মা/প্রথম খণ্ড/এগারো
—এগারো—
পরদিন দুপুরে আবার খাবার নিয়ে মা কারখানার দুয়ারে এসে হাজির হলেন। আজ ভারি কড়া পাহারা। জামার পকেট থেকে শুরু ক’রে মাথার চুল পর্যন্ত খুঁজে তবে এক-একজন লোককে ঢুকতে দেওয়া হয়। মা এগিয়ে বললেন, একবারটি ঢুকতে দাওনা, বাবা! বড্ড ভারি, আর বইতে পারিনে, পিঠ দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
যা যা বুড়ি, ভেতরে যা···দেখোনা, উনিও আসেন যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝাতে!
মা ঢুকে পড়লেন। তারপর যথাস্থানে খাবারের পাত্র দুটো নাবিয়ে রেখে ঘাম মুছে ফেলে চারদিকে চাইলেন। গুসেভ ভ্রাতৃদ্বয় কারখানায় কামারের কাজ করে— তারা তৎক্ষণাৎ কাছে এসে দাঁড়ালো। বড়ো ভাই ভ্যাসিলি ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, পিরগ পেলে?
হাঁ, কাল আনবো।
এই ছিল নির্ধারিত গুপ্ত-সংকেত। দু’ভায়ের মুখ উজ্জ্বল হ’য়ে উঠলো। আইভান হৃদয়াবেগ কিছুতেই সামাল করতে পারলো না, ব’লে উঠলো, ওঃ, এমন মা আর হয় না!
ভ্যাসিলি মাটিতে আসন ক’রে বসে খাবারের পাত্রটার দিকে ঝুঁ’কে পড়লো, আর অম্নি এক বাণ্ডিল ইস্তাহার এসে তার বুকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরক্ষণেই তা’ তার জুতোর মধ্যে পায়ের তলায় চ’লে গেলো।
এমন চটপট কাজটা হ’য়ে গেলো যে অন্য কেউ তা’ একদম লক্ষ্য করতে পারলো না। ভ্যাসিলিও তাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য বাজে কথা বলছে, বাড়িতে না গিয়ে আজো এসো এইখানে, এই বুড়িমার কাছ থেকে খাবার খাই।
ম! ক্রমাগত হাঁকেন, চাই টক্ কপির সুপ, গরম ঝোল, রোস্ট, মাংস, আর এক-এক ক’রে ইস্তাহারের বাণ্ডিলগুলো আইভান ভ্যাসিলির কাছে চালান দেন। মজুরদল কাছে এসে পড়াতে মা ইস্তাহার দেওয়া থামিয়ে দিয়ে খাবারের হাঁক হাঁকতে লাগলেন। মজুররা এলো, খাবার খেলো, চলে গেলো। তারপর মা আবার তাঁর কাজ শুরু করলেন এবং শেষ করলেন।
সাফল্যের আবেগে আনন্দে তাঁর সমস্ত দিনটা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যে কাটলো।
রাত্রে এণ্ড্রি এসে হাজির হ’ল। সে কারামুক্ত হ’য়ে এসেছে অথচ পেভেল কোথায়?—মা এণ্ড্রির বুকে মুখ লুকিয়ে ছোটো মেয়েটির মতো কাঁদতে লাগলেন। এণ্ড্রি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কেঁদোনা, মা, পেভেলের জন্য কোন ভাবনা নেই, সে তোফা আছে। শীগ্গিরই জেল থেকে সে ফিরে আসবে।
এণ্ড্রি মার কাছে সবিস্তারে জেলের দৈনিক জীবনযাত্রাকাহিনী বর্ণনা করে যায়। মা একটু আশ্বস্ত হন, তারপর বলেন, আজ কি করেছি জানো?···
কি?
মা ইস্তাহার-বিলির কাহিনী বলেন। এণ্ড্রি উল্লসিত হ’য়ে বললো, চমৎকার, মা! এতে যে আমাদের কাজ কতটা এগিয়ে গেলো, কতো সুবিধা হ’ল, তা’ বোধ করি তুমি নিজেও বোঝোনি!
মায়ের প্রাণ···একটুকুতেই খুলে যায় স্নেহাকাঙ্ক্ষী সন্তানের কাছে। এণ্ড্রির কাছেও মা তাঁর করুণ জীবনকাহিনী বিবৃত করে বলেন: স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের মুখ চেয়ে রইলুম! সেই ছেলে যখন বাপের মতো বিপথে পা দিলো, তখন কত যে ব্যথা পেলুম প্রাণে, তা’ তোমায় কেমন ক’রে বোঝাবো, এণ্ড্রি? জানি, আমার এ ভালোবাসা স্বার্থ-দুষ্ট, সংকীর্ণ—তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেমন পরের জন্য দুঃখ বরণ করে নাও, আমি তো তা পারিনে! আমি আমার নিকট-আত্মীয়দের ভালোবাসি, পেভেলকে ভালোবাসি, তোমাকে ভালোবাসি—বোধহয় পেভেলের চাইতেও বেশি···পেভেল বড় চাপা···আমাকে কিছু বলে না। শশেংকাকে বিয়ে করতে চায়—আমি মা, আমাকে একথাটাও জানালোনা।
এণ্ড্রি বললো, এ সত্যি নয় মা,—আমি জানি এ সত্যি নয়! পেভেল শশেংকাকে ভালোবাসে একথা ঠিক, কিন্তু বিয়ে করতে চায় না, বিয়ে করতে পারেনা, বিয়ে করবেনা।···
বিষণ্ণ চোখে মা বললেন, হাঁরে, এমনি ক’রে কি তোরা নিজেদের বলি দিবি?
এণ্ড্রি নিজের মনেই ব’লে চলে, পেভেল অসাধারণ মানুষ— লোহার মতো শক্ত তার মন।
মা চিত্তাকুল কণ্ঠে বলেন, কিন্তু সে আজ বন্দী। মন প্রবোধ মানে না।···যদিও জানি সোনার ছেলে তোমরা, মানুষের হিতের জন্য এই কঠোর জীবন বরণ করে নিয়েছো, সত্যের জন্য এই জীবন-ভর দুঃখকে স্বীকার করেছো। কি সে সত্য তাও আমি জানি—ধনী যতদিন থাকবে দুনিয়ায়, মানুষ কিছু পাবে না—সত্যও না, সুখও না। এ সাচ্চা কথা, এণ্ড্রি।
এণ্ড্রি ধীরে ধীরে বলে, ঠিক কথা, মা। কার্চে একজন ইহুদী কবি ছিলেন। একবার তিনি লিখলেন—
বিনা দোষে যারা ফাঁসি কাঠে দিল প্রাণ,
সত্য তাদের করিবে জীবন দান।
ঘটনাচক্রে কার্চের পুলিসের হাতেই তিনি খুন হলেন। হ’ন, কথা তা’ নয়। কথা হলো, তিনি সত্য কি তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা’ প্রচার করার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, তিনি সত্য ব্যক্ত করেছিলেন।
এমনি ক’রে সে রাতটা কাটলো।