—নয়—

 ছেলেকে হারিয়ে মা বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন,—তাঁর প্রাণ কেবলই হা-হা ক’রে বলতে লাগলো, আমায়ও কেন পেভেলের সঙ্গে ধ’রে নিয়ে গেলো না। রাইবিন এসে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, আমার বাড়িতেও তারা হানা দিয়েছিল, কিন্তু ধরলো না—ধরলো পেভেলকে। ওদের এই-ই হাল। ম্যানেজার চোখ ইসারা করলো, পুলিস বল্লো, ‘যো হুকুম’... আর দেখতে দেখতে একটা লোক অদৃশ্য হ’ল। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। একজন পকেট মারে, আর একজন পরাণে মারে।

 মা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের উচিত পেভেলের পক্ষ হ’য়ে লড়া—তোমাদের সকলের জন্যই সে আজ জেলে গেছে!

 কার উচিত?

 তোমাদের সবার।

 রাইবিন কেমন এক শ্লেষের হাসি হেসে বললো, তোমার যে অতিরিক্ত দাবি, মা। কেউ ওর কিছুই করবে না। কর্তারা হাজার হাজার বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করেছেন। আমাদের কল্‌জের মধ্যে তারা বহুত পেরেক ঠুকে রেখেছেন···আমাদের মধ্যে ব্যবধানের বিরাট দেয়াল। আমরা ইচ্ছে করলেই এক্ষুণি তা’ সরিয়ে মিলতে পারিনে...এইগুলো বাধা দিচ্ছে...এগুলোকে আগে দূর করা চাই।

 রাইবিন চ’লে গেলো।

 রাত্রে শোময়লোভ এবং য়েগর আইভানোভিচ্‌ এসে হাজির হ’ল। আইভানোভিচ বল্‌লো, নিকোলাই জেল থেকে বেরিয়েছে, জানো দিদিমা?

 তাই নাকি? ক’মাস জেলে ছিল সে?

 পাঁচ মাস এগারো দিন। এণ্ড্রি আর পেভেলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। এণ্ড্রি তোমায় প্রণাম জানিয়েছে আর পেভেল ব’লে পাঠিয়েছে, ভয় নেই। জেল তো যাত্রা-পথের সরাই—যা প্রতিষ্ঠা এবং তদ্বির করেছেন কর্তারা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে।...এখন কাজের কথা হ’ক, দিদিমা। কাল ক’জন গ্রেপ্তার হয়েছে জানো?

 না। আরো কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে নাকি?

 হাঁ, চল্লিশ জন এবং আরো দশজনের হ’বার সম্ভাবনা। তার মধ্যে একজন ইনি শোময়লোভ।

 মা যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন, পেভেল—পেভেল তা’হলে একা নেই। বললেন, এতগুলি লোক যখন ধরেছে তখন বেশিদিন রাখতে পারবে না।

 আইভানোভিচ বললো, সে কথা ঠিক, দিদিমা। আর আমরা যদি ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারি, তা’হলে ওরা আরো নাকাল হয়। কথাটা কি জানো, দিদিমা, ওরা গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ ইস্তাহারগুলোও যদি কারখানায় আর না ঢোকে তবে কর্তারা নির্ঘাত বুঝবেন এসবের পাণ্ডা কারা। পেভেল আর তার সঙ্গীদের তখন জেলে শক্ত ক’রে চেপে ধরবে। কাজেই যেমন ব্রতের খাতিরে তেমনি পেভেলদের জন্য আমাদের কারখানার ভেতরে ইস্তাহার বিলির কাজ ঠিক আগের মতোই চালানো চাই। খুব ভালো ইস্তাহারও হাতে আছে, কিন্তু সমস্যা, তা কারখানায় ঢোকানো যায় কি ক’রে? কারখানার গেটে আজকাল প্রত্যেকের শরীর তল্লাশী করা হয়।

 মা বুঝলেন, তাঁকে দিয়ে একটা কিছু কাজ করাতে চায় ওরা। ছেলের মঙ্গলের জন্য কোন কিছুই করতে তাঁর আপত্তি নেই; কাজেই বললেন, তা’ কি করতে হবে আমাকে?

 ফেরিওয়ালী মেরি নিলোভ্‌নাকে দিয়ে ইস্তাহারগুলো ঢোকাতে পারো না?

 মা ব’লে উঠলেন, ওকে দিয়ে? সর্বনাশ, তা’ হ’লে দুনিয়ার কারো জানতে আর বাকি থাকবে না।

 তারপর একটু ভেবে বললেন, আমার কাছে রেখে যেয়ো, আমি নিজেই ব্যবস্থা করব। মেরির সাহায্যকারিণী সেজে কারখানায় খাবার নিয়ে যাবো, তখন...ধরা পড়ব না...সবাই দেখবে পেভেল জেলে গেছে বটে, কিন্তু জেল থেকেও তার হাত কাজ ক’রে যাচ্ছে।

 তিনজনের মুখই আশায় উৎফুল্ল হ’য়ে উঠলো। আইভানোভিচ বলে উঠলো, চমৎকার! শোময়লোভ বললো, এ যদি হয় তো জেল হ’বে আমার কাছে আরামকেদারা! মা ভাবলেন, ইস্তাহার বেরোলে কর্তারা একথা কবুল করতে বাধ্য হবেন, ইস্তাহার বিলির জন্য পেভেল দোষী নয়। সাফল্যের আশায় এবং আনন্দে মা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলেন, বললেন পেভেলকে বোলো, তার জন্য আমি না করতে পারি হেন কাজ নেই।

 আইভানোভিচ মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তুমি পেভেলের জন্য মিছে ভেবোনা, মা। জেল আমাদের কাছে বিশ্রাম এবং পাঠের স্থান—মুক্ত অবস্থায় যার ফুরসুৎ আমাদের মেলেনা। যাক, তা’হলে ইস্তাহারগুলো পাঠাবো। কাল থেকে আবার যুগান্ত-সঞ্চিত অন্ধকার-নাশী চাকা আগের মতো ঘুরতে আরম্ভ করবে। দীর্ঘজীবী হ’ক আমাদের স্বাধীনতা, আর দীর্ঘজীবী হ’ক এই মাতৃ-হৃদয়!

 তারপর তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলো! মা একান্ত মনে ভগবানকে ডাকেন আর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা করেন। তাঁর মানসপটে পেভেলের সঙ্গে আর সকলকার ছবি ফুটে ওঠে।

 মা মেরির কাছে গিয়ে তার সাহায্যকারিণীর কাজ নিলেন।