মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/এক
মা
—এক—
রােজ ভােরে কারখানার বাঁশি বেজে ওঠে···তীক্ষ্ণ তীব্র ধ্বনিতে মজুর-পল্লির ধূম্র-পঙ্কিল আর্দ্র বাতাস কম্পিত হয়, আর ছোট ছােট কুঠ্রি থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় বেরিয়ে আসে দলে দলে মজুর। অপ্রচুর নিদ্রায় আড়ষ্ট দেহ, কালাে মুখ। ঊষার কন্কনে হাওয়া···সংকীর্ণ মেটো পথ···তারই মধ্য দিয়ে চ'লে তারা গিয়ে ঢুকে পড়ে সেই উঁচু পাথরের খাঁচাটার মধ্যে, যেটা তাদের গ্রাস করবার জন্য কাদা-ভরা পথের দিকে চেয়ে আছে শত শত হল্দে তৈলাক্ত চক্ষু বিস্তার ক'রে। পায়ের তলায় কাদা চট্ চট্ করতে থাকে···কাদাও যেন তাদের ভাগ্য নিয়ে বিদ্রুপ করছে; কানে আসে নিদ্রা-জড়িত কণ্ঠের কর্কশ ধ্বনি, ক্রুদ্ধ তিক্ত গালাগালির শব্দ···তারপর সে-সব ডুবে যায় কলের গম্ভীর ধ্বনিতে, বাষ্পের অসন্তোষ-ভরা গর্জনে। কালো কঠিন চিম্নি মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়ায় পল্লির বহু ঊর্ধ্বে। সন্ধ্যায় কারখানা তাদের ছেড়ে দেয় দগ্ধ-সর্বস্ব ছাইয়ের মতাে। আবার তারা পথ বেয়ে চলে···ধোঁয়া-মলিন মুখ···মেশিন-তেলের বােট্কা গন্ধ···ক্ষুধার্ত সাদা দাঁত···কিন্তু সজীব, আনন্দপূর্ণ কণ্ঠ। সেদিনকার মতাে কঠিন শ্রম-দাসত্ব হ’তে তারা মুক্তি পেয়েছে, এখন শুধু বাড়ি ফেরা, খাওয়া এবং ঘুম।
গােটা দিনটা হজম করে ওই কারখানা। কল মানুষকে ইচ্ছামতাে শােষণ করে···জীবন থেকে একটা দিন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হ’য়ে যায়··· মানুষ অজ্ঞাতসারে এগােয় তার কবরের দিকে। তবু তারা খুশি···তাড়ি আছে, আমােদ আছে। আর কি চাই।
ছুটির দিনে মজুরেরা ঘুমােয় দশটা তক···তারপর উঠে’ সব চেয়ে পছন্দসই পােশাকটি পরে গির্জায় যায়···যাবার আগে ধর্ম-বিমুখতার অন্য ছােটদের একচোট ব’কে নেয়। ফিরে এসে পিরগ খায়; তারপর সন্ধ্যাতক ঘুমােয়। সন্ধ্যায় পথের ওপর আনন্দের মেলা বসে। পথ শুকনাে হ’ক, তবু ওভার-স্যু যাদের আছে পরে বেরোয়···বর্ষা না থাকলেও ছাতা নিয়ে পথে নামে! যার যা আছে তাই নিয়ে সে স্যাঙ্গাতদের ছাড়িয়ে উঠতে চায়। পরস্পর দেখা হ’লে কল-কারখানার কথাই বলে···ফোরম্যানকে গালি দেয়, কল-সংক্রান্ত কথা নিয়েই মাথা ঘামায়। ঘরে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কলহ করে, মাঝে মাঝে তাদের নির্মমভাবে মারে। যুবকেরা মদ খায়, এর-ওর বাড়ি আড্ডা দিয়ে ফিরে, অশ্লীল গান গায়, নাচে, কুৎসিৎ কথা উচ্চারণ করে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে’ আসে···নােংরা গা, ছেঁড়া পোশাক, ছিন্ন মুখ···কাকে মেরেছে তারই বড়াই, কার কাছে পিটুনী খেয়েছে তারই অপমানের কান্না। কখনাে কখনাে বাপমা-ই তাদের তুলে আনেন পথ কিংবা তাড়িখানা থেকে, মাতাল অবস্থায়। কটুকণ্ঠে গালমন্দ করেন···স্পঞ্জের মতো মদসিক্ত শরীরে দু’দশ ঘা বসান···তারপর রীতিমত শুইয়ে দেন···পরদিন ভােরে ঘুম ভাঙিয়ে কাজে পাঠান।
বহু বছর ব্যাপী অবসাদের ফলে ক্ষুধা-শক্তি তাদের লােপ পেয়েছে···ক্ষুধা উদ্রেক করার জন্য তারা গ্লাসের পর গ্লাস মদ চালায়। ক্রমে মদের মাত্রা চড়ে যায়···প্রত্যেকের প্রাণেই মাথা তু’লে দাঁড়ায় একটা অবােধ্য পীড়াদায়ক অসন্তুষ্টি, যা’ ভাষায় ফুটতে চায়। এই অশান্তিকর উদ্বেগের বােঝা হালকা করার জন্যই তারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়টি নিয়েও হানাহানি করে হিংস্র পশুর মতাে···কখনাে আহতাঙ্গ হয়, কখনাে মরে। এই প্রচ্ছন্ন হিংস্রতা ধীরে ধীরে বেড়ে চলে জীবনে। তারা জন্মে আত্মার এই পীড়া নিয়ে। এ তাদের পিতৃধন। কালাে ছায়ার মতাে কবর পর্যন্ত লেগে থাকবে সঙ্গে···জীবনকে করবে উদ্দেশ্যহীন, নিষ্ঠুরতা এবং পাশবিক উত্তেজনায় কলঙ্কিত!
চিরকাল···বছরের পর বছর···জীবন-নদী ব’য়ে এসেছে এম্নি ধারায়। মন্থর, একঘেয়ে তার গতি···পঙ্কিল তার স্রোত। দিনের পর দিন তারা একই কাজ করে চলে রুটিনের মতাে···জীবনের এ ধারা বদলাবার ইচ্ছে বা অবসর যেন কারাে নেই।
নতুন কেউ যখন পল্লিতে আসে, নতুন বলেই দু’চারদিন সে তাদের কৌতুহল উদ্রেক করে। তার কাছে ভিন্-মুলুকের গল্প শােনে, সবাই বােঝে, সর্বত্রই মজুরের ঐ এক অবস্থা। নবাগতের ওপর আর কোন আকর্ষণ থাকে না।
মাঝে মাঝে কোন নয়া লােক এসে এমন-সব অদ্ভুত কথা বলে যা’ মজুর-পল্লিতে কেউ কখনাে শােনেনি। তারা তার কথা কান পেতে শোনে···বিশ্বাসও করে না, তর্কও করে না। কারাে মধ্যে জেগে ওঠে অন্ধ বিক্ষোভ, কেউ হয় ভীত বিব্রত, কেউ হয়ে ওঠে এক অজানা লাভের ক্ষীণ সম্ভাবনায় চঞ্চল। তারা পানের মাত্রা চড়িয়ে দেয়, যাতে এই অনাবশ্যক বিরক্তিকর উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলতে পারে। নবাগতকে যেন তারা ভয়ের চোখে দেখে···সে হয়তাে তাদের মধ্যে এমন-কিছু এনে ফেলবে যা’ তাদের সহজ জীবন-স্রোতে তীব্র আলােড়নের সৃষ্টি ক’রবে। তারা আশাই করেনা যে তাদের অবস্থারও আবার উন্নতি হ’তে পারে! প্রত্যেক সংস্কারকে তারা সংশয়ের চোখে দেখে···ভাবে, শেষপর্যন্ত এ শুধু তাদের বােঝা বাড়াবে মাত্র। তাই তারা নবাগতদের এড়িয়ে চলে।
এমনি করে মজুরদের পঞ্চাশ বছরের জীবন কেটে যায়।
কামার মাইকেল ভ্লাশভের জীবনও কেটে যায় এমনি ধারায়। গম্ভীর কালাে মুখ, সন্দেহ-তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ছোট ছােট চোখ, অবিশ্বাস-ভরা হাসি, উদ্ধত ব্যবহার, কারখানার ফোরম্যান এবং সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকেও কেয়ার করে না, কাজেই কামায় কম। ফি ছুটির দিনে কাউকে মারা চাই; কাজেই পাড়ার সবাই তাকে ভয় করে, অপছন্দ করে। মারতে গিয়েও ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে। শত্রুর সাড়া পেলেই ভ্লাশভ হাতের কাছে গাছ, পাথর, লােহা যা’ পায় তাই নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। সব চেয়ে ভয়ানক তার চোখদুটো···তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যেন লােহার শলাকার মতো শত্রুকে বিদ্ধ করে···সে চোখের সাম্নাসাম্নি যে পড়ে সেই বােঝে কী এক হিংস্র ভয়-ডরহীন নিষ্ঠুর জল্লাদের কবলে সে পড়েছে। মুখের-ওপরে-এসে-পড়া ঘন চুলের ফাঁকে ফাঁকে তার হলদে দাঁত ভয়ংকরভাবে কট্মট্ করতে থাকে। ‘দুরহ নারকী কীট’—ব’লে সে তর্জন ক’রে ওঠে···শত্রুদল চকিতে রণে ভঙ্গ দিয়ে গালি দিতে দিতে পালায়। মাথা খাড়া করে দাঁতের মধ্যে ছােট মোটা একটা চুরুট চেপে সে তাদের পিছু নেয়, আর চ্যালেঞ্জ করে, কোন্ ব্যাটা মরতে চাস্, আয়। কেউ চায়না।
এমনি সে খুব কম কথা বলে, শুধু ‘নারকী কীট’ এই কথাটা তার মুখে লেগেই আছে। কারখানার কর্তাদের থেকে শুরু করে পুলিসদের পর্যন্ত সে ঐ ব’লে ডাকে। বাড়িতে গিয়ে বউকে পর্যন্ত বলে, ‘নারকী কীট’ আমার পােশাক যে ছিঁড়ে গেলো, দেখতে পাস না?
তাঁর ছেলে পেভেলের বয়স যখন চৌদ্দ, তখন একদিন তার চুল ধ’রে টানতে গেলাে। পেভেল পলকে একটা হাতুড়ি তুলে নিয়ে বললাে, ছুঁয়ােনা বলছি।
কী!—পিতা কৈফিয়ৎ তলবের সুরে গর্জে উঠলাে।
পেভেল অবিচলিত কণ্ঠে বললাে, যথেষ্ট হয়েছে, আর আমি প’ড়ে প’ড়ে মার খাচ্ছি না। বলে হাতুড়িটা সে একবার সদর্পে মাথাব ওপর ঘােরালাে।
পিতা তার দিকে চাইলেন, তারপর লােমবহুল হাত দু’খানা ছেলের পিঠে রেখে হেসে বললেন, বহুৎ আচ্ছা! ধীরে ধীরে তার বুক ভেঙে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলাে, ব’লে উঠলেন, ‘নারকী কীট’···
···এর কিছুকাল পরে বউকে একদিন ডেকে বললেন, আমার কাছে আর টাকা চেয়ােনা, ছেলেই এবার থেকে তােমায় খাওয়াবে।
স্ত্রী সাহস করে প্রশ্ন করলাে, আর তুমি বুঝি মদ খেয়ে সব ওড়াবে?
সে কথায় তাের কাজ কি, ‘নারকী কীট’ কোথাকার!
সেই থেকে মরণ অবধি তিন বছর ছেলেকে সে চোখ চেয়ে দেখেনি, ছেলের সঙ্গে কথা বলেনি।
মরলে সে ভীষণ যন্ত্রণা পেয়ে। পাঁচদিন ধরে বিছানায় গড়াচ্ছে···সমস্ত অঙ্গ কালাে হয়ে গেছে···দাঁত কট্মট্ করছে···চোখ বােজা! মাঝে মাঝে ব্যথা যখন বড়ই অসহ্য হয়, বউকে ডেকে বলে, আর্সেনিক দাও, বিষ দাও।
বউ ডাক্তার ডাকলাে। ডাক্তার পুলটিশের ব্যবস্থা করলেন, বললেন, অচিরে একে হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্র করা দরকার।
মাইকেল গর্জে উঠলাে, গােল্লায় যাও। আমি নিজে নিজেই মরতে পারব ‘নারকী কীট’ কোথাকার।
ডাক্তার চ’লে গেলে বউ সজল চোখে জেদ করতে লাগলাে, অস্ত্র করাও।
সে হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ ক’রে বউকে ভয় দেখিয়ে বল্লাে, কোন্ সাহসে ওকথা বলিস্; জানিস, আমি ভালাে হ’য়ে উঠলে তাের বিপদ।
ভােরে কারখানার বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা গেলাে। বউ একটু কাঁদলাে, ছেলে মােটেই না। পাড়া-পড়শীরা বললাে, বউটার হাড় জুড়িয়েছে, মাইকেল মরেছে। একজন ব’লে উঠলাে, মরেনি, পশুর মতাে পচতে পচতে জীবনপাত করেছে।
গাের দিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাে···দীর্ঘকাল ব’সে রইলাে শুধু মাইকেলের কুকুরটা···কবরের তাজা মাটির ওপর ব’সে নীরবে সে কার স্নেহ-কোমল পরশের অপেক্ষা করে।