মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/দ্বিতীয় খণ্ড/এক
দ্বিতীয় খণ্ড
—এক—
সমস্ত দিনটা মা’র চোখের সামনে নাচতে লাগলো সেই শোভাযাত্রার ছবি! অস্থির, উন্মনা হ’য়ে কখনো তিনি ভাবেন, কখনো বাইরের দিকে শূন্য-দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
সন্ধ্যার পর পুলিস এলো তৃতীয়বার বাড়িতে। মাকে বললো, ছেলেদের মনে রাজভক্তি, ধর্মভাব জাগাতে পারো না? এতো তোমাদের মায়েদেরই দোষ। তারপর ভালো ক’রে খানাতল্লাশী ক’রে চ’লে গেলো। ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে মা খানিকক্ষণ অন্ধকারে ব’সে রইলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন বিছানায়।
ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন, সেই শোভা-যাত্রা···নায়ক পেভেল, এণ্ড্রি···গান চলেছে···পেভেলের দিকে চেয়ে চলেছেন তিনি শহরের পথে···পেভেলের কাছে যেতে লজ্জা হচ্ছে···কারণ তাঁর পেটে একটি সন্তান···আর একটি কোলে···মাঠে আরো অনেক ছেলের মেলা, বল খেলছে তারা···কোলের ছেলেটা তাদের দেখে জোরে কাঁদছে···সৈন্যরা ধেয়ে আস্ছে সঙিন উঁচিয়ে···মা ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলেন মাঠের মাঝখানে উঁচু গির্জায়···শ্রাদ্ধ-কৃত্য চলছে সেখানে, পুরুতরা গাইছে···একজন পুরুত আলো নিয়ে এসে দাঁড়ালো তাঁর কাছে, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, গ্রেপ্তার কর···দেখতে দেখতে পুরুত হ’য়ে গেলো সামরিক কর্মচারী···সবাই ছুটে পালাচ্ছে···মা পলাতকদের সামনে কোলের ছেলেটাকে ফেলে দিয়ে বলছেন, পালিয়োনা, ছেলেটার মুখ চাও···এণ্ড্রি ছেলেটাকে কাঠ-বোঝাই গাড়িতে চাপিয়ে দিলো···নিকোলাই গাড়ির পাশে হেঁটে চলেছে···হেসে বলছে, এবার একটা শক্ত কাজের ভার পেয়েছি।···কাঁচা পথ···জান্লায় জান্লায় নর-মুণ্ডের ভিড়। এণ্ড্রি বলছে, গাও মা জীবনের জয়গান···মা ঠাট্টা ভেবে রাগছেন···তারপর হঠাৎ পথের পাশের অতল গহ্বরে টলে পড়ে গেলেন···আতঙ্ক-ভরা চীৎকারে মা’র ঘুম ভাঙলো। মা উঠে পড়লেন। তারপর হাত-মুখ না ধুয়েই তিনি ঘর গোছাতে লেগে গেলেন। নিশানের টুকরো তুলে উনোনে দিতে গিয়ে, হঠাৎ কি ভেবে লাল কাপড়টা ছাড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ ক’রে পকেটে রাখলেন। জান্লা ধুলেন, মেঝেয় ধুলেন, স্নান করলেন, চা চাপালেন···তারপর যেন আর কোনো কাজই রইল না তাঁর! কেবল মনে হ’তে লাগলো, এখন?—এখন কি করি?
হঠাৎ মনে পড়লো, প্রার্থনা করা তো হয়নি!
প্রার্থনায় বসলেন···প্রার্থনা করলেন, কিন্তু প্রাণ তবু শূন্য। সময় আর কাটে না!
এমন সময় নিকোলাই আইভানোভিচ এসে দেখা দিলো। মা পেয়ে ব’লে উঠলেন, এখানে এসেছ কেন? টের পেলেই ধরবে ওরা।
আইভানোভিচ মাকে আশ্বস্ত ক’রে বললো, এণ্ড্রি-পেভেলের সঙ্গে কথা ছিল, তারা ধরা পড়লে তোমায় আমি শহরে নিয়ে যাবো। যাবে তো, মা!
যাবো, ওরা যখন ব’লে গেছে—আর তোমার যদি কোনো অসুবিধা না হয়।
অসুবিধা কিছু হ’বে না, মা। সংসারে লোক মাত্র আমরা দু’টি—আমি আর আমার বোন শোফি। কিন্তু সেও থাকে না, মাঝে মাঝে আসে।···
মা বললেন, হাঁ, যাবো আমি। এখানে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারি না।
আইভানোভিচ বললো, কাজ তুমি আমাদের ওখানে পাবে, মা।
আমি ঘরের কাজের কথা বলছিনে!
ঘরের কাজ নয়, যে কাজ তুমি চাও, তাই।
কি কাজ দেবে আমায়?
জেলে পেভেলের সঙ্গে দেখা ক’রে সেই চাষী যে কাগজ বের করবার কথা বলেছিল, তার ঠিকানা যদি আনতে পারো!
মা সোৎসাহে ব’লে উঠলেন, জানি, তার ঠিকানা আমি জানি। কাগজ দাও, আমি দিয়ে আসছি তাদের।···আমায় একাজে টেনে নাও···সর্বত্র আমি যাবো তোমাদের কাজে···শীত মানবো না, গ্রীষ্ম মানবো না, মৃত্যু দেখেও শিউরে উঠবো না···সত্য-পথে দৃঢ় পদে এগিয়ে এগিয়ে যাবো···আমায় কাজ দাও।
চারদিন পরে আইভানোভিচ মাকে তার শহরের বাড়িতে নিয়ে গেলো।