেশে নবোঢ়া রমণী,
প্রেমে ভরা প্রাণ প্রেমানুরাগে।

এই বারি বিনা প্রকৃতি সুন্দরী,
পিপাসিতা আহা ছিল যে হয়ে।
মিটিল পিপাসা পানে ওই বারি,
শীতল হইল তাপ ঘুচিয়ে।৷

হেরি ধরা মাঝে বরষার শোভা,
জ্বলে দিবানিশি দারুণ জ্বালা।
না ভোলে নয়ন নহে মনলোভা,
করে মম মন প্রাণ উতলা।

কোথা মম নাথ! কোথা প্রাণেশ্বর!
কোথায় এখন বারেক বল?
পিপাসিত প্রাণে নব জলধর,
সম ঢাল প্রাণে শান্তির জল।

প্রাণে জাগে তব দরশন-আশা।
সতত যে মন ব্যাকুল হয়।
চাতকিনী সম দারুণ পিপাসা,
আকুল হৃদয় তৃষিত রয়।৷


উত্তপ্ত হৃদয়ে ঢাল সুধা শান্তি,
বরিষণ করি বচন-সুধা।
সুললিত সেই কমনীয় কান্তি,
হেরিবারে প্রাণ চাহে যে সদা।

নবীন নীরদে হেরিয়া গগনে,
হেরিয়া ধরায় বরষা-ধারা।
বরষা রাগিণী শুনিয়া শ্রবণে,
করিতেছে মোরে পাগলপারা।

জাগিছে অন্তরে সতত আমার,
প্রাণাধিক তব মধুর স্মৃতি।
স্মরিয়া এখন করি হাহাকার,
সেই ভালবাসা প্রণয় প্রীতি।৷

কত বা সোহাগ কত অনুরাগ,
বহিত সুখের লহর প্রাণে।
ফুটিত হৃদয়ে নব নব রাগ
জলদেরে হায় হেরি গগনে।

উথলিয়া যথা কূলে কূলে বারি;
হয়ে উচ্ছ্বসিত বহিয়া যায়।

এ হৃদয় ভূমি প্লাবিত যে করি,
সতত উচ্ছ্বাস কতই হায়॥

নব জলধর গরজি গগনে,
করিত যখন গভীর নাদ।
ভয়াকুল চিত্তে বহি ভীত মনে,
লুকাতাম মুখ গণি প্রমাদ।

হাসি হাসি তুমি আসি প্রিয়তম!
লইতে আমারে হৃদয়ে টানি।
হইত তখন ভীতি দূর মম,
সে বাহুবন্ধনে অভয় গণি॥

তব প্রীতিকর এই মেঘমালা,
তব প্রীতিকর ঋতু বরষা।
তব প্রীতিকর দামিনীর খেলা,
তব প্রীতিকর ধরা সরসা।

তব প্রীতিকর এ বাদল দিন,
লুক্কায়িত রবি গগনপথে।
মেঘমালা-ঘেরা চন্দ্রমা মলিন,
লুকোচুরি খেলা জলদ সাথে।


কোথা সেই দিন গিয়াছে চলিয়া,
রাখিয়া আমার হৃদয়ে স্মৃতি।
এ বাদল দিনে উঠে উথলিয়া,
অভাগীর প্রাণে দুঃখের গীতি।

আজি জ্বলে প্রাণ বিহনে তোমার,
নহে প্রীতিকর নিকটে মম।
শূন্যময় হেরি এ পূর্ণ সংসার,
তোমা বিনা হায় হে প্রিয়তম!

তুমি পূর্ণ নাথ! এই শূন্য প্রাণে,
কূলে কূলে সদা ভরিয়া রহ।
মিলনের আশা সদা জাগে মনে,
তব সঙ্গিনীরে ডাকিয়া লহ।৷

করি এ মিনতি জলধর প্রতি,
মম এ ভারতী প্রাণেশে কহ।
বার্ত্তাবহ হয়ে তথা কর গতি
নাথ সহ মোরে মিলায়ে দেহ।

যাও হে সত্বরে সে অমরপুরে,
কহিতে আমার দুঃখের কথা।


বিমান বিচরি যাও পরপারে,
জানাইবে মম হৃদয়-ব্যথা॥

রহিলাম আশে বসিয়া হেথায়,
জীবনের পারে যাইব বলি।
মম প্রাণনাথ রহেন যথায়,
তথা প্রাণ হায় পায় কেবলি।৷

জুড়াইব জ্বালা যত জীবনের,
শান্তিময় সেই জীবন-পারে।
নিবারিব তাপ যত হৃদয়ের,
প্রাণে রাখি যাহা গোপন করে।