মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/পনেরো

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ৮৮-৯৪)

—পনেরো—

 মে মাসে মজুরদের একটা উৎসবের আয়োজন হ’ল। বন্দী মজুররা সবাই জেল থেকে এসেছে। উৎসবের ধরণ সম্বন্ধে দু’দলের দু’মত। একদল বলে, সশস্ত্র হ’য়ে মজুরদল বেরিয়ে পড়ুক; আর একদল বলে, না। মজুররা দলে দলে নিশান হাতে সাম্য মন্ত্র ধ্বনিত ক’রে শোভাযাত্রা করুক। শেষোক্ত দলই ভারি। আইভানোভিচ বললো, বন্ধুগণ, বর্তমানের এই ব্যবস্থাকে বদ্‌লে দেওয়া একটা মহান্ কাজ, কিন্তু তার জন্য সব্বার প্রথমেই চাই আমার জন্য একজোড়া ওভার-সু, এ ছেঁড়া জুতোর বদলে; কারণ এই ওভার-সুই সোসিয়ালিজমেব জয়-যাত্রায় আমাদের সব চেয়ে বেশি কাজে লাগবে। এই পুরাণো ব্যবস্থাকে খোলাখুলি উল্টে ফেলে না দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে একপাও যেতে চাই না আমি··· তাই তো বলি, অস্ত্র এখন থাক।

 মা তাদের বাদানুবাদ শুনতেন। তাদের মুখেই শুনলেন তিনি, একদল লোক, যাদের বলে বুর্জোয়া, তারাই জনসাধারণের শত্রু। জার যখন ছিলেন, তখন তারা জনসাধারণকে ক্ষেপিয়েছে জারের বিরুদ্ধে, তারপর জনসাধারণ যখন জারকে সরিয়েছে সিংহাসন থেকে, তখন তারা ছলা-কলায় শক্তি আত্মসাৎ ক’রে জনসাধারণকে কোণ-ঠ্যাসা ক’রে বেখেছে,—জনসাধারণ এর প্রতিবাদ করলে তাদের হত্যা করেছে শতে শতে, সহস্রে সহস্রে, মানুষকে চিবিয়ে, পিষে, চুষে মারছে তারা। এই বুর্জোয়াদল···এই ধনীদল···সোনার ভারে প্রাণ তাদের চাপা পড়ে গেছে। এরা মানবজাতির নিষ্ঠুবতম শত্রু, প্রধানতম প্রবঞ্চক, সর্বাপেক্ষা উগ্র বিষ-পতঙ্গ।

 শশেংকাও আসে প্রায়ই। মা একদিন আড়াল থেকে শুনতে পান পেভেল আর সে কথা বলছে।

 তুমিই নিশান বয়ে নিয়ে যাচ্ছ?

 হাঁ।

 ঠিক হ’য়ে গেছে?

 হাঁ, আমিই এর অধিকারী।

 অর্থাৎ আবার তুমি জেলে যাবে। এ কি সম্ভব হ’ত না···

 কি?

 যে, আর কেউ নিশান ব’য়ে নিয়ে যেতো?

 না।

 এববার ভেবে দেখ, কত প্রভাব তোমার। সবাই তোমায় কত পছন্দ করে! তোমার আর নাখোদ্‌কার মতো নামজাদা বিপ্লবপন্থী আমাদের মধ্যে আর নেই। একবার ভেবে দেখ, মুক্তিকল্পে কত-কি করার শক্তি আছে তোমার। তাই তো তোমাকে পেলে তারা ছাড়বে না, দীর্ঘকালের জন্য দূরে সরিয়ে ফেলবে তোমায়।

 না শশা, আমি সংকল্প করেছি, কোন-কিছুই সে সংকল্প থেকে আমায় টলাতে পারবে না।

 পারবে না? যদি আমি অনুরোধ ক’রে বলি, পেভেল···

 এমন অনুরোধ তোমার করা উচিত নয়, শশা।

 উচিত নয় পেভেল! আমি মানুষ, রক্ত-মাংসধারী মানুষ।

 শুধু মানুষ নও, অতি-মানুষ। তাইতো তোমাকে আমি ভালোবাসি এবং জানি তুমি অমন অনুরোধ করতে পারো না।

 তবে যাও পেভেল···ব’লে শশা তাড়াতাড়ি চলে যায়।

 মার মন আবার আশঙ্কায় দুলে উঠে। পেভেলের সঙ্গে দেখা হ’লেই জিগ্যেস করেন, পয়লা মে আবার কি করতে চাস?

 পেভেল বলে, নিশান হাতে শোভাযাত্রা চালিয়ে নিয়ে যাবো। এতে জেল হবে বলে মনে হয়।

 মার চোখ সজল হ’য়ে এলো। পেভেল মার হাত ধরে বললো, আমায় এযে করতেই হবে, মা। এতেই আমার সুখ, তুমি কি এতে বাধা দেবে, মা!

 না, বাধা দেবো না—মা ধীরে ধীরে বলেন।

 তাঁর বিষণ্ণ দৃষ্টি পেভেলের চোখ এড়ালোনা, বললো, দুঃখ করো না, মা, এতে তো আনন্দ করা উচিত। কবে আমাদের দেশে তেমন মা হবে, যাঁরা হাসিমুখে ছেলেদের মৃত্যুর মুখে তুলে দেবেন?

 এণ্ড্রি চিমটি-কাটার মতো ক’রে বললো, ওহে, একটু আস্তে আস্তে চালাও...

 মা বললেন, না, তোমায় আমি বাধা দেবো না, পেভেল, কিন্তু কান্না...আমি কেমন ক’রে রোধ করব···আমি যে মা...

 এক রকমের ভালোবাসা আছে, যা মানুষের সমস্ত জীবনটাকে মাটি করে দেয়। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এই কথা ব’লে পেভেল মার কাছ থেকে সরে যায়।

 মা কেঁপে উঠলেন। পেভেল পাছে আরো এমনি নিষ্ঠুর আঘাত দেয়, সেই আশঙ্কায় তিনি বলেন, বাধা দেবো না, পেভেল, বাধা দেবো না। আমি বুঝি, সঙ্গীদের জন্য আজ তোকে একাজ করতেই হবে।

 পেভেল বললো, সঙ্গীদের জন্য নয়, তাদের জন্য হ’লে না ক’রেও পারতুম। এ আমার নিজের জন্য দরকার।

 মা চ’লে গেলেন। এণ্ড্রি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। এবার এগিয়ে এসে মায়ের ওপর পেভেলের অনাবশ্যক রূঢ়তার প্রতিবাদ করলো, বললো, এমন স্নেহময়ী মায়ের ওপর এমন আস্ফালন করার কোনই দরকার ছিল না, ওর এক কাণাকড়িরও কদর নেই।

 পেভেল নিজের ভুল বুঝতে পেরে মার কাছে ক্ষমা চাইলো, অবুঝ ছেলেকে ক্ষমা কর, মা।

 মা ছেলের মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে আর্তকণ্ঠে বলেন, যা’ দরকার তা করিস বাবা, শুধু বুড়ো মাকে কাঁদাসনি।

 এণ্ড্রিকে ডেকে বললেন, ও তোর অবুঝ ছোট ভাই, ওকে বকিসনি বাবা।

 এণ্ড্রি বললো, শুধু বকা! হতভাগাকে ধ’রে একদিন আচ্ছা মতো দিয়ে তবে ছাড়বো।

 না বাবা, না বাবা, ব’লে মা এণ্ড্রির হাত ধরলেন।

 এণ্ড্রি তখন বললো, তুমি পাগল হয়েছ, মা, আমি পেভেলের গায়ে হাত দোব! আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি দেখতে পারি না হতভাগাকে। নতুন জামা পরেছেন উনি, তাই গরবে আর মাটিতে পা পড়ে না, যাকেই পায় তাকেই ঠেলা দিয়ে বলে, দেখ, কেমন জামা পরেছি। জামাটা ভালো, কিন্তু হ’ক ভালো, তাই ব’লেই কি লোককে এমনি করে ঠেলতে হবে? বলে, এমনিতেই মানুষ হ’য়ে আছে অতিষ্ঠ...

 পেডেল হেসে বললো, কতক্ষণ মুখ চালাবে আর? কম তো বাক্যবাণ নিক্ষেপ করনি?

 এণ্ড্রি মেঝেয় উনুনের সামনে পা ছড়িয়ে বসে ছিলো। পেভেল নুয়ে পড়ে তার হাত জড়িয়ে ধরলো।...তার কিছুক্ষণ পরেই দু’ভাইয়ের মতোই তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ হ’ল। দেখে মার চোখ আনন্দাশ্রুতে ভ’রে উঠলো। তারপর যেন তিনি লজ্জিত হ’য়ে বললেন, এ মেয়ে মানুষের চোখের জল, দুখেও ঝরে, সুখেও ঝরে।

 পেভেল বললো, এ চোখের জ্বলে লজ্জিত হবার কিছু নেই, মা।

 এণ্ড্রি বললো, গর্ব করা উচিত নয় কিন্তু সত্যিই আমরা এক নবজীবনের আস্বাদ পাচ্ছি এখন। এ জীবন খাঁটি, মনুষ্যোচিত, প্রেমে, মঙ্গলে পরিপূর্ণ।

 পেভেল মার দিকে চেয়ে বললো, হাঁ।

 মা বললেন, জীবনের ধারা যেন বদলে গেছে। আজ এসেছে নতুন রকমের দুঃখ, নতুন ধরণের আনন্দ। তা যে কী, তা জানি নে, বুঝি নে, ব্যক্তও করতে পারিনে ভাষায়।

 এণ্ড্রি বললো, এই তো হওয়া উচিত। দুনিয়ার দিকে নজর দিয়ে দেখো, মা, একটা নতুন প্রাণের জন্ম হচ্ছে, একটা নতুন প্রাণ জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে! এতকাল সকল প্রাণ ছিল স্বার্থের সংঘাতে নিপীড়িত, অন্ধলোভে জ্বর-জ্বর, হিংসা-বিদ্বেষে ভারাক্রান্ত, মিথ্যা-ভীরুতা-হীনতায় দুষিত, রোগজীর্ণ, শঙ্কিত-জীবন, কুহেলির যাত্রী,—নিজের ব্যথাভারে ক্রন্দনোন্মুখ,—হঠাৎ তারি মধ্য থেকে জেগে উঠেছে এক নতুন মানুষ, যুক্তির আলোকে জীবনকে সে আলোকিত করেছে। মানুষকে ডেকে বলছে, ওগো পথ-ভ্রান্ত বন্ধুর দল, আজ দিন এসেছে এ সত্য উপলব্ধি করার যে, তোমাদের সবার স্বার্থ এক, তোমাদের প্রত্যেক মানুষের বাঁচবার দরকার আছে, বাড়বার দরকার আছে। আজও সে একা, তাই কণ্ঠস্বর তার এতো তীব্র। তার আহ্বানে খাঁটি কর্মীরা একপ্রাণ হ’য়ে দাঁড়ায়, বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে নব বাণী, হে আমার দেশ-বিদেশের বন্ধুগণ, তোমরা মিলিত হ’য়ে এক মানরগোষ্ঠী গঠন কর! তোমাদের জীবনের প্রসূতি প্রেম—ঘৃণা নয়। আমি শুনতে পাচ্ছি, বিশ্বময় আজ সেই বাণীই প্রতিধ্বনিত···রাতে বিছানায় শুয়ে···একা জেগে···সর্বত্র এই বাণী শুনি, আর প্রাণ নেচে ওঠে। দুঃখ, অন্যায়ের ভারে প্রপীড়িতা এই ধরণীও সে আহ্বানে সাড়া দেয়, কেঁপে কেঁপে ওঠে, আর মানুষের হৃদয়াকাশে উদিত নবারুণকে সৎবর্ধিত করে।···

 পেভেল তাকে কি বলতে যাচ্ছিল, মা বাধা দিয়ে বললেন, ওর কথা শেষ করতে দে।

 দীপ্তোজ্জ্বল চক্ষু তুলে এণ্ড্রি বললো, কিন্তু জানো, এখনো অনেক দুঃখ সইতে হবে মানুষকে, লোভের হাতে এখনো তার অনেক রক্তপাত হ’বে,···কিন্তু আমাদের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত রক্তও কম মুল্যবান্ মনে হবে তার কাছে, যা’ আমরা এরি মধ্যে পেয়েছি উদ্বেল বক্ষে, চঞ্চল মনে, শিরায় শিরায়। তারা যেমন সোনার আলোকে ধনী, আমিও তেমনি ধনে ধনী হয়েছি। সমস্ত বোঝা আমি বইব, সমস্ত দুঃখ আমি সইব; কারণ প্রাণে আমার সেই আনন্দের সাড়া পেয়েছি, যা’ কেউ কোনো-কিছুতে চেপে রাখতে পারে না। এই আনন্দের মধ্যে নিখিল শক্তি নিহিত।

 নব-জীবনকে এমনিভাবে অভিনন্দিত করতে লাগলো তারা।