—দুই—

 দু’হপ্তা পরে এক রবিবারে পেভেল বাড়ি ফিরলাে মাতাল হয়ে···টল্‌তে টল্‌তে পড়লাে গিয়ে ঘরের এক কোনায়—পিতার মতাে টেবিলের ওপর ঘুষি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাে, মা, খাবার।

 মা উঠে গিয়ে তার পাশটিতে বসলেন, হাত দিয়ে জড়িয়ে ধ’রে ছেলের মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। ছেলে মাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাে, জল্‌দি খাবার!

 ‘বােকা ছেলে!’ দুঃখ-ভরা স্নেহ-সজল কণ্ঠে মা তাকে সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

 কোনাে মতে জিভটাকে টেনে জড়িতস্বরে পেভেল বললাে, আমি তামাক খাবাে, বাবার পাইপটা এনে দাও।

 এই প্রথম সে মাতাল হয়েছে। মদে তার শরীর নিস্তেজ হয়েছে কিন্তু জ্ঞান লােপ পায়নি। বারে বারে একটা প্রশ্ন তার মগজে এসে ঘা খেতে লাগলো, ‘মাতাল? মাতাল?’···মা যত আদর করেন, তত তার অস্থিরতা বাড়ে···মায়ের করুণ দৃষ্টি তাকে ব্যথা দেয়···সে কাঁদতে চায় কিন্তু পারে না।···মাতলামি দিয়ে উদ্যত ক্রন্দনকে রােধ করতে যায়। মা তার চুলে হাত বুলােতে বুলােতে ধীরে ধীরে বলেন, কেন এ কাজ করিস্ বাবা? এ তাে তাের কর্তব্য নয়!

 সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি করে···মা তাকে বিছানায় শুইয়ে দেন···ভিজে তােয়ালে দিয়ে উষ্ণ কপাল ঢেকে দেন। সে একটু সুস্থ হয়···কিন্তু তার চারপাশে সব-কিছু যেন দুলছে···তার চোখের পাতা ভারি···মুখে নােংরা টক আস্বাদ। চোখের পাতার মধ্য দিয়ে মায়ের বড় মুখখানির দিকে চায় আর এলােমেলাে চিন্তা করে, হয়তাে আমার এখনো মদ খাবার বয়স হয়নি। অন্য সবাই খায়, তাদের তাে কিছু হয় না···আমি শুধু ভুগি।

 দূরে কোনাে স্থান থেকে মায়ের কোমল কণ্ঠ ভেসে আসে, তুই মাতাল হ’লে তাের এ বুড়ো মাকে কি করে খেতে দিবি, বাবা?

 চোখ বুজে সে বলে, সবাই তাে খায়।

 মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। ছেলে মিথ্যে বলেনি। তিনি নিজেই জানেন, শুড়িখানা ছাড়া আর কোনাে স্থান জোটেনা মজুরদের আনন্দ করার···মদ ছাড়া আর কোনাে বিলাসিতা তাদের কপালে নেই, তবু বলেন, খাস্‌নি, খাস্‌নি, বাবা! তাের বাবা মদ খেয়ে আমাকে জীবন-ভোর দুঃখ-দুর্দশায় ডুবিয়ে রেখে গেছেন···তুই তাের মায়ের ওপর দয়া কর্। করবিনি, বাবা?

 পেভেল মায়ের কোমল-কাতর কথাগুলি কান পেতে শােনে। পিতার জীবদ্দশায় মা ছিলেন নির্যাতিতা, উপেক্ষিতা, ভীতা···সে কথা মনে পড়ে। পিতার ভয়ে বাইরে বাইরেই ঘুরতো ব’লে মা যেন তার কাছে প্রায় অপরিচিতই র’য়ে গেছেন। আজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাইলাে। লম্বা, ঈষৎ নম্র দেহ দীর্ঘবর্ষব্যাপী শ্রমে এবং স্বামীর নির্যাতনে তা’ যেন ভেঙে পড়েছে···চলেন নিঃশব্দে, একদিকে ঈষৎ হেলে···সর্বদা যেন কোন কিছু থেকে আঘাত পাবার ভর। প্রশস্ত গােলগাল মুখ···কপালে চিন্তার রেখা···বার্ধক্যে চর্ম লােল···এক জোড় কালাে চোখ উদ্বেগ এবং বিষাদে ভরা···ডান ভুরুতে একটা গভীর কাটা দাগ, ফলে ভুরুটা যেন একটু উঁচুতে ঠেলে উঠেছে···ডান কানটাও একটু লম্বা বাম কানটার চাইতে···দেখলে মনে হয়, কান যেন কি শুনবে এই আতঙ্কে উন্মুখ! গভীর কালাে চুলের মাঝে মাঝে সাদা সাদা গুচ্ছ, যেন সেগুলি আঘাতের চিহ্ন। কোমল, করুণ···বাধ্য···এই মা। দু’চোখ দিয়ে তার জল গড়ায় ধীরে ধীরে।

 ছেলে কোমল অনুনয়-ভরা কণ্ঠে বললাে, চুপ কর, মা, কেঁদোনা, আমায় জল দাও।

 মা উঠলেন, বললেন, বরফজল এনে দিচ্ছি।

 কিন্তু মা যখন ফিরলেন তখন সে নিদ্রিত।

 পান-পাত্র টেবিলের ওপর রেখে মা নীরবে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

 বাইরে মজুরদের মাতলামি-ভরা সঙ্গীত, গালাগালি এবং চীৎকার।


 আবার দিন ব’য়ে চললাে তেমনি একটানা সুরের মতাে···শুধু এ বাড়ি থেকে আগের সে মাতলামি, সে অশান্তি লোপ পেতে লাগলাে। পল্লির অন্যান্য বাড়ি থেকে একটু স্বতন্ত্র হ’য়ে উঠলো।

 বাড়িখানি পল্লির এক-প্রান্তে, একটু ঢালু জায়গায়। তিনটি কামরা,···একটি রান্নাঘর···একটি ছােট কুঠরি···মায়ের শােবার ঘর, রান্নাঘর থেকে একটি ছাদ পর্যন্ত উঁচু পার্টিশনে ভিন্ন করা···ঘরের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে এই দু’টো কামরা। বাকিটা একটা চৌকো কামরা, তাতে দু’খানা জানালা, কোনায় পেভেলের বিছানা, তার সামনে একটা টেবিল, দু’খানা বেঞ্চি, কয়েকখানা চেয়ার, একটা ছােট আরশিওয়ালা হাত-ধোয়ার পাত্র, একটা ট্রাঙ্ক, একটা ঘড়ি এবং দু’টো আইকন।

 অন্যান্য সবাই যেমন দিন কাটায়, পেভেলও চেষ্টা করেছিলাে তেমনি ভাবে দিন কাটাতে। একজন যুবক যা’ করে থাকে, সব-কিছু সে করলাে···একটা বেহালা কিনলাে, সার্ট, রঙীন নেকটাই, জুতো, ছড়ি—কোন কিছুই আর তার বাদ রইলাে না। বাহ্যত সে সমবয়সী অন্যান্য ছেলেদেরই মতাে···সান্ধ্যভােজে যায়···নাচে···মদ খায়, তারপর মাথার যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করতে থাকে, বুক জ্বলে, মুখ-চোখ মলিন হয়···আবার মা প্রশ্ন করেন, কালকের দিন ভালাে কাটলো, বাবা?

 ক্ষুব্ধ বিরক্ত হ’য়ে সে বলে ও’ঠে, ও গােরস্থানের মতাে নীরস···সবাই যেন এক-একটা মেশিন···তার চেয়ে মাছ ধরতে কি শিকার করতে যাবাে।

 কিন্তু তার মাছ ধরাও হয়ে উঠলােনা, শিকার করাও হয়ে উঠলাে না।

 ধীরে ধীরে সে সকলের চলা-পথ ত্যাগ ক’রে অন্য এক পথে এসে দাঁড়ালাে। মজলিসে যাওয়া তার ক্রমশ কমে এলাে। ছুটির দিন যদিও সে কোথাও বেরিয়ে যায়, কিন্তু আর কখনাে মাতাল হ’য়ে বাড়ি ফেরে না। মা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেন, ছেলের চোখ-মুখ যেন কি একটা অনুপ্রেরণায় ক্রমশ গম্ভীর, কঠিন, তীক্ষ্ণ হ’য়ে ওঠে···যেন সবসময়ই তার মন জ্বলছে কোনাে-কিছুর ওপর ক্রোধে···অথবা যেন একটা গােপন ক্ষত অহর্নিশ তাকে খোঁচাচ্ছে। বন্ধুরা আসতাে প্রথম প্রথম···কিন্তু কোনদিন তাকে বাড়ি না পেয়ে আসা ছেড়ে দিলাে। মা ছেলের এই স্বাতন্ত্র্য দেখে খুশিও হলেন, শঙ্কিতও হলেন। ছেলে এদিকেও টল্‌ছে না, ওদিকেও টল্‌ছে না···রুটিন-বাঁধা জীবনও তার নয়···সে চলেছে দৃঢ় নিষ্ঠায়, অটুট সংকল্পে কোন এক গােপন পথে···তাই মায়ের শঙ্কা।

 বাড়িতে সে বই নিয়ে আস্‌তে লাগলাে। প্রথম প্রথম সে লুকিয়ে পড়তাে, পড়ে’ লুকিয়ে রাখতে···মাঝে মাঝে বই থেকে অংশবিশেষ কাগজে নকল ক’রে কাগজখানাও লুকিয়ে ফেলতাে। মা-ছেলেতে কথাবার্তা বড় একটা হত না। দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় হাত-মুখ-ধু’য়ে খাওয়া শেষ করে ছেলে বই নিয়ে বসতো, অনেক রাত পর্যন্ত পড়া চলতাে। ছুটির দিনে ভােরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাে, ফিরতো অনেক রাতে। তার ভাষা মার্জিত হ’তে লাগলাে, মা তার মুখে নতুন অজানা শব্দ শুনে অবাক হ’য়ে যেতেন। মায়ের শঙ্কা বাড়তাে। ছেলে বই আনে, ছবি আনে, ঘর সাজায়, ফিটফাট হ’য়ে থাকে। মাতলামি নেই, গালাগালি নেই। ছেলে কি সন্ন্যাসী হল?···খুব সম্ভব শহরের কোনাে মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তাই বা কি ক’রে হ’বে? তাতে তাে টাকা দরকার···ছেলে প্রায় সব টাকাই তাে এনে মায়ের হাতে দেয়।······

 এমনি করে দু’ বছর কাট্‌ল।

 একদিন সান্ধ্যভােজের পর পেভেল ঘরের এক কোনে ব’সে পড়ছে···মাথার ওপর কেরোসিনের ল্যাম্প ঝুলছে···রান্নাঘরের বাসন-পত্র মুক্ত ক’রে মা সন্তর্পণে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ছেলে মাথা তুলে নিঃশব্দে প্রশ্ন-ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাইলো।

 কিছু না পাশা! এমনি এলুম,—তাড়াতাড়ি চলে গেলেন মা এই কথা ব’লে, কিন্তু চোখে তাঁর উদ্বেগের সুস্পষ্ট ছাপ। এক মুহূর্ত রান্নাঘরে স্থির, চিন্তামগ্ন, অভিনিবিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফেলে আবার ছেলের কাছে এলেন, বললেন মৃদু-কোমল সুরে, একটা কথা জিগ্যেস করতে চাই, বাবা, দিনরাত সব সময় কেবল পড়িস কেন?

 বইখানা একপাশে সরিয়ে রেখে পেভেল বললাে, মা, বােসো। মা ছেলের পাশে বসলেন···তাঁর দেহ ঋজু হ’য়ে উঠলাে, ভীষণ একটা-কিছু শােনার বেদনাময় উৎকণ্ঠায়। তাঁর দিকে না চেয়েই পেভেল ধীরে কিন্তু দৃঢ়তা-মাখানাে সুরে বলতে লাগলাে, আমি নিষিদ্ধ বই পড়ছি। এ বই নিষিদ্ধ—কারণ এতে মজুর-জীবনের খাঁটি ছবি আঁকা। এ বই ছাপা হয় গােপনে···আর আমার কাছে এ বই আছে, এ যদি প্রকাশ পায়, তাহলে আমার জেল হবে—আমার জেল হবে আমি সত্যি জানতে চাই এই অপরাধে।

 মার যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হ’য়ে এলাে বড় বড় চোখ মেলে ছেলের দিকে তিনি চাইলেন···মনে হ’ল, এ যেন সে ছেলে নয়, এ নতুন···অপরিচিত। ছেলের জন্য দরদে তাঁর বুক ভরে উঠলাে, কেন এমন কাজ করিস, বাবা?

 মার দিকে চেয়ে শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে পেভেল বললো, আমি সত্য জানতে চাই, মা।

 ছেলের শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠস্বরে রহস্য-সংকুল ভীষণ কি একটা সংকল্পের সাড়া পেয়ে মা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তাঁর চোখে নীরব অশ্রু দেখা দিলাে।

 কেঁদোনা মা।—পেভেলের মৃদু দরদ-ভরা কণ্ঠ মার কানে এসে ঠেকলাে বিদায়-বাণীর মতো। পেভেল বলতে লাগলাে, মা, ভেবে দেখ দেখি, এ কি জীবন কাটাচ্ছি তুমি! তােমার বয়স চল্লিশ বছর···কিন্তু বাঁচার মতাে বাঁচা কি একটা দিনও বেঁচেছ তুমি? বাবা তােমাকে মারতেন। আমি আজ বুঝি, তাঁর জীবন-ভরা দুঃখের ঝাল ঝাড়তেন তােমার গায়ে···দুঃখ তাঁকে পিষ্ট ক’রে ফেলতো, কিন্তু সে দুঃখের মূল কি, তা তিনি জানতেন না। তিরিশ বছর খেটে গেছেন। কারখানায় যখন সবেমাত্র দু’টি দালান, তখন থেকে তিনি খাটতে শুরু করেন···এখন সেখানে সাত-সাতটা দালান। কল সমৃদ্ধ হয়, কিন্তু মানুষ মরে···কলের জন্য খাটতে খাটতে মরে।···

 আতঙ্ক এবং আগ্রহে উন্মুখ হ’য়ে মা শুন্‌তে লাগলেন। ছেলের চোখ জ্বলছে এক অপরূপ সুন্দর দীপ্তিতে। টেবিলের ওপর ঝুঁকে প’ড়ে, মার আরাে কাছে মুখ নিয়ে তাঁর সজল চোখের দিকে চেয়ে বললাে, আনন্দ তুমি কি পেয়েছো জীবনে? তােমার অতীত জীবন···মনে রাখার মতাে কতটুকু ছিল তাতে?

 মা করুণভাবে ঘাড় নাড়তে লাগলেন···দুঃখ এবং আনন্দ-মেশানো এক অজ্ঞাত নতুন ভাব তাঁর ব্যথিত উদ্বিগ্ন অন্তরের ওপর ছড়িয়ে পড়লো শান্তি-প্রলেপের মতো। নিজের সম্বন্ধে, নিজ জীবন সম্পর্কে এমন কথা এই প্রথম কানে এলো তাঁর। যৌবনে তাঁর মনেও একদিন আকাঙ্ক্ষা, অতৃপ্তি, বিদ্রোহ ধূমায়িত হ’য়ে উঠেছিল···কিন্তু তা’ বহুদিন হল নিঃশেষে চাপা পড়ে গেছে। আজ যেন সেই আগুন নতুন ক’রে উস্‌কে উঠ্‌ছে। চিরদিন তারা শুধু দুঃখের অভিযোগই ক’রে এসেছে···কিন্তু এ দুঃখের কারণ কি, প্রতিকারই বা কি···তা’ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। আজ সে সমস্যার সমাধান করবার মহৎ সংকল্প নিয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর ছেলে···গৌরবে, আনন্দে তাঁর বুক ভ’রে উঠলো!···ছেলের বক্তৃতার মাঝখানে ব’লে উঠলেন, তা, কি করতে চাও তুমি?

 পাঠ করতে হবে এবং প’ড়ে অন্যকে শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের মজুরদের পাঠ করা অত্যন্ত দরকার···আমাদের শিক্ষা করতে হবে, বুঝতে হবে, জীবন কেন আমাদের পক্ষে এত দুর্বহ।

 মার বলতে ইচ্ছা হ’ল, বাছা, তুমি কি করবে? ওরা যে তোমায় পিষে ফেলবে! তোমার প্রাণ যাবে! কিন্তু ছেলের আনন্দের উচ্ছ্বাসে বাধা দিতে সাহস হ’ল না। ছেলে অগ্নিগর্ভ ভাষায় মনের জ্বালা ব্যক্ত ক’রে যায়, মা সচকিত হ’য়ে নিম্নস্বরে সুধোন, তাই নাকি, পাশা?

 হাঁ, মা—ছেলে দৃঢ়স্বরে জবাব দেয়। তারপর মাকে সে বলে সেই সব লোকের কথা, যাঁরা চান শুধু মানুষের মঙ্গল, যাঁরা চান শুধু মানুষের অন্তরে সত্যের বীজ বপন করতে···এবং এই অপরাধে তাঁরা পশুর মতো হত হন...জেলে যান, নির্বাসন-দণ্ড ভোগ করেন, সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন···মানুষের দুশমন যারা তাদের হাতে। আবেগের সঙ্গে বলে, এমন সব লােক আমি দেখেছি, মা···এঁরা দুনিয়ার সেরা লােক।

 মা আবার বলতে যান, তাই নাকি, পাশা? কিন্তু বলা হয় না। তাঁর ছেলেকে এমন সব বিপজ্জনক কথা বলতে শিখিয়েছে যাঁরা, তাঁদের গল্প শুনে শঙ্কিত হতে থাকেন। ছেলে মার হাত ধ’রে প্রগাঢ় স্বরে ডাকে, ‘মা!’ মা বিচলিত হন। বলেন, আমি কিছু করবনা বাছা,···শুধু তুই সাবধানে থাকিস···সাবধানে থাকিস্।

 কিন্তু কি হ’তে সাবধানে থাকবে, তা খুঁজে না পেয়ে ব’লে ফেলেন, তুই বড় রােগা হ’য়ে যাচ্ছিল। তারপর তার স্নেহ-ভরা দৃষ্টি দিয়ে পুত্রের সুগঠিত দেহখানি যেন আলিঙ্গন ক’রে বলেন, তুই যেমন খুশি চল্, আমি বাধা দেবো না, বাবা। শুধু একটা কথা মনে রাখিস আমার, অসতর্ক হ’য়ে কথা বলিস না···লােকদের নজরে নজরে রাখিস···ওরা সবাই পরস্পরকে ঘৃণা করে···অন্যের অনিষ্ট করে খুশি হয়...নিছক আমােদের লােভে মানুষকে পীড়া দেয়···যেই তাদের দোষ দিতে যাবি, বিচার করবি, অম্‌নি তারা তােকে ঘৃণা করবে,···তাের সর্বনাশ করবে।···

 দুয়ারের গােড়ায় দাঁড়িয়ে পেভেল মায়ের এই বেদনাময় অভিজ্ঞতার উপদেশ শুনলাে; তারপর মার কথা শেষ হ’লে বললাে, জানি, মা, কী শোচনীয় এই মানুষের দল! কিন্তু যেদিন উপলব্ধি করলুম, পৃথিবীতে একটা সত্য আছে, মানুষ আমার চোখে নতুনতর, সুন্দরতর শ্রীতে দেখা দিলাে। শৈশবে আমি মানুষকে শিখেছিলুম ভয় করতে, একটু বড় হ’য়ে করেছি ঘৃণা···আজ নতুন চোখে দেখছি সবাইকে···সবার জন্যই আজ আমি দুঃখিত। কেন জানিনা, আমার হৃদয় কোমল হ’য়ে এলো যখন আমি বুঝলুম, মানুষের ভিতর একটা সত্য আছে, পাপ এবং পঙ্কিলতার জন্য সকল মানুষই দায়ী নয়।···

 বলতে বলতে পেভেলের কণ্ঠ নীরব হয়···কান পেতে যেন শােনে প্রাণের ভিতরের কি এক অস্ফুট বাণী, তারপর চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলে ওঠে···এমনি ক’রেই সত্য বেঁচে থাকে।

 পেভেল ঘুমােয়, মা তাকে আশীর্বাদ ক’রে নিজের ঘরে চ’লে যান।