মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/উনিশ
—উনিশ—
চারজন অশ্বারোহী পুলিস ‘ভাগো’ ‘ভাগো’ ব’লে ছুটে এলো। পলকে মজুররা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। এণ্ড্রি তখনও রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ঘোড়া তার গায়ে এসে পড়ার উপক্রম দেখে সে স’রে দাঁড়ালো, আর তক্ষুণি মা তাকে টেনে নিলেন, তুমি না কথা দিয়েছো, পেভেলের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে!
ঘাট্ হ’য়ে গেছে, মা, তাই থাকবো।
আবার চলতে লাগলো তারা।
গির্জার বাগানে এসে থামলো। চার-পাঁচশো লোকের ভিড়। ছেলে মেয়ে, বুড়ো ছুটোছুটি করছে চারদিকে প্রজাপতির মতো আনন্দে। জনসমুদ্র দুলছে একবার এদিকে, একবার ওদিকে। ভিড়ের মধ্যে শিজভের গলা,··· না, আমাদের ছেলেদের আমরা ত্যাগ করবনা। জ্ঞানে ওরা আমাদের শ্রেষ্ঠ, সাহসে ওরা আমাদের শ্রেষ্ঠ। জলাভূমির জন্য অন্যায় কর হ’তে কারা আমাদের রক্ষা করেছে?—ওরা! কথাটা ভুললে চলবে না। এ ক’রে ওরা জেলে গেছে, কিন্তু সুফল ভোগ করছি আমরা—আমরা সকলে।···
বাঁশি বেজে উঠলো, জনতার কলরবকে ডুবিয়ে দিয়ে। সবাই চম্কে উঠলো। যারা ব’সে ছিল, উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত— সব মৃত্যুর মতো নীরব, নিথর। সবারই সতর্ক দৃষ্টি, মলিন-মুখ। তার মধ্যে আচম্কা ধ্বনিত হ’ল পেভেলের দৃঢ় কণ্ঠ, বন্ধুগণ!···
মা’র চোখের সামনে জ্বলে উঠলো যেন আগুনের দীপ্তশিখা···সমগ্র শক্তি প্রয়োগ ক’রে তিনি নিজের দেহটা পেভেলের পেছনে এনে দাঁড় করালেন। সকলের দৃষ্টি ফিরলো পেভেলের দিকে···চুম্বক যেন টানছে লৌহ-শলাকাকে।
বন্ধুগণ! ভাইগণ! আজ লগ্ন উপস্থিত···আজ বর্জন করতে হবে আমাদের এই জীবন, এই লোভ, ঈর্ষা, অন্ধকারের জীবন, এই হিংসা মিথ্যা অপবিত্র জীবন,···এই জীবন—যেখানে আমাদের কোন স্থান নেই, যেখানে আমরা মানুষ ব’লে পরিগণিত নই।···
পেভেল থামলো, জনতা নিঃশব্দে তার দিকে আরো চেপে দাঁড়ালো। মা ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন···কী গর্বপূর্ণ সাহস-দীপ্ত জ্বলন্ত ছেলের চোখ!
···বন্ধুগণ, আমরা সংকল্প করেছি, মুক্তকণ্ঠে প্রচার করব আমরা কে! ··আমরা আজ নিশান তুলে ধরব আকাশে···যুক্তির নিশান, সত্যের নিশান, স্বাধীনতার নিশান! এই সেই নিশান।
জনতার মধ্য দিয়ে মজুরদের লাল ঝাণ্ডা লাল পাখির মতোই ঊর্ধ্বে উত্থিত হ’ল পেভেলের হাতে। তারপর হঠাৎ তা’ নুয়ে পড়তেই দশ বারোখানা হাত তা’ ধ’রে ফেললো···তার মধ্যে মাও ছিলেন। পেভেল জয়ধ্বনি ক’রে উঠলো, মজুরের জয়!
শত শত কণ্ঠে তার প্রতিধ্বনি হ’ল।
সোশ্যাল-ডিমোক্রেটিক মজুরদলের জয়! সকল দেশের সকল মজুরের জয়!
জনতা যেন উত্তেজনায় টগবগ্ ক’রে ফুটছে। নিশানের অর্থ যারা বোঝে, তারা ভিড় ঠেলে তার দিকে এগোয়। মা পেভেলের হাত চেপে ধ’রে আনন্দে, আবেগে কাঁপতে থাকেন। নিকোলাইও পেভেলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
সকল কোলাহল ছাপিয়ে এণ্ড্রির কণ্ঠ ধ্বনিত হ’ল, বন্ধুগণ, আমরা আজ এক পবিত্র জয়-যাত্রার সূচনা করলুম···নবীন এক দেবতার নামে। আমাদের সে দেবতা হচ্ছে—সত্য, আলোক, যুক্তি, মঙ্গল। এই পবিত্র জয়-যাত্রার পথ যেমন দীর্ঘ, তেমনি কণ্টক-সংকুল। আমাদের লক্ষ্য দূরে, অতি দূরে। কাঁটার মুকুট আমাদের সামনে নাচচে, আমাদের অপেক্ষায়। যারা সত্যের শক্তিতে বিশ্বাসী নও, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সত্য রক্ষা করার সাহস যাদের নেই, আত্ম-শক্তিতে যারা বিশ্বাস করে না, দুঃখের নামে যারা শঙ্কিত হও— তারা তফাতে সরে দাঁড়াও। আমরা তাদেরি আহ্বান করছি, যারা বিশ্বাস করে, জয়ী আমরা হবোই। আমাদের লক্ষ্য সম্বন্ধে যারা সন্দিগ্ধ, তারা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ ক’রে চ’লে যাক···তারা চিরদিন পাবে শুধু দুঃখ। সঙ্গীদল, সজ্জিত হ’য়ে দাঁড়াও, বলো, জয়যুক্ত হ’ক এই পয়লা মে···জয়যুক্ত হ’ক মুক্ত মজুর সংঘের এই উৎসব-তিথি।
হাজার হাজার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, জনতা চেপে দাঁড়ালো। পেভেল লাল-নিশান তুলে ধরলো···তাতে সূর্যের রক্ত-বর্ণ কিরণ এসে ঝক্ ঝক্ ক’রে জ্বলতে লাগলো। ফেদিয়া মেজিন চেঁচিয়ে উঠলো, পুরাণো জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে পড় যাত্রীদল।···
যাত্রা শুরু হ’ল। সবার আগে নিশান হাতে পেভেল। তারপরেই অন্যান্য নায়কদল। সবাই মজুরদের বিজয়-সংগীত গাইতে গাইতে চলেছে!
ওঠো, জাগো, মজুরদল!
ক্ষুধিত মানব যুদ্ধে চল।
পথের দু’ধার থেকে দলে দলে লোক সোল্লাসে নিশানের দিকে ছুটে আসে, ভিড়ে মিশে যায়, তারপর বিপ্লব-সংগীতে গগন আলোড়িত ক’রে অগ্রসর হয়।
মা এ গান এর আগেও শুনেছেন বহুবার। কিন্তু আজ যেন প্রথম এর সুর তাঁর প্রাণে গিয়ে লাগলো,—
দুঃখী সঙ্গী কাঁদিছে হায়!
সেথা যেতে হবে···আয়রে আয়···
জনতা গানের সুরে মেতে উঠতে লাগলো।
এক মা যাত্রী ছেলেকে বেঁধে রাখার চেষ্টায় কেঁদে উঠছেন, মিতিয়া, কোথায় যাচ্ছিস, বাবা!
মা তাকে বললেন, ছি বোন, যেতে দাও, ভয় পেয়োনা, ভয় কি? আমিও প্রথম প্রথম ভয় পেতুম; কিন্তু এখন ঐ দেখ, আমার ছেলে সবার আগে—নিশান হাতে—ঐ···
শঙ্কিতা মাতার কানে তা গেলো না। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন আর্ত কণ্ঠে, ডাকাতরা করছে কি? কোথায় যাচ্ছে? সৈন্যেরা যে ওদের মেরে ফেলবে গো!···
মা বললেন, অধীর হয়োনা বোন! মহৎ কাজের ধরণই এই! এই যীশুখৃস্ট···তিনিই কি যীশুখৃস্ট হ’তে পারতেন, যদি না শত সহস্র লোক তাঁর জন্য মরতো?
গানের সুর তখন আরও চ’ড়ে গেছে—
জারের যখন সৈন্য চাই
ছেলে দাও, নইলে রক্ষা নাই···
শিজভ জোর গলায় ব’লে উঠলো, সাবাস্ জোয়ান, ভয়ডর কিছু নেই তোমাদের।···আমার ছেলে, সে যদি আজ বেঁচে থাকতো! কারখানা তাকে খুন করেছে। হাঁ, খুন করেছে।
মার বুকের রক্ত দ্রুততালে নেচে উঠলো। কিন্তু ভিড়ের অসম্ভব চাপে তিনি কোণঠাসা হয়ে এক দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন, জন-স্রোতের বিচিত্র গতি। হাজারে হাজারে উন্মত্ত লোক···মনে হয় যেন একটা বৃহৎ কাঁসার জয় ঢাকের প্রলয়ংকর ধ্বনি তাদের মাতিয়ে তুলেছে···কেউ মাতছে যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায়, কেউ মাতছে একটা অস্পষ্ট আনন্দে, একটা নতুন কিছুর সম্ভাবনায়, একটা জ্বলন্ত কৌতূহলে! বহু বছরের পুঞ্জীভূত কণ্টকিত ব্যথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যেন আজ সংগীতের মধ্য দিয়ে বেরুচ্ছে।
সবাই ঊর্ধ্বে নিশানের দিকে চেয়ে পথ চলেছে, সবাই চিৎকার করছে, কিছু-না-কিছু বলছে, কিন্তু সমস্ত কণ্ঠ ডুবিয়ে বেজে উঠছে সেই গান···নতুন গান···এ সে পুরাণো দুঃখ-করুণ সুর নয়, এ সে অভাবক্লিষ্ট ভয়াতুর ব্যক্তিত্বহীন নিরানন্দ নিঃসঙ্গ নিশি-যাত্রীর আর্ত-বিলাপ নয়, এ সে রুদ্ধ-শক্তির অভিব্যক্তি বেদনা নয়।···ভালোমন্দ দুই-ই, অবিভেদে নাশ করে যে—এ সে ক্রুদ্ধ সাহসের উত্তেজিত সুর নয়! এ সে পশুশক্তি নয়, যা শুধু মুক্তির জন্যই মুক্তি চাই ব’লে চিৎকার করে, যা অন্যায়ের প্রতিহিংসাবশে শুধু ধ্বংসই করে চলে, সৃষ্টি করতে পারে না। দাসত্ব-দুষিত, পুরাণো জগতের কোন-কিছু নেই এতে। সোজা··· সরল···সুদৃঢ়···শান্ত এ সংগীত। মানুষকে এ মাতিয়ে নিয়ে চলে দীর্ঘ অন্তহীন পথে, সুদুর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের অভিমুখে। পথের দুঃখ এ গোপন করে না। এর স্থির অচঞ্চল আগুনে জ্বলে পুড়ে গলে যায় মানুষের স্তূপীকৃত দুঃখ-বেদনা, তার চিরাভ্যস্ত মলিন সংস্কার-ভার, নব-যুগের সম্বন্ধে তার মিথ্যা আশঙ্কা।
সেই বিশাল জন-সমুদ্র এই সংগীতে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে এগিয়ে চললো। পেছনে সংশয়ী বিজ্ঞদল। এ অভিনয়ের কখন কোথায় অবসান হ’বে, তা যেন তারা আগে থেকেই জানে। মা শুনলেন তাদের কথা।
একদল সৈন্য স্কুলের কাছে, আর একদল কারখানার কাছে।
গভর্ণর এসে পড়েছে।
তাই নাকি?
হাঁ, আমি স্বচক্ষে দেখলুম তাঁকে৷
একজন তা’ শুনে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলো, আমাদের ওরা কম ডরায় মনে করেছো? এইতো দেখো—গভর্ণর স্বয়ং সৈন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন।···
বিজ্ঞদের কথা মার ভালো লাগছিল না। ভিড় ঠেলে তিনি সামনে এগিয়ে চললেন।
হঠাৎ মনে হল, জন-স্রোতের অগ্রভাগ যেন কি একটা কঠিন জিনিসের ওপর ঘা খেয়ে পেছনে টলে পড়ছে···জনতার মধ্য দিয়ে উঠছে একটা মৃদু কিন্তু আতঙ্ক-ভরা গুঞ্জন। গানের সুরটাও একবার কেঁপে উঠলো, তারপর ধ্বনিত হ’ল আরো উচ্চ এবং দ্রুত তালে। কিন্তু আবার গানের তাল ভঙ্গ হ’ল··· গায়কদল একে একে সরে পড়তে লাগলো দল থেকে···এদিকে ওদিকে দু’চারটি কণ্ঠ গানকে বাঁচিয়ে রাখার দুরূহ চেষ্টায় চেঁচাতে লাগলো।
“ওঠো, জাগো, মজুরদল,
ক্ষুধিত মানব যুদ্ধে চল···”
শোভা-যাত্রার সামনে কি ব্যাপার হচ্ছে তা’ চোখে দেখতে না পেলেও মা যেন ভাবতে পারলেন। দ্রুতপদে তিনি ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললেন।