মালা/হেমন্তে হেরিয়া

হেমন্তে হেরিয়া

আবার আইল দারুণ হেমন্ত
এসেছিল ও যে হইয়া কৃতান্ত
হরি লয়ে মম গেছে প্রাণকান্ত
শোকের ধূমেতে আবরি মোরে।

সঙ্গে এনেছিল উত্ত‍ুরে বাতাস
পরশিলে অঙ্গে উপজয়ে ত্রাস
চিরতরে মোরে করিয়া নিরাশ
কাড়িয়া লয়েছে মম নাথেরে॥

যেন মহাকাল ফুকারিছে শ্বাস
কিবা বিভীষিকা শীতল নিশ্বাস
হিমে মাখা সেই শীকর বাতাস
কালান্তক রূপে এল ধরায়।

সতত বহিত সম করকার
দিবানিশী এই বায়ু অনিবার
কাঁপাইয়া তাহা দিক‍্ চরাচর
আপনার মনে চলিত হায়।৷


রাশি রাশি হিম ঢালি ধরামাঝ
পরিয়া সতত হিমময় সাজ
আধিপত্য করে হিম ঋতুরাজ
জল স্থল নভে আসন পাতি।

হিমেতে আঁধার গগনমণ্ডল
হিমেতে ব্যাপৃত রহে ধরাতল
হিমময় যত জলাশয়ে জল
হিমাংশুরে ঢাকে সে হিম পতি॥

দিবাকরে সদা ঢাকি হিমজালে
আবরি রাখিত গগনের থালে
নাহি উজ্জ্বলতা সে নভোমণ্ডলে
নাহি ছিল তাপ তপন-কায়।

মুকুতার সম শিশিরের কণা।
সহস্র ফণীতে যেন ধরে ফণা
প্রবেশি হৃদয়ে দংশি মনোবীণা
নিজ কাজ সারি চলিয়া যায়॥

নীহারভূষিত নব দূর্ব্বাদল
রবি করে তাহা হয়না উজ্জ্বল
যেন ম্লান মুখে কাঁদে অবিরল
অশুভ কামনা করিয়া মনে।৷

নাহি ডাকে পাখী বসি শাখীপরে
আকুল উচ্ছ্বাসে কলকণ্ঠ সুরে
চমকিয়া উঠে সভয় অন্তরে
কহে মনোব্যথা শোকের গানে।

হেমন্ত-নিশীতে আসি কুঞ্জবনে
গোপাঙ্গনাগণ বাঁশরির তানে
মিলিত হতেন মুরারির সনে
প্রেমেতে বিভোলা গোপিকাচয়।

এ হেমন্ত হায় অসি লয়ে করে
এসেছিল যে গো অবন-মাঝারে
বধিবারে মোরে নিদারুণ শরে
শোকাকুলা করি মম হৃদয়॥

তেরশ উনিশ হেমন্তে অঘ্রাণ।
কি করাল বেশে হল অধিষ্ঠান
লয়ে হিমরাশি অসি খরসান
হানিল আমার হৃদয়মাঝে।

হিম-অন্ধকারে আবরি নয়ন
হিমেতে আচ্ছন্ন করিয়া জীবন
হরি লয়ে মম গেছে প্রাণধন
হিমরাজ মোর হৃদয়রাজে।৷


চিরস্মরণীয় এই কাল হায়
কি শোকের স্তম্ভ প্রোথিলে ধরায়
হেমন্তে অঘ্রাণ জাগিবে হিয়ায়
সপ্তদশ দিনে অষ্টমী তিথি।

যতদিন রবে রবি শশী তারা
যতদিন এই রবে বসুন্ধরা
চির দুঃখময় এই শান্তিহরা
হয়ে শান্তি হারা রহিল পৃথ্বী॥

কি দারুণ এই হেমন্ত সময়
নির্ম্মম নিষ্ঠুর পাষাণহৃদয়
আবার ফিরিয়া আসিল ধরায়
না আসিল ফিরে প্রাণেশ আর।

একা এল পুন এ মর ভুবনে
লয়ে গিয়েছিল মম প্রাণধনে
রাখিয়া নাথেরে অমর-ভবনে
এই কি হইল তার বিচার।

বলি সকাতরে শুন্ ও হিমানী
রাখ দুঃখিনীর এই দুঃখ বাণী
লয়ে চল মোরে যথা গুণমণি
করিয়া বসতি রব তথায়।


এ শূন্য ভবনে রহিতে যে আর
কাতর পরাণ না চাহে আমার
প্রাণনাথ বিনা সব অন্ধকার
শোক-সমাচ্ছন্ন হেরি ধরায়॥

না সহিত সেই কোমল শরীরে
হিমের প্রতাপ ডুবায়ে নীহারে
নবনীত কায় আবরি তুষারে
লইয়া গিয়াছে তোমারে কোথা।

ক্ষণ অদর্শনে রহিতে না পারি
কোথা আছ নাথ মোরে পরিহরি
হরিল হেমন্ত কালবেশ ধরি
দিয়া মম প্রাণে দারুণ ব্যথা॥

শোক-তাপময় পাপ-তাপ-ভরা
হিংসাদ্বেষপূর্ণ এই বসুন্ধরা
জ্বালাময় সদা কলুষিত ধরা
না হইল তব আবাস-স্থান।

চির শান্তিময় তোমার অন্তর
শীতলতা তাহে পূর্ণ নিরন্তর।
ছিল সে হৃদয় শান্তির নির্ঝর।
তাপ-বিরহিত ছিল সে প্রাণ।৷


বুঝি মনোমত হল এই কাল
নীহারের মাঝে জীবন মিলাল
সুরভি কুসুম অকালে নাশিল।
হিমে আবরিয়া ঢাকিল কায়।

নিদাঘের তাপে হইতে তাপিত
রবিকর-তাপ প্রাণে না সহিত
তাই কি হেমন্তে করি মনোনীত
তাহার সহিত গিয়াছ হায়॥

আসিল যে ফিরে হেমন্ত আবার
কই তুমি ফিরে এলে নাকো আর
শূন্য এ হৃদয় শূন্য এ আগার
এই যে হেমন্ত কৃতান্ত সম।

হায়রে কি কাজ করিলিরে বল্
ও হেমন্ত ঋতু এত তুই খল
ভরা ছিল তোর হৃদে হলাহল
ভুলাতিস্ নানা ছলনা করি॥

মিত্র জ্ঞানে তোরে করি সমাদর
তোর আশাপথ চাহি নিরন্তর
তব আগমনে প্রফুল্ল অন্তর
হইতাম সুখী তোমারে হেরি।৷


ভাল প্রতিফল দিলে হিমরাজ
হানিলে শিরেতে কি দারুণ বাজ
মিত্রদ্রোহী মত করিলে যে কাজ
করিলে শতধা হৃদয় মম॥

অনুকম্পা করি লয়ে যাও মোরে
সেই দূরন্তর জীবনের পারে
তব নিষ্ঠুরতা ভুলিব সত্বরে।
মিলিত হইয়া সে প্রিয়তম।৷