সম্প্রদান।


করিলেন তব করে মোরে সম্প্রদান।
স্নেহময় জনকের ব্যাকুল পরাণ।
স্নেহবতী জননীর কাতর হৃদয়।
সমর্পণ করিলেন যবে তনয়ায়।
বক্ষ-নীড়ে ছিনু ঢাকা স্নেহ-আচ্ছাদনে।
ভাঙ্গিয়া সে স্নেহ-নীড় এ চির-বন্ধনে।
বাঁধিলেন পিতামাতা সযতন করি।
সমর্পণ করিলেন প্রাণের কুমারী।
কতই আনন্দ আর বিষাদ তখন।
ক’রেছিল আন্দোলিত দোঁহাকার মন।
পরাইয়া কর্ত্তব্যের কঠোর শৃঙ্খল—
শৃঙ্খলিত করিলেন ফেলি আঁখিজল।
স্নেহ-তরুতলে সদা রাখিতেন যারে।
স্নেহ বারি ঢালিতেন সতত যে শিরে।
প্রাণাধিকা সে দুহিতা তব করে দিয়া।
করিলেন কর্ত্তব্যের সম্পাদন ক্রিয়া।
লহ লহ ও বাছনি তনয়া রতনে।
সমর্পণ করিলাম রাখিও যতনে।


বড় আদরের ধন গৃহ-সুশোভিনী।
হৃদয় বৃন্তের ফুল সৌরভদায়িনী।
ছিল মম এ ভবন আলোকিত করে।
নয়নের তারা সমর্পিনু তব করে।
কমনীয় বালার এ জীবন-নলিন।
কভু যেন নাহি হয় বিষাদে মলিন।
আজীবন তব পাশে হইয়া সঙ্গিনী।
হবে তব অনুরতা অনুজ্ঞা পালিনী।
দাম্পত্য জীবন সুখী হোক্ দুজনার—
এস বৎস! ধর হাত মম তনয়ার।
লয়ে যাও তব গৃহে গৃহলক্ষ্মী করি।
আঁধার হইল আজ মম এই পুরী।
এস বৎসে! এস মাগো যাও স্বামী পাছে—
রহিবে সতত ওমা ছায়া সম সাছে।
বলিয়া দিলেন পিতা বিদায় তখন।
স্নেহময়ী জননীর সজল নয়ন।
বলিতে বলিতে বাজে বাদ্য ঐক্যতান।
উচ্ছসিত হল তবে সকলের প্রাণ।
নমি শির পিতৃ-পদে করিলে প্রণাম।
স্নেহাশীষ শিরোপরে ল’য়ে গুণধাম!


ঈঙ্গিতে সম্মতি তুমি করিয়া জ্ঞাপন।
আকাঙ্ক্ষিত হ’য়ে মোরে করিলে গ্রহণ
শুভাশীষ সকলেতে বর্ষিল সাদরে।
পুরোহিত মন্ত্র পাঠ পুনঃ পুনঃ করে।
শুভযাত্রা করিলাম সেই শুভক্ষণে—
শৃঙ্খলিত হয়ে এই পবিত্র বন্ধনে।
সে স্নেহ-বন্ধন ছিন্ন করি জনকের—
জননীর ক্রোড় যাহা আবাস স্নেহের—
সে সকল পাশরিনু হেরিয়া তোমারে।
জনকের শুভাশীষ ল’য়ে শিরোপরে।

পুলকেতে পরিপূর্ণ হইল অন্তর।
সাধনার ধন লভি মনোমত বর।
ভাবিলাম ছায়াসম সতত হেরিব।
পিতৃ মাতৃ এ আদেশ যতনে বহিব।
কভু না ছাড়িয়া রব এ হেন রতন।
রহিব নিকটে সদা যাবত জীবন।
আনন্দেতে উচ্ছ্বসিত হইলাম হায়।
সুখোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হেরিনু ধরায়।
হারাইনু আপনারে ভুলিনু জগত।
পাশরিনু শৈশবের ধূলাখেলা যত।


ভুলিলাম পিতা মাতা গৃহ পরিজন।
ভুলিলাম স্বজনের মিষ্ট আলাপন।
চিরপরিচিত সেই জনকের ঘর—
শৈশবের ক্রীড়াভূমি স্নেহের আকর—
ভুলিলাম সে সকল তোমারে হেরিয়া।
আনন্দেতে পুলকিত হইল যে হিয়া।
ধরাতল জ্ঞান হল অমর ভুবন।
দেবতা-আকার তুমি দেবের নন্দন।
পবিত্র সে সৌম্যরূপ মাধুর্য্য আকার।
সুদিব্য যানেতে কিবা শোভা চমৎকার!
দেবের কুমার যেন চাপি দেবযানে।
চলিয়াছে আনন্দেতে অমর ভুবনে।
বিজয়ী হইয়া যথা রণজয় করি—
বসিয়াছে মহোৎসাহে বীরেন্দ্রকেশরী।
সেইরূপ উৎসাহেতে হইয়া উল্লাস।
বিজয়ী হইলে নাথ পূর্ণ মন-আশ।
অধিকার করিলে যে বালিকা-হৃদয়।
প্রীতি প্রেম ভালবাসা সেনা সমুদয়।
অনুরাগে ল’য়ে তবে সেনাপতি করি।
সুমধুর তব বাণী বিজয়ের ভেরি।


যুগল নয়নে করি শরের সন্ধান।
ফুল ধনু ভ্রূযুগল সদা হানে বাণ।
বালিকা-হৃদয় রাজ্যে তুমি অধীশ্বর।
হইলে বিজয়ী বীর জিনিয়া সমর।
কোথা সেই সুখময় বিবাহ উৎসব!
কোথা সেই আনন্দের বাদ্যভাণ্ড রব!
কোথা সেই হরষের ছুটিছে লহর!
কোথায় সে পরিজনে প্রফুল্ল অন্তর!
হাহারবে ভরিয়াছে সকল সংসার—
আকুলিত হয়ে সবে করে হাহাকার!
নীরবতা ঘেরিয়াছে আজি এ ভবন।
বিষাদেতে দিবানিশি রহে পরিজন।
তোমা বিনা শূন্য হায় হয়েছে সকল!
নাহিক কুসুমে শোভা নাহি পরিমল।
তরুবরে ফল নাহি শোভা পায় আর।
সরোবরে সরোজের শোভা চমৎকার।
নাহি আসে গুঞ্জরিয়া, অলি সে গুঞ্জনে।
নাহি ডাকে পিক্ আর সে পঞ্চম তানে।
পাপিয়ার পিউ তান হয়েছে নীরব।
সবে রহে নিরানন্দে সবে যেন শব।


হরিয়া সকল সুখ সকলের মধু।
রহিয়াছ ভুলি সবে ওহে প্রাণবঁধু।
ভুলিয়া সে বিবাহের দৃঢ় অঙ্গীকার,
ভুলিয়া সে স্নেহভরে আদেশ পিতার—

সতত রাখিবে পাশে মম তনয়ারে।
লয়েছিলে সে আদেশ তুমি নত শিরে।
এখন ফেলিয়া মোরে করি অনাথিনী,
এই কি প্রতিজ্ঞা তব ওহে গুণমণি!

ডুবাইয়া চিরতরে বিষাদ-সাগরে।
রহিয়াছ কোথা নাথ নিশ্চিন্ত অন্তরে।
হৃদয়েতে জ্বালি হায় প্রবল অনল।
বহায়েছ নয়নেতে ধারা অবিরল।
অভাগিনী করিয়াছ করি রাজরাণী।
কোথায় সে প্রতিশ্রুত তব দৃঢ় বাণী?
সত্যের আকর তুমি দৃঢ় তব পণ।
প্রতিজ্ঞা পালনে সদা করিতে মনন।
এই কি কর্ত্তব্য তব ওহে প্রাণপতি!
এই কি সে প্রতিজ্ঞার নিয়ম পদ্ধতি?
লও নাথ তব কাছে এই নিবেদন।
বারেক করিয়া সেই আদেশ স্মরণ।

সেই অঙ্গীকার তুমি স্মরি ক্ষণতরে।
রহিয়াছ যথা তুমি লও দুঃখিনীরে।
জীবনের পরপারে সেই মহাস্থানে।
স্থান দিও অভাগীরে বাঞ্ছিত চরণে।