মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/তিন

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ২৩-৩০)

—তিন—

 মাঝ হপ্তায় এক ছুটির দিনে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেভেল মাকে বলে, মা, শনিবার জনকয়েক লােক আসার কথা আছে এখানে।

 কারা?

 দু’চারজন এ পল্লিরই লােক···বাকি আসবে শহর থেকে।

 শহর থেকে? মাথা নেড়ে মা বললেন, পরক্ষণেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

 পেভেল ব্যথিত হয়ে বললাে, এ কি মা, কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?

 জামার হাতায় ছােখ মুছে মা বললেন, জানি না, কান্না পাচ্ছে।

 ঘরের এদিক-ওদিক পায়চারি ক’রে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে পেভেল প্রশ্ন করলো, ভয় পাচ্ছ, মা?

 মা ঘাড় নাড়লেন, হাঁ—শহরের লােক, কে জানে কেমন!···

 পেভেল নীচু হ’য়ে মার দিকে চাইলাে, তারপর ঈষৎ আহত এবং ক্রুদ্ধভাবে বললাে, এই ভয়ই আমাদের সর্বনাশের মূল···যারা কর্তা তারা এই ভয়কে ষোলো-আনা কাজে লাগায়···আমাদের উত্তরোত্তর ভীত করে তোলে। শোন, মা···মানুষ যতদিন ভয়ে কাঁপবে, ততদিন তাকে পচে পচে মরতে হবে···আমাদের সাহসী হ’তে হবে, আজ সেদিন এসেছে।

 তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ভয় খাও, আর যা’ কর, তারা আসবেই।

 মা করুণভাবে বললেন, রাগ করিস্‌নি বাবা, কি করে ভয় না পেয়ে থাকি বল···চিরটা জনম আমার ভয়ে ভয়েই কেটেছে।

 ছেলে আরও নরম হ’য়ে বলে, ক্ষমা কর, মা, কিন্তু আমি বন্দোবস্ত বদলাতে পারব না।


 তিনদিন ধ’রে মার প্রাণে কাঁপুনি···ভাবেন, যারা আসছে বাড়িতে, না জানি তারা কী ভয়ংকর লোক···তাঁর গা শিউরে ওঠে।

 শেষে শনিবার এলো। রাত্রে পেভেল মাকে বললো, মা, আমি একটু কাজে বেরুচ্ছি, ওরা এলে বসিয়ো, বলো, এক্ষুণি আসছি। আর ভয় খেয়ো না···তারাও অন্য সবারই মতো মানুষ।

 মা প্রায় মূর্ছিত হয়ে চেয়ারে বসে পড়েন।


 বাইরে জমাট-বাঁধা অন্ধকার। কে যেন তার মধ্য দিয়ে শিষ দিতে দিতে এগোচ্ছে···শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হ’য়ে জানালার কাছে এসে পড়লো···পায়ের শব্দ শোনা গেলো···মা ভীত চকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন···দোর খুলে গেলো···প্রথমে দেখা গেলো, একটি প্রকাণ্ড হ্যাট, তলার অবিন্যস্ত কেশগুচ্ছ···তারপরে ঢুকলো একটি ক্ষীণ আনতদেহ··· দেহকে ঋজু করে ডান হাত তু’লে আগন্তুক অভিবাদন করলো, নমস্কার।

 মা নীরবে, প্রত্যভিবাদন জানিয়ে বললেন, পেভেল ফেরেনি এখনো!

 নবাগত নিরুত্তরে নিরুদ্বিগ্নভাবে লোমের কোটটা ছেড়ে রেখে গা থেকে পুঞ্জিত তুষার ঝেড়ে ফেলতে লাগলো। তারপর চারদিক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে টেবিলের ওপর আরাম ক’রে বসে মার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো, এটা কি ভাড়াটে-বাড়ি, না আপনাদের নিজেদের?

 ভাড়াটে।

 বাড়িটা তো বিশেষ ভালো না।

 পাশা এক্ষুণি আসবে, বসো।

 বসেছি তো। আচ্ছা, মা, তোমার কপালে ও দাগটা কে করে দিলে?

 প্রশ্নকর্তার ঈষৎ হাস্য এবং প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে আহত হয়ে মা একটু কঠিন সুরে বললেন, তা দিয়ে তোমার দরকার কি?

 রাগ করো না, মা। আমার মার কপালেও অমন একটা দাগ ছিল;···তার মুচি স্বামী লোহার ফর্মা দিয়ে আঘাত করেছিল কি না···ইনি ছিলেন ধোপানি, উনি ছিলেন মুচি···মাকে যে কী মার মারতেন···ভয়ে আমার গায়ের চামড়া যেন ফেটে যেতে চাইতো।

 মা’র রাগ জল হয়ে গেলে এ কথায়। এরপর দু’জনের আলাপ জমে উঠলো। মা ভাবলেন, এর মতো যদি আর সবাই হয়!

 আগন্তুকের নাম এণ্ড্রি।

 এণ্ড্রির পর এলো একটি মেয়ে—ন্যাটাশা। মাঝারি চেহারা, মাথাভরা ঘন কালো চুল, সাধারণ পোশাক, হাসিমুখ, মধুর স্পষ্ট কণ্ঠ, স্বাস্থ্য-নিটোল দেহ, নিবিড় নীল দুটি চোখ···মার প্রাণ খুশিতে, স্নেহে ভরে উঠলো···মনে হল, এ যেন তারই হারিয়ে-যাওয়া মেয়ে আবার তার কোলে ফিরে এসেছে।

 এর পরে এলো নিকোলাই—মজুর-পল্লির নামজাদা চোর বৃদ্ধ দানিয়েলের ছেলে। মা অবাক হ’য়ে বললেন, তু্মি, এখানে?

 পেভেল বাড়ি আছে?

 না।

 নিকোলাই তখন ঘরের দিকে চেয়ে বললো, সুপ্রভাত কমরেড।

 ন্যাটাশা হাসিমুখে নিকোলাইর করমর্দন করলেন।

 মা অবাক হয়ে গেলেন, নিকোলাইও তবে এই দলে আছে।

 এর পরে এলো ইয়োকোভ—কারখানার পাহারাদার শোমোভের ছেলে। তার সঙ্গে আর একটি ছেলে—সেও অপরিচিত কিন্তু ভীষণ-দর্শন নয়।

 সব্বার শেষে এলো পেভেল—কারখানার দু’জন মজুরকে সঙ্গে নিয়ে।

 মা ছেলেকে প্রশ্ন করলেন ধীরে ধীরে, এরাই কি তোর সেই বে-আইনী সভার লোক?

 হাঁ, বলে পেভেল কমরেডদের কাছে চলে গেলো।

 মা মনে মনে বলতে লাগলেন, বলে কি, এরা তো দুধের ছেলে!

 ঘরের মধ্যে ততক্ষণ মজলিস বসে গেছে। আগন্তুকদল টেবিলের চারদিকে উন্মুখ হয়ে বসেছে। এককোনে ল্যাম্পের নীচে ন্যাটাশা একখানা বই খুলে পড়ছে, ‘মানুষ কেন এমন হীনভাবে জীবন-যাপন করে বুঝতে হলে···’

 —‘এবং মানুষ কেন এত হীন হয় বুঝতে হলে:’ এণ্ড্রি জুড়ে দিলো।

 ‘আগে দেখতে হবে, কেমন ভাবে তারা জীবন-যাত্রা শুরু করেছিল···’

 বই থেকে ন্যাটাশা সেই আদিম অসভ্যদের জীবন-যাত্রা প্রণালী, তাদের গুহাবাস, পাথরের অস্ত্রে শিকার প্রভৃতির সরল বর্ণনা পড়ে যেতে লাগলো। মা ভাবলেন, এতো বুনো লোকদের গল্প, এতে আবার বে-আইনী কি আছে!

 হঠাৎ নিকোলাইর অসন্তুষ্টি-ভরা কণ্ঠ বেজে উঠলো, ওসব যাক। মানুষ কেমন ক’রে জীবন কাটিয়েছে তা শুনতে চাইনা···শুনতে চাই, মানুষের কি রকম ভাবে বাঁচা উচিত।

 ‘হাঁ, তাইতো।’—লাল-চুলওয়ালা একটি লোক সায় দিলো।

 ইয়াকোভ প্রতিবাদ ক’রে বললো, যদি আমাদের সামনে এগোতে হয়, তবে আমাদের সব-কিছু জানতে হবে।

 ‘নিশ্চয়ই’—কোঁকড়া চুলওয়ালা একজন ইয়াকোভকে সমর্থন করলো।

 পলকে বিষম তর্কাতর্কি শুরু হ’ল, কিন্তু অশ্লীল অন্যায় ভাষা কারু মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না। মা ভাবলেন, ওই মেয়েটি আছে ব’লেই ওরা সামলে চলছে।

 সহসা ন্যাটাশা ব’লে উঠলো, থামো, শোন ভাইসব।

 পলকে সবাই নীরব, ন্যাটাশার দিকে নিবদ্ধ-চক্ষু।

 ন্যাটাশা বললো, যারা বলে আমাদের সব-কিছুই জানা উচিত, তারাই ঠিক বলছে। যুক্তির দীপ-শিখায় চলার পথ আলোকিত ক’রে নিতে হবে আমাদের—অন্ধকারে যারা আছে, তারা যাতে আমাদের দেখতে পায়। প্রত্যেকটি প্রশ্নের সাধু এবং সত্য জবাব দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের থাকা চাই। যা কিছু সত্য এবং যা-কিছু মিথ্যা,···সবার সঙ্গেই আমাদের পরিচয় থাকা দরকার।

 ন্যাটাশা চুপ করলে পেভেল উঠে বললো, আমাদের একমাত্র কাম্য কি পেট বোঝাই করা?

 তারপর নিজেই জবাব দিল, না। আমরা চাই মানুষ হ’তে। যারা আমাদের ঘাড়ে চেপে ব’সে আমাদের চোখ ঢেকে রেখেছে, তাদের আমরা দেখাবো,—আমরা সব দেখি, আমরা বোকা নই, পশু নই, শুধু আহার করতে চাই না,—আমরা বাঁচতে চাই মানুষের মতো মানুষ হ’য়ে। আমাদের শত্রুদের আমরা দেখাব যে, বাইরে আমরা কুলি-মজুর, শ্রমদাস যা’ হই না কেন, বুদ্ধিবৃত্তিতে আমরা তাদের সমান, আর প্রাণশক্তিতে, তেজে, বীর্যে আমরা তাদের চাইতেও ঢের বেশি শ্রেষ্ঠ।

 মার বুক ছেলের বাগ্মীতায় স্ফীত হ’য়ে উঠলো।

 এণ্ড্রি বললো, দেশে আজ ভুঁড়ির ছড়াছড়ি, সাধু লোকেরই আকাল। এই পচা জীবনের জলাভূমি থেকে এক সেতু গড়ে আমাদের যাত্রা করতে হবে মঙ্গলময় ভবিষ্যতের অভিমুখে। বন্ধুগণ, এই আমাদের ব্রত,—এই আমাদের করতে হবে।

 দুপুর রাতে মজলিস ভাঙলো, যে যার ঘরে চ’লে গেলে॥

 মা বললেন, এণ্ড্রি লোকটি কিন্তু বেশ। আর ওই মেয়েটি, কে ও?

 জনৈক শিক্ষয়িত্রী।

 আহা হা, গরম কাপড়চোপড় একদম নেই, ঠাণ্ডা লাগবে যে। ওর আপনার জনেরা কোথায়?

 মস্কোতে। ওর বাবা বড়লোক, লোহার কারবার, মেলাই টাকা। ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এই দলে ভিড়েছে ব’লে। বড়লোকের আদরিণী মেয়ে, সুখ-সম্পদে লালিত। যা’ চাইতো তা পেতো, কিন্তু আজ সে একা, অন্ধকার রাতে পায়ে হেঁটে চার মাইল পথ চ’লে যায়।

 মার প্রাণ পলকে ভারি হয়ে উঠলো, বললেন, শহরে যাচ্ছে?

 হাঁ।

 ভয় করে না ওর?

 না।

 কেন গেলো? এখানে তো থাকতে পারতো, আমার সঙ্গে শুতো।

 তা’ হয় না। কাল সকালে উঠে সবাই দেখতো। আমরা তা চাই না, ও-ও চায় না।

 মার মনে সেই আগেকার উদ্বেগ জেগে উঠলো, বললেন, কিন্তু আমিতো বুঝতে পাচ্ছিনা পেভেল, এর ভিতর বিপজ্জনক বা অন্যায় কি আছে? তোরা তো আর খারাপ কিছু কচ্ছিস না।

 শান্তভাবে মায়ের দিকে চেয়ে স্থির কণ্ঠে পেভেল জবাব দিলো, আমরা যা করছি, তাতে খারাপ কিছু নেই, খারাপ কিছু থাকবেও না; কিন্তু তবু আমাদের জেলে যেতে হ’বে।

 মার হাত কেঁপে উঠলো। বসা গলায় তিনি বললেন, ভগবান তোমাদের যে ক’রে হ’ক রক্ষা করবেনই।

 না, মা, তোমায় আমি মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারি না; রক্ষা আমরা কিছুতেই পাবোনা।···

 মাকে শুতে ব’লে ছেলে চ'লে গেলো নিজের কামরায়।

 মা একা জানালার কাছটিতে এসে বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন। তুষারে-ছাওয়া পথ, ঝড়ো হাওয়ার অবিরাম মাতামাতি···তারপরেই একটা খোলা মাঠ···সাদা তুষার রাশি,···তার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে শিমুল তুলোর মতো ঘন ধারায়···বাতাস প্রলয়-বাঁশি বাজিয়ে যায়···মা দেখলেন, তারই মধ্য দিয়ে একা চলেছে ন্যাটাশা···তার পোশাক বাতাসে দাপাদাপি করছে, পা ব’সে যাচ্ছে, মুখে-চোখে কে যেন মুঠো মুঠো তুষার ছুড়ে মারছে—ন্যাটাশা এগোতে পারছে না, ঝড়ের মুখে একগাছি-কুশের মতো সে সুরে সুরে পথ বেয়ে চলেছে। ডানে তার কৃষ্ণাভ অরণ্য-প্রাচীর, নগ্নপত্রহীন গাছগুলি যেন বাতাসে ব্যথিত হয়ে আর্তনাদে চারিদিক পূর্ণ করে তুলেছে। দূরে শহরের ক্ষীণাতিক্ষীণ আলো।

 কী এক অভূতপূর্ব আতঙ্কে শিউরে উঠে’ মা উর্ধ্বে চেয়ে প্রার্থনা জানান, ভগবান, রক্ষা করো।