মা/প্রথম খণ্ড/ছয়
—ছয়—
পুলিস এলো একমাস পরে অপ্রত্যাশিতভাবে। দুপুর রাত, নিকোলাই, এণ্ড্রি, পেভেল গল্প করছে...মা অর্ধ-নিদ্রিতা।
এণ্ড্রি কি কাজে রান্নাঘরে গিয়েই হঠাৎ ফিরে এলো ব্যতিব্যস্ত হ’য়ে, পুলিসের সাড়া পাচ্ছি।
মা বিছানা থেকে উঠে পড়লেন কাঁপতে কাঁপতে। পেভেল মাকে শুইয়ে দিয়ে বললো, শুয়ে থাকো, মা, তুমি অসুস্থ।
স্থানীয় চৌকিদার ফেদিয়াকিনকে সঙ্গে ক’রে পুলিসের এক কর্তা এসে ঢুকলেন। মাকে দেখিয়ে পেভেলের দিকে চেয়ে ফেদিয়াকিন বললো, এই হুজুর ওর মা—আর ঐ হ’ল পেভেল।
কর্তা গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন, তুমি পেভেল ভ্লাশভ?
হাঁ।
তোমার বাড়ি খানাতল্লাশ করব। এই বুড়ি, ওঠ্...
হঠাৎ কি একটা শব্দে সন্দিগ্ধ হ’য়ে কর্তা পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে চীৎকার ক’রে বললেন, কে তুমি? নাম কি তোমার?...
তারপর খানাতল্লাশী চললো...জিনিসপত্রগুলো তছনছ ক’রে...বইগুলো খুশিমতো এদিক-ওদিক ছুঁড়ে ফেলে’। এ অন্যায় অত্যাচার আর সইতে না পেরে নিকোলাই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ব’লে উঠলো, বইগুলো মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলার কি দরকার?
মা নিকোলাইর সাহস দেখে বিস্মিত, তার পরিণাম ভেবে শঙ্কিত হ’য়ে উঠলেন। কর্তা রক্তচোখে নিকোলাইর দিকে চাইতে লাগলেন। মা পেভেলকে বললেন, নিকোলাই চুপ থাকুক না কেন!
কর্তা ধমক দিয়ে বললেন, কি কথা হচ্ছে! চুপ...এ বাইবেল পড়ে কে?
পেভেল বললো, আমি।
এসব বই কার?
আমার।
কর্তা তখন নিকোলাইর দিকে ফিরে বললেন, তুমিই বুঝি এণ্ড্রি?
হাঁ।
পরক্ষণেই এণ্ড্রি তাকে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে এসে বললো, ও নয়, আমি এণ্ড্রি।
কর্তা নিকোলাইর দিকে কটমট ক’রে চেয়ে বললেন, হুঁশিয়ার! তারপর পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের ক’রে ঘেঁটে এণ্ড্রিকে বললেন, এণ্ড্রি, রাজনৈতিক অপরাধে এর আগেও তোমার খানাতল্লাশ হয়েছিল?
হাঁ, রস্টোভ এবং সারাটোভে। তবে সেখানকার পুলিসের ভদ্রতা-জ্ঞান ছিল। আমার নামের আগে মিস্টার যোগ দিতে অবহেলা করেনি!
কর্তা ডান চোখ কুঁচকে, রগ্ড়ে, চক্চকে সাদা দাঁতগুলি বের ক’রে বললেন, তা’ মিস্টার এণ্ড্রি, তুমি কি জানে। কোন্ বদমাশরা এই বে-আইনী ইস্তাহার আর বই বিলি ক’রে বেড়ায়?
এণ্ড্রি জবাব দিবার আগেই নিকোলাই ব’লে উঠলো, বদমাশ তো আমরা প্রথম দেখছি এখানে।
কর্তা হুকুম করলেন, শুয়োরকে নিয়ে যাও এখান থেকে।
দু’জন সৈনিক নিকোলাইকে বের করে নিয়ে গেলো। খানাতল্লাশ শেষ হ’লে কর্তা বললেন, মিস্টার এণ্ড্রি নাখোদ্কা, আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করলুম।
কি অপরাধে?
পরে বলবো। তারপর মার দিকে চেয়ে বললেন, লিখতে পড়তে জানো, বুড়ি?
জবাব দিল পেভেল, না।
কর্তা ধমক দিয়ে বললেন, তোমায় কে জিগ্যেস করেছে! বুড়ি বলবে।
মার মনে রি-রি করে উঠলো একটা অপরিসীম ঘৃণা। কর্তার মুখের সামনে হাত নাচিয়ে বললেন, চেঁচিওনা, এখনো তুমি বড় হওনি। জানো না, কী দুঃখ, কী বেদনা...
পেভেল বললো, স্থির হও মা!
এণ্ড্রি বললো, বুকের ব্যথা দাঁত দিয়ে চেপে থাকা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই, মা।
মা সে কথা কানে তুললেন না, চেঁচিয়ে উঠলেন, কেন তোমরা এমন ক’রে মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে যাও?
কর্তাও চড়া সুরে জবাব দিলেন, সে জবাব তুমি চাইতে পারোনা। চুপ কর...
মা ক্রুদ্ধা ফণিনীর মতো ফুলতে লাগলেন।
কর্তা তখন হুকুম দিলেন, নিকোলাইকে হাজির কর।
সৈন্যেরা, দু’জুনে দু’হাত ধ’রে নিকোলাইকে নিয়ে এলো। নিকোলাইর মাথায় টুপি...কি একটা দলিল পড়তে পড়তে কর্তার সেটা খেয়াল হল। পড়া বন্ধ ক’রে তিনি গর্জে উঠলেন, টুপি নাবাও...
নিকোলাই একটু রসিকতা করে বললো, আজ্ঞে হুজুর, আমার তো একখানা তৃতীয় হাত নেই যে আপনার হুকুম তামিল করব। দেখছেন, দু’জনে দু’হাত ধ’রে।
কর্তা একটু অপ্রস্তুত হ’লেন। তারপর নিকোলাই এবং এণ্ড্রিকে ধ’রে নিয়ে চলে গেলেন।
পেভেল বন্ধুদের হাসিমুখে বিদায় দিলো, আবেগে বলে উঠলো, আণ্ড্রে, নিকোলে ভাই!
তার কেবলই মনে হ’তে লাগলো, পুলিস দু’জনকে ধ’রে তাকে যে ছুঁলোনা, এ তাকে অপমান করা ছাড়া আর কিছুই না। তাকে কেন এই সঙ্গে ধ’রে নিয়ে গেলোনা!
মা সান্ত্বনার সুরে বললেন, নেবে বাবা, নেবে—দু’দিন সবুর কর।
পেভেল বললো, সত্যিই নেবে, মা।
মা ব্যথিত হয়ে বললেন, তুই কি নিষ্ঠুর, পেভেল! একবারও যদি প্রবোধ দিস! আমি একটা আশঙ্কার কথা বললে, তুই বলিস তার চাইতেও ভয়ংকর-কিছু।
পেভেল মার দিকে চাইলো, তাঁর কাছটিতে এগিয়ে এলো, তারপর ধীরে ধীরে বললো, আমি যে পারি না, মা, তোমায় মিথ্যে প্রবোধ দিতে পারি না...তোমার যে সব সইতে হবে, সব শিখতে হবে, মা!