মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/দ্বিতীয় খণ্ড/আট

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ১৫৯-১৬১)

—আট—

 পরদিন ভোরে হাসপাতালের সামনে লোকে লোকারণ্য, মৃত বীরের শবদেহ শোভা যাত্রা করে নিয়ে যেতে এসেছে সবাই। জনতা নিরস্ত্র, আর তাদের মধ্যে শান্তি-রক্ষা করতে এসেছে পুলিস রিভলবার, বন্দুক, সঙিন নিয়ে।

 গেট খুলে গেলো···তারপর বেরিয়ে এলো শবাধার···ফুলের মালায় সাজানো···লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। সবাই নীরবে টুপি খুলে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলো, এমন সময় এক লম্বাপানা পুলিস অফিসার একদল সৈন্য নিয়ে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে শবাধারটি ঘিরে ফেলে হুকুম দিলেন, ফিতে সরিয়ে ফেল!

 মৃতের প্রতি এই অসম্মানের সূচনার জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। পুলিস অফিসারটি তা গ্রাহ্য না ক’রে সুর চড়িয়ে হুকুম দিলেন, ইয়াকোলেভ, ফিতে কেটে ফেল।

 হুকুমমাত্র ইয়াকোলেভ তরবারি কোষমুক্ত ক’রে ফিতে কেটে ফেললো। জনতা নেকড়েদলের মতো গর্জন ক’রে উঠলো। পুলিসের সঙ্গে মারামারি বাধে আর কি! নায়করা কোন মতে থামিয়ে রাখলো। লোকদের বললো, বন্ধুগণ, এখন আমাদের সব সয়ে যেতে হবে—যে পর্যন্ত-না আমাদের দিন আসে!...

 শোভাযাত্রা গোরস্থানে প্রবেশ করলো। সবাই নীরব, নিঃশব্দ। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো একটি যুবক, সদ্য-প্রস্তুত কবরের ওপর দাঁড়িয়ে সে শুরু করলো, সঙ্গিগণ!...

 পুলিস অফিসারটি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, পুলিস সাহেবের হুকুম, বক্তৃতা করা নিষেধ।

 যুবকটি বললো, আমি মাত্র দু-চারটি কথা বলব। সঙ্গিগণ, আমাদের এই শিক্ষক এবং বন্ধুর কবরের ওপর দাঁড়িয়ে এস আজ আমরা নীরবে এই শপথ করি যে, আমরা এঁর অভিলাষ ভুলবো না, প্রত্যেকে অবিশ্রান্তভাবে খনন করতে থাকবো এই স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের কবর, যে স্বেচ্ছাচারতন্ত্র আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের দুশমন।...

 পুলিস অফিসার হুকুম দিলেন, গ্রেপ্তার কর ওকে।

 কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ডুবে গেলো জনতার উন্মত্ত চিৎকারে, ‘স্বেচ্ছাচারতন্ত্র নিপাত যাক্‌’ ‘দীর্ঘজীবী হ’ক স্বাধীনতা’ ‘আমরা তার জন্য বাঁচব, তার জন্য প্রাণ দেব।’

 তৎক্ষণাৎ পুলিস ঝাঁপিয়ে পড়লো অস্ত্র হাতে নিরস্ত্র জনতার ওপর। মাও সেখানে ছিলেন। দেখলেন, মার খেয়েও জনতা সেই বক্তা যুবকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন ছিনিয়ে নেবে পুলিসের হাত থেকে। পুলিস তাকে ঘিরে রয়েছে··· জনতার ওপর সঙিন চলছে, তলোয়ার চলছে, রক্তে গোরস্থান লাল হ’য়ে উঠেছে...যুবক তখন মিনতি করে বললো, ভাইসব, শান্ত হও, আমি বলছি আমায় যেতে দাও।...

 তার কথায় জন-সমুদ্র স্থির হ’য়ে দাঁড়ালো। তারপর এক এক করে ছত্রভঙ্গ হ’য়ে চলে যেতে লাগলো। শোফি একটা আহত ছেলেকে এনে মার কাছে দিলো, বললো, শীগগির একে নিয়ে ভাগো এখান থেকে।

 ছেলেটির নাম আইভান। মা আহত আইভানকে একটা গাড়ি করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।