মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/দ্বিতীয় খণ্ড/উনিশ

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ১৯৮-)

—উনিশ—

 সময় মত মা স্টেশনে গিয়ে হাজির হ’লেন। একটি যুবক ইস্তাহারভরা একটা হলদে ব্যাগ দিয়ে গেলো তাঁর কাছে। মা একটা বেঞ্চিতে ব’সে ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 গোয়েন্দারাও নিশ্চিন্ত ছিলোনা। তারা মার চারদিকে এসে জড়ো হ’ল, এক বুড়ো তাঁর দিকে চাইলো ক্রোধ-বক্রিম দৃষ্টিতে। মা তার দিকে চেয়ে সংযতকণ্ঠে বললেন, কি চাও তুমি?

 কিছু না।

 একজন ব’লে উঠলো···বুড়ি—চোর কোথাকার।

 আমি চোর নই, মা গর্জন করে উঠলেন।

 দেখ্‌তে দেখ্‌তে চারপাশে বেশ একটা ভিড় জমে গেলো।

 কি, কি, ব্যাপার কি?

 একটা গোয়েন্দা।

 চোর···।

 কে, ঐ বুড়ি?

 চোর হলে কখনো চেঁচায়?

 মা জোর গলায় বলেন, আমি চোর নই। কাল ওরা রাজনৈতিক আসামীদের বিচার করেছে। তাদের মধ্যে একজন···পেভেল একটা বক্তৃতা দিয়েছিলো···এই সেই বক্তৃতা···আমি লোকদের কাছে তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যাতে তারা এ পড়ে সত্য চিন্তা করে। এই বলে কাগজ বের ক’রে উঁচুতে দুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে ফেলে দিলেন।

 একজন ব’লে উঠলো, এতে বখ্শিস যা মিলবে তা বিশেষ লোভনীয় নয়।

 হাঁ।

 মা দেখলেন, সবাই কাগজ হাতাহাতি ক’রে নিয়ে পকেটে, বুকে গুঁজে রাখতে লাগলো। উৎসাহিত হ’য়ে আরো কাগজ ছড়াতে ছড়াতে বললেন, এর জন্য, মানুষের কাছে এই পবিত্র সত্য প্রচার করার জন্য, আমার ছেলে এবং তার কমরেডরা নির্বাসিত হয়েছে।—

 বিস্মিত, মুগ্ধ শ্রোতৃমণ্ডলী আরো চেপে দাঁড়ালো মার দিকে। ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। মা বলতে লাগলেন, দারিদ্র্য, অনশন, ব্যাধি··· শ্রম ক’রে গরীবের লাভ হয় এই। সমাজের এই ব্যবস্থা আমাদের ঠেলে দেয় চুরির দিকে, অন্যায়ের দিকে। আর আমাদের মাথার ওপর বসে আছে ধনীরা·· শান্তিতে এবং তৃপ্তিতে। যাতে আমরা তাদের বাধ্য থাকি তাই তাদেরই হাতে পুলিস, সরকার সৈন্য-সামন্ত সব-কিছু! সবাই আমাদের বিরুদ্ধে, সব-কিছু আমাদের প্রতিকূলে। আমাদের জীবন আমরা নষ্ট ক’রে চলেছি দিনের পর দিন শ্রমে নোঙরামীতে··· প্রবঞ্চনায়। আর ওর মজা লুঠছে, রাজভোগ ওড়াচ্ছে আমাদের শ্রমের সুবিধা নিয়ে। কুকুরের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ ক’রে রেখেছে আমাদের অজ্ঞানের অন্ধকারে। আমরা কিছু জানি না, আতঙ্কে আমরা সবকিছুকেই ভয়ের চোখে দেখি। আমাদের জীবন এক অমাবস্যার অন্ধকারঘেরা রাত্রি—এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। মনের বিষে আচ্ছন্ন ক’রে রেখে ওরা আমাদের রক্তপান করছে। ওরা অতিভোজনে ভুঁড়ি বাগাচ্ছে, বমি করছে,—ওরা লোভ-শয়তানের চেলা···তাই নয় কি?

 তাই-ই।

 মা দেখতে পেলেন, ভিড়ের পিছনে দু’জন পুলিস এবং সেই গোয়েন্দা। অমনি তাড়াতাড়ি কাগজগুলো ছড়াতে গেলেন, কিন্তু কার যেন একখানা অপরিচ্ছন্ন হাত এসে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে পলকে অদৃশ্য ক’রে ফেললো—তারপর প্রশ্ন হ’ল, কাকে বলবো? কাকে খবর দেবো?

 মা তাতে কান না দিয়ে বলতে লাগলেন···এই জীবনযাত্রাপ্রণালীকে বদলাতে, সকল মানুষকে মুক্তি দিতে, আমার মতো তাদের জীবন্ত কবর হ’তে তুলে নবজীবন, দিতে এগিয়ে এসেছে কতিপয় যুবক···যারা তাদের গোপন প্রাণে পেয়েছে সত্যের দর্শন···গোপনে···কারণ, তোমরা জানো আজ যা সত্য, মানুষ তা খোলাখোলি বলতে পারেনা। ওরা তা’হলে গুলি করবে, টুটি টিপে ধরবে, জিভ কেটে ফেলবে। ধন একটা শক্তি কিন্তু তা সত্যের সুহৃদ নয়। সত্য ধনীর চির-শত্রু, মরণ-শত্রু। আমাদের ছেলেরা দুনিয়ায় এই সত্যের বার্তা প্রচারে বেরিয়েছে। তারা পবিত্র, তারা জ্যোতির্ময়। সংখ্যা তাদের অল্প, শক্তি তাদের কম, কিন্তু দলে বাড়ছে তারা। তরুণ প্রাণ সমর্পণ করছে তারা স্বাধীন সত্যের ব্রতে, সত্যকে পরিণত করছে তারা সর্বজয়ী শক্তিতে। তাদের প্রাণের পথ দিয়ে সেই সত্য এসে ঢুকবে আমাদের কঠোর জীবনে!— আমাদের উদ্দীপিত ক’রে তুলবে, সঞ্জীবিত করে তুলবে; আত্ম-বিক্রয়ী যারা, ধনী যারা, তাদের অত্যাচার থেকে টেনে তুলে বাঁচাবে। তোমরা বিশ্বাস কর একথা।

 ভাগো এখান থেকে—পুলিসেরা ভিড় ঠেলতে ঠেলতে চেঁচাতে লাগলো।

 বেঞ্চির ওপর উঠে নাও।

 দরকার নেই—এখনই গ্রেপ্তার হবো।

 তাড়াতাড়ি ব’লে যাও। এসে পড়লো ব’লে।

 মা বলেন, সেই সত্য প্রচারকদের, সর্বরিক্ত-দরিদ্রের বান্ধবদের পাশে গিয়ে দাঁড়াও···আপোস করোনা, বন্ধুগণ, আপোস করোনা। শক্তি-গর্বীদের কাছে মাথা নুয়িয়োনা। ওঠো, জাগো মজুর ভাইসব, এ জীবনের নিয়ন্তা তোমরা, তোমাদের শ্রমের দৌলতে সবাই বেঁচে আছে, অথচ তোমরাই বন্দী। হাত তোমাদের খোলা। শুধু কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য। চেয়ে দেখো, তোমাদের চারিদিকে বন্ধন। ওরা তোমাদের খুন করছে, তোমাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করছে।···আজ মন-প্রাণ একীভূত ক’রে একশক্তিতে উঠে দাঁড়াও। সমস্ত বাধা পরাভূত হবে। তোমরা ছাড়া তোমাদের আর বন্ধু কেউ নেই—এই কথাই মজুরদের বন্ধুরা তাদের বলতে চেয়েছে এবং বলতে গিয়ে কারাগারে, নির্বাসনে পলে পলে প্রাণ দিয়েছে। অসৎ লোকেরা কি এম্‌নিভাবে কথা বলে? প্রতারকরা কি এমনিভাবে প্রাণ দেয়?

 পুলিসরা ‘ভাগো’ ‘ভাগো’ বলে উপর্যুপরি ঠেলতে লাগলো লোকগুলোকে। মার প্রাণ যেন কথার ভারে, আবেগে উচ্ছ্বাসে ঝংকৃত হ’তে লাগলো গানের মতো? কম্পিত ভগ্নকণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, আমার ছেলের এই বাণী এক ন্যায়নিষ্ঠ শ্রমিকের বাণী···আত্মবিক্রয় যে করেনি তার বাণী। এর সত্যতা তোমরা বুঝতে পারবে এর স্পষ্ট তেজোদৃপ্ত ভাষা হ’তে, নির্ভীক এ ভাষা। হে আমার মজুর বন্ধুগণ, এই নির্ভীক, নিত্য জ্ঞানদীপ্ত বাণী আজ তোমাদের কাছে উপস্থিত। প্রাণ খুলে একে গ্রহণ কর···এ দিয়ে প্রাণকে পুষ্ট কর। তোমাদের শক্তিলাভ হবে, সব আপদ হ’তে আত্মরক্ষা করার, সত্যের পরিপন্থী যুক্তির প্রতিকূল সবকিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। এ বাণী গ্রহণ কর, বিশ্বাস কর,—একে পাথেয় করে বিশ্বমানবের সুখের পথে যাত্রা কর, পরম আনন্দভরে এক নবজীবনের অভিমুখে অগ্রসর হও!···

 মায়ের বুকে এক প্রচণ্ড ঘুষি এসে পড়লো। মা ট’লে বেঞ্চির ওপর পড়ে গেলেন। জনতার ওপরও অবিশ্রাম প্রহার চলতে লাগলো।

 মা একটু পরেই শেষ শক্তি প্রয়োগ করে চেঁচিয়ে উঠলেন, ভাইসব, তোমাদের বিচ্ছিন্ন শক্তি একত্র ক’রে এক মহাশক্তির সৃষ্টি কর···

 একজন বৃহদাকার পুলিস তার কলার ধ’রে ধমকে উঠলো, চুপ রও। জনতাকে ভয় দেখিয়ে বলতে লাগলো, ভাগো।

 মা বললেন, কোনো কিছুতেই ভয় পেয়ো না। ওরা কি যন্ত্রণা দেবে? এর চাইতে ঢের-ঢের বেশি যন্ত্রণা জীবন-ভোর সইছো তোমরা।···

 চুপ কর বলছি, ব’লে একজন পুলিস তাঁর একহাত ধরলো, তারপর অন্যদিক থেকে আর একজন অন্য হাতটা ধ’রে লম্বা পা ফেলে মাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চললো।

 মা বলতে লাগলেন, এর চেয়ে ঢের ঢের বেশি নির্যাতন অহর্নিশ গোপন-কাঁটার মতো তোমাদের অন্তর-বিদ্ধ ক’রে তুল্‌ছে, তোমাদের শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে।···

 গোয়েন্দা গর্জন করে উঠ্‌লো, এই বুড়ি, থাম।

 মা বে-পরোয়া হ’য়ে বলতে লাগলেন,— এই নব-উদ্বুদ্ধ আত্মাকে হত্যা করে কার সাধ্য?···

 একটা গাল দিয়ে গোয়েন্দাটা মার মুখের ওপর এক চড় লাগালো। একমুহূর্তের জন্য মা চোখে অন্ধকার দেখলেন। রক্তের নোনা স্বাদে তাঁর মুখ ভরে এলো। কানে এলো ক্ষিপ্ত জনতার চীৎকার, খর্বদার, ওঁকে মেরো না।— শয়তান কোথাকার—দোব এক ঘা বসিয়ে—

 মা উৎসাহিত হ’য়ে বলতে লাগলেন—রক্তে ওরা যুক্তিকে ডুবিয়ে দিতে পারবে না, সত্যের শিখাকে নিভিয়ে দিতে পারবে না তারা।

 মার মাথায় পিঠে ঘাড়ে ঘা পড়তে লাগলো। চারদিকের সবকিছু যেন ঘুরতে আরম্ভ করলো। চারদিকে চীৎকার, তর্জন-গর্জন, হুম্‌কি—কানে যেন তালা লাগছে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে, পায়ের তলা থেকে মাটি স’রে যাচ্ছে। পা নুয়ে পড়ছে, শরীর কাঁপছে, জ্বলছে, টলে পড়ছে কিন্তু চোখ বন্ধ হয়নি। মা দেখলেন, জনতার চোখে এক অপূর্ব উত্তেজনা।

 তাঁকে ঠেলে এক দোরের ভিতর দিয়ে ঢোকানো হ’ল। পুলিসের কবল থেকে হাত ছিনিয়ে দরজার কাঠ ধরে মা বলে উঠলেন—রক্তের সমুদ্র বহালেও সত্যকে ডুবিয়ে মারতে পারবে না ওরা।

 পুলিসেরা মার হাতের ওপর ঘা লাগালো।

 —বোকা ওরা, নিজেদের ওপর জমিয়ে তুলছে বিদ্বেষের স্তুপ। এক দিন তারই তলে চাপা পড়বে ওরা···

 কেউ যেন গলা টিপে কণ্ঠরোধ করলো—মার গলা থেকে মোটা সুরে বেরিয়ে এলো: নির্বোধ হতভাগ্য ওরা, ওদের জন্য দুঃখ হয়···

সমাপ্ত