মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/দ্বিতীয় খণ্ড/বারো

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ১৭৮-১৮০)

—বারো—

 শুয়ে শুয়ে মা স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন শুনতে লাগলেন।

 তেতিয়ানা বললে, বুড়িরা পর্যন্ত একাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর তুমি!···

 স্টিপান বললো, আহা, এসব কাজ এত তাড়াহুড়োয় হয় না। বেশ ক’রে ভেবে-চিন্তে দেখা চাই।

 হাঁ, ভাবতে তো তোমায় আগাগোড়াই দেখছি।

 স্টিপান বললো, আহা, তুমি বুঝতে পারছো না। কাজ করতে হ’লে এই রকম ক’রে—প্রথমে যারা অন্যায় সয়েছে, অত্যাচার সয়েছে, তাদের আড়ালে ডেকে নিয়ে দলে ভাগাও। তারপর আমি শহরে যাবো —কাঠ কেটে খরচ চালাবো, আর ওদের খুঁজে নিয়ে ওদের সঙ্গে কাজে যোগ দেবো···খুব সন্তর্পণে চলবে এ ব্যাপার! আর সত্যিই, নিজের দাম নিজে কষবে। ঐতো রাইবিন···পুলিস কমিশনার তো দূরের কথা, স্বয়ং ঈশ্বরের সামনে দাঁড় করালেও ও দমবেনা। তারপর নিকিতা···হঠাৎ ওর মন বদলে গেলো কি করে? এ কি যাদু? —না। মানুষ যদি বন্ধুভাবে মিলে মিশে কিছু করে, সবার কাছে তাতে সহানুভূতি পায়।

 তেতিয়ানা ব’লে উঠলো, বন্ধুভাবে! চোখের সামনে একটা লোককে মারবে আর আমরা থাকবো হাঁ করে দাড়িয়ে!

 স্টিপান বললো, সবুর। তার ভগবানকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত যে আমরা নিজেরা তাকে মারিনি। কর্তারা তো আমাদের বাধ্য করেই এম্‌নি করে মারতে···প্রাণ যতই কাঁদুক, ঘুষি তোমায় চালাতেই হবে,···হুকুম না তামিল করো, তোমার মরণ। কর্তাদের নিষেধ—মানুষ হোয়োনা, এ বাদে শেয়াল-কুকুর যা খুশি হতে পারো। বীর হ’লে তোমার রক্ষা নেই···ভবসাগর পার করে দেবার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগবে, বুঝলে তেতিয়ানা! চাই আজ অত্যাচারিত জন-সাধারণের ক্রোধ এবং বিদ্রোহ!···

 পরদিন মা শহরে চলে এলেন। এসে দেখেন বাসা সার্চ হয়ে গেছে ···সব জিনিস তছনছ। আইভানোভিচ বললো, শাসিয়ে গেছে, মা, আমার কাজ খতম হবে। বাঁচা গেলো, মা! চাষীদের কার কি নেই এ হিসেব ক’রে মাইনে গোনা দস্তুরমতো হারামি।

 তারপর মা রাইবিনের শোচনীয় গ্রেপ্তার-কাহিনীর বর্ণনা করলেন। আইভানোভিচ প্রথমটা উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠলো, তারপর দীপ্ত চোখে কিন্তু সংযতকণ্ঠে বললো, চমৎকার লোক! এমন মহৎ। কিন্তু জেলে থাকা ওর পক্ষে কষ্টকর, ও রকম লোক জেলে গিয়ে সুস্থ থাকে না।···

 তারপর তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললো, আর ঐ পুলিস এবং সার্জেণ্ট,—ওরা তো শয়তানের হাতের অস্ত্র···পশুকে যেমন পোষ মানায়, ওদেরও তেমনি ক’রে পোষ মানানো হয়েছে। হাঁ, পশু ওরা··· আর পশু যখন কামড়ায়, তখন তাকে করতে হয়,···

 উত্তেজনায় আইভানোভিচ পাইচারি করতে করতে রাগ-ভরা কণ্ঠে বলতে লাগলো, কী ভয়ানক! মানুষের ওপর অন্যায় কর্তৃত্বমদে মত্ত হ’য়ে মুষ্টিমেয় পশু মানুষকে মারছে, অত্যাচার করছে, গলা টিপে খুন করছে। বর্বরতার সুর উঁচু হতে উঁচুতে উঠছে, নিষ্ঠুরতা হ’য়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের নীতি। একটা গোটা জাতি আজ অধঃপতিত। একদল করছে অত্যাচার। একদল এই অত্যাচার নীরবে স’য়ে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে আর একদল হুংকার করছে—প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ।···

 নিষিদ্ধ কাগজ-পত্রের কথা উঠলে মা কেমন ক’রে তা ছড়াবার বন্দোবস্ত ক’রে এসেছেন তা বলেন। আইভানোভিচ আনন্দে বিহ্বল হ’য়ে ‘মা মা’ বলে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো, চাষীরাও তাহ’লে ন’ড়ে উঠেছে!

 হাঁ! পেভেল-এণ্ড্রি যদি এখন থাকতো!

 আইভানোভিচ বললো, তুমি শুনে হয়তো প্রাণে খুব আঘাত পাবে, মা···কিন্তু পেভেল জেল পালাবে না; সে চায় বিচার। তারপর নির্বাসনদণ্ড হ’লে সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে আসবে।

 মা বললেন, তাই করুক তবে। কিসে ভালো হবে, সে-ই বেশি বোঝে।

 আইভানোভিচ বললো, রাইবিনের সম্বন্ধে একটা ইস্তাহার বের করা দরকার।···আমি আজই লিখবো। কিন্তু গ্রামে পাঠাবো কি ক’রে?

 কেন, আমি নিয়ে যাবো।

 না, মা। তোমার আবার যাওয়া ঠিক হ’বে না। এবার বরং নিকোলাই যাক।

 আইভানোভিচ ইস্তাহার লিখে দিলো। মা তা লুকিয়ে রাখলেন গায়ের জামার মধ্যে···ফুরসুৎ মতো ছাপাতে দিয়ে আসবেন ব’লে।